২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

অশ্লীলতা থেকে বাঁচতে হবে

-

ইদানীং পর্নোগ্রাফিতে আসক্তের সংখ্যা ভয়াবহ আকারে বেড়ে যাচ্ছে। শিশু থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যেও আসক্তির মাত্রা প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। সম্পর্কগুলো দিন দিন বেশ জটিলতার দিকে এগোচ্ছে। কখনো কখনো তা সম্পর্কচ্ছেদের করুণ পরিণতিতে গিয়ে শেষ হয়। যৌনতা প্রাণিজগতে খুব স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। কিন্তু সমস্যাটা তখনই হয়, যখন তা পর্নোগ্রাফির মতো একটি বিষয়ে আসক্তির পর্যায়ে চলে যায়। পর্নোগ্রাফির ভয়াবহ ছোবল থেকে কিভাবে নিজেকে এবং সমাজটা রক্ষা করা যায় সে সম্পর্কে আলোচনার দরকার আছে।
মিডিয়া হলো, জাতির দর্পণ, একই সাথে পথ প্রদর্শক। মিডিয়া জাতিকে ঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে আবার ধ্বংসাত্মক পথেও ঠেলে দিতে পারে। একটি দেশের মিডিয়া জগৎ যদি অশ্লীলতায় আক্রান্ত হয়, সেই দেশের যুবসমাজ তিলে তিলে ধ্বংসের দিকে যেতে বাধ্য। একসময় অশ্লীলতার ছড়াছড়ি পশ্চিমা দেশগুলোতে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন তা ব্যাপ্তি লাভ করেছে মুসলিম বিশ্বেও। আধিপত্যবাদী, সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো মুসলমানদের ঘায়েল করতে পর্নোগ্রাফি নামক আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর হাতিয়ারটি বেছে নিয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির অনলাইন সিস্টেমে এটা যে কেউ উপভোগ করতে পারে। বর্তমানে আমাদের দেশে প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এগুলো খুব দ্রুত ছড়াচ্ছে। সরকারিভাবে পর্নোগ্রাফি বন্ধের কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেই। মুসলিম বিশ্বের মধ্যে যে বিভেদ এবং অনৈক্য তা ভোগবাদী জীবন ব্যবস্থার দিকে আকৃষ্ট হওয়ার কারণেই ঘটছে। এই ভয়ানক অসুখ থেকে রাষ্ট্রপ্রধান এমনকি রাজা বাদশাও মুক্ত নন। এসব অনাচার দেখে সম্প্রতি এক আরব যুবক তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন এভাবে, বর্তমানে আরব দেশে পণ্যসামগ্রীর মূল্য আকাশচুম্বী আর বেহায়াপনায় নারীরা সার্টিফিকেটধারী। মসজিদগুলো পড়ে থাকে শূন্য এবং অকার্যকর আল্লাহর বিধানাবলি। আমাদের দেশে চোরেরা পদকপ্রাপ্ত। আর সত্যিকারের নায়করা কারারুদ্ধ। আমাদের দেশে প্রায় অসম্ভব বিবাহবন্ধন। বৈধতা পায় জেনা আর পরস্ত্রী গমন। ওদিকে নারীরা পুরুষদের ওপর শক্তিমান। আল্লাহর জমিন করে রেখেছে ভোগদখল। আমরা এমন এক শতাব্দীতে বসবাস করছি যে, আরব দেশে প্রতিটি ভালো কাজ আমরা ছেঁড়া থলের ভেতর ভরছি। আমরা ওজু করি, সেই সাথে করি পানির অপচয়। দরিদ্রকে দান সদকা করি। কিন্তু সেটার ছবি তুলে ঘটা করে ছড়িয়ে বেড়াই। তাহাজ্জুদ পড়ি, অন্য দিকে পরিবার পরিজনদের হক নষ্ট করি। রোজায় সারাদিন না খেয়ে থাকি, সেই সাথে মিথ্যা বলি আর দিই অভিশাপ আর গালিগালাজ। কিছু লোক হজে যেতে পারে না। বিভিন্ন অজুহাত দেখায়। অথচ ঠিকই তারা হাওয়ায় ভেসে দূরদেশ ভ্রমণ করতে পারে। আবার অনেকে কোরবানি করতে পারে না। তারাও নানান কারণ দর্শায়। অথচ শুধু কথা বলার জন্য লাখ টাকা মূল্যের ফোন কিনতে পারে। জেনে রাখুন, আল্লাহর দেয়া সম্পদই সবচেয়ে দামি। আমাদের অনেকেই দিনে কুরআনের ১০টি আয়াত পড়তে পারে না। কিন্তু ঠিকই সে অহেতুক গল্প করে সময় নষ্ট করতে পারে। সাবধান, নিশ্চয়ই আল্লাহর জান্নাতই সর্বোচ্চ মূল্যের। গুনাহের সমুদ্রে হাবুডুবু খেলেও সালাত ছেড়ে দিও না। এই সালাত নিশ্চয়ই তোমাকে জান্নাতে পৌঁছে দেবে। আর যত প্রকার কল্যাণ তার মূলে রয়েছে স্বামী-স্ত্রীর মধুর সম্পর্ক এবং পারিবারিক সংহতি ও স্থিতিশীলতা। পারিবারিক জীবন সম্পর্কে এটাই হচ্ছে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি। নিজের প্রবৃত্তির লাগাম শয়তানের হাতে সমর্পণ এবং শয়তান যে দিকে পরিচালনা করে সে দিকে চালিত হওয়ার নামই প্রবৃত্তির পূজা-(সূরা নিসা-আয়াত ১১৯)।
যেসব অজ্ঞ অদূরদর্শী বিদ্বেষপরায়ণ খ্রিষ্টান ও পৌত্তলিক লেখক ‘ইসলামে নারীর আত্মমর্যাদা নেই’ বলে অসাধারণ অজ্ঞতা প্রকাশ করেছে, আমরা তাদেরকে পবিত্র কুরআন পড়ে দেখার জন্য অনুরোধ করছি এবং সাথে সাথে এ কথাও মুক্তকণ্ঠে ঘোষণা করছি, যে পবিত্র ইসলাম নারীজাতির স্বাধীনতা, অধিকার, গৌরব ও মর্যাদার যে উচ্চ আদর্শ করেছে, জগতের অন্য কোনো ধর্মেই তার তুলনা নেই (সূরা নিসা-আয়াত ১২৪-শানেনুজুল)। ২৬ আগস্ট ২০২০ বুধবার, বহুল প্রচারিত একটি দৈনিকের লিড নিউজ ছিল অনলাইন প্ল্যাট ফর্মগুলোতে অশ্লীলতার ছড়াছড়ি। পত্রিকায় লিখেছে, গণমাধ্যমে অশ্লীলতা সমাজকে কী পরিমাণ কলুষিত করে তার আঁচ আমরা নব্বই দশকের শেষ ভাগ থেকেই পেয়েছিলাম। তখন থেকেই এ দেশের চলচ্চিত্রে শুরু হয়েছিল লাগামছাড়া অশ্লীল ছবির ছড়াছড়ি। যার পরিণামে দেশের যুবসমাজের মধ্যে চরম অবক্ষয় দেখা দিয়েছিল, যেটা এখন আরো বেগবান হয়েছে। দেশে ধর্ষণ এখন নিয়ন্ত্রণহীন। নানা অপরাধপ্রবণতাও বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। এর সাথে যুক্ত হয় ছোটপর্দায় ভিনদেশী সিরিয়াল দেখার ধুম। এসব সিরিয়ালের প্রধান বিষয় পারিবারিক কোন্দল ও পরকীয়া। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে আমাদের সমাজে। পরকীয়া আর কথায় কথায় ডিভোর্স রীতিমতো কালচারে পরিণত হয়েছে। দেশ ও সমাজে এমন দৈন্যদশার পর এবার শুরু হলো অনলাইন প্ল্যাটফর্মে অশ্লীলতায় ভরা ওয়েব সিরিজ ও ওয়েব ফিল্মের মহোৎসব। যুবসমাজ এসব দেখতে রীতিমতো নেশাগ্রস্ত। চিন্তার বিষয় হলো, দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যদি এসব দেখে অনৈতিক পথে পা বাড়ায় তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ কী হবে? কিছু নির্মাতা মনে করেন, ছবির প্রয়োজনে যৌনতার আশ্রয় নিতে হয়। এ যুক্তি কতটা সঙ্গত? এ ক্ষেত্রে ভাবতে হবে, দেশের যুবসমাজের নৈতিকতাটা কোন দিকে ধাবিত হচ্ছে। স্বাধীনতার পর থেকে ভারতীয় কালচার বাংলাদেশে প্রবেশ করার কারণে আমরা লক্ষ করছি, আমাদের যুবসমাজ নেতিবাচক পথে হাঁটছে। এ জন্য রাষ্ট্র কম দায়ী নয়। অনৈতিকতার ব্যাপারে আমরা যুবসমাজকে দায়ী করতে পারি না কোনোভাবেই।
যারা এসব অশ্লীলতা ভারত থেকে আমদানির সুযোগ করে দিয়েছে তারাই মূলত দায়ী। তারা তাদের ভুলগুলো ভবিষ্যতে আর হবে নাÑ এ কথা বলে পার পেতে চান। তাদের ব্যাপারে কুরআন হাদিস বলছে, সারাজীবন পাপ করে মৃত্যুশয্যায় এসে যারা বলে, আমি তওবা করলাম, তাদের তওবা কাজে আসবে না। আর সত্য অস্বীকারকারী হিসেবেই যারা মৃত্যুবরণ করে তাদের জন্যও তওবা কাজে আসবে না। তাদের জন্য আল্লাহ নিদারুণ শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন।’ ভুলের খেসারত যে কতটা ভয়ানক হতে পারে, একটি উক্তিতে তা আরো পরিষ্কার হয়ে যাবে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে একজন পিতার আর্তনাদ ছিলÑ এরকম, আজ আমি আমার সন্তানের গোলাম, আর সে আমার মালিক। আমি আজ বড়ই অসহায়। আমাকে বাঁচতে দিন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব কঠিন কথা প্রকাশ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমাদের ভুলের কারণে সমাজ ও রাষ্ট্রে চলছে গণধর্ষণ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, খাদ্যে এবং জীবন রক্ষাকারী ওষুধে ভেজাল, অনলাইনে রমরমা জুয়া, নিঃস্ব হচ্ছে হাজারো মানুষ। মাদকাসক্তির ব্যাপকতার খবরও থাকছে পত্রপত্রিকায়। ওপেন সেক্স মানুষকে ‘মানুষ বানায় না, তাকে পশুতে পরিণত করে।’
বাংলাদেশ পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র, ইসলাম আমাদের রাষ্ট্রধর্ম। সেই দেশে এসব কেন ঘটবে, কারা এ জন্য দায়ী এমন প্রশ্ন করাই যায়। ভারতে বাংলাদেশের কোনো টিভি চ্যানেল দেখানো হয় না। এমনকি বাংলাদেশের কোনো নিউজ ভারতের পত্রপত্রিকায় খুঁজে পাওয়া দুরূহ। অথচ ভারতের ছোটখাটো সংবাদও লিড নিউজ হয়ে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় স্থান পায়। ভারতের লেখক-লেখিকাদের প্রবন্ধ নিবন্ধ বাংলাদেশে পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করার জন্য রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয় কার আগে কে ছাপাতে পারে। বললেই তো হবে না, আমরা দেশপ্রেমিক। বাস্তবে তা প্রমাণ করতে হবে। ভারত কিন্তু তাদের দেশপ্রেমে শতভাগ এগিয়ে। আর আমরা পিছিয়ে আছি এখনো। পাকিস্তান আমলে আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীরা লাহোরের ছায়াছবির বিরুদ্ধে যতটা সোচ্চার ছিল তারাই আজ অতিমাত্রায় ভারতপ্রেমিক। প্রায় শতাধিক ম্যাগাজিন এবং অশ্লীল বইপুস্তক বাংলাদেশে আসছে। অথচ কলকাতার কলেজস্ট্রিট সড়কে হেঁটে বইয়ের দোকানগুলোতে বাংলাদেশের কোনো বইপুস্তক পত্রপত্রিকা খুঁজে পাওয়া যায় না। বাংলাদেশের বাংলাবাজার এবং নীলক্ষেত এলাকায় একবার চক্কর দিলে বোঝা যাবে আমরা কোন দেশে বসবাস করছি। সম্প্রতি খবর প্রকাশ পেয়েছে, ভারত আমাদের প্রকাশনা শিল্প থেকে প্রতি বছর কয়েক হাজার কোটি টাকা কামিয়ে নিচ্ছে। এক দিকে চরিত্র নষ্ট করছে অন্য দিকে অর্থ কামিয়ে নিচ্ছে। আমরা নিজেরা যদি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ না হই, কেউ এ কাজটি করে দেবে না। দেশের রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেনি দীর্ঘ ৪৯ বছর পরেও। আমাদের দেশের যুবকরা খারাপ নয়, তবে তারা ভালো থাকতে পারছে না। ইন্টারনেট এবং নানারকম অশ্লীল ওয়েবসাইটে এমন সব দৃশ্য দেখানো হয় যা, একটি সুস্থ মনকে অসুস্থ বানিয়ে ফেলবে। বসন্তে ভালোবাসা দিবসে দেখছি মেয়েরা খোলাপিঠে উত্তেজক কথা লিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় চক্কর মারছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও এসব ব্যাপারে নীরব। সোশ্যাল মিডিয়া এসব ছবি ভাইরাল করে সুস্থ মনকে অসুস্থ করার জন্য আরো একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
হজরত মোহাম্মদ সা: বলেছেন, যদি ভালো হতে চাও তবে সর্বপ্রথম তুমি মিথ্যা বলা ছেড়ে দাও। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অসুখের নাম মিথ্যা। এই মিথ্যা ছেড়ে দিলে মন ও শরীরের সব দূষণ দূর করা সম্ভব। শুধু মিডিয়ায় জিডিপির শ্লোকবাক্য শুনিয়ে দেশে অনৈতিকতা বন্ধ করা যাবে না। পণ্য দেখতে ৩টি জিনিস লাগেÑ চিন্তা, ডিভাইস এবং স্থান। ইসলামিক চিন্তাবিদরা বলছেন, এই তিনটির যেকোনো একটি পরিত্যাগের অভ্যাস গড়ে তুলতে পারলে পর্নো আসক্তি কমে যাবে। পর্নো ভিডিও আপলোড না করলে পর্নো দূষণ থেকে বাঁচা যাবে।
দেশের জাতীয় দৈনিকগুলো প্রায় সময়ই ভারতের নায়ক- নায়িকাদের অশ্লীল ছবি ছাপছে। দেশের মিডিয়া নোংরামিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে কিভাবে যুবসমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছেÑ সে ব্যাপারে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ভাবতে হবে। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা গবেষক এবং স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের শিক্ষক মতিন রহমান বলেছেন, একজন সুস্থ নাগরিক হিসেবে সবার দায়িত্ব হচ্ছে যুবসমাজকে আমরা কোন পথে ধাবিত করব সেই চিন্তা করা। এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। স্বেচ্ছায় একটি কার্যকর ভূমিকা নিতে পারলে অশ্লীলতার প্রতি আসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। নিজের সাথে প্রমিজ করুন এবং চ্যালেঞ্জ তৈরি করুন যে নোংরা ছবি আর দেখবেন না। শুধু মনকে স্থির করতে পারলেই আপনি অর্ধেক এগিয়ে যাবেন নিঃসন্দেহে। আসুন আমরা সবাই আধুনিক প্রযুক্তির এই মরণ ছোবল থেকে নিজেকে বাঁচাই। যুবসমাজকে বাঁচাই। নিজের দেশকে বাঁচাই। হ
লেখক : গ্রন্থকার ও গবেষক


আরো সংবাদ



premium cement