২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

এইচএসসি অটো পাসের পরিণাম

-

বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো পাবলিক পরীক্ষায় অটো পাসের উদাহরণ ছিল না। সম্প্রতি বর্তমান সরকার সে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। গত ৩০ জানুয়ারি মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সরাসরি অনলাইনে যুক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী ২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষার অটো পাসের ফল ঘোষণা করেন। এর আগে পরীক্ষা না নিয়ে ফল প্রকাশের জন্য প্রয়োজনীয় আইন সংশোধন করা হয় জাতীয় সংসদে।
উল্লেখ্য, সংশ্লিষ্ট এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের পূর্ববর্তী জেএসসি পরীক্ষায় পাওয়া নম্বরের ২৫ শতাংশ এবং এসএসসি পরীক্ষার পাওয়া নম্বরের ৭৫ শতাংশ বিবেচনায় নিয়ে মূলত এবারের অটো পাস এইচএসসি পরীক্ষার ফল নির্ধারণ করা হয়। এই পরীক্ষার ফল তৈরি করার লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠিত আট সদস্যদের একটি জাতীয় কমিটি অটো পাসের নীতিমালা তৈরি করেছে। এই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী, সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের ভিত্তিতে জেএসসির ২৫ শতাংশ ও এসএসসির ৭৫ শতাংশ নম্বরের সাথে চতুর্থ বিষয়ের প্রাপ্ত নম্বর যোগ করে ৮০ থেকে ৮৫ নম্বর তথা মার্জিন লাইনের কাছাকাছি পাওয়া নম্বরের শিক্ষার্থীদের জিপিএ ফাইভ দেয়া হয়েছে। ফলে পূর্ববতী বছরের তুলনায় এবারের অনেক বেশি শিক্ষার্থী জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। স্মর্তব্য, ২০২০ সালে সারা দেশে জিপিএ ফাইভ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক লাখ ৫৩ হাজার ৬১৪, যা পূর্ববর্তী ২০১৯ সালের তুলনায় তিন গুণেরও বেশি। ২০১৯ সালে জিপিএ ফাইভ পায় ৪১ হাজার ৮০৭ জন। অপর দিকে পূর্ববর্তী জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষায় যারা জিপিএ ফাইভ পেয়েছে, কিন্তু এইচএসসিতে চতুর্থ বিষয় না থাকায় তাদের ক্ষেত্রে চতুর্থ বিষয়ের কোনো নম্বর যোগ করা হয়নি। এর ফলে জিপিএ ফাইভ থেকে বঞ্চিত হয়েছে ৩৯৬ জন শিক্ষার্থী।
এর ফলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে এই অটো পাস নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। চতুর্থ বিষয়ের নম্বর কারো ক্ষেত্রে যোগ হওয়া, আবার কারো ক্ষেত্রে যোগ না হওয়ায় এই ফল নির্ধারণে একটি বৈষম্য হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। এ ক্ষেত্রে চতুর্থ বিষয়ের নম্বর কোনো শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রেই যোগ না হওয়াই যৌক্তিক ছিল। সমালোচনা আছে, সরকার শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সস্তা সন্তুষ্টি অজর্নের উদ্দেশ্যেই এ ধরনের সাবজেক্ট ম্যাপিং পদ্ধতিতে অটো পাসের ফল নির্ধারণের পদক্ষেপটি নিয়েছে।
এই অটো পাস সামগ্রিকভাবে কারো জন্যই সন্তুষ্টির কারণ হতে পারে না। প্রতিটি ভালো ছাত্রের প্রত্যাশা থাকে, একটি বাস্তব পরীক্ষার মাধ্যমে তাদের মেধার গৌরবজনক স্বাক্ষর রাখা হবে। এই অটো পাস যেন তাদের সেই সুযোগটুকু ‘ছিনতাই’ করল। তা ছাড়া যারা এই অটো পাসের সার্টিফিকেট নিয়ে বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের চেষ্টা করবে, তারা অটো পাসের কারণে হোঁচট খেতে পারে। কারণ অটোপাসের মাধ্যমে অর্জিত সার্টিফিকেট আর পরীক্ষা দিয়ে সার্টিফিকেট অর্জন কখনোই একইভাবে বিবেচিত হবে না। তা ছাড়া এসএসসি পরীক্ষায় যারা প্রত্যাশিত ফল পায়নি, তাদের অনেকেই এইচএসসিতে তা পূরণে সচেষ্ট ছিল। তাদের জন্য এই অটো পাস ক্ষোভের কারণ হয়ে থাকবে। আর এই অটো পাসে যাদের ফলাফল নিচের দিকে, তারা কর্মজীবনে চাকরি ও পদোন্নতি পাওয়া ব্যাপারে অবহেলার শিকার হতে পারে। কার্যত ওরা সারা জীবন এই অটো পাসের বিরূপ প্রভাব বয়ে বেড়াবে। কারণ সংশ্লিষ্ট চাকরিদাতারা জানেন, এসব শিক্ষার্থী পুরো একটি বছর ক্লাসের বাইরে থেকে কোনো পরীক্ষা ছাড়াই অটোপাসের সার্টিফিকেট হাতে পেয়েছে। ধরেই নেয়া যায়, এদের জ্ঞানার্জনে ঘাটতি থাকবে।
বাস্তব পর্যবেক্ষণে দেখা গেছেÑ ২০১৮ ও ২০১৯ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় গড় ফেলের হার ছিল ২৮.২২ শতাংশ। ২০২০ সালে আলোচ্য এইচএসসি পরীক্ষা অটো পাসের বদলে যদি স্বাভাবিক নিয়মে হতো, তবে এই ২৮.২২ শতাংশ হারে ফেল করত চার লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী। কিন্তু অটো পাসের সুবাদে এরা সবাই এখন ‘এইচএসসি পাস’। প্রকৃতপক্ষে, ভবিষ্যতে জাতির জন্য এরাই হতে পারে বড় ধরনের জঞ্জাল। কিন্তু আগের বছরের তুলনায় তিন গুণেরও বেশি জিপিএ ফাইভ পাওয়া শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি এরাও ‘ঘাটতি জ্ঞান’ নিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের স্বপ্নে বিভোর। অথচ সংশ্লিষ্ট অনেকেই মনে করেন, এই করোনা অতিমারীর সময়েও প্রায় সবক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবং অনেক ক্ষেত্রে না মেনে জাতীয় কর্মকাণ্ড চলেছে। সেখানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে এইচএসসি পরীক্ষা নেয়া হলে এ ধরনের নানা জটিলতা থেকে জাতি মুুক্ত থাকতে পারত।
এ দিকে এক বছর ক্লাসের বাইরে থেকে পরীক্ষা না দিয়েই অটো পাসের সার্টিফিকেট নিয়ে মেডিক্যাল কলেজ ও বিশ্বদ্যিালয়ে যারা ভর্তি হতে যাচ্ছে, তাদের কেবল এইচএসসির বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষা নিয়ে মেধার ভিত্তিতে ভর্তি করা হবে বলে জানা গেছে। এসব পরীক্ষায় তারা মেধার স্বাক্ষর কতটুকু রাখবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। কারণ, স্বাভাবিকভাবে পাস করা ছাত্রছাত্রীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জনে লজ্জাজনক ব্যর্থতার নানা দুঃসংবাদও অতীতে আমাদের শুনতে হয়েছে।
এ দিকে অতিমারীর কারণ উল্লেখ করে গত বছর চলমান অনার্স চতুর্থ বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা মাঝপথে ১৪ মার্চে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তখন অনার্স পরীক্ষার্থীরা তাদের এইচএসসির মতো অটো পাসের দাবি তুলে দুর্বার আন্দোলনে নামে। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সে দাবি মেনে নেয়নি। বরং প্রায় এক বছর বন্ধ থাকার পর বাদবাকি বিষয়গুলোর পরীক্ষা স্বাস্থ্যবিধি মেনে আবার চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি শুরু করা হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে অনেকেরই অভিমত, সরকার চাইলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে এইচএসসি পরীক্ষাও একইভাবে নিতে পারত। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সরকার অটো পাসের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, করোনা মহামারীর তাণ্ডব আমাদের দেশের তুলনায় ভারতে অনেক বেশি হওয়া সত্ত্বেও সে দেশের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীকে অটো পাস দেয়া হয়নি।
আমরা লক্ষ্য করেছি, এই অটো পাসের ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী বরাবর আগ্রহী ছিলেন। তিনি গত বছর ৮ অক্টোবরেই ঘোষণা দিয়ে বসেন : ‘এইচএসসি পরীক্ষা হবে না, অটোপাস দেয়া হবে।’ ওই দিন তিনি যে কমিটি ও সদস্যের কথা উল্লেখ করেন, বাস্তবতার সাথে এর মিল পাওয়া যায়নি। শেষ পর্যন্ত কার্যকর করা হলো অটোপাসের এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। অনেকের অভিমত, মন্ত্রী অন্যের মাধ্যমে প্ররোচিত হয়ে এই কাজটি সম্পন্ন করলেন। কারণ, এই অটো পাস সিস্টেম কার্যকর করার কোনো যৌক্তিক কারণ ছিল না।
মনে রাখতে হবেÑ আজ অটো পাস দিয়ে যেসব শিক্ষার্থীকে আমরা অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিয়েছি, এরাই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। এদেরই হাল ধরতে হবে জাতীয় অগ্রগমনে। যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হলে এদের অটো পাসের বৃত্ত থেকে বের করে আনতেই হবে। সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে তাদের মেধা বিকাশের। সে দায়িত্ব আমাদেরই। নইলে আগামী দিনের প্রতিযোগিতায় আমরা কিছুতেই সফল হতে পারব না। হ
লেখক : গবেষক ও কলেজ শিক্ষক


আরো সংবাদ



premium cement