২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

সত্য ও অসত্যবচন প্রসঙ্গ

-

নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা সদর বসুরহাট পৌরসভার দুইবারের মেয়র এবং তৃতীয়বারেও বিপুল ভোটে বিজয়ী জেলা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত সহসভাপতি আওয়ামী লীগের দুইবারের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী মির্জা ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই মির্জা আব্দুল কাদের তার নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ কালে বলেছেন ‘সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এমপিরা পালানোর দরজা পাবে না’। প্রথম আলোর সাথে কথোপকথনে তিনি আরো বলেছেন ‘নোয়াখালীসহ সারা বাংলাদেশের চিত্রটা আমার চোখের সামনে ভেসেছে, আমার অনুভূতিতে আঘাত করেছে। নোয়াখালী এবং পাশের ফেনী দিয়ে শুরু করেছি। এই দুই এলাকার কিছু বাস্তব চিত্র আজ আমি তুলে ধরছি, এটাই হলো মূল কথা। বড় ভাইয়ের জন্য বিব্রতকর। কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সাহস করে সত্য কথা বলব। অন্যায়, অবিচার ও অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করব। আমাকে সত্য কথা বলতে হবে।’ তিনি তার সত্য বচন অব্যাহত রেখে ৫ জানুয়ারি আরো বলেছেন ‘আমি বললে অপরাধ। ধমকায়...গুলি করবে, ঝাঁঝরা করে দেবে। ভোট ডাকাতির বিরুদ্ধে কথা বললে তখন আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয় জাতীয় পর্যায় থেকে। সরকার মানুষের ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে কিন্তু ভোটের অধিকার দিতে পারেনি’ (৫ ও ৬ জানুয়ারির দৈনিক প্রথম আলো)। তার এসব বচনের পরিপ্রেক্ষিতে সাংবাদিকদের সাথে আলাপে বড় ভাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন ‘দলীয় সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী ছাড়া দলে কেউ অপরিহার্য নয়। কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে কাউকে কোনো ধরনের ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই। দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে যেকোনো সিদ্ধান্ত দলীয় সভাপতি নিতে পারেন’ (সূত্র : ৭ জানুয়ারির দৈনিক প্রথম আলো)। পৌর মেয়র মির্জা কাদেরের বড় ভাই ওবায়দুল কাদের ২০১৯ সালের শেষের দিকে দ্বিতীয়বারের মতো আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন। এর আগে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের জিরো আওয়ারের নির্বাচনে বিএনপির সাবেক চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার শক্ত ঘাঁটি নোয়াখালী, ফেনী ও লক্ষ্মীপুর হতে বিএনপিকে ভিটে ছাড়া করা হয়। দেশব্যাপী আওয়ামী লীগ, জাপা, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ (ইনু) ও বিকল্প ধারা মিলে ২৯২টি আসন দখলের মাধ্যমে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চের প্রথম সংসদ নির্বাচনের দীর্ঘ ৪৫ বছর পর একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ‘হৃতগৌরব’ পুনরুদ্ধারের কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রীর পরেই সাধারণ সম্পাদকের। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় এসে জাতিসঙ্ঘের মহাসচিবের বিশেষ দূতকে হটিয়ে দিয়ে ‘একাই ১৫৪’ হওয়ায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, জাপা, ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ (ইনু) মিলে সংসদের শতভাগ আসন দখল করে দীর্ঘ ১৭২৬ দিন নির্বিঘেœ ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিল। প্রখ্যাত আইনজীবী ড. শাহদীন মালিকের নেতৃত্বে বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দের একটি প্রতিনিধিদল মহামান্য রাষ্ট্রপতির সাথে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে সাক্ষাৎ করে তাকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে ভূমিকা রাখার অনুরোধ জানালে তিনি তাদেরকে সংবিধান দেখিয়ে বলেছিলেন, সংবিধান এমন কোনো ক্ষমতা দেয়নি। ফলে সাক্ষাৎকারীদের আরজি বিফলে গিয়েছিল। তিনি যেমন দ্বিতীয়বারের মতো রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে স্বাধীনতার পর প্রথম রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন তেমনি ওবায়দুল কাদের টানা তৃতীয়বারের মতো সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং দুইবারের জন্য সাধারণ সম্পাদক হতে পেরেছেন। ছোট ভাইয়ের ‘সত্যবচন’ অনুযায়ী ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন যদি এরশাদের আমলের ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চের মতো না হয়ে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির মতো এবং ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন ১৯৮৬ সালের ৭ মের মতো না হয়ে ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের মতো হতো তাহলে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির যে অবস্থা হয়েছিল আওয়ামী লীগেরও অবস্থা অনুরূপ হতো। কোম্পানীগঞ্জের সাবেক এমপি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে ২০০৮ সালের নির্বাচনে ওবায়দুল কাদেরের কাছে পরাজিত হয়ে উপনির্বাচনে বগুড়া হতে এমপি নির্বাচিত হতে হয়েছিল, তেমনি ওবায়দুলকে সংসদে আসার জন্য নোয়াখালীর আরেক কৃতী সন্তান স্পিকার শিরীন চৌধুরীর স্থলে রংপুরের পীরগঞ্জের আসনেই হয়তো উপনির্বাচন করে সংসদে আসতে হতো। দল নিরপেক্ষ ভোটারদের মতে, মির্জা কাদের এবং ওবায়দুলের বচন সত্য। ভোটারদের মনের কথাই মির্জা কাদের বলেছেন। দেশের ৯৯ শতাংশ পত্রপত্রিকা ও শতভাগ টেলিভিশন চ্যানেল সরকার সমর্থক হলেও তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থেই পাঠক ও দর্শকপ্রিয়তা ধরে রাখার জন্যই অনেক সময় সত্যবচন প্রচার করছে। আর বড় ভাই যেটা বলেছেন সেটা হচ্ছে ‘দলের সত্য বচন’। একই রকম বিতর্ক শুরু হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্তমান ও সাবেক মেয়রের মধ্যে। কিন্তু বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করলে দুর্গন্ধ বেশি ছড়ায় বলে মুরব্বিগণ উভয়কে সংযত হওয়ার পরামর্শ দেয়ায় এবং দুইজনেই তা মেনে নেয়ায় জনগণ ‘যা বুঝার বুঝে গেছে’।
রাজনীতিবিদ দুই ভাই এবং ঢাকা দক্ষিণের বর্তমান ও সাবেক মেয়র যার যার বচনকে ‘সত্য’ বলে দাবি করছেন। তেমনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী মূলবাহিনী পুলিশ ও এলিট ফোর্স র্যাবও উভয়েই একে অপরের মামলাকে ‘ভিত্তিহীন’ বলে তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করায় সুবিধাভোগী আসামিরা মুক্তি পেয়েছেন। অবসরপ্রাপ্ত মেজর রাশেদ সিনহাকে গত বছর ৩১ জুলাই কক্সবাজারের টেকনাফ থানার শ্যামলাপুর পুলিশ ফাঁড়ির সামনে ‘বন্দুকযুদ্ধে’র নামে হত্যা করে তার ও সহযাত্রীদের বিরুদ্ধে পুলিশের কাজে বাধাদান ও মাদক পাওয়ার অভিযোগে পুলিশ বাদি হয়ে যে মামলা করেছিল এবং সিনহার বোন টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে যে হত্যা মামলা করেছিল সেসব মামলার তদন্তভার পড়ে র্যাবের ওপর। র্যাব তদন্ত করে পুলিশবাদী মামলার সত্যতা না পাওয়ায় আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করায় আসামিরা মামলা হতে অব্যাহতি পেয়েছেন। অপর দিকে সিনহার বোনের করা হত্যা মামলায় টেকনাফ থানার সাবেক ওসি ও তার সহযোগীদের থানায় বসে সিনহা হত্যার পরিকল্পনা ও তা কার্যকর করার অভিযোগে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে র্যাব। এই চার্জশিট দাখিলের দুই মাস পর গত ২৫ অক্টোবর রাতে ধানমন্ডিতে হাজী সেলিম এমপির সরকারি গাড়ি থেকে নেমে তার পুত্র এরফান সেলিম, নিজের বডিগার্ড ও ড্রাইভার মিলে নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে প্রহার করে তার দাঁত ভেঙে দেয়ার দায়ে পুলিশ গাড়িচালককে গ্রেফতার এবং এমপির গাড়ি জব্দ করলেও তার ছেলেসহ বাকি সবাইকে ছেড়ে দিয়েছিল। পরের দিন নৌবাহিনীর ওই কর্মকর্তা এমপিপুত্রসহ চারজনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাত দুইজনসহ মোট ছয়জনের বিরুদ্ধে হত্যা চেষ্টার অভিযোগ এনে ধানমন্ডি থানায় মামলা করলেও অজ্ঞাত কারণে পুলিশ নির্লিপ্ত থাকায় র্যাব সেলিম এমপির বাড়িতে অভিযান চালিয়ে বাসায় অবৈধভাবে রাখা মদ, ওয়াকিটকি এবং বেআইনি অস্ত্র পাওয়ায় র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট এমপি পুত্রকে ও তার বডিগার্ডকে এক বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। মাদক ও অস্ত্র আইনে তাদের বিরুদ্ধে চারটি মামলা দায়ের করে র্যাব এই দুইজনকে নিজেদের হেফাজতে নিয়েছিল। পুলিশ দুই মাস তদন্ত করে এমপি পুত্রের বিরুদ্ধে মাদক ও অস্ত্র রাখার অভিযোগের কোনো প্রমাণ পায়নি বলে আদালতে ফাইনাল রিপোর্ট দাখিল করায় এমপি পুত্র গত ৫ জানুয়ারি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাদক ওয়াকিটকি ও অস্ত্র সবই তার দেহরক্ষী জাহিদের কাছে পাওয়া গিয়েছিল। সে তার দায় স্বীকার করায় ফাইনাল রিপোর্ট আদালতে দাখিল করা হয়েছে। মামলার বাদি ও তদন্তকারী উভয়েই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দু’টি শাখার কর্মকর্তা। কাজেই বাদির আর্জি অথবা তদন্ত প্রতিবেদন দু’টির মধ্যে একটি মিথ্যা প্রমাণিত হলে তাতে পুলিশ ও র্যাবের উভয়ের ভাবমূর্তিই ক্ষুণœ হয়ে থাকে। পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী মনে হয়, এমপি সেলিমের বাড়ির চতুর্থ তলাটি পুত্র ইরফান সেলিমের বডিগার্ড জাহিদ ভাড়া নিয়েছিলেন এবং এমপিপুত্র ওই বাসায় তার বডিগার্ডের উপভাড়াটিয়া হিসেবে থাকতেন। এ কারণে অবৈধভাবে মদ, ওয়াকিটকি ও অস্ত্র রাখার সম্পূর্ণ দায় বডিগার্ডের ওপর বর্তায়। ঘটনার সাথে ভারতীয় টিভি চ্যানেল জি বাংলায় প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬.৩০ মিনিটে প্রচারিত আলো-ছায়া ধারাবাহিকের মূল ভিলেন তীর্থংকর সেনগুপ্ত ও তার ভাতিজা উপভিলেন ভাবনের চরিত্রের হুবহু মিল দেখে আশ্চর্য হতে হচ্ছে। চাচা-ভাতিজা মিলে নিজেদের ফ্যাক্টরিতে নেশাজাতীয় ড্রাগ উৎপাদন ছাড়াও মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধের লেভেল পরিবর্তনপূর্বক বাজারজাতকরণের মতো অপরাধ করেছিল। চাচার মেয়ের জামাই অনীক, শ্যালক ও শ্বশুরের সব অপরাধ নিজের ঘাড়ে নিয়ে স্বীকারোক্তি দেয়ায় পুলিশ তাদের দু’জনকেই ছেড়ে দিয়েছিল। তেমনি এমপিপুত্রের বাসায় রাখা মদ, ওয়াকিটকি এবং বেআইনি অস্ত্র পাওয়ার সব দায় তার বডিগার্ড নিজের কাঁধে নেয়ায় এবং তা তদন্তকারী কর্মকর্তা সত্য বলে মেনে নেয়ায় এমপি পুত্র মুক্তি পেয়েছেন। ভারতীয় টিভি চ্যানেলে যেটা দেখানো হয়েছিল তার যেন লাইভ শো হলো বাংলাদেশে।
২০০৬-২০০৭ সালে ১৪ দল ও তাদের সমর্থক বুদ্ধিজীবী, সুশীলরা বলেছিলেন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন নিরপেক্ষ নন বিধায় তার অধীনে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে পারে না। তাই যেকোনো মূল্যে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি প্রস্তাবিত নির্বাচন বন্ধ করতে হবে। ওবায়দুল কাদের ২০০৬ সালের ডিসেম্বরের শেষে বঙ্গভবনে ‘অক্সিজেন সাপ্লাই বন্ধ’ করে দেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। কাদেরের বচনে জেনারেল মঈনের ছোট ভাই জাভেদ মিনহাজের নাম আসায় এত দিনে জনগণ বুঝতে পারল, জেনারেল মঈন ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের ‘অক্সিজেন মাস্ক খুলে নিয়ে’ যে দাবি আদায় করেছিলেন তার সুফল স্বরূপ ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ‘আজীবন ক্ষমতায়’ ও জাপাকে ‘আজীবন বিরোধী দলের আসনে’ বসানো হয়েছে। ত্রয়োদশ সংশোধনী অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অক্সিজেন ছিল, সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রপতির এখতিয়ারে থাকবে। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী এই ক্ষমতা চলে গেছে প্রধানমন্ত্রীর হাতে। আওয়ামী লীগের আজীবন সভাপতি হিসেবে যিনি মূলত ৩০০টি আসনেই বিরোধী দলের প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বী। যে ক্ষমতা বলে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুরোধে ২০০১ সালে ১ অক্টোবরের নির্বাচনের ১০ দিন আগে সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা দিয়ে মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। আর এই কারণে ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জাপাকে পরাজয়বরণ করতে হয়েছিল বলে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টা ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার গোপালগঞ্জের আবু সাঈদ এই তিন সম্মানিত পদাধিকারীকে ‘বেঈমান’ বলে আখ্যায়িত করেছিল। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় গিয়ে নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে সেনাবাহিনীকে বাদ দেয়া হয়েছে আর ২০১৮ সালে দাবির মুখে ভোটগ্রহণের ছয় দিন আগে ‘স্টাইকিং ফোর্স’ হিসেবে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল। দায়িত্বরত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট যারা সরকারের আইন বিভাগের অধীনে, তারা ডাকলে সেনাসদস্যরা ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবেন, নচেত নয়। যে এলিট শ্রেণী ২০০৬-০৭ সালে বলেছিলেন ‘রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন প্রধান উপদেষ্টা পদে থাকলে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না’ তারাই ২০১৩-১৪ সালে ভোল পাল্টিয়ে বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী তার মন্ত্রিসভা এবং ১৪ দলের ৩১৫ জন এমপি ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করলে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। বিএনপি ওই নির্বাচন বর্জন করে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার দায় তাদের ওপরই বর্তায়।’ ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এমনিতেই জিততো। অহেতুক নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা সমীচীন হয় নাই। গত ৩১ বছরেও যাদের বিবেক জাগ্রত হয়নি, মির্জা কাদেরের সাথে সেই বিবেক জাগ্রত করা সম্ভব নয়। সরকারি দলের নেতাদের ও প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কানে জনগণের আকুতি পৌঁছে না বিধায় মির্জা কাদেরকে সত্য প্রকাশ করতে হচ্ছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজ উদ্দিনের ওপর আস্থা না থাকায় যে চারজন উপদেষ্টা ২০০৬ সালে ডিসেম্বরে পদত্যাগ করায় আওয়ামী লীগ কর্তৃক অভিনন্দিত হয়েছিলেন তারা ২০১৪ সালের নির্বাচন অবাধ করার দাবি জানালে ২০০৭ সালে নির্বাচন করতে ব্যর্থ উপদেষ্টা বলে আওয়ামী লীগ কর্তৃক নিন্দিত হয়েছিলেন। যে সম্মানিত নাগরিকবৃন্দ বর্তমান রাষ্ট্রপতির সাথে ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে সাক্ষাৎ করে বিফল হয়েছিলেন, তারাই সাত বছর পরে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে ব্যর্থ নির্বাচন কমিশনকে অপসারণের লক্ষ্যে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের জন্য শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে একই রাষ্ট্রপতির সমীপে আর্জি পেশ করেছেন। ষোড়শ সংশোধনীতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সংসদ বাতিল করায় এবং আপিল বিভাগের রায়ে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হলেও সরকার রিভিউ আবেদন করায় শুনানি না হওয়া পর্যন্ত ষোড়শ সংশোধনী সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের অস্তিত্ব সংবিধানে কোথাও নাই। সরকারের করা রিভিউ খারিজ হয়ে গেলে সংসদেই জুডিশিয়াল কাউন্সিলের পুনর্বহাল করতে হবে। জনগণের আকুল আবেদন, নেতারা ভেবে দেখুন এইরূপ নির্বাচন, নাশকতার গায়েবি ঘটনার হাজার হাজার মামলা, বন্দুকযুদ্ধের নামে হাজার ভোটার হত হওয়া এবং সাত লক্ষাধিক কোটি টাকা বিদেশে পাচারের ঘটনা ঘটলে এবং পৌর ইউপি নির্বাচন ব্যালটে হলে ২টি ব্যালট ও ইভিএমে হলে দু’টি ইভিএম ভোটারদের জন্য এবং মেয়র/চেয়ারম্যানের ব্যালট ইভিএম নৌকার জন্য সংরক্ষিত থাকতো; তাহলে তা আওয়ামী লীগ মেনে নিত কী? ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের বা ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের মতো নির্বাচন করা সরকারের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভোটাধিকারের দাবিতে জনগণকে কেন তাদের বিরুদ্ধেই আন্দোলন করতে হবে যারা তা প্রতিষ্ঠার দাবিদার। একটানা একযুগ কী করেছেন তার মূল্যায়নের ভার জনগণের ওপর ছেড়ে দিন। একযুগ ভালো কাজ করে থাকলে জনগণ পুনরায় ক্ষমতায় বসাতে পারে।


আরো সংবাদ



premium cement