২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

‘হক কথা’ সমাজ থেকে উঠে গেছে

সময়-অসময়
-

‘হক কথা’ সমাজ থেকে উঠে গেছে, মানুষ ‘হক কথা’ অর্থাৎ ন্যায্য কথা বা দোষীকে দোষী এবং নির্দোষকে নির্দোষ বলার মানসিকতা হারিয়ে ফেলেছে। ফলে ‘সত্য’ সমাজ থেকে ‘বিদায়’ হওয়ার পর প্রভাবশালীদের দ্বারা ভিকটিম হচ্ছে সমাজের নিরীহ, নিপীড়িত মানুষ এবং প্রভাবশালীদের ভয়ে ভিকটিমদের পক্ষে সাধারণ মানুষ এখন আর কথা বলে না। ঘটনায় প্রত্যক্ষ সাক্ষী থাকলেও, সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে আসে না, কারণ রাষ্ট্র তাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। এর পেছনের কারণ আরো জঘন্য। কারণ ‘টোকাই’দের প্রভাবশালী হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে রাষ্ট্র। সন্ত্রাসীদের নিরাপত্তার বিধান করছে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায়। রাষ্ট্র সরকারি দালালদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করে না, আইন প্রয়োগ করা হয় শুধু বিরোধী দলের বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রীয় বাহিনী কাউকে কখন ধরে নিয়ে যায় তা কেউ বলতে পারে না। হত্যা করে বলবে যে, ক্রসফায়ারে মৃত্যুবরণ করেছে। মিডিয়া প্রকাশ করলে দেশবাসী রাষ্ট্র কর্তৃক সংগঠিত অপরাধগুলো জানতে পারে, নতুবা নয়।
দেশের স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানরা যখন জনস্বার্থবিরোধী কথা বলেন, তখন তাদের প্রতি জনগণের করুণা করা ছাড়া শ্রদ্ধাবোধ জাগে না। কারণ তাদের (সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান) অপকর্ম ঢাকা দেয়ার জন্য মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে বলে জনগণের শ্রদ্ধা উঠে গেছে। জনগণকে ভোটকেন্দ্রে নিতে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ হচ্ছে, তার পরও গালভরা মিথ্যা বুলির ঝুলি বন্ধ হচ্ছে না।
যখন দেশ ও জাতির ভাগ্য চাটুকারবেষ্টিত প্রভাবশালীদের হাতে বন্দী তখন প্রাকৃতিক নিয়মে ‘হক কথা’ বলার জন্য কাউকে না কাউকে দাঁড়াতে হয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে যখন গণতন্ত্র হরণ করা হয়েছে তখন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ‘হক কথা’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। ভাসানীর ‘হক কথা’ প্রকাশিত হওয়ার বহু বছর আগে ১৯২০ সালের জুনের দিকে বিট্রিশবিরোধী বিপ্লবী দল ‘অনুশীলন সমিতির’ প্রভাবশালী নেতা পুলিন বিহারী দাসের প্রতিষ্ঠিত ‘ভারত সেবক সংঘ’-এর মুখপাত্র হিসেবে ‘হক কথা’ নামে একটি স্বল্পকালস্থায়ী পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল, যার সম্পাদক ছিলেন নলিনী কিশোর গুহ। গান্ধীজি এবং তার অনুসারীদের প্রতি বিরূপ না হয়েও অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের কার্যকারিতা এবং ভুলত্রুটি তুলে ধরে ‘হক কথা’য় বিভিন্ন সমালোচনামূলক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রিকাটিতে দেশাত্মবোধের ভিত্তিতে হিন্দু-মুসলমান মিলনের আহ্বান জানানো হয়েছিল বটে, কিন্তু উচ্চবর্ণের হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক মানসিকতার কারণে তা বাস্তবায়ন হয়নি।
হকের পথ অর্থাৎ সত্যের পথে মানুষকে আসতে হবে, নতুবা দুর্দশা থেকে সাধারণ মানুষের মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিনা ঘুষে কোনো সেবা পাওয়া যায় না। সরকারি কর্মকর্তা সরকারদলীয় পছন্দের লোকদের অপকর্মের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে না। ফলে অনাচার, অবিচার, খুন, ধর্ষণ, গণধর্ষণ বন্ধ হচ্ছে না। এর মূল কারণ, সমাজ থেকে ‘হক কথা’ উঠে গেছে।
পবিত্র কুরআন মজিদে আল্লাহ পাক বলেছেন, ‘মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত, কিন্তু উহারা নয়, যাহারা ঈমান আনে ও হক পথে থাকে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈর্যের উপদেশ দেয়।’ হক পথে থাকা এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয়া সৃষ্টিকর্তার একটি নির্দেশ। তিনি বলেছেন, হক পথে যারা থাকবে না, সৎকর্মের পরামর্শ দেবে না, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত। পৃথিবী বা সমাজের অধিকাংশ মানুষই হক পথে না থাকায় সমাজে আজ এত বিপর্যয়।
মানুষ ভোটাধিকার হারিয়েছে, হারিয়েছে গণতান্ত্রিক অধিকার, হারিয়েছে সাংবিধানিক অধিকার, বঞ্চিত হচ্ছে মৌলিক অধিকার থেকে, বঞ্চিত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সেবা থেকে। কোথাও কোথাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সন্ত্রাসীদের দোসর হিসেবে কাজ করছে। সমাজের চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা যদি সরকারি দলের হয় তবে তাদের দ্বারা সংঘটিত কোনো অপরাধ আইন আমলে আসে না (মিডিয়াতে প্রকাশিত কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, মুখ রক্ষার জন্য সরকার যা করে থাকে)। সরকারি সন্ত্রাসী বাহিনী কর্তৃক বিরোধী দলের ওপর আক্রমণ হলে পুলিশ বলে যে, জানি না, শুনিনি।’ অথচ পুলিশকে ম্যানেজ করেই সরকারি দলভুক্ত সন্ত্রাসীরা সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে। পত্রিকান্তরে ধর্ষণ বা গণধর্ষণের যত ঘটনা ঘটছে তা ঘটছে সরকারি দলের লোকজন দ্বারা এবং সেটি সংঘটিত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় আশ্রয় প্রশ্রয়ে। কারণ রাষ্ট্রযন্ত্র যখন হক পথে থাকে না, হক কথা তাদের মুখ দিয়ে প্রকাশ পায় না, বরং প্রকাশ পায় শুধু তোষামোদি।
পবিত্র কুরআন মজিদের প্রথম সূরার প্রথম লাইনে বলা হয়েছে, ‘সব প্রশংসার মালিক আল্লাহ (সৃষ্টি কর্তা)।’ অথচ যার কর্ম যতই খারাপ ও নিন্দনীয় হোক না কেন, যদি তার শক্তি থাকে তবে আমাদের সমাজ সে খারাপ বা নিন্দনীয় কাজের সমালোচনা না করে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে যায়, ফলে খারাপ লোকটি আরো নিন্দনীয় কাজের দিকে অধিকতর অগ্রসর হতে থাকে। এ ভাবেই নিন্দনীয় লোকেরা সমাজে প্রভাবপ্রতিপত্তি অর্জন করে মহীরুহতে পরিণত হয়।
সামাজিক প্রতিরোধ ছাড়া কোনো সমাজ অনাচারমুক্ত হয়নি। প্রভাবশালী অত্যাচারীদের হাত থেকে জাতি ও রাষ্ট্রকে রক্ষা করার জন্য একটি গণজাগরণ দরকার; পৃথিবীর ইতিহাস এটাই সাক্ষ্য দেয়। নতুবা ‘হক কথা’ বেহক কথায় পরিণত হবে এবং এর প্রতিফল সবাইকেই ভোগ করতে হবে।
একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বিনিময়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি স্বাধীন হয়েছেন। ফলে জাতি পেয়েছে একটি সংবিধান। ‘সংবিধান’ একটি দলিল যা জনগণ ও রাষ্ট্রের মধ্যে একটি চুক্তি। এই চুক্তির ২১(২) অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে যে, ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।’ কিন্তু প্রজাতন্ত্রের নিযুক্ত আমলারা প্রভাবশালীদের সেবাদাসে পরিণত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের (বধিরদের) জন্য একটি ‘বধির কমপ্লেক্স’ স্থাপন করার জন্য ২০০৫ সালে রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ জাতীয় বধির সংস্থাকে লালবাগে ১ একর ১ শতাংশ জমি প্রতীকী মূল্যে রেজিস্ট্রিকৃত দলিলমূলে বরাদ্দ দেন। ওই দলিলে রাষ্ট্রপতির পক্ষে জেলা প্রশাসক, ঢাকা, রাষ্ট্রপতির পক্ষে স্বাক্ষর করে দলিল সম্পাদন করেছেন। কিন্তু ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সরকারদলীয় এমপি হাজী সেলিম ওই জমি জোর করে দখল করে নেন। জাতীয় বধির সংস্থা মানববন্ধন, সাংবাদিক সম্মেলন, জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে জমিটি উদ্ধারের জন্য আকুল আবেদন জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনেক আবেদন নিবেদন করেছে। কিন্তু সেলিমের ওই অবৈধ দখলের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী বা প্রশাসনিক কর্মকর্তারা কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা তো দূরের কথা জমির অবৈধ দখল ছেড়ে দেয়ার জন্য একটি নোটিশ বা চিঠি পর্যন্ত প্রদান করেনি। জমির দখল নেয়ার জন্য বধির সমাজের পক্ষে জেলা প্রশাসক, ঢাকার নিকট যতবারই যাওয়া হয়েছে ততবারই হাজী সেলিমের নাম শুনলে জেলা প্রশাসক ও প্রশাসনিক আমলারা চুপসে গেছেন। যে প্রশাসন প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দকৃত সরকারি জমি প্রভাবশালীদের কবল থেকে উদ্ধার করতে পারে না, সেই আমলা নামক শ্বেতহস্তীদের জনগণের অর্থে লালন পালন করে লাভ কী?
প্রশাসনের কাছে দেশের জনগণ গিনিপিগে পরিণত হয়েছে। কারণ প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের একমাত্র জ্ঞান ও ধ্যান হলো প্রভাবশালীদের তুষ্ট রাখা, বিনিময়ে অঢেল বিত্ত-বৈভবের মালিক হওয়ার বাসনা। একটি জাতি কেন স্বাধীন হওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়, এ বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার। শেরশাহ আমলেও উন্নয়ন হয়েছে, মোগল আমলে উন্নয়ন হয়েছে, তখনকার প্রযুক্তি মোতাবেক যার যার সাধ্যমতো উন্নয়ন হয়েছে। ওই সময়ে পুকুর বা দীঘি খনন, বিশুদ্ধ পানির জন্য কুপ খনন, মেঠোপথে রাস্তা করে দেয়াই ছিল উন্নয়নের মূলধারা। প্রযুুক্তিকে ব্যবহার করে শেরশাহ ‘ডাক বিভাগ’ চালু করেছেন। কথিত আছে যে, বাংলার তৎকালীন রাজধানী সোনারগাঁও থেকে লাহোর পর্যন্ত তিনি রাস্তা নির্মাণ করেছিলেন যার নাম ‘গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড’, যা ইতিহাসে আমরা পেয়েছি। ব্রিটিশ, পাকিস্তান নিজেদের সাধ্যমতো তাদের পছন্দমাফিক উন্নয়ন করেছে বটে, কিন্তু জনগণকে অধিকারবঞ্চিত করে রেখেছিল। জনগণের প্রথম চাহিদা ১. মৌলিক অধিকার ২. জন্মগত অধিকার ৩. সাংবিধানিক অধিকার। সংবিধানে নিশ্চিত করে বলা হয়েছে, স্বাধীন রাষ্ট্রের একজন নাগরিক কতটুকু অধিকার ভোগ করতে পারবে। মানুষ জন্মগ্রহণের সময়ই কিছু অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু সে ‘অধিকার’ বাস্তবায়ন থেকেও এখন গণমানুষ বঞ্চিত। মানুষ তাদের অধিকার আদায়ের জন্যই যুগে যুগে রক্ত দিয়েছে, যুদ্ধ করেছে। উন্নয়ন হলো দ্বিতীয় ধাপের চিন্তা। মেগা উন্নয়নের সাথে মেগা লুটপাটের খবর পত্রিকায় পাওয়া যায়। জনগণকে অধিকারবঞ্চিত করে জনগণের টাকায় উন্নয়নের বুলি ধোপে টিকে না। একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক যদি সংবিধানপ্রদত্ত ‘অধিকার’ ভোগ করতে না পারে তবে সে স্বাধীনতা সোনার খাঁচায় বন্দী পাখির স্বাধীনতারই নামান্তর। হ
লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয় বধির সংস্থা
ঊ-সধরষ: ঃধরসঁৎধষধসশযধহফধশবৎ@মসধরষ.পড়স


আরো সংবাদ



premium cement
ড. ইউনূসের ইউনেস্কো পুরস্কার নিয়ে যা বললেন তার আইনজীবী একনেকে ৮৪২৫ কোটি টাকার ১১ প্রকল্প অনুমোদন সান্তাহারে ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে যুবক নিহত জলবায়ু সহনশীল মৎস্যচাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে পদক্ষেপ নেয়া হবে : আব্দুর রহমান যুক্তরাষ্ট্রের সেতু ভাঙ্গার প্রভাব পড়বে বিশ্বজুড়ে! নাশকতার মামলায় চুয়াডাঙ্গা বিএনপি-জামায়াতের ৪৭ নেতাকর্মী কারাগারে হারল্যানের পণ্য কিনে লাখপতি হলেন ফাহিম-উর্বানা দম্পতি যাদের ফিতরা দেয়া যায় না ১৭ দিনের ছুটি পাচ্ছে জবি শিক্ষার্থীরা বেলাবতে অটোরিকশা উল্টে কাঠমিস্ত্রি নিহত রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জাতিসঙ্ঘের প্রতিবেদন

সকল