২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রাসন

-

বিনা প্ররোচনায় শত্রুভাব পোষণ করে অন্য দেশ ও জাতির প্রতি আক্রমণ করাকে ‘আগ্রাসন’ বলা হয়। যুগ যুগ ধরে রাজনৈতিক আগ্রাসন, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, সামরিক আগ্রাসন ও অর্থনৈতিক আগ্রাসনের সাথে মানুষ পরিচিত হলেও বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রাসনের স্বরূপ অনেকের অজানা। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বেশির ভাগ মুসলমান বুদ্ধিবৃত্তিক বা চিন্তাযুদ্ধের ষড়যন্ত্র ও ভয়াবহতা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল নন। সশস্ত্র ক্রুসেডের (১০৯৫-১২৯১) পরবর্তী সময়ে ইহুদি-খ্রিষ্ট অক্ষশক্তি বিশ্বব্যাপী মুসলিম জাগরণকে স্তব্ধ করার মানসে বহুমাত্রিক যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করে তার মধ্যে প্রধানত ছিল ‘বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই’ (ওহঃবষষবপঃঁধষ ঈৎঁংধফব)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-১৯৪৫) বিভীষিকা এবং ¯œায়ুযুদ্ধের (১৯৪৫-১৯৮০) ডামাডোলের মধ্যেও আদর্শের এ লড়াই অব্যাহত থাকে। ক্রুসেডসহ বিভিন্ন ফ্রন্টে কেবল মাত্র অস্ত্র বলে মুসলমানদের পদানত করা সম্ভব হয়নি; সাময়িকভাবে কিছু কিছু ফ্রন্টে মুসলিম শক্তি পিছু হটলেও আবার তারা শক্তি সঞ্চয় করে মাথা তুলে দাঁড়ায়। ইহুদিগোষ্ঠী ও খ্রিষ্টজগৎ মুসলমানদের শক্তির উৎস অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হয়। গোটা দুনিয়ায় তিন শতাধিক গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বুদ্ধিবৃত্তিক ফোরাম (ঞযরহশ ঞধহশ) গড়ে তোলা হয়। খুব বেশি দিন লাগেনি ফলাফল পেতে। তারা বের করে ফেলেন মুসলমানদের শক্তির উৎসগুলো যথা আল্লাহ তায়ালার প্রতি অগাধ বিশ্বাস, মহানবী সা:-এর আদর্শের প্রতি অবিচল আনুগত্য, নিষ্কলুষ চারিত্রিক দৃঢ়তা, মৃত্যুঞ্জয়ী মনোবৃত্তি, শাহাদতের আকাক্সক্ষা, ভ্রাতৃত্ববোধ ও মানবীয় গুণাবলির চর্চা।
এবার তারা অস্ত্রযুদ্ধের পরিবর্তে চিন্তাযুদ্ধের মহাপরিকল্পনা হাতে নেন। এ পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে প্রাচ্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, বিশ্বায়ন, মহানবী সা:-এর অবমাননা, খ্রিষ্টান মিশনারি, শক্তিশালী মিডিয়া কমপ্লেক্স, মিডিয়ায় ইসলামের বিরুদ্ধে বিষোদগার, সেবার আড়ালে এনজিও কর্মকাণ্ড, অশ্লীলতার বিস্তার, বিনোদন-বিলাসিতার উপকরণ সরবরাহ, মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে বিভেদ তৈরি আর বিভিন্ন মুসলিম গ্রুপের মধ্যে ‘ইখতিলাফি’ বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে অনৈক্য সৃষ্টি। রাবাত থেকে জাকার্তার পুরো মুসলিম জনপদ এখন তাদের নেটওয়ার্কের আওতায়। বুদ্ধিবৃত্তিক এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে নিয়োজিত রয়েছে লাখ লাখ বৃত্তিভোগী এজেন্ট। মুসলমানধারী কিছু ব্যক্তিও এ নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত।
অমুসলিম পণ্ডিতগণ যারা আরবি, ইসলামিয়াত ও ইসলামের ইতিহাসে গবেষণার স্বাক্ষর রাখেন তারা সবাই ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিদ্বেষ পোষণ করতেন অথবা মিশনারি লক্ষ্য সামনে রেখে কাজ করেছেন এমন ঢালাও মন্তব্য করা সমীচীন নয়। অনেকে কেবল জ্ঞানের বিকাশ ও গবেষণার উদ্দীপনা নিয়ে ইসলামকে প্রিয় বিষয় হিসেবে বেছে নেন এবং সারাটি জীবন এসব বিষয়ে মৌলিক গবেষণা, অধ্যয়ন ও অধ্যাপনায় জীবন উৎসর্গ করে দেন। এ কথা স্বীকার করতে আমাদের কোনো দ্বিধা থাকা উচিত নয় যে, অনেক পরিচ্ছন্ন অন্তরের অধিকারী অমুসলিম পণ্ডিত ও গবেষকের আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে দু®প্রাপ্য অনেক ইসলামী গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি সূর্যের মুখ দেখেছে। তাদের মেহনত ও প্রয়াসের ফলে অনেক ইসলামী উলুমের মূলসূত্র ও ইতিহাসের দস্তাবেজ মুদ্রিত হয়ে বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হয় (আল্লামা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভি, ইসলামিয়া আওর মাগরিবি মুস্তাশরিকিন, মাজলিস-ই- তাহকিকাত ওয়া নাশরিয়াতে ইসলাম, লক্ষেèৗ, ১৯৮২, পৃ.১১)।
অমুসলিম পণ্ডিতদের এ জ্ঞানসাধনার ফসল প্রাচ্য দেশগুলোর পণ্ডিত ও গবেষকদের জন্য জ্ঞানচর্চার দিগন্ত উন্মোচন করে দেয়। প্রাচ্যবিদদের ইলম, মর্যাদা ও জ্ঞান সাধনার স্বীকৃতি দেয়ার সাথে সাথে এ কথা নির্ধিদ্বায় বলা চলে যে, ইহুদি-খ্রিষ্টান আরবি ভাষাবিদগণের বৃহত্তর এক অংশ সব সময় ইসলামী শরিয়াহ, মুসলমানদের ইতিহাস, মুসলিম তাহজিব ও তমদ্দুনের দুর্বলতা ও ভ্রান্তির সন্ধানে তাদের মেধা ও শ্রমকে কাজে লাগান পুরোপুরি; রাজনৈতিক ও ধর্মীয় উদ্দেশ্য সাধনে তারা ইলম ও পাণ্ডিত্যকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী স্কলার ও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের গবেষক হজরত সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভি রহ: এ ব্যাপারে চমৎকার মন্তব্য করে গেছেনÑ
‘দুঃখের বিষয় এই যে, বহু প্রাচ্যবিদকে আমরা এ কাজ করতে দেখে, তারা তাদের সব প্রয়াস ও সাধনাকে ইসলামের ইতিহাস, ইসলামী সমাজ, তাহজিব-তমদ্দুন এবং সাহিত্য সংস্কৃতির ত্রুটি-বিচ্যুতির অন্বেষায় ব্যয় করেন। অতঃপর তা জনসমক্ষে উপস্থাপন করেন নাটকীয় ভঙ্গিতে। তারা অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে সামান্য ভুল-ভ্রান্তিকে চিহ্নিত করে ধূলিকণাকে পাহাড়ে এবং বিন্দুকে সিন্ধু বানিয়ে পাঠকের সামনে পেশ করেছেন। তাদের প্রখর মেধা ও বুদ্ধির তীক্ষèতা ইসলামের চেহারাকে বিকৃত করার প্রয়াসে নিয়োজিত।’ (প্রাগুক্ত, পৃ. ১১) অনেক অমুসলিম আরবি ভাষাবিদ তাদের লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে সূক্ষ্ম কৌশলের আশ্রয় নেন, যা সাধারণ পাঠকের পক্ষে ধরা সম্ভব নয়।
প্রথমত, তারা একটি নির্দিষ্ট বিষয়কে টার্গেট করে নেন; অতঃপর তা অর্জনে জন্য বিভিন্ন তথ্য ও উপাত্ত জোগাড়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কেবল কুরআন, হাদিস, ফিক্হ ও ইসলামের সূত্রে নয় বরং উপন্যাস, উপাখ্যান, কল্প ও গল্পগ্রন্থের সূত্র সংগ্রহ করে ভাষার দক্ষতা ও উপস্থাপনার চাতুর্য দিয়ে পাঠকের হৃদয়-মনকে সম্মোহিত করার চেষ্টা চালান। পাঠককে তারা বুঝাবার চেষ্টা করেন যে, এ বিষয়ে তারাই গবেষণার সর্বশেষ অবলম্বন।
দ্বিতীয়ত, তারা ইসলামের ইতিহাসের কোনো প্রিয় সম্মানিত ব্যক্তিকে তাদের গবেষণার বিষয় হিসেবে বেছে নেন এবং তার দুর্বল দিকটুকু চিহ্নিত করেন চতুরতার সাথে। অতঃপর পাঠকের হৃদয়ে স্থান করে নেয়ার উদ্দেশ্যে ইসলামের ওই মর্যাদাবান ব্যক্তির বেশ কিছু ভালো দিক অত্যন্ত প্রশংসার সাথে উল্লেখ করেন। ফলে সাধারণ পাঠক লেখকদের উদারতার কারণে প্রভাবিত হয়ে পড়েন এবং দুর্বল দিকটি কবুল করে নেন স্বাভাবিকভাবে।
তৃতীয়ত, এসব অমুসলিম পণ্ডিত কোনো দেশের দাওয়াত, বিপ্লবী ব্যক্তিত্ব, পরিবেশ, পরিস্থিতি ও ঘটনাপ্রবাহের এমন ধারাবিবরণী তুলে ধরেন যাতে পাঠকের মনে ধারাণা জন্মায় যে, মূলত এসব আন্দোলন প্রকৃতিগতভাবে ও স্বাভাবিক নিয়মেই সফল হয়েছে। যেন অগ্নিকুণ্ড আগেই তৈরি করা, শুধু অপেক্ষা ছিল বিস্ফোরণের। দাওয়াতি আন্দোলনের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি পরিস্থিতির সুযোগ বুঝে ফুঁ দিয়েছেন অমনি আগুনের লেলিহান শিখা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। এর ফলে পাঠকের মন ঐশী শক্তির দিকে ধাবিত হয় না; এতে বিপ্লবী ব্যক্তির প্রাণান্তকর প্রয়াসের স্বীকৃতি মেলে না; দাওয়াতি কর্মকাণ্ডের প্রতি শ্রদ্ধা জাগে না এবং আন্দোলনের চূড়ান্ত সফলতার জন্য আল্লাহ পাকের অপরিহার্য সাহায্যের প্রতি আস্থা থাকে না। এভাবে অনেক অমুসলিম পণ্ডিত কুরআন, হাদিস, দর্শন, ইতিহাস, সাহিত্য ও ইসলামী আইনের পর্যালোচনা করতে গিয়ে অত্যন্ত সূক্ষ্ম কৌশল ও সচতুরতার সাথে সন্দেহের বীজ ঢুকিয়ে দেন, যাতে পরিচ্ছন্ন পাঠকের হৃদয়-মন অহেতুক সন্দেহের ছোঁয়ায় বিষিয়ে ওঠে। আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভি যর্থাথই মন্তব্য করেছেন, ‘ইহুদি খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী আরবি ভাষাবিদদের মধ্যে অনেকে তাদের প্রবন্ধ ও গ্রন্থাদিতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ বিষ অত্যন্ত সতর্কতার সাথে মিশিয়ে দেন, যা পরিমিত মাত্রার চাইতে যাতে বেশি না হয়, পাঠকের জন্য বিরক্তি উৎপাদনের কারণ না হয়ে দাঁড়ায় এবং পাঠককে যেন সচেতন ও সতর্ক করে না দেয়। অধিকন্তু এটা যেন ‘বিজ্ঞপণ্ডিত’-এর ন্যায়ানুগ নিরপেক্ষতা ও বিশুদ্ধ নিয়তকে সন্দেহপ্রবণ না করে তোলে। এভাবে প্রাচ্যবিদদের গ্রন্থাবলি অধিকতর ক্ষতিকারক ও বিপজ্জনক ওই সব বিরুদ্ধবাদী লেখকদের তুলনায় যারা খোলামনে দুশমনি প্রকাশ করে থাকেন।’ (প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬)
আরবি ভাষা ও ইসলামী সাহিত্য বিষয়ে অভিজ্ঞ, এ অমুসলিম পণ্ডিতদের প্রচেষ্টার আরেকটি লক্ষ্য হলো ভাষা ও ইসলামী আইন, সংস্কৃতি সম্পর্কে সংশয়ের জন্ম দেয়া, যাতে তারা যখন শিক্ষা সমাপ্ত করে দেশে প্রত্যাবর্তন করেবেন তখন তারা হবেন ইসলাম ও জীবন সম্পর্কে হতাশ; ইসলামী উম্মাহর বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে হবেন দ্বিধাগ্রস্ত ও সংশয়ী। পরবর্তী সময়ে পাশ্চাত্যে শিক্ষাপ্রাপ্ত এসব ব্যক্তি যখন নিজ দেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী হন তখন তারা ইসলামী শরিয়াহ আইনকে সংস্কার ও ইসলামের আধুনিকীকরণের পুরোধা বনে যান। পাঠক স্তম্ভিত হয়ে যাবেন যে, খ্রিষ্টীয় ১৮৮০ হতে ১৯৫০ পর্যন্ত এবং দেড় শ’ বছরে ইহুদি-খ্রিষ্টান পণ্ডিতগণ ইসলামসহ প্রাচ্যের বিভিন্ন বিষয়ে ৬০ হাজার পুস্তক প্রণয়ন করে পুরো দুনিয়াবাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন (ঊফধিৎফ ডরষষরধস ঝধরফ, ঙৎরবহঃধষরংস, ট. ঝ. অ. ১৯৭৮, ঢ়. ২০৪)। দীর্ঘকাল ধরে ইসলামী বিষয়াদির ওপর ইহুদি-খ্রিষ্টান পণ্ডিতরা যেসব কিতাব প্রণয়ন করেছেন, ইসলামী দুনিয়া ও আরব জগতের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও গবেষকগণ এসব গ্রন্থকে তত্ত্ব, তথ্য ও জ্ঞানের একমাত্র উৎস ও সূত্র হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। এটা কেবল পরিতাপের বিষয় নয়; বরং এতে মুসলমানদের দুর্বলতা, জ্ঞানের দীনতা ও আত্মবিশ্বাসের অভাবই প্রকট হয়ে ওঠে। প্রাচ্যদেশীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পণ্ডিতগণ প্রাচ্যবিদদের (ঙৎরবহঃধষরংঃ) লিখিত গবেষণাকর্মগুলোকে এড়ংঢ়বষ-এর মতো পবিত্র মনে করে থাকেন।
এসব আলোচনার প্রেক্ষাপটে প্রমাণিত হয় যে, ইহুদি-খ্রিষ্টান পণ্ডিতদের ইসলামী বিষয়ে ব্যাপক ও বহুমাত্রিক বুদ্ধিবৃত্তিক গবেষণা অনেকটা রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিদ্বেষপ্রসূত, গবেষণার ফলাফলে ইতিবাচক দিকের চাইতে নেতিবাচক দিকেরই প্রাধান্য ফুটে ওঠে। এ মুহূর্তে মুসলমানদের কী করা উচিত, কী পদক্ষেপ নেয়া দরকার, সেটিই মুখ্য বিষয় এবং সময়ের দাবি। এই জিজ্ঞাসার জবাব দিয়েছেন এই বিষয়ের গবেষক আল্লামা নদভি যা মুসলিম উম্মাহর ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনার ভূমিকা রাখে- ‘দাওয়াতি লক্ষ্যকে সামনে রেখে নিজস্ব অ্যাকাডেমি, দ্বীনি ফাউন্ডেশন ও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে সাহিত্য, রাজনীতি বিজ্ঞান, নীতিবিদ্যা, আইন ও ইসলামের ইতিহাস পুনঃরচনায় স্বয়ম্ভরতা অর্জনে এমনভাবে এগোতে হবে, যাতে কোনো অনুসন্ধিৎসু পাঠক বা নিবেদিত গবেষককে আরবি সাহিত্য ও সংস্কৃতির রচনায় কোনো নিকলসন, ব্রাউন, বা হিট্টির শরণাপন্ন হতে না হয়। ইসলামী শরিয়াহ, হাদিস, ও ফিকহের গবেষণায় কোনো গোল্ডজিহর বা শাখত-এর যেন প্রয়োজন না পড়ে। অথবা আরবি গদ্য ও পদ্যের বিভিন্ন ধারার তুলনামূলক বিশ্লেষণে কোনো মার্গুলিয়সের যেন সাহায্যের প্রয়োজন না হয়। (ঝধুুরফ অনঁষ ঐধংধহ অষর ঘধফযরি, ওংষধসরপ ঝঃঁফরবং ঙৎরবহঃধষরংস ধহফ গঁংষরস ঝপযড়ষধৎং-অওজচ, খঁপশহড়,ি ১৯৮৩, ঢ়. ১৭)
বর্তমান যুগে আলিমদের ইংরেজি ভাষা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা দু’শ’ ভাগ, এক শ’ ভাগ বললে কম হবে। ইন্টারনেট প্রযুক্তি হতে শুরু করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় ইংরেজির প্রভাব অপ্রতিহত ও অপ্রতিরোধ্য। ইংরেজিকে বাদ দিয়ে অথবা ইংরেজিকে অবজ্ঞা করে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা সম্পূর্ণ অসম্ভব। ইংরেজি ভাষা আধুনিক সভ্যতা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের চালিকাশক্তি ও কেন্দ্রবিন্দু। মাদ্রাসার মাধ্যমিক (ছানভিয়া) স্তর পর্যন্ত স্কুল টেক্সট বুক বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত ইংরেজি বই পাঠ্যতালিকাভুক্ত করা যেতে পারে। এ ছাড়া দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করার পর দুই বা এক বছর মেয়াদি শর্ট কোর্সের মাধ্যমে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে দক্ষতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। একজন সচেতন আলিমে দ্বীনকে মাতৃভাষা বাংলা, ধর্মীয় ভাষা আরবি ও আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজি শিখতে হবে। হালকাভাবে শিখলে চলবে না; দক্ষতা ও পারঙ্গমতার স্বাক্ষর রাখতে হবে।
মাদ্রাসা শিক্ষার বাইরে আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষার এক বিরাট-বিস্তৃত দিগন্ত রয়েছে, এসব বিষয় সম্পর্কে বেশির ভাগ ওলামায়ে কেরামের ধারণা দুর্ভাগ্যজনকভাবে অত্যন্ত সীমিত। ব্যতিক্রম ছাড়া বেশির ভাগ আলিম এগুলোকে আদৌ প্রয়োজন মনে করেন না বরং মনে করেন ‘অমর্যাদাকর’। বাছাইকৃত আলিমদের একটি অংশকে পৃথিবীতে চালু যত ধর্ম আছে বিশেষত ইসলাম, খ্রিষ্ট, ইহুদি, হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, জরথুস্ত্র, কনফুসিয়ানিজম সম্পর্কে ব্যাপক পড়ালেখা করতে হবে। এই সম্পর্কিত প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ থাকলে তা হাতছাড়া করা উচিত নয়। ইসলাম সম্পর্কে অমুসলিমদের যেসব অভিযোগ রয়েছে এগুলোর দালিলিক জবাব তৈরি করতে হবে। বক্তৃতার চাইতে কলমের আবেদন দীর্ঘস্থায়ী। বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রাসন প্রতিরোধে ‘কলম সৈনিক’ গড়ে তোলা সময়ের দাবি।
সঙ্গত কারণে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মধ্যযুগে মুসলমানগণ পবিত্র কুরআন, হাদিস, ফিক্হ ও দর্শনশাস্ত্র চর্চার পাশাপাশি ভূগোল, খগোল, জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থ, চিকিৎসা বিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে। মুসলমানগণ বিদেশী গ্রিক ভাষা ভাষা শিখে গ্রিক জ্ঞান-বিজ্ঞানকে আরবি ভাষায় তরজমা এবং প্রয়োজনীয় টীকা-টিপ্পনী সংযোজন করে জ্ঞানের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। তাদের উচ্চতর জ্ঞান সাধনার ফলে গোটা এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জ্ঞানের দীপ্তিতে আলোকিত হয়ে পড়ে। ইংরেজ পণ্ডিত ইবৎহধৎফ খবরিং তার বিখ্যাত ডযধঃ ডবহঃ ডৎড়হম? গ্রন্থে যে চমৎকার মন্তব্য করেছেন তা এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য, ‘বহু শতাব্দী ধরে মুসলিমবিশ্ব মানব সভ্যতার উন্নয়নে একেবারে পুরোভাগে ছিল। ইসলাম সর্বশ্রেষ্ঠ সামরিক শক্তি হিসেবে গোটা বিশজুড়ে প্রতিনিধিত্ব করেছে। ইসলামের সেনাদল একই সময়ে ইউরোপ, আফ্রিকা, ভারত ও চীনে অভিযান পরিচালনা করে। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে নৌযোগাযোগ ও বাণিজ্যিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিপুল দ্রব্যসামগ্রীর ব্যবসা সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে মুসলমানগণ সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। সভ্যতা, শিল্পকলা, ও বিজ্ঞানে মধ্যযুগের ইউরোপ ছিল মুসলমানদের সামনে ছাত্রের ন্যায় এবং আরবিতে ভাষান্তরিত অজানা গ্রিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের তথ্য-উপাত্তের জন্য ইউরোপীয় জনগোষ্ঠী পরোক্ষভাবে মুসলিম বিশ্বের ওপর নির্ভরশীল ছিল (খবরিং. ই.,ডযধঃ ডবহঃ ডৎড়হম? ঙীভড়ৎফ টহরাবৎংরঃু চৎবংং, ঘবি ণড়ৎশ, ২০০২, ঢ়ঢ়. ৩-৭; ৮১),
মধ্যযুগে মুসলমানগণ বিজ্ঞান ও চিকিৎসাশাস্ত্রে এত বেশি উন্নতি করে যে, ইবন সিনা লিখিত ‘কানুন আল মাসউদি’ (আরপবহহধদং ঈধহড়হ ড়ভ গবফরপরহব) ইউরোপের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আবশ্যকীয় পাঠ্যগ্রন্থ হিসেবে অন্তর্ভুক্তি লাভ করে। ধর্মীয় ইল্মের চর্চা ও আধুনিক জ্ঞান গবেষণার বহুমাত্রিকতার ফলে আল ফারাবি, আল গাযালি, ইব্ন তাইমিয়া, আল বেরুনি, আল কিন্দি, ইবন মিশকাভী ও উমর খৈয়ামের মতো পণ্ডিতগণ দুনিয়াব্যাপী খ্যাতি লাভ করেন। মধ্যযুগে মুসলমানরা যেমন বিশ্বসংস্কৃতি ও সভ্যতার মালিক ছিলেন, আধুনিক সংস্কৃতি, তথ্য-প্রযুক্তি ও মিডিয়ায় তেমনি তাদের অপ্রতিহত প্রভাব রাখতে হবে। আল্লাহ তা’আলা মানবজাতির হেদায়াতের জন্য যত নবী ও রাসূল প্রেরণ করেন তাদের প্রত্যেকেই সমসাময়িক প্রতিপক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে যুগের চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করেছেন সার্থকতার সাথে।
নবীর উত্তরাধিকারী হিসেবে আলিমদেরও শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এগিয়ে আসতে হবে। নিজেদের দুর্বলতা ও ত্রুটির প্রতি লক্ষ রেখে মুসলিম উম্মাহর মেধাবী সন্তানদের, বিশেষত আলিমদের এগিয়ে আসতে হবে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জ্ঞানের ভাণ্ডারকে আত্মস্থ করার মহান ব্রত নিয়ে। আধুনিক সমাজের আবিষ্কার ও অভিজ্ঞতাকে বিজ্ঞান গবেষণা, তথ্য-প্রযুক্তি, সাংবাদিকতা, যোগাযোগ ও শিক্ষা ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হবে। শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষমতা অর্জনের জন্য আমাদের সেই আত্মবিশ্বাস ও হারানো আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে; যে বিশ্বাস ও আস্থার ফলে মধ্যযুগে মুসলমানগণ যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সফল হয়েছিলেন। কর্মকৌশল ও পরিকল্পনার মাধ্যমে, প্রশাসন, অর্থনীতি, বাণিজ্য, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াকে আমাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে এবং তৈরি করতে হবে দক্ষ মিডিয়াকর্মী। ইসলামকে বিজয়ী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে আলিম সাংবাদিক, লেখক, প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী, গবেষক ও চিকিৎসক তৈরি করা ছাড়া বিকল্প পথ নেই। বিশেষজ্ঞ আলিম তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশের আলিম সমাজকে আগামী দিনের সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতির মোকাবেলার জন্য এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। বিপদ ও সঙ্ঘাত মানুষের মনে নব চেতনার সঞ্চার করে, বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগায়। হ
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক

 


আরো সংবাদ



premium cement
ডিএমপির অভিযানে গ্রেফতার ৩৭ বাংলাদেশে নতুন করে বাড়ছে ম্যালেরিয়া আক্রান্তের সংখ্যা হিট অ্যালার্ট নিয়ে আবহাওয়া অধিদফতরের নতুন বার্তা ভান্ডারিয়ায় পিকআপ চাপায় বৃদ্ধ নিহত হোচট খেল লিভারপুল, পিছিয়ে গেল শিরোপা দৌড়ে যোদ্ধাদের দেখতে প্রকাশ্যে এলেন হামাস নেতা সিনওয়ার! ফের পন্থ ঝড়, ঘরের মাঠে গুজরাটকে হারাল দিল্লি ইউক্রেনকে গোপনে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র গ্রেফতারের পর যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফিলিস্তিনপন্থীদের বিক্ষোভ আরো বেড়েছে ইউক্রেন যুদ্ধে দুর্নীতি, পুতিনের নির্দেশে গ্রেফতার রুশ উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী!  আমেরিকানরা কি ধর্ম থেকে সরে যাচ্ছে?

সকল