১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দৃষ্টিপাত : মক্তবশিক্ষা ও শিশুর ধর্মীয় মূল্যবোধ

-

ইসলামের প্রথম যুগে ধর্ম বা দ্বীনের চর্চা ছিল মসজিদভিত্তিক। মক্কায় গোপনভাবে এর সূচনা হলেও মদিনায় হিজরতের পর মসজিদে নববীই ছিল দ্বীনি ইলমের প্রধান কেন্দ্র। এরপর বিভিন্ন এলাকায় নতুন মসজিদ নির্মিত হলে ইলম চর্চার প্রসার ঘটতে থাকে। মদিনার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলো একেক করে মুসলমানদের দখলে আসার পর যখন মিসর, ইরাক, দামেস্ক ইত্যাদি দূরদেশ বিজিত হয় তখন সেসব দেশেও মসজিদভিত্তিক শিক্ষার ধারা অব্যাহত থাকে।
৩৯০ হিজরিতে সুলতান মাহমুদ গজনবী ভারত জয় করেন এবং এখানে মসজিদ-মাদরাসা স্থাপনে ব্রত হন। ৪০৯ হিজরিতে উত্তর ভারতের কনৌজ বিজয়ের পর গজনীতে ফিরে এসে তিনি একটি আকর্ষণীয় মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন। বাংলায় মুসলিম ছেলেমেয়েদের শিক্ষার প্রয়োজন মেটাতে ‘মক্তব’ শিক্ষার কেন্দ্র ছিল খানকা, মসজিদ, মক্তব, মসজিদের চত্বরে; আবার কখনো কখনো কোনো মুসলমানের কাচারিঘর বা বৈঠকখানা। শিশুদের কুরআন মজিদ ও দ্বীনের মৌলিক বিষয় শিক্ষাদানের জন্য বর্তমানে আরো কয়েকটি ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এদের মধ্যে প্রাইমারি, মক্তব, নূরানি শিক্ষা, নাদিয়াতুল কুরআন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। মক্তব শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলোÑ দ্বীনি বিষয়ে মৌলিক শিক্ষাদান, সহিহ শুদ্ধরূপে কুরআন মজিদ পড়তে পারা এবং তার কিছু অংশ মুখস্ত করা। বিষয়ভিত্তিক কিছু হাদিস ও দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় মাসআলা-মাসায়েল ইত্যাদি এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধান পাঠ্যসূচি। তবে একটি শিশু অতি অল্প সময়ে দ্বীনের মৌলিক জ্ঞান লাভ করে এবং আল্লাহ রাসূল সা:-এর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রেরণা তার কোমল হৃদয়ে জাগ্রত হয়। মূলত শিশুদের দ্বীন ও ঈমানের সাথে পরিচিত করাই এসব প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য। বর্তমান সময়ে এসব মক্তবের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে। কেননা, বর্তমান প্রজন্ম কুরআন-সুন্নাহর ইলম ও ইসলামী আদর্শ থেকে দূরে সরে শুধু বৈষয়িক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠেছে। অর্থ উপার্জন হয়ে দাঁড়িয়েছে জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য। ফলে সুদ-ঘুষ, দুর্নীতি, অন্যায় ও অনৈতিক কাজের প্রসার ঘটেছে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, খুন, ধর্ষণ ইত্যাদির ব্যাপকতায় শান্তিশৃঙ্খলা হারিয়ে গেছে। অথচ যারা এসব কাজে জড়িত তাদের প্রায় সবাই জাগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত। উচ্চশিক্ষিত ও মেধাবী হয়েও ইসলামী জ্ঞান ও আদর্শের অভাবেই তারা এসব অসামাজিক ও অনৈতিক কাজে জড়িত হয়ে পড়ছে। মানবজীবনের প্রতিটি বিষয় নিয়েই রয়েছে ইসলামের স্বতন্ত্র নীতিমালা। শিশু, যুবক, প্রৌঢ়, সব স্তরের মানুষের জন্য রয়েছে পৃথক পৃথক কল্যাণধর্মী ও সময়োপযোগী বিধান। আর এ জন্য ইসলাম প্রয়োজনীয় ইলম অর্জন করাকে অপরিহার্য করে দিয়েছে যেন অজ্ঞতার অজুহাতে ইসলামের কোনো বিধান অসম্পন্ন থেকে না যায়। ইলম অর্জনের অপরিহার্যতা সম্পর্কে হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছেÑ ‘প্রতিটি মুসলিমের জন্য ইলম অন্বেষণ করা ফরজ।’ (মিশকাত শরিফ) তাই একজন মুসলমান প্রাপ্ত বয়সে উপনীত হওয়ার পর অজ্ঞতার অজুহাতে শরিয়তের কোনো হুকুম পালনে অলস বা উদাসীন যেন না হয় এ জন্য শৈশব থেকেই তাদের দ্বীনি ইলম শিক্ষা দেয়ার তাকিদ দেয়া হয়েছে। আর এ দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে অভিভাবকদের ওপর। নিজ সন্তানের তালিম-তরবিয়তসহ যাবতীয় বিষয় নিশ্চিত করতে অভিভাবকদের কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কুরআন মজিদে ইরশাদ হচ্ছে, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা নিজেকে ও নিজের পরিবার-পরিজনকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো।’ (সূরা তাহরিম, আয়াত-৬) হাদিস শরিফে আছেÑ ‘তোমরা সবাই দায়িত্বশীল আর প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।’ (বুখারি শরিফ)
সুতরাং অভিভাবকদের কর্তব্য হলো, শৈশবেই সন্তানকে দ্বীনের মৌলিক জ্ঞানদান এবং তাদেরকে ইবাদতের প্রতি উৎসাহী করে তোলা; বিশেষ করে নামাজের। ছোটকাল থেকেই সন্তানদের নামাজের মাসআলা- মাসায়েল শিক্ষা দেয়া এবং নামাজের ব্যাপারে অভ্যস্ত করে তোলা উচিত। শিশুর বয়স ১০ বছর হলে এ জন্য প্রয়োজনে প্রহারের কথাও হাদিসে রয়েছে। কারণ, শৈশবে শিশুর মন-মস্তিষ্ক থাকে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ ও নিষ্কলুষ। এ সময়ে শিশুরা যা শুনে বা শেখে সবই তার কচি মনে রেখাপাত করে এবং তার স্মৃতিতে স্থায়িত্ব লাভ করে। শৈশবকালই হচ্ছে একটি শিশুর ঈমান-আমল শিক্ষালাভের উপযুক্ত সময়। মনে রাখতে হবে, ধর্মের মৌলিক ও প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জনের পর বৈষয়িক কিংবা জাগতিক কোনো জ্ঞান লাভ করা নিষিদ্ধ নয়। তবে এই শিক্ষাগ্রহণ ও কর্মক্ষেত্রে তার প্রয়োগের বেলায় ইসলামের আদর্শ ও বিধিনিষেধ মেনে চলাও আবশ্যক। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামী আদর্শ ও অনুশাসনের ব্যাপারে সচেতন থাকা একান্ত প্রয়োজন। প্রত্যেক মা-বাবার জন্য এই অনুধাবন খুবই জরুরি যে, আপন সন্তানের ধর্মীয় মূল্যবোধ গড়ে তোলার গুরুদায়িত্ব মা-বাবার ওপর ন্যস্ত। আগের মতো এখনো শহর-গ্রামসহ দেশের সর্বত্র মসজিদভিত্তিক মক্তব পরিচালিত হয়ে আসছে। তবে কোনো কোনো অঞ্চলে স্থানীয়দের সম্মিলিত উদ্যোগে বা কোনো দানশীল ধর্মানুরাগী ব্যক্তির উদ্যোগে নানা ধরনের শিশুশিক্ষার কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মানোন্নয়ন ও গঠন-পঠনরীতি সহজীকরণের লক্ষ্যে মক্তব শিক্ষকদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও গড়ে উঠেছে। তার মধ্যে নূরানি তালিমুল কুরআন, নাজাতুল উম্মাহ ও খুদ্দামুল কুরআন বিশেষভাবে উল্লেøখযোগ্য।
এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে শিক্ষকরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শিশুদের উন্নত ও সহজ পদ্ধতিতে কুরআন মজিদ পাঠদানে নিয়োজিত রয়েছেন। বর্তমান বিশ্বের সব আবিষ্কার ও গবেষণা পরবর্তী প্রজন্মকে ঘিরে। পরবর্তী প্রজন্মের জীবনযাপনের ধরন, তাদের সংস্কৃতি আদর্শ ও প্রযুক্তি কী হবেÑ এসব নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চলছে অথচ মুসলমান হয়ে শুধু আমরাই পিছিয়ে। আগামী প্রজন্মের শিক্ষা-দীক্ষা, চরিত্র ও নৈতিকতার বিষয়ে আমাদের যেন বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই। অথচ আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদের কাঁধে। তাদের ধর্মীয় শিক্ষা নিশ্চিত করা আমাদের কর্তব্য। মনে রাখা উচিত, আজকের শিশুরাই আগামীর অভিভাবক। আর অভিভাবক নিজেই যদি দ্বীনি ইলম থেকে বঞ্চিত থাকেন, তাহলে সন্তানও যথাযথ ধর্মীয় জ্ঞান লাভ করতে পারবে না; যেমনটি বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অভিভাবকদের উদাসীনতা কিংবা তাদের অলসতায় আজকের অভিভাবকরা শৈশবে ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষা না করায় এর প্রভাব তাদের সন্তানদের ওপর পড়েছে। এভাবে যদি শৈশব থেকেই শিশুর ধর্মীয় শিক্ষা নিশ্চিত করা না হয়, তাহলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধর্মীয় শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাবে। তখন অন্যায়, অত্যাচার, দুর্নীতি ইত্যাদি অনৈতিক ও অসামাজিক কাজ নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হবে। সবচেয়ে বড় কথা, অভিভাবককে সন্তানদের ব্যাপারে জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। তাই আমাদের উচিত, পরবর্তী প্রজন্মের কথা ভেবে তাদের ধর্মীয় শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্বিক সহযোগিতায় সর্বদা সচেষ্ট থাকা। হ
লেখক : উপাধ্যক্ষ, রোকনউদ্দিন মোল্লøা গার্লস ডিগ্রি কলেজ, আড়াইহাজার, নারায়ণগঞ্জ
ঊ-সধরষ: সধৎধযসধহথনরঁ@ুধযড়ড়.পড়স


আরো সংবাদ



premium cement