১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

হেমন্তের ধান ও আশ্বিনের ঝড়

-

শরতের শেষে আশ্বিনের ঝড়
ভেসে যায় ধান উড়ে যায় ঘর
আশ্বিনের ঝড়ে ঘর উড়ে গেলেও ধান আর ভাসে না। একসময় কৃষকের অন্যতম প্রধান ফসল ছিল হেমন্তের আমন ধান। তখন কৃষকের ফসলের ভাগ্য সম্পূর্ণরূপে প্রকৃতিনির্ভর ছিল। অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, পোকাসহ বিরূপ প্রকৃতি থেকে রক্ষা পেলেও শরতের শেষে আশ্বিনের ঝড় থেকে হেমন্তের ধানকে রক্ষা করা কঠিন ছিল। নদীমাতৃক দেশ হিসেবে কৃষকের অধিকাংশ জমির অবস্থান নদীকূলবর্তী এলাকায়। হেমন্তের ধান বর্ষার পানির সাথে পাল্লা দিয়ে ছাড়িয়ে যেত ১৫ ফুট পর্যন্ত। পরিবেশবান্ধব বিস্ময়কর এ ধানটি পানির সাথে সমন্বয় করেই ফলন দেয়। তাই মাঠের পর মাঠ ভর্তি থাকত সবুজ ধানে। হেমন্তের ধানক্ষেতে আশ্রয় নিত নানা রকম পাখি। দিনের বেলা কান পাতলেই শোনা যেত কোরার টুলুপ্ টুলুপ্ ডাক। রাতে কট্ কট্ করে ডেকে উঠত ব্যাঙছানারা। ধানের ডগায় আটকে থাকা শেওলা খেতে আসত নানা রকমের মাছ। ধান আলাদা করার পর গাছের লম্বা অংশ (নাড়া) দিয়ে হয় নিম্নবিত্ত মানুষ কাঁচাঘরের চাল, বেড়া ও রান্নার খড়ি। ধানের খড় গবাদিপশুর প্রিয় খাদ্য।
শরতের শুরুতেই কমতে শুরু করত বর্ষার পানি। পানি কমতে থাকার সাথে সাথে জট পাকাতে শুরু করে ধানের গাছ। ডিম থেকে বাচ্চা ফোটার আগে মুরগি যেভাবে কুঁকড়িমুকড়ি হয়ে ডিমের ওপর তা দেয়, ঠিক সেভাবে শীষ বের হওয়ার আগে ধানগাছও কুঁকড়িমুকড়ি হয়ে বসে থাকে। ধানগাছের এ অবস্থাকে স্থানীয় ভাষায় বলে ‘কোরচো’। কোরচোর পরই বের হয় ধানের শীষ। তখন কৃষাণের মন ঘরে টেকে না। ডিঙি নৌকায় করে সারা দিন ধানক্ষেতের পাশে ঘুরঘুর করে। দুই আঙুলে আলতো করে ধানগাছের পেট টিপে, ঘ্রাণ শোঁকে। পাতার গায়ে জমে থাকা ভোরের শিশির হাতে নিয়ে জিহ্বায় লাগায়, মুখ ধোয়। ধানগাছের পেট স্ফীত হতে দেখলেই বুঝতে পারে ভেতরে শীষ। শীষ উঁকি দিলেই আনন্দে অস্থির হয়ে পড়ে কৃষক। ধান নেয়ার জন্য উঠোন-বাড়িঘর পরিষ্কারসহ মেরামত করে ধানের গোলা। ঋতু পরিবর্তনের চিরায়ত নিয়মে ঠিক এ সময়ই সূর্য পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধ্বে লম্বভাবে কিরণ দিতে শুরু করে। সাগরের জলভাগ স্থলভাগের চেয়ে বেশি উত্তপ্ত হয়ে লঘুচাপের সৃষ্টি হয়। বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া লঘুচাপের কারণে স্থলভাগের ওপর টানা বৃষ্টিসহ ঝড়-বাদলকে ‘আশ্বিনের ঝড়’ বলে। লঘুচাপের প্রভাবে ফুলে ওঠে নদ-নদীর পানি। জটবাঁধা ধানগাছের গোড়া মাটি থেকে আলগা হয়ে পড়ে। জোর বাতাসে ক্ষেতের ধান সহজেই নেমে যায় নদীতে। ভয়ার্ত কৃষক অস্থির ডাকচিৎকারসহ দড়াদড়ি ও বাঁশ-খুঁটি নিয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করে ধান আটকানোর জন্য। কৃষকের কান্না ও পরিশ্রম উপেক্ষা করে ঝড়-ঝঞ্ঝা ও তীব্র স্রোত ভাসিয়ে নেয় মাঠের ধান। মুরগির বুক থেকে চিল ছোঁ মেরে বাচ্চা ছিনিয়ে নিলে মুরগির যে হাল হয়, আশ্বিনের ঝড় হেমন্তের ধান ছিনিয়ে নিলে সে হাল হয় কৃষকের।
ঋতু পরিবর্তনের অমোঘ নিয়মে শরতের শেষে আশ্বিনের ঝড় এখনো দেখা যায়। শুধু দেখা যায় না বর্ষা আর আমন ধানের ক্ষেত। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাসের ভাষায়, ‘১৯১১ সালে ১৮ হাজার জাতের ধানের একটি রেকর্ড আছে। ১৯৮৪ সালে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে করা একটি জরিপে ১২ হাজার ৪৮৭ জাতের হিসাব পাওয়া যায়। সর্বশেষ ২০১১ সালের জরিপ বলছে, বাংলাদেশে আট হাজার জাতের ধান আছে।’ অর্থাৎ গত ১০০ বছরে বিলুপ্ত হয়েছে দেশী জাতের ১০ হাজার ধান।
অপর এক তথ্যে প্রকাশ, ‘বর্তমানে অর্ধশতাধিকের বেশিসংখ্যক নতুন জাতের ধানের চাষ হচ্ছে বাংলাদেশে। এগুলো উচ্চ ফলনশীল (উফশী) বা আধুনিক ধানের জাত হিসেবে পরিচিত। সেই সাথে চাষ হচ্ছে হাইব্রিড ধান। বর্তমানে প্রতি বছর দুই কোটি ৬০ লাখ একর জমিতে ধানের আবাদ হয়। এর মধ্যে নতুন জাতের আবাদ করা হয় এক কোটি ৮৮ লাখ একরে। দেশী জাতের আবাদ দ্রুত কমে যাচ্ছে। সত্তর দশকে আমাদের দেশে শতকরা ৯৭ ভাগ জমিতে দেশী জাতের ধানের চাষ হতো। দেশী জাতের ফলন কম হওয়ায় তখন আমাদের হয়তো কম ভাত খেতে হতো কিন্তু ছিল তৃপ্তি। নতুন জাতের চাষ করে আমরা একই জমিতে ধানের উৎপাদন তিন গুণ বৃদ্ধি করেছি, ভাত বেশি খেতে পারছি কিন্তু তৃপ্তি কম।’
‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ প্রবচনটির বহুল ব্যবহার থাকলেও খাদ্যদ্রব্য হিসেবে ভাতের ব্যবহার শুরু হওয়ার সঠিক সময় জানা নেই। যতদূর জানা যায়, চীন ও জাপানের রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রায় ১০ হাজার বছর আগে ধান চাষ শুরু হয়েছিল। চীন দেশ থেকেই হোক আর জাপান থেকেই হোক, ধান ছড়িয়ে পড়েছিল পুরো এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে এবং সুদীর্ঘকাল ধরে এই বিশাল অঞ্চলে এটি প্রধান খাদ্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ১৫ ফুট গভীর পানিতে টিকে থাকাসহ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কয়েক হাজার ফুট উচ্চতায় ধান জন্মানোর মতো ব্যাপক অভিযোজন ক্ষমতার দরুন উত্তর কোরিয়া থেকে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত প্রধান শস্য ধান। বাংলায় খাদ্যশস্য হিসেবে ধানের প্রচলনের উদাহরণ পাওয়া যায় প্রাচীন পুণ্ড্রনগরে। ধানের অস্তিত্ব যেহেতু ছিল, সেহেতু ভাত খাওয়ার প্রচলনও ছিল সেই প্রাচীনকাল থেকেই।
বাবা ছিলেন একজন আদর্শ কৃষক। মাটি, ফসল ও গবাদিপশুর সাথে বাবার ছিল গভীর সখ্য। এ কারণেই পাশের জমি থেকে আমাদের জমিতে ফসল বেশি ফলত। মেঘনা ও কাঁঠালিয়া নদীবেষ্টিত দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে আমাদের গ্রাম। এ গ্রামে কয়েক ঘর মৎস্যজীবী ছাড়া সবাই গৃহস্থ পরিবার। কাপড়, লবণ ও কেরোসিন প্রভৃতি আবশ্যকীয় কয়েকটি দ্রব্য ছাড়া সব কিছুই আসত জমি থেকে। শুষ্ক মৌসুমে মিষ্টি আলু ও উচ্ছে (ছোট করলা) এবং বর্ষায় পাট ছাড়া আমাদের আর কোনো অর্থকরী ফসল ছিল না বললেই চলে। পাট বিক্রির টাকা ফুরিয়ে গেলে চাল বিক্রি করতে হয়। আমার পড়ালেখার খরচ চলত চাল বিক্রির টাকায়। চাল বিক্রির কথা উঠলে মা খুব বিব্রতবোধ করতেন। কারণ পরবর্তী ধান ওঠার আগে ঘরের চাল ফুরিয়ে যাওয়ার পরিণাম বাবার চেয়ে মা বেশি টের পেতেন। আমাদের ঘরে শতমণ ধারণক্ষমতার একটি গোলাঘর ছিল। যে বছর হেমন্তের ধান ঠিকমতো ঘরে উঠত সে বছর শনপাটের খড়ি দিয়ে নির্মিত গোলাঘরটি ধানে ধানে ভরে ওঠে।
বাবা চাইতেন, তার একমাত্র ছেলেও একজন আদর্শ কৃষক হোক। এ উদ্দেশ্যে শৈশবেই বাবা আমাকে নিয়ে মাঠে যেতেন। বোঝাতেন, ‘মাটির মতো খাঁটি আর কিছু হয় না। এ মাটির পানি ও ফসল খেয়ে সবাই বাঁচে, মরার পর এই মাটির বুকেই আশ্রয় হয়।’ বাবা আরো বলতেন, ‘যে যাই করুক, বাঁচার জন্য সবাইকে খাবার খেতে হয়। খাবারের একমাত্র জোগানদাতা কৃষক। কৃষকের ক্ষেতের ফসল মানুষ ছাড়াও খেয়ে বাঁচে হাজরো জীবজন্তু ও কীটপতঙ্গ।’ এসব বলে মাটি ও ফসলের সাথে আমার সখ্য সৃষ্টি করতে চাইতেন। মাটি ও ফসলের সাথে গভীর সখ্যের কারণেই, বাবার মতো অপরাপর কৃষককে দেখতাম, কনকনে শীত উপেক্ষা করে ভোররাতে লাঙল কাঁধে হাল নিয়ে মাঠে যেতে, চৈত্রের কাঠফাটা রোদে স্বল্প বসন গায়ে চড়িয়ে জমি চাষ করতে এবং ঝড়-ঝঞ্ঝা মাথায় করে ফসল ঘরে তুলতে। দেখেছি, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, বন্যা, পোকামাকড় ও আশ্বিনের ঝড়ে ধান ভাসিয়ে নেয়ার ভয়াবহতা। মাসের পর মাস মেঘের নাম-গন্ধ নেই। কাঠফাটা রোদে মাঠে ফেটে চৌচির। এক দিকে জমিতে লাঙল বসানো যায় না, অন্য দিকে ধেয়ে আসছে বর্ষা। এমন উভয় সঙ্কটে কৃষকের মুখের দিকে তাকানো যেত না। বৃষ্টির জন্য মসজিদ-মন্দিরে দোয়াসহ বৃষ্টির জন্য নামাজ আদায় করা হতো। আমরা শিশুরা কলাপাতা ও কুলা মাথায় করে নেমে পড়তাম মেঘের গান নিয়ে।
‘আল্লাহ মেঘ দে; আল্লাহ মেঘ দে
আল্লাহ মেঘ দে,পানি দে, ছায়া দে রে তুই,
আল্লাহ মেঘ দে।’
গানে গানে আল্লাহর কাছে মেঘ চেয়ে বাড়িবাড়ি ঘুরতাম। মহিলারা কলসভরা পানি নিয়ে কলাপাতার ওপর ঢেলে দিত। কলসের পানি খরার তাতানো উঠানে পড়ার সাথে বাষ্প উঠতে শুরু করত। বাষ্প নির্গত হওয়া উঠানের তপ্ত মাটিতে গড়াগড়ি যেতাম। একবার তো মেঘের গান চলাকালেই ঈশান কোণে মেঘ করে ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছিল।
অনাবৃষ্টির পরই সমস্যা ছিল অতিবৃষ্টি ও অকাল বন্যা। খরার পর বৃষ্টি শুরু হতেই শুরু হতো ফসল বোনার ধুম। দিনের সময়ে সঙ্কুলান করতে না পেরে রাতেও চলত ফসল বোনা। দেখতে দেখতে মাঠ ভরে উঠত কচি ফসলের সবুজ চারায়। ফসলের সবুজ চারা শক্ত হওয়ার আগেই শুরু হয় ঝড়-বৃষ্টি। নদী, খাল-বিলে বর্ষার আগমন, অন্য দিকে মুষলধারা বৃষ্টি। কৃষকের চোখে আবার হতাশার ছায়া। অতিবৃষ্টি ও বর্ষা মিলে শুরু হয় অকাল বন্যা। অসময়ে তলিয়ে যায় ফসলের মাঠ। সাথে সাথে তলিয়ে যায় কৃষকের স্বপ্নও। একসময় থামে বৃষ্টি, নেমে যায় অকাল বন্যার পানি। ততক্ষণে কচি ফসল মরে মাঠ বিরান ভূমি।
অনাবৃষ্টি ও অতিবৃষ্টি থেকে কৃষকের যে ক’টি জমি রক্ষা পায়, সে ক’টি জমি আক্রান্ত হয় কচুরিপানায়। নদীভর্তি হয়ে আসা কচুরিপানা সামান্য বাতাসেই প্রবেশ করে ফসলের মাঠে। দিন-রাত ঠেলাঠেলি করেও কচুরিপানা সরানো যায় না। লোকজন ও নাও লগি নিয়ে রাত-দিন খাটা-খাটনি করার পরেও জমির যে অংশ থেকে কচুরিপানা সরানো সম্ভব সে অংশের ফসল রক্ষা পায়।
ধানগাছের বড় শত্রু পামরি পোকা। স্থানীয় নাম ‘পিসি’। পামরি পোকা ধানের পাতার রস খেয়ে ডিম দেয় পাতার তলায়। ডিম থেকে কীট বের হয়ে পাতার আবরণের মধ্যভাগে অবস্থান নেয়। ক্ষুদ্র সাদা কীট পাতার সম্পূর্ণ রস খেয়ে ফেলে। কীট কাঁটাযুক্ত পাখা নিয়ে শুষ্ক পাতা থেকে বের হয়ে আসে। উড়ে গিয়ে অন্য পাতায় বসে। পামরি পোকার প্রজনন ক্ষমতা এত দ্রুত যে, কয়েক সপ্তাহে ফসলের সবুজ মাঠ বিরান ভূমিতে পরিণত করে দিতে পারে। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা ছাড়া পামরি পোকার কোনো প্রতিকার ছিল না।
ফসল ও প্রকৃতির সাথে কৃষকের খোঁড়াখুঁড়ির বিষয়টি রবীন্দ্রনাথ খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করেছেন। কবির জন্ম ও মৃত্যু পশ্চিমবঙ্গ হলেও কর্মক্ষেত্র প্রধানত পূর্ববঙ্গ। শিলাইদহ, শাহজাদপুর ও পতিসর এই তিন পরগনার জমিদারি দেখাশোনার সময় রচিত সাহিত্যের একটি বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে কৃষকসহ খেটেখাওয়া মানুষ। কৃষকের কল্যাণে নোবেল পুরস্কারের টাকা দিয়ে নওগাঁর পতিসরে একটি কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেছিলেন। কৃষকের কষ্ট দেখে কবি বসুমতিকে ‘কৃপণা’ আখ্যা দিয়ে তার কাছে প্রার্থনা করেন,

‘বসুমতি, কেন তুমি এতই কৃপণা,
কত খোঁড়াখুঁড়ি করি পাই শস্যকণা।
দিতে যদি হয় দে মা, প্রসন্ন সহাস,
কেন এ মাথার ঘাম পায়েতে বহাস।’
কবির প্রার্থনার উত্তরে ঈষৎ হেসে বসুমতি বলেন,
‘আমার গৌরব তাহে সামান্যই বাড়ে,
তোমার গৌরব তাহে নিতান্তই ছাড়ে।’
প্রকৃতির সাথে লড়াইকে কেউ কেউ সাধনার চোখে দেখেন। লড়াই কৃষকের গৌরব হ্রাস না করে বরং বৃদ্ধি করেছে। তাই অপর এক কবি তার কবিতায় বলেছেন,
‘সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা,
দেশ মাতারই মুক্তিকামী, দেশের সে যে আশা।’
শত সাধনায় লব্ধ বলে সবার প্রিয় হেমন্তকালের ধান। এই ধানের মতো স্বাদের খাদ্য আর কোনো ধানে হয় না। আমন ধানের মধ্যে যে ধানটি গভীর পানিতেও টিকে থাকতে পারে এর নাম লেঞ্জা আমন। প্রায় দেড় ইঞ্চি লম্বা লেজ থেকে ধানটির এরকম নাম হয়েছে। অপেক্ষাকৃত নিচু জমিতে ধানটি বুনতে হয় সবার আগে এবং কাটতে হয় সব ধান কাটার পরে। এ ধানের চালে মিষ্টি স্বাদসহ রয়েছে ভিন্ন একটা ঘ্রাণ (ফ্লেভার)। জ্বালাপিঠার জাউ (এখন বিলুপ্ত), গ্রামবাংলার শীতকালীন মুখরোচক খাবার। বিশেষ পদ্ধতিতে একদিন পাক করলে অনেক দিন খাওয়া যায়। খেজুর গুড় ও মচমচে মুড়ি যোগ করে মুখরোচক খাবারটির অন্যতম উপাদান লেঞ্জাধানের আওলা চাল। মা এ ধানটি যতœ করে রেখে দিতেন বারো মাস পিঠা-পার্বণসহ শীতকালে জ্বালাপিঠার জাউ খাওয়ার জন্য। বিন্নি ধানের খৈ-বাতাসা ছাড়া কোনো মেলা পার্বণই হয় না। লেঞ্জাচালের পিঠা-চিঁড়া একবার যে খেয়েছে, তার মুখে অন্য চালের পিঠা-চিঁড়া রুচবে না। লেঞ্জাধানের পরেই মুড়িওল ধান। লেজহীন গোলাকার মুড়িওল ধান দেখতে ছোট মটর দানার মতো। এ ধানের ভাত খুব বড় আকারের হলেও মুড়ির জন্য বিখ্যাত। এ জন্য উপযোগিতা থেকেই ধানটির নাম হয়েছে মুড়িওল ধান। এরকম কোনো চালের পিঠা মিষ্টি, কোনো চাল দিয়ে সুস্বাদু চিঁড়া, কোনোটা দিয়ে মচমচে মুড়ি, কোনোটা দিয়ে ফ্লেভারযুক্ত পায়েস। হৈমন্তিক শত প্রকারের ধানের চাল থেকে শত প্রকারের সুস্বাদু খাদ্য তৈরি হতো।
ষাটের দশকে যখন বাড়ি ছেড়ে সোনারগাঁও এলাকায় তখন প্রথম হাইব্রিড (ইরি) ধান দেখি। প্রকৃতির প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে ডিজেলচালিত ইঞ্জিনে নদী থেকে পানি তুলে ড্রেনের সাহায্যে পানি ছড়িয়ে দেয়া হয় মাঠে। তিন থেকে চার মাসে ধান ঘরে ওঠে। সোনারগাঁও স্কুল বোর্ডিংয়ে থাকাকালে বাড়ি থেকে আমন ধানের চাল এনে পাক করে খেতাম। আমার সহপাঠী আনত হাইব্রিড (ইরি) ধানের চাল। খেতে বসে ধবধবে সাদা হাইব্রিড চালের ভাতের দিকে নজর যেত। সাদা ভাতের সাথে বাদামি রঙের ভাত অদলবদল করতাম। দুই দিন অদলবদল করতেই জিহবা জানান দেয় ঠকে যাওয়ার বিষয়টি।
এর প্রমাণ ২০ মে, ২০১৮ দৈনিক কালের কণ্ঠে প্রকাশিত শামস শামীমের প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতি, ‘দেশী ধানের ছাউলের বাতের মজা জিফরায় (জিহ্বায়) লাগি থাখত। খাউয়ায় রুচিও আইন্যা দিত। যেকুনু তারাকারি দিয়া মজায় মজায় খাওয়া যায় দেশি ছাউলের বাত।’ হারিয়ে যাওয়া হেমন্তের ধানের স্মৃতিচারণা করে আক্ষেপের সুরে কথাটি বলছিলেন সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ধল এলাকার সত্তরোর্ধ্ব কৃষক মো: উরফত উল্লাহ। হ

লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক


আরো সংবাদ



premium cement