২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ন্যাটোকে আবার একঘরে করেছে

-

ন্যাটো হচ্ছে একটি নামমাত্র জোট। পূর্বাঞ্চলীয় ভূমধ্যসাগরে আঞ্চলিক পানিসীমা নিয়ে সঙ্ঘাত ঘনিয়ে আসার পরিপ্রেক্ষিতে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, বেশির ভাগ পশ্চিমা দেশের সমন্বয়ে গঠিত সামরিক ইউনিয়নটি এখন দ্বিধাগ্রস্ত। ইসরাইল, মিসর, সাইপ্রাস, ফ্রান্স, লিবিয়া এবং ভূমধ্যসাগরীয় ও ইউরোপীয় অন্যান্য দেশকে নিয়ে যে খুব বড় একটি বিরোধ বা সঙ্ঘাতের সৃষ্টি হতে যাচ্ছে তাতে বর্তমান তুরস্ক-গ্রিক উত্তেজনা কেবল একটি বিশেষ দিক মাত্র। দেশগুলোর তালিকা থেকে বাদ পড়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। তবে রাশিয়া বিশেষভাবে এই সঙ্ঘাতের ফলাফল থেকে বেশি অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জন বা সুবিধা হারানোর অপেক্ষায় রয়েছে।
এই ধরনের সঙ্ঘাতের কিন্তু ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে। কারণ তুরস্ক ও গ্রিস ১৯৭৪ সালে একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু ফলপ্রসূ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। গত জানুয়ারি মাসে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু, গ্রিসের কাইরিয়াকোস মিটসোটাকিম এবং সাইপ্রাসের নিকোস এনসিটামিয়েডস একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। তার সাথে বর্তমান সঙ্ঘাত ও উত্তেজনা গভীরভাবে সম্পৃক্ত। এই চুক্তির মাধ্যমে ‘ইস্টমেড পাইপলাইন’ প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা করা হয়। এক সময় এই পাইপলাইনের বিষয়টি চূড়ান্ত হলে ইসরাইলি অনেক প্রাকৃতিক গ্যাস ইউরোপে রফতানি করার চিন্তা করা হয়। লেভিয়াথান বেসিন থেকে পাম্প করেই ইউরোপে ইসরাইলি এই গ্যাস সরবরাহ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। ইউরোপের কয়েকটি দেশ এই প্রকল্প থেকে গ্যাস সংগ্রহ করে লাভবান হতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ইউরোপ কেবল অর্থনৈতিক সুবিধা নয়, ভূ-কৌশলগত সুবিধা পাওয়ারও আশা করে। ইসরাইলি সস্তা গ্যাস সংগ্রহ করতে পারলে, ইউরোপের দেশগুলো রাশিয়ার ওপর থেকে গ্যাসের নির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠতে পারবে বলে আশা করে। উল্লেখ্য, বর্তমানে নোরস্ট্রিম ও তুর্কস্ট্রিম-এই দু’টি পাইপলাইনের মাধ্যমে ইউরোপে রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। তুর্কস্ট্রিম পাইপলাইনটি গেছে তুরস্কের ওপর দিয়ে। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন গ্যাস কোম্পানি গ্যাজপ্রম ইউরোপে তাদের চাহিদার প্রায় ৪০ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করে থাকে। এই গ্যাস সরবরাহ করে মস্কো পেয়ে থাকে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুবিধা। কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ বিশেষত ফ্রান্স তাদের ভাষায় নিজেদের অর্থনীতিকে রাশিয়ার অর্থনৈতিক শোষণ থেকে বের করে আনার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য ফ্রান্স ও ইতালি বর্তমানে লিবিয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থানে রয়েছে। তাদের এই মনোবৃত্তি ঔপনিবেশিক গতি-প্রকৃতিরই নামান্তর। রাশিয়ার গ্যাস ও অন্যান্য জ্বালানি সরবরাহের ওপর থেকে অতি নির্ভরতা কাটিয়ে উঠে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান সৃষ্টির জন্য উভয় দেশ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। লিবিয়ায় ফ্রান্স ও ইতালির মনোবৃত্তি উপলব্ধি করতে পেরে রাশিয়া ও তুরস্ক ন্যাশনাল অ্যাকর্ড সরকার (জিএমএ) ও ফিল্ড মার্শাল খলিফা হাফতারের অনুগত বাহিনীর মধ্যকার সামরিক শোডাউনে পরিপূর্ণভাবে সম্পৃক্ত হয়েছে।
লিবিয়ায় গত কয়েক বছর ধরে যুদ্ধ ও সঙ্ঘাত যখন চলমান রয়েছে, তখন ইস্টমেড পাইপলাইন পরিকল্পনা ‘আগুনে জ্বালানি ঢেলে দেয়া’র মতোই পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করে তুলেছে। এই পরিকল্পনায় তুরস্ক ক্ষুব্ধ। তুরস্ককে এই চুক্তির বাইরে রাখা হয়েছে। এই পরিকল্পনার ব্যাপারে রাশিয়াও উদ্বিগ্ন। চুক্তির মাধ্যমে ইসরাইলকে ক্ষমতাশালী করে তোলা হয়েছে। কারণ ইসরাইল এখন পাইপলাইনের মাধ্যমে ইউরোপ মহাদেশের সাথে অর্থনৈতিক সংযোগ ঘটাতে পারে। ইসরাইলের নেতৃত্বে জোট গঠনের পূর্বাভাস পেয়ে তুরস্ক ও লিবিয়া গত বছর একটি সমুদ্রসীমা চুক্তি (মেরিটাইম বাউন্ডারি ট্রিটি) স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তির মাধ্যমে আঙ্কারাকে লিবিয়ার রাষ্ট্রীয় জলসীমায় প্রবেশের সুযোগ দেয়া হয়। সাহসী ও দুর্দান্ত সামরিক মহড়ার মাধ্যমে তুরস্ক তার দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূল থেকে লিবিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় উপকূল পর্যন্ত ব্যাপক এলাকায় গ্যাস আহরণের লক্ষ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর ভূখণ্ডগত অধিকার দাবি করে। তুরস্কের এই গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চলের দাবি ইউরোপের কাছে অগ্রহণযোগ্য। কারণ এটা উচ্চাভিলাষী ইস্টমেড প্রকল্পের সাথে সাংঘর্ষিক এবং এতে মৌলিকভাবে ভূরাজনীতি পাল্টে যাবে। ইউরোপের নির্দেশনায় এবং ন্যাটোর অনুমোদনে ওই অঞ্চল নিয়ে যে পরিকল্পনা করা হয়েছে তুরস্কের অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার দাবি তাদের এ পরিকল্পনা ও ভূরাজনীতিকে পাল্টে দিতে পারে। তাই তারা এর বিরোধী। তবে ন্যাটো এখন আর আগের মতো দুর্ধর্ষ ও ঐক্যবদ্ধ শক্তি নেই। ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ন্যাটোর অব্যাহতভাবে উত্থান হয়েছে। ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রগুলো একটি অপরটিকে সহায়তা এবং ‘সোভিয়েত হুমকি’ থেকে রক্ষা করার জন্য বড় বড় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। এমনকি ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন আর ওয়ারশ জোট ভেঙে যাওয়ার পরও ন্যাটো শক্তিশালী এবং তুলনামূলকভাবে ঐক্যবদ্ধ ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন পরাজিত হওয়া সত্ত্বেও ন্যাটো নিজের ঐক্য ধরে রেখেছিল। সোভিয়েতের বিষয়টি দীর্ঘদিন আর ফ্যাক্টর থাকেনি। কারণ ওয়াশিংটন বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে তার সামরিক আধিপত্য বজায় রাখতে চেয়েছে।
১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধ ন্যাটোর নতুন মিশন হিসেবে প্রথম ক্ষমতার প্রকাশ ঘটায়। কিন্তু ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধ ন্যাটোর ক্ষমতার সর্বনাশ ডেকে আনে। যুক্তরাষ্ট্র ইরাক থেকে ‘প্রস্থানের বা ফিরে আসা’র কৌশল গ্রহণ করে। এতে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমেরিকার ক্রমান্বয়ে সরে আসার এবং একই সাথে ‘কেন্দ্রবিন্দু এশিয়ার দিকে’ এই পূর্বাভাস পাওয়া যায়। প্রশান্ত মহাসাগরে চীনের সামরিক আধিপত্য খর্ব করার দুর্ধর্ষ আশাবাদ নিয়ে আমেরিকা এগিয়ে যাওয়ার লক্ষণ ফুটে ওঠে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমেরিকা যে সামরিকভাবে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার সর্বোত্তম প্রকাশ ঘটে ২০১১ সালে লিবিয়ায় ন্যাটোর হস্তক্ষেপ থেকে। সামরিক কৌশলবিদরা লিবিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা বর্ণনা করার জন্য ‘পেছন থেকে নেতৃত্ব দেয়ার’ মতো একটি বিভ্রান্তিকর টার্ম খুঁজে বের করেন। ন্যাটো প্রতিষ্ঠার পর থেকে সেবারই প্রথম ওয়াশিংটন এমন একটি দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের অংশ হয়েছিল যেটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইতালি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যসহ তুলনামূলকভাবে ছোট ও দুর্বল সদস্যদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এ দিকে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা মার্কিন সামরিক কৌশলে ন্যাটোর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দেন। এটা প্রমাণিত যে, এক সময়ের ক্ষমতাশালী জোট ওয়াশিংটনের জন্য নিজেদের ব্যবহৃত হওয়াকে অত্যধিক গুরুত্ব দিত। এ দিকে ফ্রান্স ইউরোপীয় ইউনিয়নকে অখণ্ড হিসেবে টিকিয়ে রাখার জন্য যেভাবে নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করে থাকে, একইভাবে ন্যাটোর জন্য সর্বাত্মক প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে। এই ফ্রান্সই ইউরোপিয়ান ও পশ্চিমা আদর্শে আস্থা রেখেছে এবং ওই আদর্শ থেকে আমেরিকার ক্রমান্বয়ে সরে যাওয়ার শূন্যতা পূরণ করতে প্যারিসকে বাধ্য করছে। বর্তমানে ভূ-মধ্যসাগরের পূর্বাঞ্চলের সঙ্ঘাত জ্বলে ওঠাসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক চলমান সঙ্কটে ফ্রান্স সামরিক কর্তৃত্ব এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
গত ডিসেম্বরে ইমানুয়েল ম্যাক্রো লন্ডনে অনুষ্ঠিত ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাশে দাঁড়ান। আগে আমেরিকার ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় ট্রাম্প ন্যাটোকে কঠোর শাস্তি এবং ন্যাটো সদস্যরা জোটে তাদের যথাযথ অনুদান দেয়া শুরু না করলে জোট থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের প্রত্যাহার করে নেবে বলে হুমকি দেন। ইসরাইল, গ্রিস, মিসর ও তুরস্কের মতো দেশগুলো ভূমধ্যসাগরে যখন নিজেদের দাবি জানাচ্ছে, তখন এটা একটা অদ্ভুত ও নজিরবিহীন দৃশ্য। অথচ এই সময়ে ন্যাটোর নিজ সদস্যদের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধ প্রতিরোধ করাই ছিল সংস্থাটির কর্তব্য। এটা একটা একেবারে অচেনা ব্যাপার যে, ফ্রান্স ও জার্মানি দৃশ্যত ন্যাটোর নেতৃত্ব নিয়ে নিয়েছে আর যুক্তরাষ্ট্র দৃশ্যপটে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।
এটা অন্তত ধারণা করা কঠিন যে, ওয়াশিংটনের স্বার্থের নির্দেশ অনুযায়ী একটি সংগঠন হিসেবে ন্যাটোকে আবার নতুন করে সাজানো যাবে। ফ্রান্সের সাম্প্রতিক আচরণ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ন্যাটোতে হয়তো অবশ্যম্ভাবী পরিবর্তন আসতে পারে। ২০১৮ সালে ম্যাক্রো ‘একটি সত্যিকারের ইউরোপিয়ান সেনাবাহিনী’ গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছিলেন। দ্রুত আঞ্চলিক পরিবর্তন এবং ন্যাটোর ক্রমবর্ধমান পতন বিবেচনা করলে ম্যাক্রো হয়তো একদিন তার সেনাবাহিনী পেয়ে যেতে পারেন। হ
লেখক : একজন সাংবাদিক, প্যালেস্টাইন ক্রনিকলের সম্পাদক
আরব নিউজ থেকে ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার


আরো সংবাদ



premium cement