২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আত্মদর্শীর আক্ষেপ ও আকুতি

-

‘আমরা আর কত আহাম্মক হবো’ বলে গত ২৯ জানুয়ারি এবং ১১ ফেব্রুয়ারি ‘পেশাজীবীদের দলীয় লেজুড়বৃত্তির ইতি ঘটাতে হবে’ বলে দৈনিক নয়া দিগন্তে প্রকাশিত মইনুল হোসেনের কলাম দু’টি প্রসঙ্গে কিছু বলার ধৃষ্টতা দেখাতে হলো। কৈশোরে বৃদ্ধদের পান চিবানো আর হুক্কা টানা আলোচনায় প্রায়ই বলতে শুনতামÑ হবে, হবে। কাউকে আবার করা প্রশ্নে শুনতামÑ আর কবে হবে? কিন্তু প্রসঙ্গটি তখন অবোধগম্য থাকলেও প্রত্যাশা ও প্রশ্নের এ কথা দু’টি লুকানো মনের গভীর হতে প্রায়ই আমাকে নাড়া দিত।
ম্যাট্রিক পরীক্ষায় রবীন্দ্রনাথের ‘দুরন্ত আশা’ কবিতা হতে, ‘মাথায় ছোট বহরে বড়ো বাঙালি সন্তান।
ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন।
চরণতলে বিশাল মরু দিগন্তে বিলীন। ...
কিসের এত অহঙ্কার! দম্ভ নাহি সাজেÑ
বরং থাকো মৌন হয়ে সসংকোচ লাজে।’
তখন এর অবোধগম্য মর্মার্থের দেয়া ব্যাখ্যায় ভালো নম্বরও হয়তো পাইনি।
সাল ১৯৬৭। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের ‘ঋৎরবহফং ঘড়ঃ গধংঃবৎং’ বইটি পড়তে গিয়ে এর ১৮৭ পৃষ্ঠায় পাকিস্তানিদের সাথে জাতিগত তুলনায় আমাদের সম্পর্কে লেখা (ঞযবু যধাব নববহ ধহফ ংঃরষষ ধৎব ঁহফবৎ... ঞযব ৎবয়ঁরৎবসবহঃং ড়ভ ঃযব হব-িনড়ৎহ ভৎববফড়স.) তারা বহুদিন ধরে এবং এখনো হিন্দু সংস্কৃতি ও ভাষার বেশ প্রভাবাধীন আছে। অতএব, নিপীড়িত জাতির সব বিধিনিষেধ থাকায় মনস্তাত্ত্বিকভাবে এখনো তারা নবজাত স্বাধীনতার সমন্বয়ে সম্ভাব্য আবশ্যকতা মেটাতে পারছে না।’ পড়ে মনে সঞ্চারিত হলো তীব্র ক্রোধ আর ধিক্কার। এর অনেক পরে বাংলা অভিধানে ‘পাণ্ডববর্জিত’ শব্দের অর্থে নিকৃষ্ট দেশ বলতে গঙ্গার পূর্বতীরবর্তী (বাংলার বহুলাংশ) দেশ বলায় হয়ে গেলাম বিভ্রান্ত। ইতিহাসের ছাত্র বিধায় বাংলা ও বাঙালি চেনার জন্মাল প্রবল আগ্রহ। খ্যাতনামা বেশ কয়েকজনের বইসহ ভারতীয় ইতিহাস যতই পড়লাম ততই যেন সেই ক্রোধ আর ঘৃণার হলো অবসান। তবে প্রাচীন গ্রিকদের ‘সিনিক’ (পুহরপ) (কোনো কিছুর ভালোকে স্বীকার করে না এমন) না হয়ে বরং হয়ে গেলাম হতগৌরব।
একশত বছরের নৈরাজ্য বাংলা ছাড়া উপমহাদেশের অন্য কোথাও হয়েছে বলে কোনো ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায়নিন। প্রসঙ্গত, বলা হয়েছে ‘রাষ্ট্র ছিন্নভিন্ন; ক্ষত্রিয়, বণিক, ব্রাহ্মণ, নাগরিক যে যার ঘরে সবাই রাজা। আজ যে রাজা হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় প্রভুত্ব দাবি করছেÑ কাল তার কাটা মুণ্ডু ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে। এ নৈরাজ্যের নাম দেয়া হয়েছে মাৎস্যন্যায়। রাজা নেই অথচ সবাই রাজার গদিতে বসতে চায়।’ এমন মনোবাঞ্চার ন্যূনতম সাদৃশ্য আজো আমাদের না থাকলে কী লজ্জাকর আন্তর্জাতিক এমন রসিকতা হতো যে, ‘তিন বাঙালি এক নির্জন দ্বীপে অসহায় অবস্থায় পতিত হলে, তাদের প্রথম কাজই হয় চারটি রাজনৈতিক দল গঠন?’ (তিনজনের তিনটি ও সবাই মিলে একটি)। আমেরিকার ভূতপূর্ব কূটনীতিক আর্চার কে. ব্লাডের ঞযব পৎঁবষ ইরৎঃয ড়ভ ইধহমষধফবংয, চধমব-৩ হতে এটি উদ্ধৃত। মাত্রাতিরিক্ত বহু রাজনৈতিক দলে আমরা বিভাজ্য হওয়ায়, বিভাজন করে শাসনের দোষে ব্রিটিশদের দোষারোপ করা অসমীচীন নয় কী?
শশাঙ্ক নরেন্দ্র গুপ্ত (গৌড়ের সম্রাট আ: ৬০০-৬২৫ খ্রি:) পূর্বে ছিলেন মগধস্থ (দক্ষিণ বিহার) গুপ্ত সম্রাটদেরই বিহারের রোহতাসগড়ের সামন্ত এবং পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপালকে (আ: ৭৫০-৭৭৫ খ্রি:) দু-একজন ঐতিহাসিক ‘বাঙালি’ বলার খোঁড়াযুক্তি প্রত্যাখ্যাত সবার দ্বারাই অসমর্থিত। বাংলাভাষার সূচনা গোপালেরও প্রায় দুই শ’ বছর পরে। তা ছাড়া বাংলায় বহিরাগত ছাড়া কস্মিনকালেও বাঙালি কোনো শাসক ছিলেন বলে নির্দিষ্ট কোনো ঐতিহাসিক তথ্য নেই। তাই জাতি হিসেবে আমরা বাঙালি নিপীড়িত এ কথা ঐতিহাসিক সত্য।
প্রায় হাজার বছর আগে কাশ্মিরি কবি ক্ষেমেন্দ্র তার দশোপদেশ (অনুবাদিত) গ্রন্থে কয়েকজন বাঙালি শিক্ষার্থীর আচার-আচরণ সম্পর্কে করেছেন কটূক্তি। বাংলার প্রথম গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস (১৭৩২-১৮১৮ খ্রি:) এবং ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর এইচ বেভারেজও ১৮৭৬ সালে লন্ডনে প্রকাশিত ঞযব উরংঃৎরপঃ ড়ভ ইধশবৎমধহল বইয়ের ১৯৪-৯৫ পৃষ্ঠায় ‘বাঙালিরা মিথ্যা বলায় অভ্যস্ত’ বলে মন্তব্য করেছেন। যুগে যুগে করা অনুরূপ কটূক্তি অমূলক বা বিদ্বেষপ্রসূত বলার উপায় নেই। বরং এসবই যেন আমাদের চরিত্রের প্রতিচ্ছবি। দৈহিক শ্রম ছাড়া শিক্ষা হলো জীবিকার্জনের মাধ্যম, যার মানের উচ্চতায় শিক্ষার মান সম্পর্কিত। ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর (১৪৮৩-১৫৩০ খ্রি:) তুর্কি ভাষায় তার রচিত ‘বাবরনামায়’ (আত্মজীবনী) লিখেছেন, ‘বাঙালিরা পদকে শ্রদ্ধা করে’। তাই আজ প্রায় ৪৯০ বছর পরে আমরা কতজন অকপটে বলতে পারি যে, পদমর্যাদার চেয়ে আলোকিত সুশিক্ষার নীতি-আদর্শ অধিক মূল্যবান?
গ্রিক দার্শনিক প্লেটো প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে জোর দিয়ে বলেছেন, ‘গণতন্ত্রের সফলতা জনগণের চরিত্রের ওপর নির্ভর করে’। প্রজাতন্ত্রের ধারণা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘ঞযব ওফবধষ ঝঃধঃব ড়ৎ ঝড়পরবঃু নবমরহং ঃড় ফবপষরহব যিবহ ফরভভবৎবহঃ ড়ৎমধহং ড়ৎ বষবসবহঃং ড়ভ ংড়পরবঃু ঃবহফ সড়ৎব ধহফ সড়ৎব ঃড় ঢ়বৎভড়ৎস ৎিড়হম ভঁহপঃরড়হং.’ (একটা আদর্শ রাষ্ট্র বা সমাজের পতন হতে শুরু করে যখন তার বিবিধ অঙ্গ বা উপাদান ক্রমেই অধিকতর অবৈধ কার্যকারণের ঝোঁকে পড়ে)।
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ড. নীহাররঞ্জন রায় তার বাঙালির ইতিহাস, পৃষ্ঠা-২০১ ও ২০২ এ করা মন্তব্যটি হলো, ‘ব্যাপক সামাজিক দুর্নীতির কীট ভেতর থেকে সমাজ-জীবনের সব শাঁস ও রস টেনে নিয়ে তাকে ফোঁপড়া করে দিয়েছিল। শাস্ত্রের অন্ধ বিধির বাঁধনে সমাজের যে স্তর পঙ্গু, আচার-বিচারের অরণ্যে যারা দিগভ্রান্ত-তাদেরই হাতে ছিল সামাজিক নেতৃত্বের বল্গার একটা দিক। সমাজ ছিল একান্তভাবে ভূমি ও কৃষিনির্ভর, কিন্তু যারা রৌদ্রে-জলে ভিজে-পুড়ে ফসল ফলায়, তাদের প্রতি সমাজভুক্ত রাষ্ট্রের নায়কদের ছিল গভীর অবজ্ঞা। তাই সেসব রাষ্ট্র ও সমাজ-নায়কদের প্রতি তাদের কোনো আন্তরিক শ্রদ্ধা বা বিশ্বাস ছিল না। তাদের মধ্যে সুপ্ত হয়েছিল বিপ্লব-বিদ্রোহের যে বীজ, তাকে অঙ্কুরিত করে তোলার কোনো আয়োজন ছিল না। সে আয়োজন থাকলে পরবর্তীকালে বাঙালির ইতিহাসের কী চেহারা হতো বলা যায় না।’
ইতিহাসের এই অপ্রিয় সত্যতায় এটি কি প্রতীয়মান হয় না যে, আহাম্মকি আর লেজুড়বৃত্তি আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য? হাজার বছরেও যখন হয়নি, তখন আমারও আজ প্রশ্ন রইলÑ আর কবে হবে?হ


আরো সংবাদ



premium cement
ভুয়া সনদ সিন্ডিকেট : কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যানকে ডিবির জিজ্ঞাসাবাদ ঢাকার পয়োবর্জ্য-গ্যাস লাইন পরীক্ষায় কমিটি গঠনের নির্দেশ হাইকোর্টের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রয়োজন ৫৩৪ বিলিয়ন ডলার : পরিবেশমন্ত্রী সাকিবকে ডিপিএলে চান বিসিবি প্রধান নির্বাচক কাতারের সাথে যৌথ বাণিজ্য কাউন্সিল গঠনে এফবিসিসিআইয়ের চুক্তি টি-২০ খেলতে সিলেটে পৌঁছেছে ভারতীয় নারী ক্রিকেট দল খুলনায় হিটস্ট্রোকে এক ব্যক্তির মৃত্যু ভারতের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কী বলল যুক্তরাষ্ট্র? জিম্বাবুয়ে সিরিজের জন্য বাংলাদেশের প্রাথমিক দল ঘোষণা বৃষ্টির জন্য রাজশাহীতে ইসতিসকার নামাজ আদায় গাজীপুরে মহাসড়কের পাশ থেকে মৃত হাতি উদ্ধার

সকল