২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

ঘুম

-

অনেক দিন আগে থেকেই টের পাচ্ছিলাম, ঘুম নিয়ে মনে বেশ কিছু কথা জমা হচ্ছে। তবে এগুলো লেখাপড়া করে হাসিল করিনি, কোনো গবেষণা থেকে পাইনি, এমনকি চিন্তা করেও বের করিনি। আজ বলার জন্য যে সব কথা মনের দুয়ারে উঁকিঝুঁকি মারছে, তা একান্তই আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ফসল। এই অভিজ্ঞতার জন্য আমাকে কোনো প্রকার কোশেশ করতে হয়নি, কোনো রকম বাড়তি ঝুঁকিও নিতে হয়নি। জীবনে চলার পথে অতি স্বাভাবিক নিয়মে কাহিনীগুলো আমার ঘুমের থালায় পড়ে জমাট বেঁধে আছে। আজ শনিবারÑ ছুটির দিন, সকাল বেলার সোনালি সূর্যের উষ্ণ আলোয় নরম করে আমার নতুন-পুরান ঘুমের রসালো কেচ্ছাকাহিনী একে একে সব শোনাতে চাই। সমস্যা হলো, ঘুমের ইতিহাসটা শুরু করব কোত্থেকে? এইমাত্র গুগ্ল করে পেলাম, প্রতিটি আদম সন্তানের ঘুমের জীবন নাকি তার জন্মের আগে থেকেই শুরু হয়ে যায়। মায়ের গর্ভে শিশুসন্তান ৯৫ শতাংশ সময় ঘুমিয়েই কাটায়। মুষ্টিবদ্ধ দুটো হাত নিয়ে কানফাটা কান্না করতে করতে আমার জগতের আলো দেখা। তারপরেই তো ঘুম। মায়ের আদর, খাওয়া আর ঘুম- এভাবেই তো দুনিয়াজীবনের সূচনা। মা-বাবার সংসারে পয়দা হওয়ার পর থেকে আজ অবধি অনেক দূর পথ হেঁটে এসেছি। হিসাব করলে দেখা যাবে, আর দশ-পাঁচ জনের মতো ইতোমধ্যে জীবনের এক-তৃতীয়াংশ সময় ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিয়েছি।
মানুষ যেমন বিচিত্র, তার ঘুমের অভ্যাসটাও সেইরূপ। একেকজন একেক তরিকায় ঘুমায়। কেউ ঘুমের মাঝে বালিশসহ বৃত্তাকারে বিছানায় চক্কর মারে। কারো অভ্যাসÑ ঘুমের মাঝে সে নড়ে চড়ে, কেউ মড়ার মতো ঘুমায়। আবার এমনও মানুষ আছে, ঘুমের সময় আবোল-তাবোল বকে, কেউ কথা শুনলেই ঘুম থেকে জেগে ওঠে। চা খেলে কারো ঘুম হয় না, আবার গরম চায়ের পেয়ালায় চুমুক না দিলে অনেকে ঘুমাতেই পারে না। বাবার মতো, ঘুমের সময় কেউ শীত-গরম বারো মাস কাঁথা গায়ে দেয়, কেউ খালি গায়ে ঘুমায়। উদাম দেহে ঘুমানোর অভ্যাস আমার একেবারেই ছিল না। কেমন করে রপ্ত করলাম ঘুমানোর এই অভিনব কায়দা, শুনবেন সে ঘটনা? যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র, আমার এক বন্ধু পড়ত ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে। সে থাকত এফএইচ হলের সম্প্রসারিত কক্ষে একতলায় একটি ছোট্ট ঘরে। ১৯১৭ সালের মাঝামাঝি কোনো একসময় গরমের দিন দুপুর বেলা তার সাথে দেখা করতে গিয়ে দেখি, বন্ধু আমার দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে, মেঝেতে চাটাই বিছিয়ে লুঙ্গি পরে খালি গায়ে আরামে ঘুমাচ্ছে। বুদ্ধি হওয়ার আগে থেকেই আমার এই বাল্যবন্ধুকে অন্ধভাবে অনুকরণ ও অনুসরণ করার চেষ্টা করতাম। সে কিন্তু এসব কথা জানে না। তাকে সে দিন খালি গায়ে ঘুমোতে দেখে আমিও একই অভ্যাস গড়ে তুলি। আমার বন্ধু হয়তো এখন আর ও-ভাবে ঘুমায় না, কিন্তু আমার সেই স্বভাব আজও বদলায়নি।
আমরা যে এত ঘুমাই, কখনো কি ভেবে দেখেছিÑ এই ঘুমের সময়টাকে আল্লাহ কিভাবে রাঙিয়ে দিয়েছেন রঙবেরঙের স্বপ্ন দিয়ে, বিছানায় শুয়ে শুয়ে অন্ধকার রাতে বন্ধ চোখে মানুষ কত কিছু দেখে, কত জায়গায় যায়, কত কিছু করে! ঘুম ভাঙলেই মরীচিকার মতো প্রায় সবই উবে যায়। রহস্যময় এই স্বপ্নজগতের কথা বুঝতেও আমার অনেক সময় লেগে গেছে। জীবনে কোন বয়সে কোন দিন প্রথম খোয়াব দেখে অবাক হয়ে মাকে গিয়ে বলেছিলাম- তার কোনো হদিস পাই না। তবে এটুকু মনে আছে, এত দিন ধরে সরল-গরল, অম্লমধুর অসংখ্য স্বপ্ন দেখেছি। অনেক সময় ভয় পেয়ে গভীর রাতে জেগে উঠেছি, হৃৎকম্পন বেড়ে গেছে- তারপর আস্তে আস্তে আবার স্বাভাবিক হয়েছে। যাই দেখি না কেন, বেশির ভাগ খোয়াব আমি ঘুম ভাঙার আগেই ভুলে যাই। যা মনে থাকে, তাও বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে বেশি দিন সময় লাগে না। আবার এমনো হয়েছে, স্বপ্নের মতোই স্বপ্ন এসেছে অনেক অনেক আগে। সেই স্বপ্ন আবছা আবছা স্মৃতি হয়ে আজ হঠাৎ আবার ভেসে উঠছে আমার মনের কোণে।
কাহিনীর পরম্পরা বলতে গেলে- কোনটা আগে, কোনটা পরে- সব তালগোল পাকিয়ে ফেলি। আবার আমার জীবনে এমন কিছু স্বপ্নও আছে, যা কোনো দিন ভোলার নয়। এগুলোকে আর স্বপ্ন বলি না। এ সব আমার জীবনের আশা-আকাক্সক্ষা ও প্রত্যাশার মূর্ত প্রতীক, বাস্তব জীবনের অনুষঙ্গ। জানি, কোনো দিন হয়তো ফলবে না- তবু তারা আমার জীবনস্মৃতিতে চিরস্থায়ী আসন গেড়ে বসে আছে। এ-ও তো এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা!
শৈশব, কৈশোর, যৌবন ও প্রৌঢ়ত্বে বেঁচে থাকার তাগিদেই যে সবটুকু সময় ঘুমিয়েছি তা নয়, বরং আমার কাছে মনে হয়, ঘুমের মাঝে, ঘুমের ঘোরে, খোয়াবে খোয়াবেই যেন পুরো জীবনটা কাটিয়ে দিলাম। নিজের জন্য যা করতে হয়, তা করার চেষ্টা-তদবির কম করিনি। কিন্তু দেশ, সমাজ ও মানুষের জন্য কী করেছি? Ñহিসাব করতে গেলে কিছুই পাই না। জীবনভর এই যে এক ম্যারাথন ঘুম ঘুমালাম- এত আরামের ঘুম! কোনো দিন তো আমার ঘুমের অসুবিধা হয়নি। ভুলেও একবার আলহামদুলিল্লাহ বলিনি! মাটির মেঝেতে শীতল পাটির ওপর কিংবা কাঠের তক্তপোষে অথবা নরম বিছানা, যেখানেই হোক না কেন, বালিশে মাথা রাখার সাথে সাথে বেহেশতি ঘুমের আবেশে চোখের পাতা বুজে এসেছে, ঢুলু ঢুলু নয়নে দেহ-মন প্রশান্তির কোলে ঢলে পড়েছে। প্রতিদিন সকাল বেলা যখন ঘুম পুরো করে উঠেছি- মনে হয়েছে যেন নতুন জীবন লাভ করেছি। জ¦র-জারি, অসুখ-বিসুখের সময় ঘুমের সমস্যা হতো। ঘুম ঘুম চোখেও ঘুম আসত না। অস্থিরতায় বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতাম, ওই সময়টাতে ছটফটানির কোনো সীমা থাকত না। তখন হাড়ে হাড়ে টের পেতাম, ঘুম আল্লাহ তায়ালার কত বড় নিয়ামত!
এই আরামের ঘুমের জীবনে একটি বড় রকমের ব্যত্যয় শুরু হয় যখন আমার বয়স ৫০ ছুঁই ছুঁই। তখন রাতে ঘুম হতো না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে উল্টোদিক থেকে সংখ্যা গুনতাম, দোয়া-দরূদ পড়তাম, কোনো কিছুতেই কোনো কাজ হতো না। ঘুম আসত না। কতক্ষণ পর পর ঘড়ির কাঁটার দিকে চেয়ে চেয়ে সময় মাপতাম। যেটুকু সামান্য ঘুমের দেখা মিলত তা-ও রাত ৩টা-সাড়ে ৩টার আগে নয়। এত অল্প ঘুমে প্রয়োজন মিটত না। যা-ও বা ঘুমাতাম তাকে ঘুম বলা যায় না, বড়জোর তন্দ্রা। দু-এক রাতের ব্যতিক্রম বাদে, এ রকম আমার প্রায় ১৫টি বছর কেটেছে- নির্ঘুম রাত। ডাক্তারের কাছে গেছি, ঘুমের দাওয়াই খেয়েও কোনো ফায়দা পাইনি। যে মানুষটি দিনের পর দিন, বছরের পর বছর অনিদ্রায় ভোগে, সে-ই কেবল জানে- একটি রাতের জন্য হলেও নিরবচ্ছিন্ন গভীর ঘুম কত আরামের, কত স্বস্তির। এরই ধারাবাহিকতায়, ঘুমের খরা নিয়ে ২০১৯ সালের মে মাসে কয়েক দিনের জন্য দুবাই গিয়েছিলাম। তখন রাতে একদম ঘুম হতো না, দিনেও না। খাবার সময়টা বাদে দিবানিশি হোটেল কক্ষের বিছানায় পড়ে থাকতাম- বুঝতে পারতাম, এক রত্তি ঘুমের জন্য আমার কী হাপিত্যেশ, কী কাঙালপনা!
এভাবে দু-তিন দিন যাওয়ার পর, একটু আশার আলো দেখলাম; আসর আর মাগরিবের মাঝখানে একটু নিদ্রা এসে দু’চোখে ভর করত। এত হালকা নিদ্রা, ঘুমাতাম কি না বুঝতেও পারতাম না। একদিন বিকেল বেলায় বিছানায় শুয়ে আছি- ঘুমালাম কি না জানি না, তন্দ্রা এসেছিল কি না, তাও বুঝতে পারিনি। হঠাৎ চোখ খুলে জানালা দিয়ে চেয়ে দেখি, পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবু ডুবু এবং মনের আকাশে তাজা নতুন স্বপ্ন ভেসে বেড়াচ্ছে- অর্থাৎ আমি এইমাত্র একটি স্বúœ দেখে উঠলাম। বাহ, কী আনন্দ, কী স্বস্তি! বুঝলাম, তাহলে চোখে ঘুম এসেছিল ঘণ্টা খানেকের জন্য হলেও। না ঘুমালে স্বপ্ন দেখলাম কী করে? সে দিনের জন্য এটুকু নিদ্রা বা তন্দ্রাই ছিল আমার অনেক বড় পাওয়া। ওই দিনগুলোতে আমার ঘুম এত হালকা হতো যে, বুঝতেই পারতাম না, আসলে আমি ঘুমালাম কি না। দীর্ঘ সেই সময়ে এটা আমার নিত্যদিনের নিদ্রাবিহীন যন্ত্রণাদায়ক রাত কাটানোর কাহিনী। এরই মধ্যে অফিস-আদালত, হাট-বাজার সবই করেছি। না করে তো কোনো উপায় ছিল না।
আল্লাহর অশেষ কৃপায়, অতি সম্প্রতি বিনা চিকিৎসায়, অলৌকিকভাবে আমার ঘুমের সমস্যা দূর হয়ে গেছে। এখন আমার ঘুম হয়, গভীর ঘুম। আজকাল ঘুম থেকে আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠি, তারপর ঘুমের আমেজ কাটতে কাটতে আরো ১৫ মিনিট সময় লাগে। ১৫ বছরের অনিদ্রা আর আধা-নিদ্রার কারণে আমি ঘুমের স্বাদ বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। রাতের একটি ভালো গভীর ঘুম পুরো হওয়ার পর সকালে হাত-পা ঝেড়ে বিছানা থেকে উঠলে কেমন লাগে, তা-ও বিস্মৃত হয়েছিলাম। সামান্য একটু সুন্দর ঘুমের অনুভূতি যে কী মজার, কী প্রশান্তির তা আমি এখন নতুন করে হৃদয়-মন দিয়ে উপলব্ধি করি, উপভোগ করি! ঘুম নিয়ে এখন আমার আর কোনো অভিযোগ নেই, কোনো অনুযোগ নেই। আজ আমার একটি আকুল আবেদন, হে প্রভু, করুণা করে আমার চোখে যে ঘুম দিয়েছ, ‘শেষ ঘুম’ ঘুমানোর আগে তা আর কেড়ে নিও না।
লেখক : অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি, এডিটর- জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ, ইউএসএ
Email: wahid2569@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement