২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

করোনাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া নারী চিকিৎসক

-

জীবিকার চেয়ে জীবন বড় প্রশ্ন তুলে যখন মানবতার সেবকরা আত্মসমর্পণ করেন, ঠিক সে মুহূর্তে করোনাযুদ্ধের ফ্রন্ট ফাইটার কিছু চিকিৎসক মানবসেবায় নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিচ্ছেন। তাদের প্রতি দেশ ও জাতির সুগভীর শ্রদ্ধা। আজ এমন এক চিকিৎসা সৈনিককে নিয়ে লিখছি, যখন করোনা বা কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সঙ্কট চরমে, যখন তারা নানা অবহেলা ও বৈষম্যের শিকার, তখন নিজের ও দুগ্ধপোষ্য শিশুসন্তানের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন যে নারী চিকিৎসক, তিনি আমাদের প্রেরণার বাতিঘর। সদ্য প্রসূতি জননী হয়েও ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি বাতিলের আবেদন করেন ওই চিকিৎসক।
চট্টগ্রামের মা ও শিশু হাসপাতালের ওই মানবতাবাদী দুঃসাহসী চিকিৎসকযোদ্ধার নাম ডা: মাহমুদা সুলতানা আফরোজা। স্বামী আমাদের অত্যন্ত স্নেহধন্য ‘মা ও শিশু হাসপাতালের’ আজীবন সদস্য কর্মবীর মাহমুদুর রহমান শাওন। সিদ্ধান্তটি তার একান্ত ব্যক্তিগত হলেও সহযোদ্ধা স্বামীর সমর্থনও বিশাল মানসিক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। আফরোজা দম্পতি আমাদের সমাজের জন্য ইতিহাসের পাতায় প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন। আমার কলেজ জীবনের বন্ধু মানুষ গড়ার কারিগর আদর্শ শিক্ষক মানবাধিকারকর্মী রিদোয়ানুল বারীর মেয়ে এবং তালতো ভাই মরহুম আকতার আহমদ মাস্টারের পুত্রবধূ ডা: মাহমুদা সুলতানা আফরোজা। একজন মানবিক চিকিৎসক ও একজন দুগ্ধদাত্রী মা। মাত্র সাড়ে চার মাস বয়সী একটি ফুটফুটে ছেলে আছে তাদের। ওকে পর্যাপ্ত সময় দিতে মাতৃত্বকালীন ছুটিতে ছিলেন। ২০১৬ সালে এমবিবিএস পাস করা মেয়ে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের জেনারেল সার্জারি বিভাগে চিকিৎসক হিসেবে যোগ দেন। এ বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি আসে তার কোলজুড়ে একটি ফুটফুটে সন্তান। মাতৃত্বকালীন বেশ কিছু শারীরিক অসুস্থতা ও অতিরিক্ত রক্তচাপের কারণে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই অর্থাৎ সাত মাসেই শিশুটি ভূমিষ্ঠ হয়। মাত্র এক হাজার ২০০ গ্রাম ওজনের শিশুটি জন্মের পর ১৫ দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিল এবং মা ডা: আফরোজাও পাঁচদিন আইসিইউতে ছিলেন। এত কষ্টের জীবনযুদ্ধের পরও মা হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিয়েছেন এই নারী চিকিৎসক। এবার করোনাযোদ্ধা হিসেবেও যোগ্যতার প্রমাণ দিলেন ডা: আফরোজা। মায়ের বুকের দুধই একমাত্র শিশুসন্তানের খাবার। আর বেড়ে উঠতে প্রতিমুহূর্তে চাই মায়ের মমতা, আদর আর পরশ। তবে সব কিছুর মায়া ত্যাগ করে তিনি একজন চিকিৎসক হিসেবে একাধিক মায়ের প্রাণ রক্ষার্থে ছুটে যেতে চান নিজ পেশায়। বৈশ্বিক মহামারীর এই দুঃসময়ে নিজের দুগ্ধপোষ্য শিশুসন্তানের কথা ভুলে গিয়ে নিজের মাতৃত্বকালীন ছুটি বাতিল চেয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেন ডা: আফরোজা। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম দিকে শিশুসন্তানের কথা বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষ ইতস্ততায় থাকলেও পরে তার প্রবল আগ্রহে অনুমতি দেয়। গত ১৮ জুন থেকে নিজের দুধের শিশুকে পরিবারে রেখে এসে হাসপাতালে করোনা রোগীর চিকিৎসায় নিয়োজিত হলেন তিনি।
গণমাধ্যমে দেয়া তার সাহসী এক বক্তব্যে তিনি বলেছেন, ‘মহামারীর এই ক্রান্তিকালে ঘরে বসে থাকা চিকিৎসকের কাজ নয়। চিকিৎসা পেশাটাই মানবাধিকারে পরিপূর্ণ। যারা চিকিৎসা নিতে আসেন তারাও কারো না কারো মা-বাবা, কারো সন্তান। এটি সবসময় মাথায় রেখে রোগীর সেবা করি। আমি চাই না বিনাচিকিৎসায় একটি প্রাণও ঝরে পড়ুক, এতে বিবেকের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করে। অনেক চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত। বর্তমানে চিকিৎসকের সঙ্কট রয়েছে। যারা সুস্থ রয়েছেন তারাও যদি গা ছেড়ে দেন, তাহলে রোগীরা যাবে কোথায়? তাই মাতৃত্বকালীন ছুটি বাতিল করে এই কঠিন ঝুঁঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ এ রকম বক্তব্য বর্তমান সমাজের জন্য আলোর দিশা, আলোকবর্তিকা।
এরই মধ্যে আমরা হারিয়েছি চট্টগ্রামে করোনার বিরুদ্ধে সম্মুখযোদ্ধা অধ্যাপক ডা: সমিরুল ইসলাম, ডা: জাফর হোসেন রুমিসহ কয়েকজন মানবিক চিকিৎসককে। তাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। সাথে সাথে শ্রদ্ধা জানাই করোনাযুদ্ধে শাহাদৎবরণকারী বাংলাদেশে প্রথম চিকিৎসকযোদ্ধা সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মঈন উদ্দীনকে। সবসময় মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন-বিএইচআরএফের অনুরোধে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন যারা তাদের মধ্যে ল্যাব এইডের মেডিসিন ও কার্ডিও বিশেষজ্ঞ মাহবুবুর রহমান, চট্টগ্রামের শ্রদ্ধেয় কার্ডিওলজিস্ট ডা: মোহাম্মদ নুরুল আমীন চৌধুরী, ডা: কোহিনূর আক্তার, ডা: ইকবাল করিম মুরাদ, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ এ জে এম সাদেক, রংপুর মেডিক্যাল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ও ভগ্নিপতি অধ্যাপক ডা: আবদুুল কাদের জিলানী, ছোট বোন ডা: জান্নাতুল ফেরদৌস হাসি, ঢাকা শাহাবুদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত জান্নাতুল মাওয়া রুজি, লায়ন্সের চক্ষু চিকিৎসক আসমা খানম প্রমুখের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। তারা আমাদের অনুরোধে সার্বক্ষণিক চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। আলহামদুলিল্লাহ, ডা: আফরোজা গত ১৮ জুন থেকে ১০ দিন করোনা রোগীর চিকিৎসা শেষে কোভিড-১৯ টেস্ট দিয়ে এখন হোম কোয়ারেন্টিনে। আল্লাহ পাক শিশুসন্তানসহ তার পরিবার পরিজনকে হেফাজত করুন। মানবতার জয় হোক। বাংলার ভাগ্যাকাশে হাজার হাজার মানবদরদি চিকিৎসকের জন্ম হোক, আমীন। হ
লেখক : উপদেষ্টা, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল আজীবন সদস্য ফোরাম এবং মানবাধিকার ও সুশাসনকর্মী।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল