মাদকের অবাধ বিস্তার
- এইচ এম আবদুর রহিম
- ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০০:০০
ভেজাল ও বিষাক্ত মদপান করে সারা দেশে অনেকে প্রাণ হারাচ্ছে। গত এক মাসে অন্তত ১০০ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। বগুড়ায় এক মাসেই ১৫ জন মারা গেছে। এদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী, চাকরিজীবীরা রয়েছেন। বেশি লাভের আশায় ভেজাল মদ তৈরি হচ্ছে। পানি, চিনি, রঙ আর স্পিরিট দিয়ে ভেজাল মদ তৈরি হচ্ছে।
উঠতি বয়সী যুবকরা বিশেষ করে স্কুল কলেজগামী ছেলেরা এ মরণ নেশায় জড়িয়ে পড়ছে। কৌতূহল, পারিবারিক অশান্তি, বেকারত্ব, প্রেমে ব্যর্থতা, বন্ধুদের প্রচরণা, অসৎ সঙ্গ, নানা রকম হতাশা ও আকাশ সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাবে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। যারা নেশা করে তারা জানে নেশা কোনো উপকারী বা ভালো কাজ নয়। এটি মানুষের জীবনীশক্তি নষ্ট করে দেয়।
দেশে মাদকদ্রব্য অধিদফতর রয়েছে। দেশে মাদকসেবীদের চাহিদা মেটাতে লাইসেন্স দেয়া হয়। এর বাইরে বিদেশ থেকে বৈধ অবৈধ নানা পন্থায় মাদকদ্রব্য এ দেশে আসে। নানা পন্থায় মাদকদ্রব্য দেশে বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো ঢুকছে। চিকিৎসার মাধ্যমে মুক্তি মিললেও ভেজাল মেশানো মাদক সেবনে মৃত্যু থেকে রেহাই পাওয়া যাচ্ছে না। মানুষের অজ্ঞতা অসচেতনতার কারণে অবস্থার এতটা অবনতি হয়েছে। মাদকদ্রব্যের মধ্যে বেশি ভেজাল মেশানো হচ্ছে ইয়াবায়। বিশ্বের কোথাও ইয়াবার রেজিস্টার্ড ফর্মুলা নেই। ফলে যেভাবে খুশি সেভাবে এটি তৈরি করা হচ্ছে। এটি গ্রহণের ফলে কিডনি লিভার ও ফুসফুসসহ শরীরের অঙ্গ-প্রতঙ্গের অপূরণীয় ক্ষতি হয়। মাত্র কয়েক হাজার টাকার কাঁচামাল দিয়ে অন্তত এক লাখ ইয়াবা তৈরি করা যায়। যার মূল্য দুই থেকে তিন কোটি টাকা। লোভে পড়ে অনেকেই এটি তৈরি করছে। চাহিদা থাকায় অলিগলিতে বিক্রি হচ্ছে এসব মাদকদ্রব্য। নিষিদ্ধ মাদকদ্রব্য গোপনে বিক্রি করায় এ যাচাই বাছাই করার সুযোগ থাকে না। দেশে ভেজাল মাদকদ্রব্য সেবন করে অনেকের মৃত্যু হওয়ার পর ও মাদকসেবীদের টনক নড়েনি। কারণ মাদকসেবীদের সাধারণত ভালোমন্দ বাছবিচার করার মতো জ্ঞান থাকে না।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ করছে একধরনের গডফাদাররা। মাদক পাচার, ব্যবসা ও ব্যবহারকারীর ক্রম প্রসাররোধকল্পে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পর্যায়ে নানা রকম কার্যক্রম দেখা গেলেও তেমন ইতিবাচক ফল মিলছে না। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতায় দেশের অভ্যন্তরে মাদকের বিকিকিনি এবং বিভিন্ন সীমান্ত পথে দেশের অভ্যন্তরে মাদকের অনুপ্রবেশ নিয়ে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ বহু দিনের। বিভিন্ন সময়ে পুলিশি অভিযানে মাদকদ্রব্য আটক ও জড়িতদের আটকের কথা শোনা গেলেও মাদক ব্যবসা গডফাদারদের আটক করা হয়েছে কিংবা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে এমন সাধারণত হয় না। ফলে মাদকবিরোধী নানা অভিযান থাকলেও কিছু দিন যেতে না যেতেই আবার নতুন করে মাদকের ব্যবসা আরো প্রসার ঘটে।
দেশের তরুণ সমাজ মাদকের ভয়াবহ প্রভাবে বিপদগামী হচ্ছে। মাদকের নীল ছোবলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে আমাদের আগামী প্রজন্ম। সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার প্রকট রূপের পেছনে মাদক অন্যতম বড় উপসর্গ হিসেবে দেখা দিয়েছে। মাদকাসক্তদের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না, যেকোনো অনৈতিক কাজে লিপ্ত হতে বিবেক বাধা দেয় না। মিথ্যা কথা বলা তাদের একটি স্বাভাবিক বিষয়। কোনো ধরনের অপরাধবোধ তাদের স্পর্শ করে না। মাদকসেবনকারীর দেহ মন চেতনা, মনন, প্রেষণা, আবেগ, বিচারবুদ্ধি সবই মাদকের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এক গবেষায় দেখা গেছে, মাদকাসক্তের কারণে বিগত ১০ বছরে ২০০ মা-বাবা খুন হয়েছেন। দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৭৫ লাখ এবং প্রতি বছরে এর পেছনে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা নষ্ট হচ্ছে।
মিয়ানমার তৈরি করছে ইয়াবা আর ভারত তৈরি করছে ফেনসিডিল। করোনার মধ্যে ইয়াবা আর ফেনসিডিল সেবন করছে বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ। ফলে ভারত আর মিয়ানমার এ দেশের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। দেশে প্রতি বছর ২৫ হাজার কোটি টাকার মাদকদ্রব্য বেচাকেনা করা করা হয়। পত্রিকা মারফতে জানা যায়, প্রতিদিন রাজধানী ঢাকা শহরেই ইয়াবা বাবদ হাত বদল হয় সাত কোটি টাকা। বেসরকারি হিসাব মতে মাদকাসক্তদের সংখ্যা এক কোটিরও বেশি। মাদক গ্রহণকারী ৮০ ভাগের বয়স ১৫ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। বিশ্বের নেশাগ্রস্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। ঢাকা শহরে ১০ লাখ মাদকসেবী রয়েছে। প্রতিটি গ্রামে গড়ে ১৫০ জন করে মাদকসেবী রয়েছে। এর প্রতিরোধ, দমন নিয়ন্ত্রণের উপায় দেখা যাচ্ছে না। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হয়েছে।
৩২ ধরনের মাদক দেশে সেবন চলছে। এ পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন নামে যে মাদক উদ্ধার হয়েছে সেগুলো হচ্ছে হেরোইন, গাঁজা, চোলাই মদ, দেশী মদ, বিদেশী মদ, বিয়ার, রেকটিফায়েড স্পিরিট, কেডিন, ফেনসিডিল, তাড়ি, প্যাথেডিন, টিডি জেসিক, ভাং, কোডিন চ্যাবলেট, ফার্মেন্টেড, ওয়াশ (জাওয়া), বনোজেসিক ইনজেকশন (বুপ্রেনরফিন), রটরাহাইড্রোবানাবিল, এক্সএলমুগের, মরটিন, ইয়াবা, আইএসপিল, ভায়াগ্রা, সানাগ্রা, টলুইন, পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট, মিথাইল, ইথানল ও কিটোন। রাজধানীতে পাইকারি খুচরা মিলিয়ে পাঁচ শতাধিক মাদক স্পট নিয়ন্ত্রণ করছে সহস্রাধিক চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। এ ছাড়া রয়েছে অসংখ্য ভাসমান বিক্রেতা। মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও লাওস নিয়ে গঠিত ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল’। ভারত, নেপাল ও তিব্বতের সীমান্তবর্তী অঞ্চল নিয়ে ‘গোল্ডেন ক্রিসেন্ট’ বাংলাদেশকে ঘিরে ফেলেছে। ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম মাদক উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের থাবার মধ্যে অবস্থান করছে। বাংলাদেশকে ঘিরে প্রতিবেশী দেশের সীমান্তে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার ফেনসিডিল কারখানা। সঙ্ঘবদ্ধ দল মিয়ানমার থেকে কক্সবাজার দিয়ে সারা দেশে কৌশলে ছড়িয়ে দিচ্ছে ইয়াবা।
ফেনসিডিল, হেরোইন, ইয়াবার কোনোটি দেশে উৎপাদিত না হলেও তা পাওয়া যাচ্ছে যত্রতত্র। মাদকের করাল গ্রাস থেকে সন্তানদের ফেরাতে না পেরে পরিবারের শান্তি রক্ষায় অনেক বাবা-মা তার সন্তানকে পুলিশের হাতি উঠিয়ে দিচ্ছেন। মাদকাসক্ত সন্তানদের হাতে মা-বাবাও জীবন হারাচ্ছেন। এ থেকে পরিত্রাণের আশায় ১৯৯০ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯০ সালের ২০ নং আইন প্রণীত হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ও মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনকল্পে ওই আইন ১৯৯০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি প্রণয়ন করা হয়। ওই আইনের ২(ঠ) ধারায় মাদকের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। সে মতে মূলত অপিয়াম পপি বা তৎনিঃসৃত আঠালো পদার্থ; আফিম; আফিম থেকে অদ্ভূত মরফিন, কোডিন, হেরোইন প্রভৃতি এবং এদের ক্ষারগুলো; শতকরা ০.২ শতাংশের অধিক মরফিন যুক্ত যেকোনো পদার্থ, কৃত্রিম উপায়ে তৈরি আফিমের সমধর্মী দ্রব্য যথা পেথিডিন, হাইড্রোমরফিন, ডিমেরাল, বেটাপ্রোডাইন প্রভৃতি, কোকা পাতা এবং তা থেকে উদ্ভূত সব দ্রব্য, কোকেন এবং ০.১ শতাংশের অধিক কোকেনযুক্ত যেকোনো পদার্থ অথবা কোকেনের যেকোনো ক্ষার, চারস হাশিশ, গাঁজাগাছ, গাঁজা বা ভাং সহযোগে প্রস্তুত যেকোনো পদার্থ, এলকোহল এবং ০.৫ শতাংশের অধিক অ্যালকোহলযুক্ত যেকোনো পদার্থ, রেকটিফাইড স্পিরিট এবং তৎসহযোগে যেকোনো ওষুধ বা তরল পদার্থ, বিয়ার, বারবিচুয়েটস, তাড়ি, পচুই, মেথিলেটেড স্পিরিট প্রভৃতি দ্রব্য মাদক হিসেবে পরিচিত। ভারতের তৈরি ফেনসিডিল সিরাপ আমাদের দেশে মাদক হিসেবে পরিচিত। অ্যালকোহল ছাড়া অন্য কোনো মাদকদ্রব্যের চাষাবাদ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বহন, পরিবহন, আমদানি-রফতানি, সরবরাহ, ক্রয়-বিক্রয়, ধারণ, সংরক্ষণ, গুদামজাতকরণ, প্রদর্শন প্রয়োগ ও ব্যবহার ওই আইনের ৯ ধারায় নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
আশির দশকের শুরুর দিকে বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে মাদকের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়েছিল। ওই সময় বিদেশ থেকে আসা মাদক সম্পর্কিত অপরাধের বিচার করা হতো ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন অনুসারে। সেখানে শুধু শুল্ক ফাঁকি দিয়ে চোরাপথে আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য দেশে নিয়ে আসা বা নিজ হেফাজতে রাখার অপরাধেই আসামির বিচার হতো। জনজীবনে ব্যাপক ক্ষতিসাধনকারী এ মাদকসংক্রান্ত অপরাধের জন্য ওই আইন পর্যাপ্ত ছিল না। তাই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ এবং মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনকল্পে ১৯৯০ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করা হয়। ১৯৯০ সালের ২ জানুয়ারি থেকে এ আইন কার্যকর হয়। কিন্তু মাদকের প্রসার বেড়েই চলেছে। আইন সঠিকভাবে প্রয়োগ হয়নি বলে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়েছে।
গত বছর ১০ মার্চ কক্সবাজার থেকে এক ব্যক্তিকে আটক করা হয় যার মাথার পাগড়ির মধ্যে ৬০০০ ইয়াবা বড়ি লুকানো ছিল। টেকনাফে দুই লাখ মানুষের মধ্যে ৮০ হাজার কোনো না কোনোভাবে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত। নারী-পুরুষ উভয় শ্রেণীর মধ্যে মাদক সেবনের প্রবণতা বাড়ছে। ডিশ অ্যান্টেনার যুগে বিদেশী সংস্কৃতির আগ্রাসন এ দেশের কোমলমতি ছাত্রছাত্রীকে নেশাগ্রস্ত করার মানসিকতা তৈরি করছে। বিষ শরীরে ঢুকিয়ে নেশা করার মতো অভ্যাস গড়ে উঠছে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে। বাংলাদেশে ইয়াবার মূল উৎস মিয়ানমার। সেখানে বিক্রি হয় কেজি কিংবা টনে। বাংলাদেশে আসার পর তা বিক্রি হয় কাট হিসেবে। প্রতি কাটে থাকে ১০ হাজার পিস ইয়াবা। নানাভাবে চোরাচালান হয়। কলার মধ্যে আনা হয়। অপারেশন করে পেটের মধ্যে পর্যন্ত ঢুকিয়ে আনা হয়। ট্রাকের টায়ার কেটে আনা-নেয়া করা হয়। এ ছাড়া গাড়ির হেড লাইটের ভেতরে ও চেয়ারের স্টিলের পাইপের ভেতরে এসব অবৈধ দ্রব্য আনা হয়।
মাদক পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসঙ্ঘের একটি জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ দেশে কমপক্ষে ৮৫ লাখ মানুষ সরাসরি মাদকাসক্ত। এদের মধ্যে ৮৭ ভাগ পুরুষ আর ১৩ ভাগ নারী। এক লাখের মতো নারী মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত। প্রভাবশালী ব্যক্তি থেকে শুরু করে নারী-কিশোররা এ ব্যবসার সাথে জড়িত। ফ্যামিলি হেলথ ইন্টারন্যাশনালের পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, প্রতি বছর ভারত থেকে প্রায় ৩৪৭ কোটি টাকার বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য দেশে আসে। এর মধ্যে ফেনসিডিলই আসে ২২০ কোটি টাকার। বিডিআরের একটি সূত্র জানায়, বিস্তীর্ণ সীমান্তের ৫১২টি পয়েন্টকে মাদক আনা নেয়ার কাজে ব্যবহার করে চোরাচালানীরা। এসব পয়েন্টে বিডিআরের বিশেষ নজরদারি না থাকায় রাত-দিন আসছে হেরোইন, আফিম, প্যাথেডিন, ফেনসিডিল, গাঁজাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক। সারা দেশে বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজার মাদকসংক্রান্ত মামলা ঝুলে আছে। মাদকের ৮৫ শতাংশ ভেজাল। ফলে মাদকাসক্তরা নানা ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তার মধ্যে কিডনি, লিভার ছাড়াও মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যক্রম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে । হ
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা