২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

সংশোধিত আমেরিকা দেখব কি?

-

গ্লোবাল নেতৃত্ব বিশেষত গ্লোবাল অর্থনৈতিক নেতা হওয়ার লড়াই এবার তুঙ্গে উঠতে যাচ্ছে। এটা ফাইনাল লড়াইও হয়ে ওঠার লক্ষণ সম্পন্ন। আমেরিকার আসন্ন নভেম্বর নির্বাচনের জন্যই যেন সবাই অপেক্ষা করছে, আর রাষ্ট্র হিসেবে আমেরিকা মরণপণ লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। মোটাদাগে এই লড়াই হবে বাই-পার্টিজান। মানে ডেমোক্র্যাট-রিপাবলিকান দু’দলই এমন লড়াইয়ের পক্ষে, যদিও নির্বাচনে যে জিতবে সে নিজের কায়দায় ও কৌশলে এ লড়াইয়ে নামবে ও নেতৃত্ব দেবে, ফারাক শুধু এখানেই। কিন্তু তবু দু’দলে আরেকটা মিল আছে। সেটি হলো, খোদ আমেরিকাকে এ দুই দল যেন চাইলেই গ্লোবাল নেতৃত্ব বজায় রাখতে পারবে। ‘আমি সরব না’ বললেই যেন গ্লোবাল এম্পায়ারের নেতার আসন ধরে রাখা যায়। যেমন অনেককে আবার দেখছি সামরিক শক্তির বিচারে চীন আমেরিকার কত পেছনে সেটি মেপে দেখিয়ে দাবি করছে, আমেরিকাকে কেউ নেতাচ্যুত করতে পারবে না। তাহলে সোজা আরেক কমন দিক হলো, এ দু’দলই মনে করেÑ গ্লোবাল এম্পায়ারের নেতা থাকার ব্যাপারটা আমেরিকার ইচ্ছা।
অথচ কেউ আর চাইলেও যেন গ্লোবাল লিডার বা এম্পায়ারের ভূমিকায় আমেরিকাকে রাখতে পারছে না বা চাইছে না, এটাই হলো বাস্তবতা। যে আমেরিকা আগে নিজেই ছিল গ্লোবাল নেতা, অর্থনৈতিক গ্লোবালাইজেশনের লিডার, পণ্য বিনিময় ব্যাপকভাবে দুনিয়ার কোণে কোণে ছড়িয়ে এক গ্লোবাল বিনিময় লেনদেনের ব্যবস্থা বা অর্ডার গড়ে তোলা ছিল যার লক্ষ্য, সেই আমেরিকা এখন ফিরে গ্লোবালাইজেশনের লিডার হওয়া ছেড়ে বুড়ো বয়সে এসে কেবল ‘আমেরিকান জাতির’ নেতা হওয়ার চেষ্টা শুরু করেছে যেটা অবশ্যই ব্যর্থ হবে। কারণ যে দুনিয়া একবার কথিত ‘জাতি’ থেকে গ্লোবালাইজড বিনিময়ের এক ব্যবস্থা বা অর্ডারে ঢুকে গেছে সে আর ফিরে ঘরোয়া একা একা নিজ সীমানার ‘জাতি ব্যবস্থায়’ ফিরে যাবে না, পারবে না। তবু ‘জাতি ব্যবস্থায়’ ফিরে যাওয়ার চেষ্টা ট্রাম্পের গত চার বছরের তৎপরতার প্রত্যক্ষ ফসল। শুধু তাই নয়, এতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবস্থা এমন জায়গায় চলে গেছে যে, বাইডেন জিতলেও ট্রাম্পের এক্সিকিউটিভ অর্ডার বা পলিসিগুলো আর বদলাতে বা পুরনো জায়গায় নিতে পারবেন না। বাইডেনকে ট্রাম্পের কাম-আকাম সবই অনুসরণ করে যেতে হবে। আর এভাবেই যেন আমেরিকা ক্রমশ শেষ হয়ে যেতে চাওয়ার রাস্তায় উঠে গেছে; শেষ দিনগুলোতে যতদিন না গ্লোবাল নেতা আমেরিকা এভাবে ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিজেকে বিলীন হওয়ার দিকে নিয়ে চলে যায়। চলতি সপ্তাহের ‘ইকোনমিস্ট’ ট্রাম্পের এমন নীতিগুলোর একটা তালিকা তৈরি করে রেখেছে।
আমেরিকার জন্য বাস্তব অসুবিধা হলো, কেউ গ্লোবাল অর্থনৈতিক নেতা হবে কি না এটা তার নিজের খেয়ালে নেয়া ইচ্ছায় সিদ্ধান্তের ইস্যু নয়। অন্যভাবে সরাসরি বললে, মূল কথাটা হলোÑ অর্থনৈতিক কারণে কোনো রাষ্ট্র যখন গ্লোবাল সারপ্লাস সঞ্চয় বা পুঞ্জীভবনের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়, এটাই সেই পূর্বশর্ত যে, সে গ্লোবাল অর্থনৈতিক নেতা হচ্ছে কি না।
যেমন ধরা যাক, আমেরিকা এখন খুবই আগ্রাসী হয়ে ইন্দো-প্যাসিফিক জোটের কথা বলে এগিয়ে আসছে। সম্ভবত সেটি ভারত যতটা ঘনিষ্ঠ হয়ে মাঠে আমেরিকাকে পেতে আকাক্সক্ষা করে, এর চেয়েও আগ্রাসীভাবে। কিন্তু তবু মোদি চীনের সাথে আপস করতেই ছুটে চলে গেলেন। কেন?
কারণ নরেন্দ্র মোদি জানেন তার দরকার এখন বিনিয়োগ-অবকাঠামো আর এফডিআই দুটোই। যার একটা, এফডিআই আমেরিকা হয়তো দিতে সক্ষম এমন বিশেষ সুবিধার শর্তে যে, আমেরিকান ব্যবসায়ীদেরই সরাসরি ব্যবসা, কারখানায় আসতে দিতে হবে। আর প্রথমটা অবকাঠামো বিনিয়োগ, এখানে আমেরিকা অপারগ। কাজেই এই আমেরিকাকে নিয়ে মোদি কী করবেন? কোন কাজে আসবে?
অর্থাৎ এই আমেরিকা আর গ্লোবাল নেতা নয়। এটা আমেরিকা মুখে দাবি করলেও হচ্ছে না। মোদির আমেরিকার প্রতি আকাক্সক্ষা থাকলেও তা কাজে আসছে না। আমেরিকায় যারা এটা মানছে না এরাই অসম্ভব জিনিসটা মেনে নিতে না পেরে পরিস্থিতিকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়ে নিজেদের ও দুনিয়াকে আরো দুস্থ অবস্থায় ফেলে দিতে পারে।

লন্ডন ইকোনমিস্ট সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন বাংলাদেশ নিয়ে এক আর্টিকেল ছেপেছে। শিরোনামÑ ‘ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক দুর্বল বলে চীনের সাথে বন্ধন শক্তিশালী হচ্ছে’। লেখাটায় কোনো লেখকের নাম নেই। যদিও লেখা পড়ে মনে হয়, প্রো-ইন্ডিয়ান বাংলাদেশের কোনো সাংবাদিকের সহযোগিতায় কোনো ইন্ডিয়ান বা পশ্চিমা সাংবাদিক এটি লিখেছেন। এই লেখক বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক কেন দুর্বল হলো বা চীনের সাথে কেন সবল হলো এর কোনো ব্যাখ্যা দেননি। এমনকি তিনি ধরে নিয়েছেন, ভারতের সাথে এখন যে সম্পর্ক দুর্বল হয়ে গেছে বলছেন তা আগে এটা সবল ছিল। কিন্তু এটা সবল ছিল কেন অথবা কবে থেকে সবল ছিল এরও কোনো ব্যাখ্যা দেয়া নেই এখানে। তবে পুরো রিপোর্টে একটা দুঃখবোধ চার দিকে ছড়িয়ে আছে যে, ভারতের সাথে সম্পর্কটা ঢিলা হয়ে গেছে।
আবার লেখার শুরুর প্যারায় প্রসঙ্গ হলো সিলেটের এয়ারপোর্ট নির্মাণের টেন্ডারে ভারতের এক কোম্পানি হেরে গেছে, চীনের এক কোম্পানি কাজ পেয়েছে। কিন্তু এটা কী করে চীন বা ভারতের সাথে সম্পর্কের দুর্বল বা সবল হওয়ার উদাহরণ হয়? এটা লেখক বলেননি। টেন্ডারে হেরে গেলে কার কী করার আছে? এটা তো বাংলাদেশের কারো সাথে সম্পর্ক সবল নাকি দুর্বল এর প্রমাণ হতে পারে না। পাঠকদের মনে এই প্রশ্ন থেকেই যাবে।
আবার বলা হয়েছে, গত জুন মাসে চীন বাংলাদেশের আমদানিতে ৯৭ ভাগ পণ্যে ডিউটি ফ্রি সুযোগ দিয়েছে। অথচ বটম লাইন হলো, এটাও ঠিক এখন দেয়া সুবিধা নয়। এসব প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল ২০১০ সালে ‘কম্প্রিহেনসিভ কো-অপারেশন’ নামে যে আলাপ শুরু হয়েছিল শেখ হাসিনার প্রথম চীন সফরের সময় থেকে, এতে ২০১২ সালে এ নিয়ে ডেইলি স্টারে চীনা রাষ্ট্রদূতের বিস্তারিত সাক্ষাতকার ও রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল। সেসব চীনা প্রস্তাব এই প্রথম কিছুটা কার্যকর করা হয়েছে, এই আর কি। এ ছাড়াও ওই লেখায় বলা হয়েছেÑ বাংলাদেশে কিভাবে ভারতের দখলদারসুলভ দম্ভ ও খারাপ আচরণে বাংলাদেশীদের মধ্যে ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্ট বাড়ছে।
আসলে ইকোনমিস্টের ওই রিপোর্ট অনেক জায়গাতেই প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। আর তা যে যার মতো কাজে লাগাচ্ছে। যেমন বিবিসি পরোক্ষে ওই রিপোর্ট নিয়ে আরেকটি রিপোর্ট করেছে। সেখানে ফোকাস হলো, ভারত না আবার কংগ্রেসও না, মোদি সরকারের কারণে বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক ঢিলা হয়ে গেছে। আর সম্পর্ক যে ঢিলা হয়েছে এর প্রমাণ হলো ইকোনমিস্টের ওই রিপোর্ট। রাহুল গান্ধীও ইকোনমিস্টের ওই রিপোর্টের বরাতে মোদির বিরুদ্ধে লম্বা টুইট করেছেন।
এতে লেখকের প্রো-ইন্ডিয়ান অবস্থান সবচেয়ে ভালোভাবে ধরা পড়েছে। তিনি লিখছেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়াকে ভারতের অবদান। আর দাবি করছেন সেই থেকে নাকি ‘দুই দেশের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ হয়ে আছে’। এ কথাটা কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বোঝেন, এমন লেখক বলতে পারেন না। তবে রাস্তার ধারে টংয়ের চা দোকানে বসে গুলতানির আলাপ হতে পারে এটা। কারণ দুই রাষ্ট্রীয় কোনো সম্পর্কের ভেতরে কখনো দয়া বা দান-ধ্যান ধরনের ধারণা থাকে না। দুই রাষ্ট্র দু’পক্ষের কোনো বিষয়ের মধ্যে উভয়েই নিজেদের স্বার্থ দেখতে পেলে একমাত্র তখনই তারা একসাথে কাজ করে, পদক্ষেপ নেয়। পরস্পরের পক্ষে খাড়া হতে সম্মত হয়। স্বার্থ কমন না হলে এটা করতেই পারে না। তাই এখানে কেউ কাউকে ‘দয়া’ করার কিছু নেই। বাংলাদেশকে সহায়তা করতে ভারতেরও স্বার্থ ছিল। বিশেষত পাকিস্তানের ওপর তার অবস্থান এতে আরো শক্ত হবে, সীমান্তে এবং কূটনীতিক সভা ও ফোরামগুলোতে ভালো অবস্থান সৃষ্টি হবেÑ এসব স্বার্থেই ভারত বাংলাদেশকে সেসময় সহায়তা করেছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তখনকার পাকিস্তানের অর্ধেকের বেশি সীমান্তে পাহারার দায় ও টেনশন কমে যায়। এটাও এক বিরাট লাভ।
অতএব ১৯৭২ থেকে ‘দুই দেশের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ হয়ে আছে’ এটি অমূলক কথা। ফ্যাক্টস হলো, ২০০৭ সালে আমেরিকা বাংলাদেশকে ভারতের হাতে ‘তুলে দিয়েছিল’; আমেরিকার পক্ষে চীন ঠেকানোর জন্য ভারতের কাজ করে দেয়ার বিনিময়ে ‘উপহার’ হিসেবে। কাজেই ২০০৯ থেকে ২০১৯ মোটামুটি এই সময়ে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ভারতের নিজের জন্য স্বর্ণযুগ বিবেচনা করা হয়, যেটা এর আগে কখনো বা ১৯৭২ সালেও ছিল না। আর ফাইনালি এখন সেটিই নানান কারণে চলতি বছর থেকে নানান সমীকরণে ক্ষমতাসীন সরকার আবার অনেক বেশি চীনমুখী হয়ে থাকাটা পাবলিকের স্বার্থ হোক আর নাই হোক, সরকারের ক্ষমতায় থাকার জন্য জরুরি মনে করা হচ্ছে।
কিন্তু এ নিয়ে রিপোর্ট লিখতে বসে, ভারতমুখী করে যা ইচ্ছা ব্যাখ্যা দেয়া তো অর্থহীন। বরং এটি ইকোনমিস্ট গ্রুপের সম্মান ইজ্জত ও ইন্টিগ্রিটি বা সততাকে ধুলায় লুটাবে। আমাদের কি মনে নেই, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে, যেটাকে দেশের মানুষ ‘নৈশভোটের নির্বাচন’ বলে চিনে, তাকে ইকোনমিস্ট গ্রুপের ‘ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’ ১২ ডিসেম্বর ২০১৮ ‘লীগ সরকার পুনর্নির্বাচিত হবে’ বলে প্রেডিকশন দিয়েছিল। অথচ এটা কেমন নির্বাচনী পূর্বাভাস বা ইন্টেলিজেন্স? এর মানে কি ইকোনমিস্ট জানত যে, এটি নৈশভোট হবে? তাই কি? ইকোনমিস্ট গ্রুপ কখনো এ নিয়ে অন্তত লজ্জা পেয়েছিল বলে শুনিনি।
আবার লেখকের কাণ্ডজ্ঞান দেখে আমাদের অজ্ঞান হওয়ার দশা। তিনি বাংলাদেশে চীনা ও ভারতীয় ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগের এক তুলনামূলক গ্রাফ দিয়েছেন। আচ্ছা, দুনিয়ার কোনো দেশে বিদেশী বিনিয়োগকারী হিসেবে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের কি খুব নামডাক? তারা কি খুবই যোগ্য আর তুলনীয়? তা-ও আবার প্রবল উঠতি অর্থনীতির হবু নেতা চীনের সাথে তুলনায়? তাতে ফলাফল কি দেখানো হয়েছে? বলা হয়েছে যে, এটি ১:১২ অনুপাতে। মানে, ভারতের এক হলে চীন এর ১২ গুণ বিনিয়োগকারী, চীনের আধিপত্যে। তাহলে এটা দিয়ে কি বুঝানো গেল? আর এতে কি উল্টা ভারতকে তুচ্ছ দেখানো হয়ে গেল না?
লেখক বলছেন ‘চীনা মুগ্ধতা দেখানো অশোভন ইঙ্গিত’। কেন, তা কিছুই বোঝা গেল না। কেবল পরের বাক্যে তিনি বলছেন, চীন বাংলাদেশকে সাম্প্রতিককালে সাতটি ফেন্ডশিপ ব্রিজ বানিয়ে দিয়েছে। হ্যাঁ দিয়েছে, আর সাথে একটি আধুনিক অডিটোরিয়ামও তৈরি করে দিয়েছে, আর সবই বিনা পয়সায়। প্রথমে বানিয়ে দিয়েছিল ঋণের অর্থে, পরে সব ঋণ সে মাফ করে দিয়েছে অনুদান হিসেবে।
সর্বসাকুল্যে এর খরচ সেকালের হিসাবে কয়েক শ’ মিলিয়ন ডলার। আর এ ছাড়া তা সাম্প্রতিককালের ব্যাপার নয় আর বাংলাদেশের দুই দলের সরকারের আমলেই ঘটেছে এমন পুরনো ঘটনা। কিন্তু মূল কথাটা হলো, যে চীন আমেরিকার বদলে গ্লোবাল এম্পায়ারের আসনে বসতে যাচ্ছে তার জন্য বাংলাদেশেও প্রভাব বিস্তারের জন্য কয়েক শ’ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করা কি বেশি ব্যয়? গত ৭২ বছরের নেতা আমেরিকা কি এমন কয়েক শ’ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে পরে মাফ করেনি, অনুদান দেয়নি? এশিয়া আফ্রিকায় এমন কতগুলো দেশের নাম চান? গুগলে সার্চ দিলেই টের পাবেন। গ্লোবাল আম্পায়ার হতে গেলে এমন অনেক খরচ করতেই হয়।
আসল ঘটনা অন্য, এককথায় আমেরিকা বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক করার কৌশলেও চীনের কাছে হেরে গেছে। আর তা আমেরিকার তথাকথিত ‘বাংলাদেশী এক্সপার্টদের’ ভুয়া পরামর্শের কারণে।
একে তো বাংলাদেশকে তারা ভারতের হাতে ‘তুলে দিয়েছেন’। আর শুধু এ জন্যই আমেরিকা বাংলাদেশ থেকে চির-বিতাড়িত হয়ে যেতে পারে। সে জন্য অন্তত কারেকশন হিসেবে আমেরিকার একবার মাফ চেয়ে আবার শুরু করা উচিত। এখনো সে দেশে পজিটিভ রাজনৈতিক ভূমিকা রাখার সুযোগ সব শেষ হয়নি, যদিও যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কথিত এক্সপার্ট আর দেশী বোকা এনজিও কর্তাদের কারণে। এরা এখন দাবি করেন, চীন-ভারত নাকি বাংলাদেশের সব ক্ষতি করে ফেলছে। এরা এখন টের পেয়েছেন, ভারত নাকি বাংলাদেশে পাকিস্তানের চেয়েও বড় শোষক ইত্যাদি...। আসলে এরা না বাংলাদেশের জন্য না আমেরিকার জন্য প্রয়োজনীয়, বা কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন।
চীন নিজের কাজ ও লক্ষ্য ঠিকমতোই বোঝে। কাজেই চীন বাংলাদেশের অবকাঠামো, বিদ্যুৎ ও টেলিকম ইত্যাদি সব খাত দখলে নিয়েছে বলে এখন আপসোস করার কী আছে? চীন যে বাংলাদেশে ব্যবসায় বিনিয়োগ-বাণিজ্য ও প্রভাব চায় তা কী করে পেতে হয় প্রতিযোগিতার যুগে তা ভালোই জানে আর প্রয়োজনীয় হোমওয়ার্কসহ সবকিছু তারা করে এসেছেন। হবু গ্লোবাল ইকোনমিক এম্পারার চীনকে এমনই তো হতে হবে। আমেরিকা এমন এম্পারার হয়েই গত ৭২ বছর ধরে রাজত্ব করেছে, তারা তো এমনি এমনিতে টিকে ছিল না! কিন্তু ‘শেষ বয়সে’ তার বাংলাদেশে নেয়া পদক্ষেপগুলো ছিল ধারাবাহিকভাবে ভুল আর ভুল। যেমন দেখুন, পদ্মা সেতুর দুর্নীতি ইস্যুতে বিশ্ব ব্যাংক যদি প্রশ্নই তুলে থাকে, শেষ করল না কেন? প্রমাণ করল না কেন? উল্টা মামলাটাই প্রত্যাহার করে সব ছেড়ে পালাল কেন? আর এমনভাবে ও এমন সময়ে পালাল যাতে বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিযোগী ও বিকল্প হিসেবে চীনের নিজেকে হাজির করা সবচেয়ে সহজ হয়।
চীন বিশ্ব ব্যাংকের চেয়ে অনেক বড় সক্ষম দাতা, উদীয়মান, পরিকল্পিত ও স্ট্র্যাটেজিক এবং সর্বোপরি লোকাল এজেন্ট বা কমিশন ব্যবস্থা সে রাখে। যে গ্রহীতা সরকার যেভাবে সন্তুষ্ট হয় সেটিই সে অনুসরণ করে। এটা কি ২০১৩ সালের আগে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট বা বিশ্ব ব্যাংকের স্ট্র্যাটেজিস্টরা বোঝেননি যে, প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে চীন এসে যাচ্ছে? যদি না বুঝে থাকেন এটাই তো প্রমাণ, চীন উত্তম ও যোগ্য গ্লোবাল ইকোনমিক এম্পায়ার হয়ে উঠেছে, যার সাথে তুলনায় আমেরিকার দিন ফুরিয়ে গেছে।
আবার গ্লোবাল রাজনৈতিক দিক, যে খাতে চীনের দেয়ার কিছুই নেই, অথচ কথিত এক্সপার্টদের কারণে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে আজ আমেরিকার কোনো আবেদন নেই। এর এক নম্বর কারণ খোদ আমেরিকায় মুসলমানদের সাথে তার বিদ্বেষী আচরণ। ভুলে গিয়েছিল আমেরিকান রাষ্ট্রের মানবাধিকারের প্রতি কিছু প্রতিশ্রুতি আছে যা রক্ষা করতে পারলেই কেবল সে আমেরিকা রাষ্ট্র আর, গ্লোবাল পলিটিক্যাল লিডার হয়ে থাকতে পারে।
মূল কথাটা হলো, যারা আমেরিকান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নেয় কেবল সেই ব্যক্তিরাই এ রাষ্ট্রের শত্রু। কিন্তু হোমল্যান্ড সিকিউরিটি এর অর্থ করেছেÑ ‘মুসলমানরা’ আমেরিকার শত্রু। এভাবে যেখানেই মুসলমান পেয়েছে তারা কিছু করুক আর নাই করুক সবাইকে সে উঠিয়ে এনেছে। এভাবে বুশের আমল থেকে এ পর্যন্ত ভুল পথে আমেরিকা হাঁটছে। এতে আমেরিকান রাষ্ট্রের ‘কবর’ ওই দিন থেকেই দেয়া হয়ে গেছে। এটা হয়ে গেছে, কারণ মুসলিমবিদ্বেষী আর নাগরিক বৈষম্যের রাষ্ট্র যে নিজের প্রতিশ্রুতি বা কনস্টিটিউশনই ধরে রাখতে পারে না, মানে না; সে তো আসলে মৃত। আবার এশিয়াতে তারা ভারতের সাথে কৌশলগত মিত্রতা করেছে। এর ঐক্যের ভিত্তিও এই দুই রাষ্ট্রও মুসলিমবিদ্বেষ, এরা মুসলমানদের নিজের রাষ্ট্রের শত্রু মনে করে। এটা তো হতেই পারে না। অথচ মৌলিক বোঝাবুঝিটা হচ্ছে, যেকোনো জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্য বা অসাম্য করা, এটা নিজ রাষ্ট্রকে বিলুপ্ত করে ফেলার শামিল। তাই আমেরিকা বা ভারত মুসলিমবিদ্বেষী রাষ্ট্র হয়ে যেতে বাধ্য, হয়েছেও তাই।
আমেরিকার আত্মস্বার্থও যারা বোঝে না আর মনভর্তি মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা নিয়ে আছে যারা; এমন কিছু প্রজন্ম চলতি শতকের শুরু থেকেই আমেরিকার প্রশাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে গেছে।
এবার, বাংলাদেশে যারা এক্সপার্ট আমেরিকার বন্ধু হিসেবে কাজ করেন তাদের দিকে দেখি। তারা মনে করেন, একজন ইসলামিস্ট কত দূর সেক্যুলার বা আধুনিকতা থেকে দূরে আছে তা মেপে রায় দেয়াটা তার কাজ। এর অর্থ, তাহলে একজন আল্লামা আহমদ শফী হুজুরকেও যেন তিনি মেপে বলতে আহ্বান জানাচ্ছেন যে, দেখুন তো, আমেরিকান এক্সপার্ট কতটুকু ইসলামিস্ট হয়েছি। বলাই বাহুল্য, এতে শফী হুজুরের মতো কোনো আলেমকে দাওয়াত দিয়ে আনা আর তাকে দিয়ে বলানো যে, আমি তো আপনার মতো কওমি মাদরাসায় পড়িনি তাই আমি আধুনিক বলে আমাকে নাকচ করে দেন। অথচ এটাও কোনো ইসলামিস্টের কাজ নয়।
ব্যাপারটা হলো, আমরা কেউ আরেকজনকে তার ইডিওলজি মেনে নিতে বা নিয়ে চলার দাওয়াত দিতে বা দাবি করতে পারি না। কারণ ওটা আমাদের কারোই কাজ নয়। বরং সব ইডিওলজির লোকেরা যেন পাশাপাশি বৈষম্যহীনভাবে সমান সুযোগসহ বসবাস করতে পারি এমন নীতির একটা রাষ্ট্রের জন্য সবাই ঐক্যমত হওয়া, এটাই আমাদের সবার কাজ। এতে এরপর থেকে সবাই ওই রাষ্ট্রের কমন নীতিগুলো মেনে চলা সাপেক্ষে সবার মতাদর্শ সবাই কারো সাথে একমত না হয়েই বাধাহীনভাবে চর্চা করতে পারি।
মানে কথিত এক্সপার্টরা আসলে নিজের আসল কাজটা কী তাই তো বোঝেননি। তারা ভেবেছেন, একজন ইসলামিস্ট যে প্রগতিশীল নয়, হতেও চায় না এই ফতোয়া দেয়া ও জারি রাখাই তার কাজ। ইসলামিস্টরা কত পশ্চাৎপদ তা দেখিয়ে দেয়াই যেন তার কাজ। ফলে এরই পরিণতি হলো ঘৃণার চর্চা বাড়িয়ে চলা।
আমেরিকা আবার উঠে আসার চেষ্টা করছে আমরা টের পাচ্ছি। কিন্তু তারা কি নিজেদের সংশোধন করে হাজির করতে সক্ষম হবেন?
তবে ইকনোমিস্ট সব শেষে তাদের এক রিডিং জানিয়েছে। বলেছে, চীনের কাছে খুব বেশি দায়বদ্ধ হয়ে যাওয়া নয়, আবার ভারতের প্রতি অবজ্ঞাপূর্ণ আচরণ না করা নিয়ে সতর্ক বাংলাদেশ। হ

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
মড়ঁঃধসফধং১৯৫৮@যড়ঃসধরষ.পড়স

 


আরো সংবাদ



premium cement