২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

রাজনীতিতে তোষামোদ, সুশাসনে প্রতিবন্ধক

-

মানব ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকেই তোষামোদ অর্থাৎ চামচামি চলে আসছে। প্রথম মানুষ আদম আ:-এর সাথে প্রথম তোষামোদ করে ইবলিশ। আদম আ:কে তোষামোদের মাধ্যমে বোঝাতে সক্ষম হয়, ইবলিশ তাঁর হিতাকাক্সক্ষী। জান্নাতে বিদ্যমান একটি গাছের ব্যাপারে ইবলিশ বলেছিল সেটি থেকে খেলে আপনি জান্নাতে চিরস্থায়ীভাবে থাকতে পারবেন। ইবলিশের কথায় প্রভাবিত হয়ে আদম আ: গাছ থেকে খেয়ে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করায় জান্নাত থেকে পৃথিবীতে প্রেরিত হন।
তোষামোদের প্রতিশব্দ ‘চামচা’। শব্দটি এসেছে ফারসি ‘চমচহ’ থেকে। বাংলা অভিধানে, বিভিন্ন নামে শব্দটির প্রচলন রয়েছে। যেমন : চাটুকার, তৈলবাজ, তোষামোদি, মোসাহেব, চেলা, পাচাটা, দালাল ইত্যাদি। ইংরেজিতে বলে, ণবং সধহ, টহফবৎষরহম, ঝুপড়ঢ়যধহঃ, বঃপ. ক্ষমতার সাথে চামচামি বা তোষামোদের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। উপমহাদেশে অশোক, চন্দ্রগুপ্ত, সুলতানী, মোঘল আমল কিংবা তার আগ থেকেই চামচামির জয়যাত্রা শুরু। বিশেষ করে সিরাজ-উদদৌলার পতন এবং উপমহাদেশে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠায় তোষামোদের একটি ভূমিকা ছিল। বাংলাদেশে বিভিন্ন সরকারের আমলে ক্ষমতাসীনদের চামচামি করে অনেক চামচাই অঢেল ধনসম্পদের মালিক হয়েছে। তাই, দেখা যায়, শাসকের উত্থান-পতন ঘটলেও তোষামোদকারী বা চামচারা টিকে থাকে সগৌরবে।
চামচামির নানা পরিক্রমার মধ্য দিয়ে এ উপমহাদেশে প্রায় সাড়ে সাত শ’ বছরের মুসলিম অবসান ঘটে, ব্রিটিশদের হাতে। জাতিগতভাবে মুসলিমদের রক্তে এক দিকে শাসকশ্রেণীর আভিজাত্যবোধ, অপর দিকে ধর্মীয় নৈতিকতার কারণে মুসলিমরা ব্রিটিশদের মনোরঞ্জনে চামচামি করতে পারেনি। চামচামির সুযোগটি সহজেই রপ্ত করতে পেরেছিল ‘বর্ণবাদী হিন্দুরা’। তারা ব্রিটিশ রাজ সরকারের চামচামির মাধ্যমে সব ধরনের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা গ্রহণে ছিল অগ্রগামী। শিক্ষা-দীক্ষা, সরকারি চাকরি, জমিদারিপ্রাপ্তি সব কিছুতেই তারা ছিল এগিয়ে। অপর দিকে, মুসলিমরা রাজক্ষমতা হারিয়ে, বিদেশী শিক্ষা গ্রহণ, সরকারি চাকরি এবং জমিদারি প্রাপ্তিতে একেবারেই পশ্চাৎপদ।
চামচামি নিয়ে সাহিত্য
একশ্রেণীর বর্ণবাদী গোষ্ঠী তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের হালুয়া-রুটির আশায় যেভাবে চামচামি করেছেন, তা দেখে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাজ্জব হয়ে ব্যঙ্গ কবিতা লিখলেন:
“সাহেব কহেন, ‘চমৎকার! সে চমৎকার!’/মোসাহেব বলে, ‘চমৎকার সে হতেই হবে যে!/ হুজুরের মতে অমত কার?’/ সাহেব কহেন, ‘কী চমৎকার,/ বলতেই দাও, আহা হা!’/ মোসাহেব বলে, ‘হুজুরের কথা শুনেই বুঝেছি,/ বাহাহা বাহাহা বাহাহা!’/ সাহেব কহেন, ‘কথাটা কি জান? সেদিন -’/ মোসাহেব বলে, ‘জানি না আবার?/ ঐ যে, কি বলে, যেদিন -’/ সাহেব কহেন, ‘সেদিন বিকেলে/ বৃষ্টিটা ছিল স্বল্প।’ মোসাহেব বলে, ‘আহা হা, শুনেছ?/ কিবা অপরূপ গল্প!’ ... .../ সাহেব কহেন, ‘কি বলছিলাম,/ গোলমালে গেল গুলায়ে!’/ মোসাহেব বলে, ‘হুজুরের মাথা! গুলাতেই হবে।/ দিব কি হাত বুলায়ে?’/ সাহেব কহেন, ‘শোনো না! সেদিন/ সূর্য্যটা উঠেছে সকালে!’/ মোসাহেব বলে, ‘সকালে সূর্য্য? আমরা কিন্তু/ দেখি না কাঁদিলে কোঁকালে!’/... ..সাহেব কহেন, ‘জাগিয়া দেখিনু, জুটিয়াছে যত/ হনুমান আর অপদেব!’/ ‘হুজুরের চোখ, যাবে কোথা বাবা?’/ প্রণামিয়া কয় মোসাহেব ॥”
মানুষের সন্তুষ্টি অর্জনে যেখানে শক্তি, বিদ্যা, ধন-কৌশল প্রভৃতি কোনো কাজে আসে না, তখন তেল সেখানে বেশ কাজে দেয়। তেল হলো মিথ্যা প্রশংসা, যা দিয়ে স্বার্থসিদ্ধি করা যায়। কলেজ জীবনে পাঠ্যপুস্তকে আমরা হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘তৈল’ নামে একটি রম্যরচনা পড়েছি। সেখানে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তেলবাজদের চমৎকার চিত্র অঙ্কন করেছেন। তিনি লিখেছেন, “বাস্তবিকই ‘তেল’ সর্বশক্তিমান। যে এই শক্তিমান তেল ব্যবহার করতে জানে, সে সর্বশক্তিমান। তাহার কাছে জগতে সব কাজই সোজা, তাহাকে চাকুরির জন্য ভাবিতে হয় না। ... যে জায়গামতো তেল দিতে পারিবে তাহার বিদ্যা না থাকিলেও সে প্রফেসর হইতে পারে, আহম্মক হইলেও ম্যাজিস্ট্রেট হতে পারে। সাহস না থাকিলেও সেনাপতি হইতে পারে।” চামচামির ওপর প্রখ্যাত রম্যলেখক আবুল মনসুর আহমেদ ও সৈয়দ মুজতবা আলীর অনেক রম্যরচনা আছে।
রাজনীতিতে তোষামোদ বা চামচামি
বাংলাদেশের রাজনীতিতে চামচামি বা তোষামোদ একটি অবিচ্ছেদ্য উপাদান। চামচামি ছাড়া রাজনীতি সে তো অসম্ভব বিষয়। নেতা যত বড় এবং ক্ষমতাধর তার চামচাও তত বেশি। চামচা ছাড়া নেতা চলতে পারেন না, মর্যাদাও যেন বাড়ে না। চামচা তার চামচামির দ্বারা প্রমাণ করে দিবেন তিনি কত বড় নেতা। এই চামচামির দুটো ধরন আছে। এক. ক্ষমতাসীন দলের চামচা, দুই. বিরোধী দলের চামচা।
ক্ষমতাসীন দলের চামচা
ক্ষমতাসীনদের চামচামি করে চামচারা অবৈধ, অনৈতিক সুযোগ গ্রহণ করে। চামচার সাথে দুর্নীতির একটি নিবিড় সম্পর্ক আছে। চামচামির উদ্দেশ্য কিভাবে ক্ষমতাসীন নেতাকে বাগিয়ে দুর্নীতি করা যায়। এই উদ্দেশ্য হাসিলে কেউ বুদ্ধিবৃত্তিক তোষামোদের আশ্রয় নেয়। যেমন সে নেতার প্রশংসা করে জাতীয় পত্রিকায় লেখে, পোস্টার করে, লিফলেট করে নেতার সুনজরে থাকার জন্য। চামচার প্রধান অস্ত্র চাপাবাজি। চাপাবাজি করে সে নেতার মনোযোগ আকর্ষণ করে। নেতা খুশি থাকলে, চামচার পদ-পদবি আর উন্নতি ঠেকায় কে? বিনা পুঁজিতে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা সম্ভব শুধুই ক্ষমতাসীন নেতার চামচামি করে। যোগ্যতা না থাকলেও চাকরি পেতে বেগ পেতে হয় না, অভিজ্ঞতা না থাকলেও ঊর্ধ্বতন বসের চামচামি করে প্রমোশন বাগিয়ে নেয়া যায় সহজে। এমনকি জায়গামতো চামচামি করতে পারলে, চাকরিতে চুক্তিভিত্তিক মেয়াদও বাড়ানো সম্ভব। চামচামি করে টেন্ডারে কাজ পাওয়া, রডের বদলে বাঁশ দিয়ে নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা, এমনকি চাপাবাজি ও চামচামির দ্বারা নেতাকে পুরোমাত্রায় গলাতে পারলে, কাজ না করেও বিল উত্তোলনে সমস্যা হয় না।
রাজনীতিতে হাইব্রিড চামচার আমদানি
শুধু ফলনেই যে হাইব্রিড আছে এমন নয়। রাজনীতিতেও হাইব্রিড আছে। দল ক্ষমতায় থাকলে ভিন্ন দল থেকে কিছু নেতাকর্মী, হঠাৎ ক্ষমতাসীন দলের সাথে যুক্ত হয়ে বড় বড় পদ বাগিয়ে নেয়। যাদের আগে রাজপথে মিছিল-মিটিংয়ে টিকিটিও দেখা যায়নি। এরা এসে চোখ ধাঁধাঁনো বক্তৃতা, বিবৃতি, টকশো ইত্যাদির মাধ্যমে বিশাল কিছু বনে যায়। অল্প দিনে হাজার কোটি টাকার মালিক হওয়া যায়, ্এমন উদাহরণও রয়েছে। আমেরিকায়, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম তৈরি করা যায়। এরা দেশের অর্থনীতির বারোটা বাজায়। মিডিয়া টকশোতে গিয়ে তারা সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা পায়। ফলে, সে হয়ে যায় পাবলিক ফিগার।
বিরোধী ও ছোট দলে চামচামি
শুধু যে সরকারি দলেই চামচা থাকে এমন নয়। বিরোধী দলে এবং এক নেতার ছোট দলেও চামচার অভাব হয় না। যেহেতু দল ক্ষমতায় নেই, তাই তারা আপাতত পদ-পদবি নিয়ে চামচামি করে। এই পদ-পদবি একসময় হয়তো তাদের বিপুল সম্পদের মালিক বানাবে, সেই আশায় তারা চামচামি করে। এক নেতাকেন্দ্রিক ছোট দল এবং বিরোধী দলের নেতারাও কিন্তু বেশ চামচাপ্রিয়। যোগ্যতা থাক বা না থাক শুধু চামচামির বদৌলতে ওমুককে দলের ভাইস চেয়ারম্যান, তমুককে মহানগর সভাপতি, আসন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও জাতীয় সরকার নির্বাচনে চামচাদের দৌরাত্ম্য মারাত্মকভাবে বেড়ে যায়। তখন চামচাদের মধ্যে হয় তীব্র প্রতিযোগিতা। যে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকে তাকে দেয়া হয় নমিনেশন।
সুশাসন প্রতিষ্ঠায় চামচামি প্রধান প্রতিবন্ধক
বিভিন্ন সময়ে সরকারে চামচাপ্রিয় অনেক নেতা ক্ষমতাসীন থাকায় স্বাধীনতার ৫০ বছরেও জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি আসেনি। দলান্ধতা ও চামচামির কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন হয় না। চামচামিতে যারা যত বেশি এগিয়ে, তারা তত বেশি ক্ষমতাবান। ভাবতে অবাক লাগে, বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও এখন ক্ষমতাসীনদের চামচা। তাই দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র গঠনের পূর্বশর্ত, চামচামুক্ত রাজনীতি। হ


আরো সংবাদ



premium cement
ইসলামের বিজয়ই বদরের মূল চেতনা : ছাত্রশিবির পরিবেশ দূষণে বাংলাদেশে বছরে ২ লাখ ৭২ হাজার মানুষের মৃত্যু : বিশ্বব্যাংক নোয়াখালীতে ল’ইয়ার্স কাউন্সিলের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত ‘আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ল’ ইয়ার্স কাউন্সিল কাজ করে যাচ্ছে’ পুকুরে পাওয়া গেল ১০০ ইলিশ অবন্তিকার আত্মহত্যা : জবির সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের জামিন আবারো নামঞ্জুর পাথরঘাটায় বদর দিবস পালনে দেড় হাজার মানুষের ইফতারি আদমদীঘিতে ৭২ হাজার টাকার জাল নোটসহ যুবক গ্রেফতার সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান মির্জা ফখরুলের জলবায়ু সহনশীল মৎস্যচাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে পদক্ষেপ নেয়া হবে : মন্ত্রী গাজীপুরে গাঁজার বড় চালানসহ আটক ২

সকল