২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অর্জন-বর্জন, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির স্বাধীনতা

-

৪৯ বছরেও মেলেনি আমাদের স্বাধীনতার হালখাতা। অথচ কঠিন মূল্য দিতেই হচ্ছে জাতির গৌরবের অর্জনের ইতিহাসকে। এর বিকৃতিও কম হয়নি। যে যার মতো ইতিহাস বলছেন-শোনাচ্ছেন। গর্জন দিয়ে শুনতে বাধ্য করছেন। স্বাধীনতার চেতনা-উদ্দেশ্যও কলঙ্কিত করতে বুক কাঁপছে না। অবান্তর বিষয়েও ব্যস্ততা চাপিয়ে দিয়ে যে যার মওকা হাসিলের এ খেলায় কমতির লক্ষণ নেই। বরং সম্প্রতি আরো বাড়তি।
রাজনীতি কোনো কালে কোথাও খুব স্বচ্ছ-পরিচ্ছন্ন ছিল, এমন প্রমাণ মেলে না। সেখানে বাংলাদেশের রাজনীতির রং-রূপটা বেশি কদাকার। একেক সময় একেক রঙে আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকেও রাজনীতির ক্ষমতাধররা তাদের সুবিধাজনক বিষয়ে পরিণত করেছেন। এ ধারাবাহিকতায় একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীনতার রূপকারকে ঘৃণ্যভাবে হত্যা করা হয়েছে। স্বাধীনতাযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার, ঘোষক বা ঘোষণাপত্রের পাঠককেও হত্যা করা হয়েছে নৃশংসভাবে। কখনো দেশে এসেছে সামরিক শাসন। কখনোবা সামরিক শাসকরাই উর্দি খুলে করেছেন গণতন্ত্রের চর্চা। আবার কখনো নির্বাচিত সরকার ছলে-বলে অগণতান্ত্রিক উপায়ে টিকে থাকতে একনায়কতন্ত্র কায়েম করেছে। যা আমাদের একাত্তরের অর্জনকে প্রকারান্তরে বর্জনে ঠেকিয়েছে।
এখানে ক্ষমতার পটপরিবর্তনে অনেক কিছুর সাথে ইতিহাসও বদলে যায়। সত্যই হয়ে যায় ‘মিথ্যা’। আর মিথ্যাটাই তখন ‘সত্য’। প্রচলিত-প্রতিষ্ঠিত বিষয়ই হয়ে যায় বিতর্কিত। এ নিয়ে জমানো হয় রাজনীতির নামে নোংরামি। মুক্তিযুদ্ধের স্লোগানও হয়ে পড়ে দলীয় তথা বিতর্কিত। রাজনৈতিক বিভক্তির বড় উদাহরণ হয়ে দাঁড়ায় দুটি স্লোগান ‘জয় বাংলা’ এবং ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’। আওয়ামী লীগ নেতাদের কারো কারো অভিযোগ জাসদই প্রথম ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেয়া বন্ধ করেছিল। জাসদ নেতাদের বক্তব্য হচ্ছে, সদ্য স্বাধীন দেশে সরকারের বিরোধিতা করে নতুন দল জাসদের উত্থান হলে সেই দলটি ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ব্যবহার করেনি। তবে, তারা ‘জিন্দাবাদ’ স্লোগানও দেয়নি। এই স্লোগানের রাজনীতি নিয়ে কত রক্ত ঝরেছে, প্রাণহানি হয়েছে! আমরা বাঙালি না বাংলাদেশী-এই বিতর্কেও বিভাজন, রক্তপাত কম নয়। ১৯৭০ এর নির্বাচন এবং পরে মুক্তিযুদ্ধেও জনগোষ্ঠীর একটা অংশ বিরোধিতা করেছিল।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ সংবিধানে যখনই আনা হচ্ছিল, তখনই পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিনিধিরা বললেন যে, তারা বাঙালি নন। তারপর যারা ইসলামপন্থী, তারা যখন বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করলেন, তারা পাকিস্তানি ধারণা ফেরত আনতে চেষ্টা করলেন বলে অভিযোগ। ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরই সামরিক শাসকরা রাজনৈতিক সমর্থন জোগাড় করার জন্য এই পন্থীদের সাথে নিয়ে কিছু বামপন্থীকে কাছে টানতে শুরু করলেন। তখন ডান-বাম মিলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি তারা নিয়ে এলেন। ফলে বিভক্তি হতে থাকে আরো দৃশ্যমান। জিয়াউর রহমান এনেছিলেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। তার সময় ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ফিরে আসে। রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগ অনেক সময়ই এই বিষয়গুলোকে নিয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করে থাকে। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের অভিযোগের তীরটা জিয়ার দিকে। আওয়ামী লীগ নেতারা বলে থাকেন, জিয়াউর রহমান সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি পাল্টিয়ে ‘বিসমিল্লাহ’ যুক্ত করেছিলেন। এর ধারাবাহিকতাতেই আরেক সামরিক শাসক এরশাদ সংবিধানের আবার সংশোধন করে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করেছিলেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে দ্বিতীয় দফায় সরকারে এসে ৭২-এর সংবিধানের অনেক বিষয় ফেরত এনেছে। কিন্তু বিসমিল্লাহ এবং রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম- এই দুটি বিষয়ে তারা হাত দিতে পারেননি। নানা বিতর্ক আমাদের যুক্তিযুদ্ধে পাশে দাঁড়ানো রাষ্ট্র ভারতকে নিয়েও। এ নিয়ে অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ এখনকার প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির। এর সুযোগেই চাতুরী, দালালি, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং উগ্রতার বিস্তার। এই বাস্তবতায় বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিতে আর এক জায়গায় আসার কোনো সম্ভাবনা দেখা যায় না। এরপরও বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা কম নয়।
বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ-এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটেছে। জাতিসঙ্ঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন নীতিসংক্রান্ত কমিটি-সিডিপি এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে। এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের জন্য মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক এ তিনটি সূচকের যে কোনো দু’টি অর্জনের শর্ত থাকলেও বাংলাদেশ তিনটি সূচকের মানদণ্ডেই উন্নীত হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের (ইকোসক) মানদণ্ড অনুযায়ী এক্ষেত্রে একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হবে কমপক্ষে ১২৩০ মার্কিন ডলার, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় তার থেকে অনেক বেশি ১৬১০ মার্কিন ডলার। মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ প্রয়োজন হলেও বাংলাদেশ অর্জন করেছে ৭২ দশমিক ৯। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক হতে হবে ৩২ ভাগ বা এর কম; যেখানে বাংলাদেশের রয়েছে ২৪ দশমিক ৮ ভাগ। বাংলাদেশ এখন ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে এগিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে আজকের এই উত্তরণ- যেখানে রয়েছে এক বন্ধুর পথ পাড়ি দেয়ার ইতিহাস। সরকারের রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নের এটি একটি বড় অর্জন। এই অর্জনের অবদানও বিতর্কিত। কেউ বলতে চান তা সম্ভব হয়েছে, কেবল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে। আবার কারো মতে, তা দেশের খেটে খাওয়া কৃষক-শ্রমিকসহ উৎপাদনমুখী মানুষের ঘামের ফল।
আয়তনে ক্ষুদ্র হলেও বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সম্পদ ও জনসম্পদে ধনাঢ্য। কৃষি খাতে অভূতপূর্ব কিছু সাফল্যের জন্য বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ বারবার আলোচিত হয়েছে। প্রায় ১৬ কোটি জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশ বর্তমানে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিগত বছরগুলোতে দেশে ধানের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৫০ লক্ষ মেট্রিক টন। প্রধানমন্ত্রী ও কৃষিমন্ত্রীর সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশের বিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলম আবিষ্কার করেছেন পাটের জিনোম সিকুয়েন্সিং। সারা বিশ্বে আজ পর্যন্ত মাত্র ১৭টি উদ্ভিদের জিনোম সিকুয়েন্সিং হয়েছে, তার মধ্যে ড. মাকসুদ করেছেন তিনটি। তার এই অনন্য অর্জন বাংলাদেশের মানুষকে করেছে গর্বিত। বর্তমানে বিশ্বের ১৫৭টি দেশে বাংলাদেশের ৮৬ লাখেরও অধিক শ্রমিক কর্মরত। এ ধরনের আরো নানা প্রাপ্তিকে স্বাভাবিক অর্জন বলা যায়। কিন্তু অপ্রাপ্তি তো মূল জায়গায়। জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করা ব্যক্তিদের প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। আমরা পাকিস্তান আমলের চেয়ে ভালো আছি বললে তা কেবল স্বাধীনতার আবেগ, আত্মমর্যাদার অনুভূতি ও স্বদেশিকতা-দেশপ্রেমের চেতনার অমূল্য সম্পদ প্রাপ্তির হিসাবেই নয়। পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রটির বাস্তব হাল-হকিকত এখন যা, তাতে আঁতকে উঠে সবাই একবাক্যে বলবে যে, ভাগ্যিস পাকিস্তানি শাসক-শোষকদের নিষ্ঠুর জাতিগত ও শ্রেণীগত শোষণবঞ্চনা, সেদেশে বর্তমানে চলতে থাকা মৌলবাদী জঙ্গি সঙ্ঘাত, সেখানকার প্রতিদিনের নির্বিচার হামলা-হত্যার নৈরাজ্যকর অবস্থা থেকে আমরা আজ বহুলাংশে মুক্ত থাকতে পারছি। এ সবই আমাদের বড় প্রাপ্তি। কিন্তু, ৪৯ বছর আগে, যে স্বপ্ন-সুযোগ-সম্ভাবনা উন্মোচিত হয়েছিল সেই তুলনায় আমরা কী পেলাম, এটাই হওয়া উচিত হিসাব-নিকাশ ও মূল্যায়নের মাপকাঠি। সেই বিবেচনা থেকে বলা যায় যে, ৪৬ বছর আগে আমরা যা অর্জন করেছিলাম তার অনেক কিছুই আমরা ধরে রাখতে পারিনি। আমাদের বিজয়ের বেশির ভাগ উপাদানই হাতছাড়া হয়ে গেছে। ৪৬ বছর আগের স্বপ্নের সাথে আজকের বাস্তবতার, সেদিনের প্রত্যাশার সাথে আজকের প্রাপ্তির ফারাক হলো আকাশপাতাল। স্বাধীন দেশ সম্পর্কে আমাদের স্বপ্ন ঝলকের মতো আবির্ভূত হয়নি।
দীর্ঘ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় তিলে তিলে আমাদের স্বপ্ন রচিত হয়েছিল। সেই স্বপ্ন মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে আরো সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। আমাদের প্রত্যাশা ছিল সব পশ্চাৎপদ থেকে আমাদের নতুন এই দেশটি সম্পূর্ণ মুক্ত থাকবে। ধর্ম-বর্ণ, ধনী-গরিব নির্বিশেষে সব নাগরিক সমান অধিকার ও মর্যাদা ভোগ করবে। সমাজ থেকে সব বে-ইনসাফি দূর হবে। মানুষের ওপর মানুষের শোষণ থাকবে না। শ্রেণীবৈষম্য থাকবে না। যৌথতার ভিত্তিতে অর্থনীতির নতুন কাঠামো ও ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প দূর হবে। মানুষের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার নিরঙ্কুশ হবে। দূর হবে পরাধীনতার গ্লানি। থাকবে না কোনো হতাশা। কিন্তু, স্বপ্ন ও প্রত্যাশা পূরণের পথে গোড়া থেকেই হরেক রকম অন্তরায় ও বাধা আমাদের এগোতে দিচ্ছে কি আকাক্সিক্ষত পথে?


আরো সংবাদ



premium cement
বাংলাদেশে নতুন করে বাড়ছে ম্যালেরিয়া আক্রান্তের সংখ্যা হিট অ্যালার্ট নিয়ে আবহাওয়া অধিদফতরের নতুন বার্তা ভান্ডারিয়ায় পিকআপ চাপায় বৃদ্ধ নিহত হোচট খেল লিভারপুল, পিছিয়ে গেল শিরোপা দৌড়ে যোদ্ধাদের দেখতে প্রকাশ্যে এলেন হামাস নেতা সিনওয়ার! ফের পন্থ ঝড়, ঘরের মাঠে গুজরাটকে হারাল দিল্লি ইউক্রেনকে গোপনে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র গ্রেফতারের পর যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফিলিস্তিনপন্থীদের বিক্ষোভ আরো বেড়েছে ইউক্রেন যুদ্ধে দুর্নীতি, পুতিনের নির্দেশে গ্রেফতার রুশ উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী!  আমেরিকানরা কি ধর্ম থেকে সরে যাচ্ছে? গাজায় রিজার্ভ ব্রিগেড মোতায়েন ইসরাইলের

সকল