২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
পৃথিবীতে মানুষ

আমরা কোথা থেকে এলাম

-

বিশাল এ মহাবিশ্বে আমরা পৃথিবী নামক একটি ক্ষুদ্র গ্রহের বাসিন্দা। আধুনিক বিজ্ঞানে সর্বাধিক আলোচিত হলেও আজো অনুদঘটিত অন্যতম বিষয়, এখানে আমরা কোথা হতে এলাম? এ পর্যন্ত প্রাপ্ত ফসিল পরীক্ষা থেকে বোঝা যায়, এ পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব কয়েক লাখ বছরের মধ্যে। পৃথিবীর বয়স এখন প্রায় ৫০০ কোটি বছর। পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকে কোটি কোটি বছর এখানে কোনো প্রাণী ছিল না, ছিল না উদ্ভিদরাজিও। প্রশ্ন হলো, এমন নির্জীব প্রান্তরে কিভাবে প্রাণের উদ্ভব ঘটল? মানুষের আবির্ভাব কি এ পৃথিবীতে, না অন্য কোথাও থেকে মানুষের আগমন?
মহাবিশ্বের বিশালতার মধ্যে এর উত্তর খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কারণ এ ক্ষেত্রে আমাদের বিরাট সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সূর্য একটি নক্ষত্র, পৃথিবী একটি গ্রহ, চাঁদ হলো উপগ্রহ। আর গ্যালাক্সি হলো নক্ষত্রের সমাহার। এরূপে মহাবিশ্বে আছে কোটি কোটি গ্যালাক্সি। একেকটি গ্যালাক্সি থেকে অপর গ্যালাক্সির দূরত্ব লাখ লাখ আলোকবর্ষ। আমাদের গ্যালাক্সির নাম ‘মিলকিওয়ে’। এই গ্যালাক্সির ব্যাস এক লাখ আলোকবর্ষ। বিজ্ঞানীদের ধারণা মতে, শুধু মিলকিওয়ে গ্যালাক্সিতে থাকতে পারে আমাদের সূর্যের মতো ১০ হাজার কোটি নক্ষত্র-সূর্য বা সৌরজগৎ। এক হিসাবে দেখা যায়, শুধু এই গ্যালাক্সিতে রয়েছে পৃথিবীর মতো অন্তত ১০ লাখ প্রাণসজীব গ্রহ। আলোর গতিতেও মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় একটি গ্যালাক্সির ক্ষুদ্রাংশেও ভ্রমণ করা। মিলকিওয়ে গ্যালাক্সির ১০ হাজার কোটি সমৃদ্ধ নক্ষত্র-সূর্যের শহরে আমাদের সৌরজগতের অবস্থান একটি বিন্দুর মতো। মহাবিশ্বে আমাদের পৃথিবীটা তুলনায় একটি বালুকণার চেয়েও ক্ষুদ্রতর। শতকোটি গ্যালাক্সি সমৃদ্ধ এই মহাবিশ্ব এতই বিশাল যে, বিজ্ঞানের বহু অগ্রগতি সত্ত্বেও এর কোনো কূলকিনারা খুঁজে পাওয়া যায়নি আজো। এ ক্ষেত্রে যতই গবেষণা চলছে রহস্যের পরিধি ততই গভীরতর হচ্ছে যেখানে বিজ্ঞানীদের কল্পনাও হারিয়ে যায় মহাবিশ্বের বিশালতায়। বিংশ শতাব্দী পেরিয়ে বিজ্ঞানের উন্নয়নের এ লগ্নে এসে নিঃসন্দেহে বলতে হয়, মহাবিশ্বের এ বিশাল প্রান্তরে কোথায় আমাদের অবস্থান, কোথেকে এলাম আমরা, তা আজো জানা হয়নি, যেন পড়ে আছি মহাকালের অজানা এক গলিপথে, যার আদি-অন্ত আমাদের দৃষ্টিতে অন্ধকার। এসব বিবেচনায় জীবন ও জগৎ বিষয়ে জন্ম দিচ্ছে রহস্যের অন্তরালে আরো অনেক রহস্য। মহাবিশ্বের এ বিশাল প্রান্তরে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই, তা ভাবতেও কষ্ট হয়। পৃথিবীতে প্রাণ আছে বলেই অন্য কোথাও প্রাণ থাকার সম্ভাবনা প্রবল। এটি পৃথিবীবাসীদের কাছে সর্বাধিক কৌতূহলী বিষয়। সম্প্রতি ওই প্রতিবেশী বুদ্ধিমান প্রাণী তথা এলিয়েনদের অনুসন্ধানে চলছে অব্যাহত গবেষণা।
পৃথিবীতে মানুষের উৎপত্তি কবে কিভাবে হয়েছিলÑ এর সঠিক উত্তর আজো জানা যায়নি। আধুনিক বিজ্ঞানে সর্বাধিক কৌতূহল উদ্রেককারী অন্যতম বিষয় হলো, এই মহাবিশ্বে প্রথম মানুষের আবির্ভাব কি অসাধারণ ও অস্বাভাবিকভাবে হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা, নাকি প্রাকৃতিকভাবে নিয়মের বিভিন্ন ধাপ পার এর উৎপত্তি? মানুষের উদ্ভব কি এ পৃথিবীতে, না অন্য কোথাও থেকে? বিষয়টি অত্যন্ত সূক্ষ্ম, জটিল, দ্ব্যর্থবোধক, অনিশ্চিত এবং তাই এটিকে অলৌকিক ঘটনা বলা চলে। কারণ পৃথিবীকেন্দ্রিক প্রাণের উদ্ভব হওয়ার ধারণাটি আজ অবধি সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়নি। তা ছাড়া আধুনিক জৈব রসায়ন ও জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি থাকা সত্ত্বেও এখনো পরীক্ষাগারে কোনো জড় পদার্থের প্রাণে রূপান্তর করা সম্ভব হয়নি। এ ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়ে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ক্রিক দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন যে, এত রকমের ঘটনা, ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া এ বিষয়টির সাথে জড়িত যে, এর তল খুঁজে পাওয়া কঠিন। তাই মাঝে মধ্যে প্রাণের উৎপত্তিকে মনে হয় যেন অলৌকিক ঘটনা। ১৯৮১ সালে প্রকাশিত বিখ্যাত গ্রন্থ খরভব ওঃংবষভ-এ তিনি বলেন, হয়তো পৃথিবীতে প্রথম প্রাণ (ঙৎমধহরংস) আমদানি করেছিল অন্য কোনো গ্রহের অজানা বুদ্ধিমান প্রাণীরা। অবশ্য তার এর সিদ্ধান্ত প্রাণের উদ্ভব ও আবির্ভাববিষয়ক তত্ত্বকে আরো রহস্যময় করে তোলে এবং বহির্বিশ্বের অন্য কোথাও থেকে প্রাণের আগমন যে ঘটেছেÑ এটি অনেকটা সুনিশ্চিত করে।
নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত এ উপমহাদেশের বিজ্ঞানী আবদুস সালামের মতেÑ প্রাণের উৎপত্তি এ পৃথিবীতে নয়। তিনি এটা প্রমাণের চেষ্টায় আত্মনিয়োজিত ছিলেন জীবনের শেষ অবধি। তাদের এ উক্তিদ্বয় পবিত্র কুরআনে বর্ণিত তথ্যের সাথে সমঞ্জস্যপূর্ণ। প্রথম মানব-মানবী জান্নাত বা বেহেশত নামীয় প্রাণসজীব ভিন্ন এক জগৎ হতে সুনির্দিষ্ট কারণে এ পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন।
এ মহাবিশ্বে প্রথম মানুষ কোথায় কিভাবে সৃষ্টি হলেন, বিজ্ঞানে এটি জটিল প্রশ্ন যেটি গবেষক দার্শনিকদেরও অশেষ ভাবিয়ে তোলে। তার সঠিক সমাধান জ্ঞাত বিজ্ঞানে আজো নেই। এ বিষয়ের সমাধানকল্পে অনেক মতবাদের জন্ম হয়েছে। অতি বিতর্কিত ডারউইনের মতবাদটিতে শুধু জীবের বিবর্তনের ধারা ব্যাখ্যা করা হয়েছে; কিন্তু এর মূল উদ্ভব বা প্রাণের আদিসত্তার উৎপত্তিসংক্রান্ত সঠিক কোনো ব্যাখ্যা ও মৌলিক আলোচনা নেই। পক্ষান্তরে, প্রাণের উৎস ও মানব জীবনের উদ্ভব নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা অব্যাহত থাকলেও এর যথার্থ সমাধান বা সর্বজনগ্রাহ্য কোনো তত্ত্ব তারা দিতে পারেননি আজো।
তবে ঐশীগ্রন্থ পবিত্র কুরআনে এ বিষয়ে বর্ণনা অত্যন্ত সুস্পষ্ট। একটি মাত্র প্রাণ থেকে বহু প্রাণের সৃষ্টি; শুরু থেকে প্রত্যেক প্রাণী জোড়ায় জোড়ায় তৈরি; প্রথম মানবের উদ্ভব এ পৃথিবীতে নয়, প্রথম মানব-মানবী অর্থাৎ আমাদের আদি মাতা-পিতা ‘আদম ও হাওয়া’ জান্নাত বা বেহেশত নামক এক স্বর্গীয় রাজ্য হতে সুনির্দিষ্ট কারণে এ পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন। প্রচলিত জন্ম প্রক্রিয়া ছাড়াই অলৌকিকভাবে পূর্ণাঙ্গ অবয়বে সৃষ্টি হয়ে বেহেশতেই তাঁদের জীবনের সূত্রপাত ঘটে এবং সে পরিবেশেই তাঁরা বেড়ে ওঠেন। শুরু থেকেই প্রথম মানব-মানবী প্রেমাসক্তিসম্পন্ন, বুদ্ধিমান ও জ্ঞানদীপ্ত, সভ্যতানুগামী, পূর্ণাঙ্গ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গধারী স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ ছিলেন। কিছুকাল পর অভিশপ্ত শয়তানের কুমন্ত্রণায় স্রষ্টার নির্দেশ লঙ্ঘিত হলে সেখানে থেকে সুনির্দিষ্ট সময়কালের জন্য তাঁদেরকে এ পৃথিবীতে নামিয়ে দেয়া হয়।
বিশেষভাবে উল্লেখ্য, সেই বেহেশতি পরিবেশেই সর্বপ্রথম মানব ‘আদম’কে সৃষ্টি করা হয় এক পূর্ণাঙ্গ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত অবয়বে, অতঃপর তাঁর সঙ্গী বিবি হাওয়াকে সৃজন করা হয় তাঁরই অঙ্গ হতে যিনি সমবয়সী, বিপরীত আকর্ষণধর্মী এবং পূর্ণাঙ্গ মানবীয় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অবয়বে, যা আধুনিক বিজ্ঞানে জেনেটিকভাবে প্রমাণযোগ্য।
উল্লেখ থাকে যে, প্রথম মানব-মানবী ‘আদম’ ও ‘হাওয়া’ দু’জনই ওই বেহেশতে অবস্থানের কিছুকাল পর ওখান থেকে তাদের নামিয়ে দেয়া হয় পৃথিবীতে, দু’জন বিচ্ছিন্নভাবে। এ পৃথিবীতে তাঁদের প্রথম নির্বাসিত জীবন শুরু হয় একা একা। আদি আবাসস্থল হারিয়ে পৃথিবীতে এসে একে অপরকে না পেয়ে বিরহ বেদনায় ও একাকিত্বে দু’জনই বড় ব্যাকুল হয়ে পড়েন। এমন হৃদয়বিদারক অবস্থায় চরম ব্যাকুলতার মাঝে একে অপরকে খুঁজতে থাকেন দিগি¦দিক। কিছুকাল পর (আরাফাত প্রান্তরে) তাঁদের একে অপরের সাথে মিলন ঘটে। হজরত আদম আ: বেহেশত থেকে বেশ কয়েকটি জিনিস এনেছিলেন পৃথিবীতে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো ‘হাজরে আসওয়াদ’ নামে একটি পাথর, যা মক্কার কাবা গৃহে সংরক্ষিত। তা ছাড়া বৃক্ষের পাতা ও ফুল, ‘আস’ নামক বৃক্ষের ঢাল বা লাঠি, চন্দন গাছ বিভিন্ন ফলদায়ক বৃক্ষ প্রভৃতি। তিনি পৃথিবীতে এসে সর্বপ্রথম কুল খেয়েছিলেন বলেও বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়।
বেহেশতেই প্রথম মানব হজরত আদমÑ জ্ঞানের প্রথম পাঠ গ্রহণ করেন। ফলে তখন থেকেই তাঁর মন-মস্তিষ্কে সব বিষয়ে জ্ঞানের অবতারণায় বুদ্ধি ও চেতনাদীপ্ত হয়ে তাতে বিশেষ জ্ঞানানুশীলন প্রক্রিয়ার সূত্রপাত ঘটে। এতে বোঝা যায়, মানুষ জন্মসূত্রেই জ্ঞানসিদ্ধ স্মৃতিময় ও বুদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। এ কারণেই হয়তো মানুষ প্রথম থেকেই বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন। পক্ষান্তরে, মানব মস্তিষ্কে জ্ঞানের মূলধন ডাউনলোড করা আছে বলেই প্রত্যেক মানুষের জ্ঞানার্জন ও বিকাশের ধারা সৃষ্টি হয়। মানুষের এসব মৌলিক বিশেষত্ব সর্বাত্মক বিবর্তনের ফল নয়। কারণ বিবর্তনের ধারায় ‘মূল’ এর সম্প্রসারণ হতে পারে; কিন্তু সমূলে বিবর্তন হয় না। অর্থাৎ ‘মূল’ থেকে উৎসারিত হয়ে বিবর্তনের সূত্রপাত হলেও মূলের মৌলিকত্ব বজায় থাকে। এ জন্যই অন্যান্য প্রাণিকুলের চেয়ে মানুষের মন বিশেষ সচেতন, জ্ঞানানুসন্ধিৎসুপ্রবণ, প্রচুর আবেগনুভূতিসম্পন্ন, সভ্যতানুগামী, জ্ঞানবিজ্ঞান ও সৃজনশীলতায় বিচার বিবেচনা শক্তির অধিকারী বা অন্যান্য প্রাণী থেকে অনেক উন্নত, অনন্য প্রতিভার অধিকারী ও মেধাসম্পন্ন।
‘জান্নাত’ বা বেহেশত অর্থ বাগান। হয়তো এ কারণেই মানুষ বাগান প্রিয় ও প্রকৃতি প্রেমিক। প্রতিটি মানবাত্মা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সুশোভিত পরিবেশে যতটুকু মানসিক প্রশান্তি লাভ করে, তেমনটি আর কোথাও নয়। জানা যায়, মানব সৃষ্টির বহুকাল আগে থেকে সেই বেহেশতটি ছিলÑ ফুল, ফল ও বৃক্ষলতা সন্নিবেশিত স্বচ্ছ ঝরনাধারা সস্বলিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত যাতে রয়েছে মানুষের জন্য অনুকূল তাপমাত্রা ও বসবাসযোগ্য মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত তথ্য ও মিরাজের ঘটনা থেকে বুঝা যায়, বেহেশতটির অবস্থান এ পৃথিবীতে নয়। হয়তো সেটি এখনো অস্তিত্ববান কিন্তু বৈজ্ঞানিক উপায়ে এর অবস্থান আমাদের জানা হয়নি। উল্লেখ থাকে যে, প্রথম মানুষদ্বয় তথা ‘আদম’ ও ‘হাওয়া’ সৃষ্টির বহুকাল আগে থেকে এ মহাবিশ্বে ‘ফেরেশতা’ ও ‘জিন’ নামক দু’টি প্রাণী জগতের অস্তিত্ব বিদ্যমান। মানুষকে ‘খেলাফত’ ও শ্রেষ্ঠত্বের পদক প্রদানের বিষয়টিও স্রষ্টা তাঁদের সাথে আলোচনা ও মতামত যাচাই করেছিলেন, এতে তারা আপত্তি করে। তবুও স্রষ্টা নিজ ইচ্ছায় পূর্বপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পথ সুপ্রশস্ত করেন এবং মানুষকে তাদের তুলনায় জগতের সব বিষয়ে জ্ঞানসিদ্ধ করে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসিয়ে দেন। এসব ঘটনা জিন ও ফেরেশতাদের জীবদ্দশায় ঘটেছে। অতএব বলা চলে, বহির্বিশ্বের সেই বেহেশতেই মানুষের উদ্ভব এবং সেখানেই আমাদের আদি আবাস। ফেরেশতা কিংবা বহির্বিশ্বের অজানা বুদ্ধিমান প্রাণীরাই হয়তো আমাদের পূর্ব মানব-মানবীদেরকে বহন করে নিয়ে এসেছিলেন এ পৃথিবীতে।
বহির্বিশ্ব থেকে প্রথম মানব-মানবীর আগমনকালে এ পৃথিবী ছিল প্রাণসজীব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা বসবাস উপযোগী অনুকূল পরিবেশ, যাতে অন্যান্য প্রাণীর উপস্থিতিও ছিল। বলা যায়, তখন পৃথিবীর পূর্ণ যৌবনকাল। যেন প্রকৃতির সমগ্র আয়োজনে পৃথিবীতে মানুষের আগমনের আগেই তৈরি করা হয়েছিল মহামঞ্চ।
মহাবিশ্বের এ প্রান্তরে ‘পৃথিবী’ নামক গ্রহে মানুষের আগমনে মানবমনে সৃষ্টি হলো অতৃপ্তি আর হতাশা। এ হতাশা থেকে জন্ম নেয়Ñ প্রেম-বিরহ, অস্থিরতা ও সৃজনশীলতায় বেড়ে ওঠার অনুভূতি। এ অনুভূতি থেকে সৃষ্টি হয় সহানুভূতি, বিবেক, মানবতাবোধ ও সমাজ-সভ্যতা। আর এই অনুসন্ধিৎসা থেকে বিকাশ লাভ করে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও অনুশীলন প্রক্রিয়া। এসব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মূলে কাজ করে চেতনা, অভাব-বিরহ-অস্থিরতা। এ অস্থিরতাই মানব জীবনের ভাঙাগড়ার অপূর্ব সাথী। এভাবে কালের আবর্তে জীবন-প্রকৃতি আবর্তন-বিবর্তনে হয়ে উঠে চঞ্চলময় অস্থির।
অতঃপর প্রশ্ন হলো, প্রতিটি জীবনের এ অস্থিরতার মূল উৎস কোথায়। এর উত্তর আগের আলোচনা থেকে সুস্পষ্টÑ আমাদের আদি মাতৃভূমি বা পিত্রালয় এখানে নয়, এ জন্যই পৃথিবীতে আমরা মুসাফিরের মতোই চঞ্চল, পথহারার মতো অস্থির, স্বজন হারার মতো অশান্ত, সর্বক্ষেত্রে যেন অতৃপ্তি আর হতাশা। কোথাও যেন শান্তি নেই, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিতে মিল নেই। ঠিকানাবিহীন অজানা কোনো গন্তব্য পানে ছুটে চলার অভিপ্রায় যেন সর্বক্ষণ মনের মধ্যে অস্থিরতার জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। অস্থির মন ছুটে চলে দেশ থেকে দেশান্তরে, পথে ঘাটে মাঠে, জলে স্থলে অন্তরীক্ষে, সর্বকালে, সর্বস্থানে। কোথাও যেন শান্তি নেই, স্থিরতা নেই। সব মানুষই অস্থির মনে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায় পথে প্রান্তরে রহস্যময় জীবনের গন্তব্যের সন্ধানে, যে ক্ষণস্থায়ী জীবনটি দাঁড়িয়ে আছে জন্মমৃত্যুর মাঝখানে। কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক-লেখক, জ্ঞান-সাধক, গবেষক-বিজ্ঞানী-দার্শনিক, ওলি-দরবেশ, ঋষি-সন্ন্যাসী-মনীষী সবার চাওয়া একটাইÑ সেটি হলো জীবনের রহস্য উদঘাটন। কমবেশি সবাই অনুসন্ধিৎসায় অজানা গন্তব্য খুঁজতে ব্যাকুল। হয়তো তাই রহস্যময় জীবনের ব্যাখ্য প্রদানের জন্যই যুগে যুগে নবী, পয়গাম্বর ও মহাপুরুষদের আগমন ঘটে এ ধরায়।
জীবনের খেলাঘরে ধর্ম ও কর্ম, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, প্রেম গান সুর সঙ্গীত ছন্দ লয় তাল সৃষ্টি হয় জীবনের অন্বেষায়। জীবনের অলিন্দে মানুষ প্রেমময়। বিরহ বেদনায় আত্মা যেন প্রকৃতির ছন্দ ও সুরের মধ্যে শান্তি খুঁজে বেড়ায়। জীবন প্রকৃতি যেন মাতৃহারা উ™£ান্ত পাখির মতো। এ অস্থিরতা সবখানে। মনে হয়, এ জগৎটাই অস্থিরতার বেলাভূমি। তারই মধ্যে শান্তির পায়রাগুলো যেন ডানা মেলে আছে আশা-নিরাশার খেলাঘরে। তবুও ব্যাকুল মন আকুল হৃদয়ে ছুটে চলে গন্তব্য পানে। এভাবে মনের আশা-নিরাশার চক্র পরিক্রমায় জীবন বয়ে চলে চিরন্তর। অতএব বলতে হয়, আমাদের জীবন প্রবাহে এমন চঞ্চল অস্থির প্রকৃতি মূলত মূল থেকে বিচ্ছেদেরই ফল। এতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, আমাদের জীবন প্রকৃতি-আদি এবং অকৃত্রিম; আমাদের মূল উদ্ভব ও আদি আবাস সেখানেই। হয়তো আমরা কোথাও স্থির থাকতে পারি না। শান্তির অন্বেষায় মন বয়ে চলে অদৃশ্য অজানা এক গন্তব্য পানে।
অজানা গন্তব্য থেকে আমরা কি এখানে মহাজাগতিক সফরে বনভোজনে এসেছিলাম? তাই যদি হয়, আমাদের অবশ্যই ফিরে যেতে হবে।
অতএব, এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে জাগিয়ে তুলুন মহাকালের অফুরন্ত জীবনের প্রত্যাশা এবং প্রত্যয়দীপ্ত সঠিক পথের পাথেয়। হ
লেখক : গবেষক ও গ্রন্থকার


আরো সংবাদ



premium cement