১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বিজ্ঞানমনস্ক প্রজন্ম গড়তে জাবি বিজ্ঞান ক্লাব

-

একটি জাতির সবচেয়ে বড় সম্পদ কী? কোথায় নিহিত এর শক্তিমত্তার সবচেয়ে বড় আধার? জাতি কি সামনে এগোবে না পিছিয়ে পড়ে হামাগুড়ি দিতে থাকবে তার নিয়ামকই বা কী? এর প্রাকৃতিক ও খনিজসম্পদ? ভূমির উর্বরতা? অর্থের জোগান? সমর সম্ভার? সন্দেহ নেই, এর সব ক’টিই গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। তবে, সন্দেহ নেই, এগুলোর চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ এর মানবসম্পদÑ একটি দক্ষ, শিক্ষিত ও সুশৃঙ্খল জনগোষ্ঠী, যারা দেশ ও জাতির প্রয়োজনে নিজেদের সর্বস্ব নিংড়ে দিতে সদা প্রস্তুত। একটি জাতির ভবিষ্যৎ উন্নতি ও প্রগতি বহুলাংশে নির্ভর করে এর ভবিষ্যৎ প্রজন্মÑ কিশোর-তরুণরা কিভাবে গড়ে উঠছে তার ওপর।
একটি দূরদর্শী জাতি এ কারণে তাদের তরুণ প্রজন্মকে ভবিষ্যতের চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে দক্ষ ও সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করে। আপনি একটু ক্ষুদ্র পরিসরে ভাবুন। একটি হতদরিদ্র পরিবারের ছেলে-মেয়েরা যখন কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সুশিক্ষিত হয়ে সমাজে আলো ছড়াতে শুরু করে, এক প্রজন্ম আগেও যারা চার দিকে অর্থবিত্তে প্রবল প্রতিপত্তিশীল ছিল তারা কেমন যেন এদের সামনে ছায়া হয়ে যায়। একইভাবে একটি জাতি যদি তার তরুণ প্রজন্মকে শিক্ষিত ও দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারে, এক প্রজন্মের ব্যবধানেই আপনি হয়তো একটি জাদুকরী পরিবর্তনের দেখা পেতে পারেন। বিপরীতে, একটি জাতি যখন বিত্ত-বৈভবে বিভোর হয়ে বিলাস-ব্যসনে গা ভাসিয়ে দেয়, এর তরুণ-যুবারা পরিশ্রম-বিমুখ হয়ে পড়ে, শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে পড়ে, তাদের মধ্যে অদক্ষতার পাশাপাশি বিভিন্ন নৈতিক বিচ্যুতিও দেখা দেয়, সমাজে নানাবিধ অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। ফলে, উন্নতি-প্রগতির শিখরে উড্ডীয়মান একটি জাতিকে দু’-এক প্রজন্মের ব্যবধানেই হয়তো ভূতলে পতিত হতে দেখতে পারেন। পৃথিবীর ইতিহাস এরকম বহু উত্থান-পতনের সাক্ষী।
তরুণরাই একটি জাতির মূল সম্পদ। এদের মধ্যে থাকে তীব্র অনুসন্ধিৎসা ও অদম্য কর্মস্পৃহা, কিছু একটা করার জন্য সদা অস্থিরতা ও আকুলি-বিকুলি। তাদের এই মনোদৈহিক চাহিদাকে আপনি কিভাবে মেটাবেন, তার ওপর নির্ভর করবে তাদের মধ্যে যে প্রতিভা ও কর্মশক্তি নিহিত রয়েছে তা কোন খাতে প্রবাহিত হবে। শৈশব পেরিয়ে যখন কৈশোরে পৌঁছে, তারুণ্যে পদার্পণ করে, চার দিকে অনেক কিছুই তাদের হাতছানি দেয়, কাছে টেনে নিতে চায়। পরিবার ও শ্রেণিকক্ষের বাইরেও বিশাল এক জগতের সাথে তাদের নিরন্তর মিথস্ক্রিয়া ঘটে। এখানে তাদের যেমন নিত্যনতুন অনেক কিছু শেখার সুযোগ হয়, অভিজ্ঞতার অভাবে ও অ্যাডভেঞ্চারাস অ্যাটিচুডের কারণে যেকোনো মুহূর্তে ভুল পথে পা বাড়ানোর আশঙ্কাও থেকে যায়।
এ অবস্থায় কিশোর-তরুণদের এই মনোদৈহিক চাহিদার জোগানে এবং বিপথগামী হওয়া থেকে সুরক্ষা দিতে প্রয়োজন তাদের বিভিন্ন রকম সৃষ্টিশীল ও গঠনমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যাপৃত করা। এতে করে তারা তাদের সমবয়সীদের পাশাপাশি সিনিয়র-জুনিয়রদের সাথে মেশার সুযোগ পায়, সামষ্টিক পরিসরে কাজ করার মধ্য দিয়ে তাদের মধ্যে ভবিষ্যতে কাজ করার উপযোগী দক্ষতা ও নেতৃত্বগুণের বিকাশ ঘটে এবং সর্বোপরি সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা কমে যায়। পাড়া-মহল্লায় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন কিশোর-তরুণদের এ ধরনের কর্মকাণ্ডে ব্যাপৃত রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
মানবসভ্যতা আজ যে পর্যায়ে উপনীত হয়েছে তাতে মূল ভূমিকা রেখেছে বিগত কয়েক শতকে বিজ্ঞানের বিস্ময়কর সব আবিষ্কার। বিজ্ঞানের কল্যাণে কৃষি ও শিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। শত-সহস্র্র বছর ধরে মানুষ যে সব রোগ-ব্যাধির কাছে অসহায় ছিল, তার অনেকগুলোই আজ মানুষের নিয়ন্ত্রণে। মানুষের বিচরণ আজ কেবল ভূপৃষ্ঠে সীমাবদ্ধ নয়। সমুদ্রের তলদেশ কিংবা মহাবিশ্বের অসীম শূন্যতা সবখানেই মানুষ চষে বেড়াচ্ছে। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এ মহাবিস্ফোরণে আমাদের মতো বহু জাতি নিতান্তই দর্শক মাত্র। আমরা চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকি, ওরা কখন কী আবিষ্কার করবে আর আমরা তার এঁটো-জুটো কিছু পাবো। বিজ্ঞানের এ যুগে একটি জাতি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে যেতে না পারলে তার ভাগ্যাকাশে পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা সুদূর পরাহত। যে প্রশ্নটি অনেকের মনে আসবে, জাতি হিসেবে কি আমাদের সামর্থ্যে ঘাটতি রয়েছে? ১৬-১৭ কোটি মানুষের এ বিশাল জনগোষ্ঠীতে মেধার কি এতই আকাল? তা তো হওয়ার কথা নয়। আসলে, প্রয়োজন আমাদের অ্যাটিচুডে পরিবর্তনÑ প্রয়োজন এমন একটি প্রজন্ম গড়ে তোলা যারা হবে বিজ্ঞান চর্চায় নিবেদিত, আত্মোৎসর্গীকৃত।
দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান ক্লাবগুলো বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানমনস্ক করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এ ক্ষেত্রে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান ক্লাব একটি অনন্য ভূমিকা পালন করে আসছে। দেশের বৃহত্তম ক্যাম্পাস-ভিত্তিক এই বিজ্ঞান ক্লাবের বর্তমানে তিন শতাধিক সক্রিয় সদস্য রয়েছে। ৪৬ সদস্যের একটি কার্যকরী পরিষদ ক্লাবের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের সমন্বয় সাধন করে। প্রতি মাসে একবার সাধারণ সদস্যরা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী কার্যকরি পরিষদ সভায় মিলিত হন। তা ছাড়া তাদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও নির্দেশনা দিয়ে সহায়তা করার জন্য বিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞান অনুষদভুক্ত শিক্ষকদের নিয়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ রয়েছে। পদাধিকার বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এ সংগঠনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে ক্লাবের একটি কার্যালয়। সেখান থেকে সামগ্রিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়।
২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ সংগঠনটি বছরব্যাপী বিজ্ঞানভিত্তিক নানাবিধ কর্মসূচির মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের বিজ্ঞান চর্চায় উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা জুগিয়ে আসছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছেÑ ম্যাথ অলিম্পিয়াড, সায়েন্স ফেস্টিভ্যাল, সায়েন্টিফিক ওয়ার্কশপ, সায়েন্স ট্যুর, কুইজ কম্পিটিশন, সায়েন্টিফিক টকিং ইত্যাদি। এ ছাড়া এ ক্লাবের নিউক্লিয়াস নামে একটি নিয়মিত বার্ষিক প্রকাশনা রয়েছে। সমসাময়িক বিজ্ঞানভিত্তিক বিষয়াবলি নিয়ে মাঝে মাঝে অরবিট নামে আরো একটি ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়। এক দিকে যেমন বিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষকমণ্ডলী এ সংগঠন পরিচালনায় নিয়মিত নির্দেশনা ও পরামর্শ দিয়ে আসছেন, অন্য দিকে প্রতি বছর ম্যাথ অলিম্পিয়াড ও বিজ্ঞান মেলার মতো অনুষ্ঠানমালার মাধ্যমে স্কুল-কলেজ এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে সংগঠনটি একটি যোগসূত্র স্থাপন করে আসছে। এ ছাড়াও প্রতি বছর সংগঠনটি এ দেশে বিজ্ঞানে অবদান রাখার জন্য কৃতী ব্যক্তিদের সম্মাননা দিয়ে থাকে।
এসব কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৮ সালে সংগঠনটি জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের নিবন্ধন লাভ করে। বর্তমানে ক্লাবটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ১৫৭টি সংগঠনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনুদান লাভ করছে। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রতি বছরের মতো ক্লাবের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে গণিত অলিম্পিয়াড। দেশের অন্যতম শীর্ষ টেকনোলজি ফার্ম নিউরাল সেমিকন্ডাক্টর লিমিটেড অনলাইনে অলিম্পিয়াডের পরীক্ষা পরিচালনা এবং এ জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। আশা করা হচ্ছে, এবারো স্কুল-কলেজের বিপুল শিক্ষার্থী ম্যাথ অলিম্পিয়াডে অংশ নেবে। এ দেশে বিজ্ঞান চর্চায় তরুণ প্রজন্মকে উৎসাহিত করতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান ক্লাব যে পথ দেখাচ্ছে, সেটি অনুসরণীয়। তবে সময়ের নিরিখে এ কার্যক্রম কিভাবে আরো আধুনিকায়ন করা যায় তা নিয়মিত পর্যালোচনা করা দরকার। দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান ক্লাবগুলোকে নিয়ে একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে বিজ্ঞান চর্চায় তরুণদের উৎসাহিত করার এ কার্যক্রম আরো জোরদার করা যায় কি না তা বিবেচনা করা যেতে পারে। তা ছাড়া বহির্বিশ্বের খ্যাতনামা বিজ্ঞান ক্লাবগুলোর সাথেও যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করা যেতে পারে। এভাবে আগামী দিনগুলোতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান ক্লাবের কর্মকাণ্ড আরো বেগবান হতে পারে। হ
লেখক : অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাবি


আরো সংবাদ



premium cement
মোরেলগঞ্জে সৎভাইকে কুপিয়ে হত্যা দুবাই পানিতে তলিয়ে যাওয়ার কারণ কি কৃত্রিম বৃষ্টি ঝরানো? এ দেশের ঘরে ঘরে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দিতে হবে : ডাঃ শফিকুর রহমান পিছিয়েছে ডি মারিয়ার বাংলাদেশে আসার সময় ইরানে হামলা : ইস্ফাহান কেন টার্গেট? মাত্র ২ বলে শেষ পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড প্রথম টি-টোয়েন্টি জেলে কেজরিওয়ালকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ দলের ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের জেরে সাংবাদিকসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা তোকে যদি এরপর হলে দেখি তাহলে খবর আছে, হুমকি ছাত্রলীগ নেতার বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক মামলা করা হয়নি : প্রধানমন্ত্রী দাওয়াতী ময়দানে সকল নেতাদের ভূমিকা রাখতে হবে : ডা. শফিকুর রহমান

সকল