২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

২০২১ সালে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হবে?

-

বাংলাদেশের বর্তমানে লালিত স্বপ্ন হলোÑ ২০২১ সালের মধ্যে বিশ্বের অন্যতম মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া। সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে দীর্ঘ সময় ধরে অকান্ত পরিশ্রমের সাথে প্রয়াস চালানো হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকসহ বন্ধুপ্রতিম দেশ ভারত, চীন, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জার্মানিসহ প্রায় সবাই আমাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য ও প্রশংসনীয় সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের ১৭ কোটি জনগণ অবশ্যই কৃতজ্ঞতার সাথে তা স্মরণ রাখবেন। বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভাগ যাতে সুনিশ্চিত করা যায়, সে লক্ষ্যে সরকার ‘ভিশন-২০২১’ নামে কর্মসূচি নিয়েছে। বাংলাদেশ এ লক্ষ্য অর্জনের দ্বারপ্রান্তে এসে গেছে বলে আমাদের বিদেশী সাহায্যকারী সংস্থা এবং দেশগুলো, বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯-এর ভয়াবহ আক্রমণের পরও এখনো আশাবাদী। সম্প্রতি জাতিসঙ্ঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, কোভিড-১৯-এর ফলে বিশ্বে যে অর্থনৈতিক ভয়াবহ মন্দভাব শুরু হয়েছে তাতে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের হারে ভাটার টান দৃশ্যমান। কারোনাকালে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের হার বাংলাদেশেও কমতে শুরু করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ সম্পর্কে জাতিসঙ্ঘের উন্নয়ন সংস্থার আরো বক্তব্য হলোÑ ‘এতদসত্ত্বেও দেশটি (বাংলাদেশ) দুর্যোগটি, অন্যদের তুলনায় ভালোই মোকাবেলা করেছে। এই সময় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কমে যাওয়ার পরও ২০২০ সালে জাতীয় উৎপাদন বেড়েছে, যদিও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি কমে গেছে’।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলোÑ বিশ্বে নতুন করে ফের করোনার তীব্র গতি লক্ষ করা যাচ্ছে। মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে বাংলাদেশের যে লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে হবে এর মধ্যে আছে, বাংলাদেশকে অবশ্যই দারিদ্র্যের হার ১৪ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে। ২০০০ সাল থেকে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের আগ পর্যন্ত মোটামুটি বাংলাদেশের অর্থনীতি সেভাবে চালিত হচ্ছিল। এ সময়ে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের হার গড়ে প্রায় ৬ শতাংশই ছিল। উল্লিখিত সময় থেকে ১ দশমিক ৭ শতাংশ করে দারিদ্র্য হার কমেছে। এখানে একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন, এই সময়ে শুধু চীন ছাড়া বিশ্বের অন্য কোনো দেশ বাংলাদেশের হারে দারিদ্র্য কমাতে সক্ষম হয়নি। এক দশকে (২০০০-২০১০) দেখা যায়, যেখানে ২০০০ সালে বাংলাদেশে গরিব মানুষের সংখ্যা ছিল ছয় কোটি ৩০ লাখ, ২০১০ সালে তা চার কোটি ৭০ লাখে নেমে এসেছিল। দারিদ্র্য হ্রাস হওয়ার এ হারকে বিশ্বের যেকোনো অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি সম্মানজনক অর্জন বলে আখ্যায়িত করবেন। আর ২০১০ থেকে ২০২০ সাল, এই দশকে স্থিতিশীলভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে। ঠিক সেই হারেই বাংলাদেশে দারিদ্র্যের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক সমীক্ষায় বলা হয়েছেÑ বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার ২০১৮-১৯ রাজস্ব বছরে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে, যার ২০১৭-১৮ সালে হার ছিল ২১ দশমিক ১৮ শতাংশ, যাকে দারিদ্র্য অবস্থা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সে রকম চরম দারিদ্র্যের হার ও ১১ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে কমে ১০ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছিল।
কিন্তু ২০১৯ সালের ৮ থেকে ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত কয়েকটি শহরের ২ হাজার ১০০ পরিবারের ওপর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো জরিপ চালিয়েছিল, এই জরিপের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০ দশমিক ৬৪ শতাংশ পরিবার খাওয়ার জন্য তারা যা পছন্দ করে তা কিনতে সক্ষম নয়।
বর্তমানে করোনাভাইরাস আক্রমণের ফলে নিশ্চয়ই উপরোল্লিখিত অবস্থার আরো অনেক অবনতি হয়েছে। ইতোমধ্যে অনেকের আয় ভয়ানকভাবে কমে গেছে। অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। ব্র্যাকের গত ২৬ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত জরিপ প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের ১৪ শতাংশ নিম্নআয়ের মানুষের ঘরে কোনো খাদ্যই নেই। আর বিবিএসের এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকা ও চট্টগ্রামের অবস্থা আরো ভয়াবহ, এই দুই শহরে ৯ দশমিক ২৩ শতাংশ পরিবার উপবাস অবস্থায় রাত কাটাতে হচ্ছে। দেশের অন্যান্য শহরেও ঠিক একই কারণে ৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ পরিবারকে উপবাসে রাত কাটাতে হয়। কিন্তু ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে দিনে ও রাতে উপবাসে কাটাতে হয় ৩ দশমিক ১৭ শতাংশ পরিবারকে। জরিপে আরো দেখা যায়, ৭ শতাংশ পরিবার অর্ধহারে এবং ১৫ শতাংশ পরিবার অপছন্দীয় খাদ্য এবং ১৪.৪৮ পরিবারকে অর্ধহারে সন্তুষ্ট থাকতে হয়।
শুধু খাদ্যের পরিমাণের সাথে নয়, খাদ্যের গুণগত মানের সাথে ও আপস করার কোনো বিকল্প নেই। অর্থাৎ গুণগত মানও অভাবে কমাতে হয়েছে। শহরে যারা বসবাস করে তাদের মধ্যে বিরাট সংখ্যক মানুষ বেকার হয়ে যাওয়ায় অনন্যোপায় হয়ে শহর ছেড়ে গ্রামেই ফিরে যেতে হচ্ছে, অনেকের আবার গ্রামেও বাস করার মতো ঘরবাড়ি নেই। এ পরিস্থিতির ফলে কল্পনাতীত কম দামে শহরেও বাসা ভাড়া দেয়া হচ্ছে, এর পরও শহরে বাসার চাহিদা দারুণভাবে কমে গেছে। আমাদের সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলোÑ বাংলাদেশের প্ল্যানিং কমিশনের প্রদত্ত তথ্য। কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার কমে নেমে এসেছিল (২০১৯ সালে) ২০ দশমিক ৫ শতাংশে তা ২০২০ সালে জুন মাসের পর এক লাফে ২৯ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছে গেছে। সাথে সাথে বর্তমানে দেশে চার কোটি ৯৪ লাখের উপরে মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে।
বর্তমানে আরো বেশি শক্তি সঞ্চয় করে করোনা সারা বিশ্বে প্রচণ্ড তাণ্ডব শুরু করেছে। এতে বাংলাদেশের অর্থনীতিও তীব্র চাপে পড়েছে। কৃচ্ছ্রতা ছাড়া সরকারের সামনে বিকল্প নেই বললেই চলে। বিশ্বের উন্নত-অনুন্নত রাষ্ট্রের সরকারের মতো বাংলাদেশ সরকারও বর্তমানে ভয়ানক সঙ্কটের মুখোমুখি। নির্ধারিত পরিমাণ রাজস্ব আদায় করা মুশকিল হয়ে পড়েছে, অথচ অন্য দিকে করোনার কারণে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের জন্য বিরাট প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করতে হয়েছে; যা বাস্তবায়ন করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এটি শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঘটছে না। ধনী হোক, গরিব হোক বিশ্বের প্রায় করোনা আক্রান্ত দেশে একই রূপ বিরাজমান। যুক্তরাষ্ট্রে ইতোমধ্যে অনুরূপ পরিস্থিতি মোকাবেলায় ৯০০ বিলিয়ন ডলারের উপর এক বিরাট অঙ্কের প্রণোদনা এই সেদিন সিনেট অনুমোদন দিয়েছে।
বাংলাদেশে বার্ষিক উন্নয়নের (এডিপি) বাজেটের আকার ছোট করে ২০২০-২১ অর্থবছরের দুই লাখ ৫৪ হাজার ৬১১ কোটি টাকা ঘোষণা করা হয়েছে। জিওবি এক লাখ ৩৪ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা আর বিদেশী সাহায্য ৭০ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। এই হিসাবে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা বেশি জিওবির টাকা মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো খরচ করতে পারবে না। মোদ্দা কথা, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) সরকারি অর্থায়ন, বরাদ্দের অনূর্ধ্ব ৭৫ শতাংশের মতো অর্থ ব্যয় করা যাবে।
অর্থাৎ ২৫ শতাংশ অর্থ সংরক্ষণ করতে হবে। আরো সহজভাবে বলা যায়, এই অর্থ বছরের পরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মসূচির কাজ ২৫ শতাংশ কমে যাবে। কোনো সরকারই ইচ্ছাকৃতভাবে কৃচ্ছ্রতায় যেতে চায় না, কিন্তু ভয়াবহ অর্থনৈতিক অবস্থায় যখন বাধ্য হতে হয়; তখন আর কিছু করার থাকে না। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) এক গবেষণামূলক প্রতিবেদনে বলা হয়েছেÑদেশের দারিদ্র্য হার শহরে দাঁড়াবে ২৫ দশমিক ১৩ শতাংশ। আর গ্রামে হবে ২৪ দশমিক ২৫ শতাংশ। একই সাথে ২০২০ সালে দেশে নতুন গরিব লোক সৃষ্টি হবে এক কোটি ৯৪ লাখ। বিশ্বব্যাংকের মতে, যার সোয়া ডলার বা এর চেয়ে কম আয় দিয়ে জীবন চালিয়ে যেতে হয় তাকে শুধু দারিদ্র্য বললে ভুল বলা হবে। তাকে অবশ্যই চরম দারিদ্র্য বলতে হবে।
বাংলাদেশের উপজাতীয় নৃগোষ্ঠীর ৭০ শতাংশেরও বেশি মানুষ এই শ্রেণীর হতদরিদ্র। এসব পরিবারের আবার ৯০ শতাংশ পরিবারের রয়েছে মাত্র একজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। আবার এমনও পরিবার আছে যেখানে একজন ও উপার্জনক্ষম মানুষও নেই। অথচ এসব উপজাতীয় প্রাকৃতিকভাবে কঠোর পরিশ্রমী। এদের যদি একটিবার এই দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বের করে আনা যায়, তা হলে তারা কৃষি এবং কৃষিসংক্রান্ত অন্যান্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিস্ময়কর ও বিপ্লবী পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবেন। দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বের করে আনতে পারলে বাংলাদেশ কৃষি উৎপাদনে একটি বিস্ময়কর বিপ্লব অবশ্যই ঘটাতে পারবে।
বাংলাদেশের সত্যিকারের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত এই শ্রেণীর মানুষকে ক্ষুধামুক্ত ও দারিদ্র্যমুক্ত করার ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়িত করা যাবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত উন্নয়ন কোনো দিন টেকসই হবে না। দুর্ভাগ্যবশত আমরা বর্তমানে দারিদ্র্যপীড়িত বাংলাদেশের যে শ্রেণীর মানুষকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে দেশের উন্নয়নের আশা করছি, তারাই বিভিন্ন দেশে দেশের মানুষের হক থেকে বঞ্চিত করে বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় রঙমহল তৈরিতে ব্যস্ত রয়েছেন। হ


আরো সংবাদ



premium cement
জাতিসঙ্ঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থাকে আবার অর্থায়ন শুরু করবে জাপান শেখ হাসিনার অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি বিএনপিকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে : ওবায়দুল কাদের রাশিয়া সমুদ্র তীরবর্তী রিসোর্টে ১৬.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে সিরিয়ায় ইসরাইলি হামলায় নিহত ৩৬ সেনা সদস্য দৌলতদিয়া ঘাটে পন্টুন থেকে নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু অ্যানেসথেসিয়ার পুরনো ওষুধ বাতিল করে কেন নতুনের জন্য বিজ্ঞপ্তি! বাইডেনের মেয়াদে রুশ-মার্কিন সম্পর্কের উন্নতির কোনো আশা নেই : রুশ রাষ্ট্রদূত ডিএমপির অভিযানে গ্রেফতার ৪০ নিউইয়র্কে মঙ্গোলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ফ্ল্যাট জব্দ করবে যুক্তরাষ্ট্র! টাঙ্গাইলে লরি-কাভার্ডভ্যান সংঘর্ষে নিহত ১ জিম্বাবুয়ে সিরিজে অনিশ্চিত সৌম্য

সকল