২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

হাসপাতালের সংখ্যা ও মান নিয়ে সংশয়!

সুশাসন
-

ইংরেজি হসপিটাল শব্দটির বাংলা রূপ হাসপাতাল। হাসপাতাল বলতে আরোগ্যালয়, আরোগ্যনিকেতন, চিকিৎসালয়, চিকিৎসানিকেতন প্রভৃতিকে বোঝায়। আধুনিক হাসপাতাল বলতে এমন প্রতিষ্ঠানকে বোঝায় যেখানে সাধারণ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং সেবাকর্মীরা রোগীদের চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত। সরকারি-বেসরকারি ছাড়াও দাতব্য সংস্থা হাসপাতাল পরিচালা করে থাকে। এমন অনেক দেশ রয়েছে যেখানে সরকারি-বেসরকারি ছাড়াও দাতব্য সংস্থার পাশাপাশি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হাসপাতাল পরিচালনা করে। হাসপাতালে রোগীদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার জন্য আবাসিক শয্যার ব্যবস্থা থাকে। হাসপাতালে সব ধরনের রোগের চিকিৎসা করা হয়। সরকারি হাসপাতালে সাধারণ রোগের ক্ষেত্রে বিনামূল্যে ওষুধ দেয়ার ব্যবস্থা থাকে।
ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার হাসপাতালের সাথে সম্পর্কযুক্ত। আধুনিক হাসপাতালগুলোর নিজস্ব ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে এমন হাসপাতাল বিভিন্ন রোগের পরীক্ষার রিপোর্টের ক্ষেত্রে নিজেদের ছাড়া বাইরের কোনো ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রিপোর্ট গ্রহণ করে না। এতে দেখা যায়, স্বল্প সময়ের ব্যবধানে অন্যত্র থেকে আগে গৃহীত ডায়াগনস্টিক রিপোর্ট মূল্যহীন হয়ে পড়ে। একই রোগের ক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার রিপোর্ট গ্রহণে বাধ্য করার কারণে রোগীরা যে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন এ বিষয়ে হাসপাতাল মালিক ও চিকিৎসকরা অনেকটা নির্বিকার। স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বিশিষ্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যাও অগণিত। হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট ও স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বিশিষ্ট বেশির ভাগ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রিপোর্টের মান নিয়ে প্রায়ই রোগীদের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, শূন্য বা খালি প্যাডে বিশেষজ্ঞ চিকিৎকের অগ্রিম স্বাক্ষর গ্রহণপূর্বক রিপোর্ট ডেলিভারি দেয়া হয়। রিপোর্ট প্রস্তুতের কাজে নিয়োজিত টেকনিশিয়ানদের শিক্ষাগত মান ও দক্ষতা বিষয়েও অনেক প্রশ্ন দেখা দেয়। স্বল্প ব্যবধানে দুটি স্বনামধন্য ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে গৃহীত রিপোর্ট পর্যালোচনায় দেখা যায় একটির সাথে অন্যটির গরমিল বা ভিন্নতা যা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়।
ক্লিনিকে হাসপাতালের মতো চিকিৎসাসেবা দেয়া হলেও ক্লিনিক ও হাসপাতাল এক নয়। অভিধানের সংজ্ঞা মতে ক্লিনিক হলো ব্যক্তিগতভাবে পরিচালিত বিশেষ উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসাকেন্দ্র। হাসপাতালের ব্যাপ্তি ও পরিসর বড় অপর দিকে ক্লিনিকের আকৃতি ও পরিধি ছোট হয়ে থাকে। ক্লিনিকে হাসপাতালের মতো রোগীর ভর্তির ব্যবস্থা থাকে না। ক্লিনিকে এক বা দু’জন চিকিৎসক ও স্বল্পসংখ্যক সেবাকর্মী চিকিৎসা কাজে নিয়োজিত থাকেন। ক্লিনিকের চিকিৎসা হাসপাতালের মতো দীর্ঘমেয়াদি হয় না। দেশের শহরস্থ সব ক্লিনিকই বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত। ক্লিনিকে সব ধরনের রোগের চিকিৎসা গ্রহণের সুযোগ অনুপস্থিত। একই সাথে ক্লিনিকের চিকিৎসা খরচ হাসপাতালের তুলনায় অনেক বেশি। ক্লিনিকে দ্রুত চিকিৎসা পাওয়া গেলেও বিনামূল্যে ওষুধ প্রদানের ব্যবস্থা নেই।
ক্লিনিক বিষয়ে প্রচলিত ধ্যানধারণার অবসানে সরকারি অর্থায়নে দেশের গ্রামীণ প্রতি ছয় হাজার জনগোষ্ঠীর জন্য একটি কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ সরকারের জাতিসঙ্ঘের এমডিজি কার্যক্রমের সাথে সম্পর্কিত। এসব কমিউনিটি ক্লিনিকে চিকিৎসক ও সেবাকর্মীর পদায়নসহ বিনামূল্যে ওষুধ প্রদানের ব্যবস্থার কথা বলা হলেও কার্যত চিকিৎসক ও সেবাকর্মীর অনুপস্থিতি এবং ওষুধের স্বল্পতা জনসাধারণের হতাশার কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
ঢাকা শহরকে একদা মসজিদের শহর বলা হতো কিন্তু বর্তমানে যে হারে বিদ্যমান সরকারি হাসপাতালের সংখ্যাকে অতিক্রান্ত করে সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি থেকে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠছে তাতে মসজিদের শহরের নামটি যদি চাপা পড়ে যায় তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে বলে মনে হয় না ।
ঢাকা শহরে ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রায় ১০টির মতো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি মতে, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন। কিন্তু এসব হাসপাতালে ভুক্তভোগী চিকিৎসা গ্রহণকারীদের অভিমত বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এগুলোতে নিয়োজিত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা রোগ নির্ণয়ে ব্যর্থ। তাছাড়া এসব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক একজন রোগীকে যে সময় ব্যয় করে পরীক্ষা করেন তা রোগীদের ভাষ্যানুযায়ী তাদের সন্তুষ্টি লাভে যথেষ্ট নয়। এসব হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পাশাপাশি আধুনিক সরঞ্জামাদির সংস্থান থাকায় যেকোনো ধরনের চিকিৎসা দেয়া সম্ভব। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, জটিল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি বা তাদের স্বজনরা এসব হাসপাতালের চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না।
আমাদের দেশে অতীতে দাঈয়ের হাতে প্রসূতির প্রসবের কাজ সম্পন্ন করানো হতো। এখনো গ্রামাঞ্চলে ধারাটি বহাল রয়েছে। দেশের দাঈদের কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ না থাকলেও অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞান দিয়ে তারা সুনিপুণভাবে প্রসবের কাজটি সম্পন্ন করেন। এছাড়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, স্বাভাবিকভাবে প্রসবের কাজটি সম্পন্ন হয়েছে। বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের ক্ষেত্রে দেখা যায়, শতকরা ৯০ ভাগ প্রসবের কাজ অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়। যেকোনো প্রসবের কাজ অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হলে স্বাভাবিকের চেয়ে ব্যয়ের পরিমাণ বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, একটি ক্লিনিকে প্রসূতিকে নেয়ার ১০ মিনিটের মাথায় স্বাভাবিকভাবে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার ঘটনা সংঘটিত হলে প্রায় আধা ঘণ্টা পরে ডাক পাওয়া গাইনি চিকিৎসক ক্লিনিকে উপস্থিত হয়ে সেবিকাদের সাথে ক্রোদান্বিত হয়ে বলেন, আধা ঘণ্টা সময়ের জন্য কি প্রসব ঠেকিয়ে রাখা যেত না? সততা ও আন্তরিকতার সাথে যেসব চিকিৎসক পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন; তাদের অভিমতÑ যেসব বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করানো হয়, তার বড় অংশই স্বাভাবিকভাবে প্রসব করানো সম্ভব। শুধু হাসপাতাল বা ক্লিনিক মালিক ও চিকিৎসকের আর্থিক লাভের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে অনৈতিকতা ও মূল্যবোধের চরম অধঃপতনে এরা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্মের কাজটি সমাধা করেন।
আমাদের দেশে অগণিত বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার থাকা সত্ত্বেও এগুলোর মান ও সেবা নিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনরা সন্তুষ্ট না হওয়ায় একটি বড় অংশ ভারতে এবং অধিক সচ্ছলরা থাইল্যান্ড বা সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নিতে যান। এতে আমাদের কী পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় ঘটে তার সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও এটি যে একটি বড় অঙ্ক তা দেশের সচেতন জনমানুষ অনুধাবনে সক্ষম।
দেশের ভুক্তভোগী রোগীদের অভিমত, আমাদের চিকিৎসকদের কাছ থেকে তারা ভালো ও আন্তরিক ব্যবহার লাভ করলে তা দিয়েই রোগ নিরাময়ের আশঙ্কার অবসান এবং রোগীদের আস্থা অর্জন সম্ভব। এ বিষয়ে আমাদের চিকিৎসকরা সচেষ্ট হলে দেশ বিপুল বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় থেকে রক্ষা পাবে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত এবং থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন এমন অনেক রোগীর সাথে কথা বলে জানা যায়, তাদের চিকিৎসাব্যবস্থার চেয়ে চিকিৎসক ও সেবিকাদের আন্তরিক আচরণ এবং অস্ত্রোপচার-পরবর্তী ব্যবস্থাপনা সত্যিই আশাব্যঞ্জক। আমাদের চিকিৎসকরা এবং চিকিৎসা খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এ দুটির সমন্বয় ঘটাতে পারলে পরিস্থিতির উত্তরণ সম্ভব।
বাংলাদেশে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রতিদিন যতজন রোগী দেখেন, পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক একদিনে এত সংখ্যক রোগী দেখেন না। এর পেছনে মূল কারণ তারা একজন রোগী দেখতে যে সময় ব্যয় করেন তাতে রোগের অতীত ইতিহাস ও বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে সঠিক ধারণা পেতে পারেন। আমাদের দেশে খুব দ্রুততার সাথে রোগী দেখার কারণে রোগের অতীত ইতিহাস এবং বর্তমান অবস্থানের বিষয় দুটি উপেক্ষিত থেকে যায়।
আমাদের দেশের বিভিন্ন বিশেষায়িত ও সাধারণ সরকারি হাসপাতালে যেসব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োজিত রয়েছেন তাদের অনেকেই সরকারি হাসপাতালের কাজ সমাপনান্তে ব্যক্তিগত চেম্বার বা বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে চিকিৎসা কাজে নিয়োজিত হন। এতে দেখা যায়, দিবসের বেশির ভাগ সময় চিকিৎসা কাজে নিয়োজিত থাকায় তাদের পক্ষে প্রয়োজনীয় বিশ্রাম ও অধ্যয়নের সুযোগ কমই ঘটে।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নয়ন ও উৎকর্ষের সাথে সাথে চিকিৎসা-বিজ্ঞানেরও উন্নয়ন ও উৎকর্ষ ঘটছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট সর্বশেষ গবেষণা প্রতিবেদন বিষয়ে ধারণা লাভ না করলে তাদের পক্ষে জটিল ও দুরারোগ্য ব্যাধির ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত চিকিৎসা দেয়া সম্ভব নাও হতে পারে। তাই এটি প্রত্যাশিত যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা নিজেদের সর্বাধুনিক চিকিৎসা বিষয়ে নিজেদের সমৃদ্ধ করার মানসে চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিবেদন অধ্যয়নে সম্পৃক্ত থাকবেন।
বর্তমানে আমাদের দেশে ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা, বিভাগীয় ও রাজধানী শহরে যে সংখ্যক বিশেষায়িত ও সাধারণ সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল এবং ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে; এগুলো আমাদের চিকিৎসা প্রত্যাশী সব নাগরিকের চিকিৎসা সমস্যার সমাধান প্রদানে সক্ষম। অথচ আমাদের দেশের নাগরিকদের মধ্যে এগুলোর মান এবং চিকিৎসকদের সততা ও আন্তরিকতা নিয়ে সংশয় থাকায় তারা বিদেশের মুখাপেক্ষী হচ্ছেন। বিদেশ মুখাপেক্ষিতা থেকে তাদের ফিরানোর দায়িত্ব চিকিৎসক ও চিকিৎসা খাত সংশ্লিষ্টদের। তবে এ কথাও অনস্বীকার্য যে, দেশের শীর্ষ পদধারী ও বিত্তবানরা আমাদের সক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে দেশে চিকিৎসা গ্রহণে আত্মপ্রত্যয়ী হলে দ্রুততার সাথে সব ধরনের সঙ্কটের অবসান হবে। হ
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail : iktederahmed@yahoo.com

 


আরো সংবাদ



premium cement