১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

করোনাকালীন পথশিশুদের অবস্থা

-

দরিদ্রতা, বহু বিয়ে, বিয়ে বিচ্ছেদ, বাল্যবিয়ে, নদীভাঙন, মারাত্মক দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত পিতামাতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মাদকাসক্ত কিংবা পিতামাতা সংসার চালাতে অক্ষম, গ্রাম থেকে শহরমুখী অভিগমনসহ নানা কারণে ঢাকা শহরের দিন দিন পথশিশু তথা সুবিধাবঞ্চিত শিশুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। ইউনিসেফের তথ্য মতে বর্তমানে বাংলাদেশে ১১ লাখ, ৪৪ হাজার ৫৫৪ জন পথশিশু রয়েছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিসের (বিআইডিএস) হিসাব মতে, শুধু ঢাকা শহরে প্রায় চার লাখ ৫০ হাজার পথশিশু রয়েছে। যদিও অনেক প্রতিষ্ঠান ভিন্ন ভিন্ন তথ্য প্রদান করে, তবে পথশিশুদের নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতায় আমরা দেখি যে, রাস্তায় পথশিশুদের সংখ্যা এখনো নেহাত কম নয়। এ বিপুলসংখ্যক শিশু শিক্ষা, স্বাস্থ্য পুষ্টিসহ নানা মৌলিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
পথশিশুরা নানা রকম সমস্যা ও ঝুঁঁকিপূর্ণ পরিবেশে বড় হয়। তারা সব মৌলিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তারা পিতামাতার স্নেহ, দাদা-দাদীর আদর, ভাইবোনের সোহাগ-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়। তাদের পথের জীবন অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর, নিরাপত্তাহীন। তাদের অধিকাংশ অপুষ্টির শিকার, পথে তারা শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারাও কখনো কখনো নির্যাতিত হয়। মোটকথা তাদের স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা প্রতি পদে পদে হয় বিঘিœত। আর এ সব কারণে তারা নানা অসামাজিক ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিজেদের জড়িয়ে ফেলে। পরে দেশ ও সমাজের জন্য এরা বোঝা হয়ে বেড়ে ওঠে।
বর্তমান করোনা মহামারী ছড়িয়ে পড়ার পর পথশিশুদের পরিস্থিতি আরো নাজুক হয়ে পড়েছে। লকডাউন চালু হওয়ার পরপরই পথশিশুদের মুখোমুখি হতে হয় এক ভয়াবহ পরিস্থিতিতে। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’, করোনা প্রকোপ শুরু হওয়ার পর পথশিশুদের অবস্থা হয়েছে ঠিক এমনই। আমরা যারা ঢাকা শহরে পথশিশুদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করি, আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে, ঢাকা শহরে সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছে একা একা থাকে যে পথশিশুরা, তারা। এই শ্রেণীর পথশিশুরা যেসব কাজ করে সেগুলো হলো : ভাঙ্গারি কুড়ানো, ভিক্ষা করা, কুলির কাজ, আশপাশের কোনো রেস্টুরেন্টের বয় এর কাজ। লকডাউন শুরু হওয়ার পর পথশিশুরা খাবার সঙ্কটে পড়ে। তাদের হাতে কোনো কাজ না থাকায় তারা খাবার কিনে খেতেও পারে না। পর্যাপ্ত শেল্টারের অভাবে তাদেরকে খোলা আকাশে রেলস্টেশনে, বাস স্টেশনে ও নদীবন্দর এলাকায় অনিরাপদ অবস্থায় রাত যাপন করতে দেখা যায়। এ ছাড়া করোনা সম্পর্কে তাদের ধারনা অপ্রতুল এবং বেশ অসচেতন।
রেলস্টেশন ও বাস স্টেশন বন্ধ থাকায় তারা কুলির কাজ করতে পারে না, রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকায় তারা রেস্টুরেন্টে বয় এর কাজ ও পায় না, যারা ভাঙ্গারি কুড়ানোর কাজ করত তাদের কাজ ও বন্ধ। ঢাকা শহরের পথশিশুদের জন্য কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান খাবার বিতরণ করলেও প্রতিদিন ৩ বেলা খাবার খাওয়া কোনো পথশিশুর জন্যই সম্ভব ছিল না। ঢাকা শহরের পথশিশুদের নিয়ে যারা কাজ করে, তারা যে ধরনের শেল্টার পরিচালনা করে তা হলোÑ ড্রপইন শেল্টার, নাইট শেল্টার ও ট্রান্সিশনাল শেল্টার। করোনা প্রকোপ শুরুর পর যখন ২৫ মার্চ, ২০২০ তারিখ থেকে লকডাউন ঘোষণা হলো, তখন সব শেল্টার নতুন শিশুদের শেল্টারে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়। এর ফলে শেল্টারে যেসব শিশু আগে থেকেই ছিল, তারা নিরাপদ ছিল, কিন্তু যেসব শিশু শেল্টারের বাইরে ছিল তারা ঝুঁকির মুখে পড়ে। তাদের না ছিল খাবার, না ছিল আশ্রয়।
উদ্বেগজনক বিষয় হলো কাজ হারানোর ফলে অনেক দরিদ্র পরিবার ঢাকা ছেড়ে চলে গেছে অথবা অন্য কোনো কাজ করে কোনো রকম বেঁচে আছে। এই শ্রেণীর পরিবারের শিশুরা পথশিশু হওয়ার ঝুঁকিতে আছে, কেননা আমাদের কাজের অভিজ্ঞতার দেখেছি যে, শিশুদের পথে আসার একটা অন্যতম কারণ হলো দরিদ্রতা। আর করোনার প্রকোপে দরিদ্র মানুষ আরো দরিদ্র হয়েছে। সরকারি সংস্থা বিআইডিএস বলছে, করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশে নতুন করে এক কোটি ৬৪ লাখ মানুষ দরিদ্র হবে। আর এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে সুবিধাবঞ্চিত শিশু তথা পথশিশুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। অর্থাৎ করোনার ফলে দেশে বিশেষ করে শহর এলাকায় পথশিশুদের সংখ্যা বাড়বে, এটা সহজেই অনুমান করা যায়। তাই করোনার প্রকোপ থেকে পথশিশুদেরকে রক্ষা করার জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে।
আপন ফাউন্ডেশন ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাস থেকে এয়ারপোর্ট এলাকার নিকটস্থ কাওলা এলাকায় ঠিকানাহীন পথশিশুদের জন্য একটি শেল্টার পরিচালনা করছে। বাড়ি থেকে শহরে চলে আসা শিশুদের উদ্ধার করে আশ্রয় প্রদান করা হয় এবং তাদের পরিবার খুঁজে তাদেরকে পরিবারে হস্তান্তর করা হয়। কোনো কারণে কোনো শিশুর পরিবার খুঁজে পাওয়া না গেলে তাকে সরকারি বা বেসরকারি স্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানো হয়। এ পর্যন্ত আমরা ৮৩৮ জন শিশুকে রাস্তা থেকে উদ্ধার করে ৩৩৮ জনকে তাদের পরিবারে হস্তান্তর করেছি। ৬৭ জন শিশুকে স্থায়ী সেবা ও আশ্রয়ের জন্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে রেফার করেছি।
পথশিশুর সংখ্যার তারতম্য যাই হোক না কেন বিশাল এ জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূলস্রোতের ও উন্নয়নের মূলধারার বাইরে রেখে দেশের সামগ্রিক টেকসই উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়। আর টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলেও তাদের পেছনে ফেলে সম্ভব নয়। আর এ জন্য দরকার সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত পরিকল্পনা ও বাস্তবভিত্তিক উদ্যোগ। পথশিশুদের বাস্তব অবস্থাকে উপলব্ধি করে পথশিশুদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী ২০১৫ সালে ঘোষণা করেন :‘আমাদের শিশুরা কেন রাস্তায় ঘুমাবে? একটা শিশুও রাস্তায় ঘুমাবে না। একটা শিশুও এভাবে মানবেতর জীবনযান করবে না।’
যেহেতু করোনা পরিস্থিতি এখনো শেষ হয়ে যায়নি এবং পথশিশুরা ঝুঁকিতে আছে সেহেতু পথশিশুদের সুরক্ষায় আমাদের সম্মিলিত কিছু উদ্যোগ নেয়া সময়ের দাবি, যা নিম্নে সুপারিশমালা আকারে পেশ করা হলো : ১.করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে উদ্ভূত পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত পথশিশু, সুবিধাবঞ্চিত ও অসহায় শিশুদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত বিভিন্ন সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা। ২.পথশিশুদের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা ও প্রয়োজনীয় আর্থিক বরাদ্দ দেয়া দরকার। ৩.শিশুর সাথে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে কাজের সমন্বয় ত্বরান্বিতকরণ। ৪.সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে তাৎক্ষণিকভাবে পথশিশুদের সাময়িক অবস্থান ও খাদ্য সরবরাহের যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে তা ক্রমেই নিয়মিত প্রোগ্রামে রূপান্তরের প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। ৫. ঢাকা শহরের পথশিশুদের নিরাপত্তার জন্য সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে জরুরিভিত্তিতে পর্যাপ্ত শেল্টার হোমের ব্যবস্থা করতে হবে। ৬.দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শিশু একক বা পরিবারের সাথে জীবিকার সন্ধানে প্রতিনিয়ত ঢাকা শহরে চলে আসে। তাই বাংলাদেশের প্রেক্ষিত বিবেচনায় কোভিড-১৯, নদীভাঙন ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ভালনারেবিলিটি শনাক্তকরণের লক্ষ্যে একটি ব্যাপক জরিপ বা সমীক্ষা পরিচালনা করতে হবে। ৭.সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ এবং চলমান কর্মসূচির আলোকে একটি সমন্বিত ফ্লাটফর্ম গঠন করা জরুরি (ইন্টিগ্রেটেট এপ্রোচ)। ৮.পথশিশু, সুবিধাবঞ্চিত এবং অসহায় শিশুদের জন্য পরিচালিত বিভিন্ন সহায়তা কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য একটি মনিটরিং সেল গঠন করা। ৯.পথশিশু, সুবিধাবঞ্চিত এবং অসহায় শিশু যাতে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ, শারীরিক, যৌন, মাদকাসক্ত, হয়রানির ও পাচারের শিকার না হয় সে বিষয়ে সবার সতর্ক দৃষ্টি রাখা এবং এ লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে দেশব্যাপী কার্যক্রম হাতে নেয়া। ১০.পথে অবস্থানকারী শিশুরা যাতে তাদের পিতামাতা, অভিভাবক বা পরিবারে ফিরে যেতে পারে, সে ব্যাপারে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা।
পথের চেয়ে পরিবারই শিশুদের নিরাপদ স্থান। তাদের পরিবারেই সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সরকার ঘোষিত ও বাস্তবায়িত সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে প্রান্তিক গরিব মানুষদের অংশ নিশ্চিত করতে হবে। আমরা পথশিশুমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে চাই। কাজটি অত্যন্ত দুরূহ। কিন্তু এ দুরূহ কাজটি সরকারি, বেসরকারি, আন্তর্জাতিক সংস্থা, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং ব্যক্তি সবাই মিলে একযোগে করলে সহজ হবে। আর তাই প্রত্যাশা করি কোভিড-১৯ অতিমারী দ্রুত কেটে যাক আর আলোয় আলোয় ভরে উঠুক শিশুবান্ধব বাংলা, যেখানে প্রতিটি পথশিশু পাবে তার মৌলিক অধিকার। হ
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, আপন ফাউন্ডেশন
ধভঃধনধঢ়ড়হ@মসধরষ.পড়স


আরো সংবাদ



premium cement
তীব্র তাপপ্রবাহে বাড়ছে ডায়রিয়া হিটস্ট্রোক মাছ-ডাল-ভাতের অভাব নেই, মানুষের চাহিদা এখন মাংস : প্রধানমন্ত্রী মৌসুমের শুরুতেই আলু নিয়ে হুলস্থূল মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে মূল্যস্ফীতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এত শক্তি প্রয়োগের বিষয়টি বুঝতে পারেনি ইসরাইল রাখাইনে তুমুল যুদ্ধ : মর্টার শেলে প্রকম্পিত সীমান্ত বিএনপির কৌশল বুঝতে চায় ব্রিটেন ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোট আজ নিষেধাজ্ঞার কারণে মিয়ানমারের সাথে সম্পৃক্ততায় ঝুঁকি রয়েছে : সেনাপ্রধান নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে বিএনপি : কাদের রৌমারীতে বড়াইবাড়ী সীমান্তযুদ্ধ দিবস পালিত

সকল