২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

স্বাস্থ্যঝুঁকিতে নারী শ্রমিকরা

-

শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ এবং রোজগার আধুনিক সময়ের এক অনিবার্য বৈশিষ্ট্য। এই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের পোশাক শিল্প নারী শ্রমিকের হাত ধরে প্রসারিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। দেশের নারী শ্রমিকের বেশির ভাগই পোশাক শিল্পে নিয়োজিত। এ ছাড়া শ্রমশক্তির প্রায় সব ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাব মতে, বাংলাদেশে মোট খাদ্য উৎপাদনে নারীর অবদান কমপক্ষে ৫০ শতাংশ। পুরুষরা যেখানে বছরে এক হাজার ৮০০ ঘণ্টা কৃষিকাজে শ্রম দেন; সেখানে নারীরা দেন দুই হাজার ৬০০ ঘণ্টা। আইএলওর হিসাব মতে, এ দেশে নারী শ্রমিকের সংখ্যা ৪৩ শতাংশ। বাংলাদেশের প্রায় ১৫ লাখ নারীর কর্মসংস্থান গার্মেন্টস শিল্পে এবং প্রায় চার কোটি নারীর কর্মসংস্থান হচ্ছে কৃষিতে। দেশের গার্মেন্ট কারখানাগুলোতে কর্মরত শ্রমিকদের ৮০ শতাংশ নারী। আবার নারী শ্রমিকের বেশির ভাগ অংশ কৃষিকাজের সাথে যুক্ত থেকে খাদ্য ঘাটতি পূরণ এবং কৃষিনির্ভর অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন।
নারী শ্রমিক-নির্ভর পোশাক শিল্প খাত বাংলাদেশের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতেও নারীর অবদান সর্বজন স্বীকৃত। অনেক নারী শ্রমিক পরিবার পরিজন ছেড়ে প্রবাসে গিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছেন। জিডিপির একটি বড় উৎস আসছে নারীদের আয় থেকে। নারীদের এত সব অর্জন সহজে আসেনি। সম্প্রতি এই বিপুল সংখ্যক নারী শ্রমিকের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বাংলাদেশের নারী স্বাস্থ্যের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। ফুড সিকিউরিটি নিউট্রিশনাল সার্ভিল্যান্স প্রোগ্রাম (এফএসএনএসপি) থেকে জানা যায়, দেশে আড়াই কোটির বেশি মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছেন। যার ৬০ শতাংশ নারী। জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) খাদ্য ও পুষ্টি পরিস্থিতি-বিষয়ক ফুড সিকিউরিটি নিউট্রিশন সার্ভিল্যান্স প্রোগ্রামের গবেষণা থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। ওই তথ্য বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। একই সাথে বাংলাদেশের মায়েদের এক-তৃতীয়াংশ অপুষ্টির শিকার এবং উচ্চতার চেয়ে তাদের ওজন কম বলেও জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসএআইডি।
খাদ্য অধিকার বাংলাদেশ নামের সংগঠনটি বলছে, বাংলাদেশের প্রায় আড়াই কোটি মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছেন। এর মধ্যে নারী ৫০ শতাংশ। গত ১০ বছরে অপুষ্টিজনিত সমস্যায় ভোগা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে সাত লাখ। অথচ বাংলাদেশ ফুড প্লানিং মনিটরিং ইউনিট থেকে জানা যায়, ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ১৬ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায়। আর এই ১৬ বিলিয়ন ডলারের ভেতরে পুষ্টি উন্নয়নে খরচ হয়েছে মাত্র ২ শতাংশ। সংগঠনটি বলছে, পুরো পরিস্থিতির ভেতরে নারীর অবস্থা আরো খারাপ। তারা প্রয়োজন অনুসারে খাদ্য পাচ্ছেন না। যার কারণে পুষ্টি থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। অপরদিকে, পুষ্টিহীনতার কারণে ৪২ শতাংশ নারী খর্বাকৃতি, ৩২ শতাংশ কিশোরী খর্বাকৃতি, ৪৪ শতাংশ নারী রক্তস্বল্পতা এবং শরীরে দীর্ঘমেয়াদি শক্তির ঘাটতি রয়েছে। এমন নারীর সংখ্যা ২৫ শতাংশ এবং খাদ্যে কম অনুপুষ্টি গ্রহণ করছেন ৬০ শতাংশ নারী। এখন যদি প্রশ্ন করা হয়, নারীরা সত্যিই কি স্বাস্থ্যঝুঁঁকিতে আছেন? তা হলে কোনো বিতর্ক ছাড়াই এ প্রশ্নের জবাবে আমরা হ্যাঁ বলতে পারি।
সরকারি চাকরিজীবী নারীর জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি বরাদ্দ থাকলেও বেশির ভাগ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এ ছুটি পেতে কাঠখড় পোড়াতে হয়। ফলে নারীরা ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়েও কাজ করে চলছেন প্রতিনিয়ত। যার কারণে প্রসবকালীন বিভিন্ন জটিলতায় প্রাণ হারাচ্ছেন হাজারো নারী শ্রমিক।
দেশে নারী শ্রমিকদের মজুরির-বৈষম্য এখনো প্রকট। দেখা গেছে, পুরুষের চেয়ে বেশি কাজ করেও নারীরা যা মজুরি পাচ্ছেন তা নিতান্তই সামান্য। এই মজুরি দিয়ে তারা অভাবের লাগাম টানতে গিয়ে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাদের পক্ষে দৈনিক খাবারের তালিকায় পুষ্টিকর খাবার সংগ্রহ করা প্রায় অসম্ভব। তা ছাড়া দেখা যায়, অজ্ঞতা বা কুসংস্কারে নারীরা অনেক পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। কোন খাবারে কোন ভিটামিন এবং কী খাবার খেলে শরীরের কোন ঘাটতিটা পূরণ হবে; তা বেশির ভাগ নারী শ্রমিকেরই অজানা। ফলে তারা অপুষ্টির শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। প্রতি বছর নারী স্বাস্থ্য উন্নয়নে সরকার বিপুল অর্থ বরাদ্দ দিলেও খুব অল্পসংখ্যক নারীর কাছে এ সুবিধা পৌঁছায়। আর বর্তমান করোনাকাল নারী স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবারের দারিদ্র্য মোকাবেলা করতে কাজের তাড়ায় বাইরে বেরোতে হচ্ছে অনেক নারীকে। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা সম্ভব হচ্ছে না তাদের। পয়সার অভাবে মাস্ক ও হ্যান্ড সেনিটাইজার ব্যবহার থেকেও বিরত থাকছেন তারা। প্রতিদিন শনাক্ত হওয়া করোনা রোগীর মধ্যে নারীদের পরিমাণ কিন্তু কম নয়। গার্মেন্টসহ আরো কিছু প্রতিষ্ঠানে নারী স্বাস্থ্যঝুঁকি উপেক্ষা করে তাদের সুবিধা অনুযায়ী কাজ করিয়ে নিচ্ছে। ফলে দিন দিন করোনায় আক্রান্ত নারী শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েই চলছে।
কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা ও নিরাপত্তা সুবিধা প্রত্যেক শ্রমিকের বৈধ ও আইনগত অধিকার। শ্রমিকদের একটি নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ দিতে হবে। একই সাথে কর্মক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপদ পরিবেশের অনুশীলন উন্নত করতে হবে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা সতর্ক করে বলেছে, শ্রমিকদের কাজে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সুরক্ষা না দিলে দেশে দেশে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ ভয়াবহ হতে পারে। সংস্থাটির জেনেভা অফিস থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ সতর্কবার্তা দেয়া হয়। এ পরিস্থিতিতে আইএলও সরকারগুলোর প্রতি কর্মক্ষেত্রে কোভিড-১৯ রোধ ও নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। এ বিষয়ে নিয়োগকর্তা ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত থেকেও সংলাপের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে বলে মনে করে আইএলও।
আইএলও বলছে, মালিকপক্ষকে কর্মীদের ঝুঁকি কমাতে ঝুঁকি মূল্যায়ন করতে হবে এবং কর্মস্থলগুলোতে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় যথাযথ ব্যবস্থা রয়েছে কি না, তা নিশ্চিত করতে হবে। এ ধরনের নিয়ন্ত্রণ ছাড়া দেশগুলো ভাইরাসের দ্বিতীয় দফা ঢেউয়ের সময় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে কর্মক্ষেত্রে সংক্রমণের দ্বিতীয় তরঙ্গের ঝুঁকি হ্রাস পাবে।
বাংলাদেশে নারীর অর্জন কম নয়। দেশের উন্নতিতে নারীদের অংশগ্রহণ উল্লেখ করার মতো। তাই সমাজের সব স্তরের নারীর স্বাস্থ্য উন্নয়নে সরকারের নজর দেয়া অপরিহার্য। সরকারিসহ বিভিন্ন এনজিওকে নারীর স্বাস্থ্যসেবায় মনোনিবেশ করতে হবে। সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই নারীরা এ ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবেলা করতে পারবেন বলে আশা করা যায়। হ
লেখক : কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement