১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ভারতনিবাসীর ভাগ্যবিড়ম্বনা

-

গুণীজনরা বলে থাকেন; অনিবার্য সাফল্য ও সম্মান দাম্ভিকদের কপালে কখনই জোটে না। আত্মশুদ্ধির উৎসাহব্যঞ্জক এই কথাটা কোনো জাতি যদি মনে রাখতে না পারে, তবে সে জাতির ভাগ্যাকাশে কালো মেঘ ঘোরাফেরা করতে পারে। সে রকম ঘনঘটা পৃথিবীর অনেক জাতির মধ্যেই দেখা গেছে, আর্য জাতি তাদের অন্যতম। আর্যরা সৃষ্টি করেছিল আত্মঘাতীমূলক সামাজিক বৈষম্য। বর্ণভেদ প্রথা, কৌলীন্যবাদ, বিধবা নিগ্রহ ও সতীদাহ প্রথার মাধ্যমে তৈরি হয়েছিল সামাজিক অস্থিরতা। এর মধ্যে বর্ণভেদ ও কৌলীন্যপ্রথা (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র) সমাজকে নিদারুণভাবে কলঙ্কিত এবং মানুষে মানুষে দূরত্বের প্রাচীর তৈরি করেছে। বিষয়টি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। সামাজিক বৈষম্য ও কুলীনদের অবজ্ঞা থেকে মুক্ত হতে দলে দলে মানুষ ধর্ম বদল করেছে। আর্যসমাজ পরিচালিত হতো বেদ অনুসারে। বেদে কুলীন-কৌলীন্য না থাকলেও প্রজাঅসন্তোষকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করতে ব্রাহ্মণ অধিপতিরা এসব ধারণা সৃষ্টি করেছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সামনে রেখে। যেমন, বল্লাল সেন তৈরি করেছিলেন কৌলীন্য প্রথা। বেদকে পরে আর্য ধর্মগ্রন্থ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এ গ্রন্থের প্রকার রয়েছে চারটি। প্রথমে রচিত হয় ঋগে¦দ। তারপর সাম, যজু ও অথর্ববেদ। দ্বিতীয় পর্যায়ে রচিত হয় ‘ব্রাহ্মণ’ এবং শেষ পর্যায়ে রচিত হয়েছে ‘উপনিষদ’। ম্যাক্সমুলার বৌদ্ধ ধর্মের সাথে উপনিষদের মিল খুঁজে পেয়েছিলেন। ২০০ বছর ধরে ১০৮টি ‘উপনিষদ’ রচিত হয়েছিল। মনে করা হয়, খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর দিকে এগুলোর বিন্যাস ঘটানো হয়েছে। তবে ভারতভূমিকে কেন্দ্র করে মুসলিম, অনার্য, আর্য ও বৌদ্ধদের স্বতন্ত্র ইতিহাস রয়েছে।
হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো আবিষ্কৃত হলে ভারত সভ্যতার ইতিহাস পাল্টে যেতে থাকে। আর্যরা দাবি করেছিলেন, তারাই ছিলেন ভারতের আদিবাসী; কিন্তু হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো তাদের এ দাবিকে অসার প্রমাণ করেছে। হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর সভ্যতাকে বলা হয় ‘সিন্ধুসভ্যতা’। সেখানে আরো পুরনো জাতির অস্তিত্ব ছিল। হরপ্পা খননের পর যে সুরম্য অট্টালিকা, উন্নত জীবনপ্রণালী ও অভিজাত রুচির হদিস পাওয়া গেছে; আর্যরা তাকে অনার্য, দুর্বিনীতদের সভ্যতা বলে প্রচার করেছে। তবে আমরা সে জাতিকে ‘অনার্য’ বলতে চাই না। অনার্য (হড়হ ধৎুধহ) শব্দের অর্থ করা হয়েছে অভদ্র, অসাধু, দুর্বিনীত। তাদের স্বচ্ছ পরিচয় উদ্ধারের জন্য আরো গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।
ভারত উপমহাদেশের জনবসতি প্রাগৈতিহাসিক। আফগানিস্তান, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, হিন্দুস্থান, বাংলাদেশসহ ছিল ভারত উপমহাদেশ। সিংহল বা শ্রীলঙ্কাতে ‘আদম পাহাড়’ নামে একটি পাহাড় রয়েছে। এই পাহাড় চূড়ায় রয়েছে মানুষের পদচিহ্ন। বলা হয় এই পদচিহ্ন প্রথম মানুষ আদম আ:-এর পদচিহ্ন। লক্ষ্মৌতে ফয়জাবাদে রয়েছে শীষ আ:-এর সমাধি। তবে ‘এনসাইক্লোপিডিয়া অব ইসলাম’ এর লেখক ঈ খ ঐঁৎঃ বলেছেন, শীষ আ:-এর কবর রয়েছে মিসরে। ইবনে কাসির বলেন, শীষ আ:-এর কবর রয়েছে আবু কুবাইস পাহাড়, মক্কাতে। কেউ বলেন, লেবাননে। কুরআন ঘোষণা করেছে ‘এমন কোনো জাতি নেই যে জাতিকে পরিশুদ্ধ করতে বার্তাবাহক প্রেরণ করা হয়নি’। শীষ আ: ৫০টি সহিফা পেয়েছিলেন। তিনি ৯১২ বছর জীবিত ছিলেন। দীর্ঘ এই জীবনের কিছু সময় হয়তো তিনি ভারতবর্ষে অবস্থান করে অনেক অনুসারী রেখে গেছেন।
হরপ্পার ধ্বংসাবশেষ প্রমাণ করেছে, আর্যরা ভারী অস্ত্রসজ্জিত বহিরাগত। রণকুশলে ছিল তারা দক্ষ। তাদের হাতেই পতন ঘটেছে হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর। এসব প্রাচীন নগরীর ধ্বংসস্তূপ থেকে যে মানবদেহাবশেষ পাওয়া গেছে সেসব মৃত্যু হয়েছিল ভারী অস্ত্রের আঘাতে। আর্য তাণ্ডবে হরপ্পা সভ্যতা যে বিলীন হয়েছে, তার প্রমাণ আজ আর অপ্রতুল নয়। সে অর্থে আর্যরা বহিরাগত। আর্যরা সিন্ধু অভিযান করেছে দুর্বৃত্ত হিসেবে। ফলে সভ্যতা সমূলে বিনষ্ট হয়েছে। কিন্তু মুসলমানদের সিন্ধু অভিযান ছিল ভিন্ন উদ্দেশ্যে। মুহাম্মদ বিন কাসিম ছিলেন সিন্ধু বিজয়ের (৭১২ খ্রিষ্টাব্দ) প্রধান সেনাপতি। তখন ইরাকের শাসনকর্তা ছিলেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। মুসলমানদের সিন্ধু অভিযানের যে কারণগুলো রয়েছে তা বিশ্লেষণ করলে এ কথা মনে হবে না যে, জোর করে মানুষকে ধর্মান্তরিত করার জন্য মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধু অভিযান করেছেন। এর অন্যতম প্রধান কারণ ছিল রাজা দাহিরের ইশারায় জলদস্যু (কথিত) কর্তৃক আরব জাহাজ লুণ্ঠন। আর দ্বিতীয় কারণ ছিল দাহির কর্তৃক আরব বিদ্রোহীদের আশ্রয় প্রদান। ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য অভিযান পরিচালিত হয়েছে; সিন্ধু অভিযানের কারণগুলোর মধ্যে এ কারণটি খুঁজে পাওয়া যায় না। ভারতবর্ষে মুসলমানদের শেকড় সেই আদম আ: ও শীষ আ:-এর পদার্পণ থেকেই রয়েছে।
মুহাম্মদ বিন কাসিমের আগেও ভারতবর্ষে মুসলমান শাসকরা অভিযান পরিচালনা করেছেন কিন্তু ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে তা করা হয়নি। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমরের খিলাফত কালে (৬৩৬-৩৭ খ্রিষ্টাব্দে) ওমান থেকে ভারতে প্রথম অভিযান শুরু হয়। এ সময় আম্মান ও বাহরাইনের গভর্নর নিযুক্ত করা হয় ওসমান নামে একজনকে। ওসমান অভিযান সমাপ্ত করে তার ভাই মুগিরাকে করাচি অভিযানে পাঠান। মুগিরা করাচিতেই শেষ পর্যন্তু থেকে যান। তৃতীয় খলিফা ওসমানের সময় ভারতের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক আবস্থা খারাপ থাকার কারণে কোনো অভিযান হয়নি। এরপর চতুর্থ খলিফা হজরত আলীর অনুমতিক্রমে সেনাপতি ‘হারিস’ সিন্ধু অভিযান পরিচালনা করেন। যুদ্ধের পর বহু সৈন্য বন্দী হলে, বন্দীদের থাকা-খাওয়া ও পোশাকের ব্যবস্থা করা হয়। দুঃখের বিষয় পরে ভারতের ‘কায়নান’ নামক স্থানে যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয় হলে সেই যুদ্ধে বন্দী মুসলমানদের সবাইকে হত্যা করা হয়েছিল। যুদ্ধবন্দীর মর্যাদা আর্যরা রক্ষা করতে পারেনি। ৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে আমির মোয়াবিয়া তার শাসনকালে মোয়াল্লাব সওয়ারকে ভারত অভিযানে পাঠান। সওয়ার বিজয়ীবেশে ফিরে যাওয়ার পর দস্যু কর্তৃক হত্যার শিকার হন। এরপর আসেন রাশেদ। তিনিও যুদ্ধে নিহত হলে সেনাপতি হিসেবে আসেন ‘সেনান’। সিন্ধুর দেবল নামক স্থানে যুদ্ধে তিনি জয়ী হয়ে সেখানে রয়ে যান। এরপর ভারত অভিযানে আসে জিয়াদের পুত্র আব্বাস। তারপর মুনজির ইবনে জরুদ আবেদি ভারত অভিযান পরিচালনা করেন। এরপর ইরাকের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন ইউসুফ সককারির পুত্র হাজ্জাজ। তিনি হারুনের পুত্র মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ ও বোদাজালকে সিন্ধু অভিযানে প্রেরণ করেন। এই দু’জন পরাজিত হলে মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধু অভিযানে নিযুক্ত হন। এসব অভিযানের উদ্দেশ্য নিছক ধর্মপ্রচার ছিল না। বরং বহুজন স্বীকৃত যে, আর্য ব্রাহ্মণ অধিপতিরা ছিলেন প্রজা ত্রাসনে ব্যস্ত এবং অধিপতিদের আশকারা পেয়ে ব্রাহ্মণ সমাজপতিরা কৌলীন্যের অজুহাতে সমাজের সাধারণ মানুষের জীবনকে করে তুলেছিলেন নরকসদৃশ। এটিই সত্য যে, ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যের যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি পেতে মুসলিম অধিপতিদের সাদরে গ্রহণ করেছিলেন সাধারণজন। সামাজিক মর্যাদার সাথে বসবাস করতে গ্রহণ করেছিলেন ইসলাম। মুসলমানরা অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে কাউকে ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করেনি। এ শুধু ভারতবর্ষেই নয়, খোদ আরব রাজ্যেও ইসলাম প্রচারে তরবারির ব্যবহার দেখা যায়নি। অথচ আল্লাহর রাসূলের জীবনে ২৩টি যুদ্ধ হয়েছে। আরব ভূখণ্ড থেকে মুসলমানদের যখন নিশ্চিহ্ন করতে ষড়যন্ত্র হয়েছে এবং মাতৃভূমি থেকে উৎখাত করতে তাদের ওপর বল প্রয়োগ করা হয়েছে, তখনই আত্মরক্ষার্থে মুসলমানরা বাধ্য হয়ে তরবারি ব্যবহার করেছে। এখন ভারতবর্ষেও বহিরাগত বলে মুসলমানদের ওপর বল প্রয়োগ করা হচ্ছে। সেখানে মুসলমানরা বহিরাগত ননÑ এ কথা নতুন করে বলার কিছু নেই।
ভারতবর্ষের স্থাপত্য, শিল্পসাহিত্য ও সভ্যতাকে মুসলমানরা ধ্বংস করেনি; আর্যাভিযানে যেমন হরপ্পা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। মুসলিম অভিযানের পরও বৈদিকসভ্যতা সগৌরবে টিকে রয়েছে আজো। কারণ মুসলমান ভারতের ঐতিহ্য জয় করতে চায়নি, জয় করেছিল মানুষের মন।
একটা সময় পর্যন্তু মানুষ ছিল যাযাবর। স্থায়ী বসতি মানুষ গড়তে চায়নি। পরে সে ধারণা থেকে মানুষ বেরিয়ে এসেছে। ইংরেজরাও ২০০ বছর ভারত শাসন করেছে। কিন্তু স্থায়ীভাবে তারা এখানে বসতি গড়ে তুলতে চায়নি। এ দেশের অর্থ-সম্পদ শোষন করা শেষ হলে তারা কলোনি গুটিয়ে নিয়েছে। মুসলমানরা তা করেনি। তারা ভারতবর্ষে এসে স্থায়ী আবাস তৈরি করে নিয়েছে। এ দেশের মাটি, মানুষ ও প্রকৃতিকে আপন করে নিয়েছে। ভালোবেসেছে। বিয়ে-শাদি করেছে। সন্তান লালন-পালন করেছে এবং জন্ম-মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বংশ পরম্পরায় যুগের পর যুগ ভারতবর্ষেই অতিবাহিত করেছে। ইংরেজদের মতো তারা ‘কলোনি’ বানায়নি। ইংরেজরা যে অর্থে বহিরাগত, মুসলমানরা সে অর্থে বহিরাগত নয়। অর্থাৎ মুসলিম সম্প্রদায় ভারতবর্ষের স্থায়ী বাসিন্দা। অথচ বৈদিক হিন্দুরা আজ মুসলমানদের বহিরাগত ভাবতে চাচ্ছে। সে লক্ষ্যে তৈরি করেছে ‘এনআরসি’। আসামে মুসলমানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মাদরাসাগুলো বন্ধ করে দেয়ার আইন পাস করা হয়েছে। যেকোনো অজুহাতে দাঙ্গা বাধিয়ে মুসলিমদের হেনস্তা করার চেষ্টা চলছে। মুসলিম স্থাপত্য ধ্বংস করা হচ্ছে। প্রচার করা হচ্ছে, ভারতবর্ষে মুসলমানরা তরবারির ভয় দেখিয়ে মানুষকে ধর্মান্তরিত করেছে। এ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে, অন্তসারশূন্য এই চেতনা ভারতকে পোড়াতে থাকবে। উত্তরাধুনিক এই যুুগেও ভিন্ন ধর্মের বহু মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছে। অস্ত্রের মুখে তাদেরকে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করা হয়েছে, এমন খবর কেউই আজো বলতে পারেনি। হ
mojaffarh40@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
বেসিক ব্যাংক একীভূত করার প্রক্রিয়া বন্ধের দাবিতে রাজশাহীতে মানববন্ধন ভরিতে ২০৬৫ টাকা বেড়ে স্বর্ণের দামে নতুন রেকর্ড ইরানি জবাব নিয়ে ভুল হিসাব করেছিল ইসরাইল! কূটনীতিতে বাইডেনবিরোধী হতে চান ট্রাম্প পেনাল্টিতে সাফল্য রিয়ালের জয়ের মানসিকতার প্রমাণ কিমিচের একমাত্র গোলে আর্সেনালকে পরাজিত করে সেমিফাইনালে বায়ার্ন বিরোধী দলকে ভাঙতে ষড়যন্ত্র করছে সরকার : ড. মঈন খান মোস্তাফিজের বিকল্প ভাবছে চেন্নাই, দলে ভিড়িয়েছে এক ইংলিশ পেসার বিদেশ যাওয়া হলো না আশরাফুলের, বাসচাপায় মামাসহ নিহত ‘সন্ত্রাসীদের ঘরে ঢুকে মারা’ বিষয়ে নরেন্দ্র মোদির মন্তব্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া মাতৃভূমি রক্ষা করা আমাদের প্রধান কর্তব্য : সেনাপ্রধান

সকল