২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

খবরের কাগজই ভরসা

বৃত্তের বাইরে
-

ইলেকট্রনিক মিডিয়া রেডিও-টিভি উদ্ভাবনের পর গণমাধ্যমবিষয়ক একটি বিতর্ক দুনিয়াজুড়েই জোরালো ছিল। তর্ক ছিল, ছাপা পত্রিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে। এই আলাপের শুরু সেই গত শতকের ষাটের দশকে। চলে কয়েক দশক। ছাপা পত্রিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েন। একপক্ষের মতে, মুদ্রিত পত্রিকার দিন শেষ হলো বলে, সময়ের ব্যাপার মাত্র। অন্যপক্ষের অভিমত, খবরের কাগজের আবেদন ফুরাবে না। বাস্তবে, টিকবে কী টিকবে না সেই আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে সম্প্রচার সাংবাদিকতার সমান্তরালে ছাপা পত্রিকার জনপ্রিয়তা অটুট ছিল। স্বমহিমায় ছিল উদ্ভাসিত। তবে বছর দশেক হলো প্রিন্ট মিডিয়ার আগের সেই জৌলুশ আর নেই। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। ত্রাহি অবস্থা। বিশ্বজুড়ে সেই আলামত স্পষ্ট। কারণ অবশ্য ভিন্ন। ডিজিটাল প্লাটফর্মের দ্রুত উত্থানে খবরের কাগজের রাজস্ব আয়ে ধস নেমেছে। বিকল্প এই মাধ্যমের তোড়ে ছাপা পত্রিকার ভেসে যাওয়ার উপক্রম। বর্তমানে গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত বিজ্ঞাপনের বড় অংশের ভাগ বসাচ্ছে ডিজিটাল প্লাটফর্ম ফেসবুক ও গুগল। অথচ ছাপা পত্রিকার আয়ের প্রধান উৎসহ বিজ্ঞাপন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সব পত্রিকা বেকায়দায় দিন গুজরান করছে।
এত দিন ছাপা পত্রিকার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল রেডিও-টেলিভিশন। এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং সার্চ ইঞ্জিন নতুন আঙ্গিকে হয়ে উঠেছে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। বিজ্ঞাপনদাতারা বিকল্প মাধ্যমের দিকেই ঝুঁকছেন বেশি। ডিজিটাল প্লাটফর্মের মাধ্যমে খুব সহজে লাখ লাখ মানুষের কাছে অল্প সময়ে পৌঁছানো সম্ভব বিধায় বিজ্ঞাপনদাতাদের এই বাঁকবদল। বিজ্ঞাপন প্রকাশের বাঁক বদলে বিশ্বের তাবৎ প্রভাবশালী পত্রিকা কয়েক বছর আগে থেকেই জনবল ছাঁটাইয়ের পুরনো পথে হাঁটছে। তবে শেষ রক্ষা হচ্ছে না। উপরন্তু ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে মহামারী করোনার অভিঘাতে ‘নতুন স্বাভাবিক’ অবস্থায় গণমাধ্যমকর্মীদের ছাঁটাইয় আরো বেড়েছে। চলমান মহামারীর ছয় মাসে বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই অজস্র সংবাদমাধ্যমের প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেছে; হাজার হাজার সাংবাদিক চাকরি হারিয়েছেন এবং এ প্রক্রিয়া অব্যাহত। করোনাকাল সৃষ্ট ‘নতুন স্বাভাবিকের’ ঘূর্ণিস্রোতে সাংবাদিকরা অসহায়ভাবে ঘুরপাক খাচ্ছেন।
এমন বাস্তবতায় বাড়তি আয়ের আশায় একাধিক পথের সন্ধানে মরিয়া ছাপা পত্রিকা। দুনিয়াব্যাপী প্রিন্ট মিডিয়া আয় বাড়াতে ই-সংস্করণে মনোযোগী। কিন্তু তাতেও পত্রিকাগুলোর আয়-ব্যয়ে ভারসাম্য আসছে না। এই যখন অবস্থা, তখন বাধ্য হয়ে সংবাদমাধ্যম বিকল্প পথে এগোচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং সার্চ ইঞ্জিনের আয়ে নিজস্ব হিস্যা কিভাবে নিশ্চিত করা যায়; তার একটি অধিকার চায় মূলধারার গণমাধ্যম। এ ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের দাবিÑ ডিজিটাল প্লাটফর্মের নিজস্ব কোনো বিষয়বস্তু বা কনটেন্ট নেই। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত কনটেন্ট ধার করে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়ে বিকাশমান এ বিকল্প মাধ্যম সমকালে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। ফলে বিজ্ঞাপনের অর্থে বিপুল রাজস্ব আয়। যেহেতু তারা পত্রিকার কনটেন্ট ব্যবহার করে; সঙ্গত কারণে এই আয়ের একটি অংশের হকদার গণমাধ্যম। এক দশক আগেও সংবাদমাধ্যমের এ দাবি ছিল উপেক্ষিত। বিকাশমান ডিজিটাল প্লাটফর্ম পাত্তা দেয়নি। সুখবর হলো, এ বিষয়ে অস্ট্রেলীয় সরকার সংবাদমাধ্যমের পক্ষে এগিয়ে এসেছে। ফলে দাবিটি বোধ হয় আমলে নিতে হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সার্চ ইঞ্জিনকে। ফেসবুক ও গুগলের রাজস্বে সংবাদমাধ্যমের অধিকার প্রতিষ্ঠায় একটি খসড়া আইন প্রণয়ন করেছে অস্ট্রেলিয়ার সরকার। পার্লমেন্টে পাস হলে তা আইনে পরিণত হবে। তখন অস্ট্রেলিয়ায় ব্যবসা করতে হলে ফেসবুক-গুগলের মতো ডিজিটাল প্লাটফর্মকে সংবাদমাধ্যমের সাথে অর্জিত আয়ের ভাগাভাগিতে আসতে হবে। সারা বিশ্বে এভাবে রাষ্ট্র যদি এগিয়ে আসে, তাহলে সহজেই অনুমেয়, সংবাদপত্রগুলোর বর্তমান সঙ্কট মোকাবেলা সহজ হবে। কাটবে বর্তমান দুর্দিন।
এ ছাড়া আরেকটি বিকল্প নিয়ে ভাবছে সংবাদপত্র। বিজ্ঞাপনের বেশির ভাগই যখন গুগল, ফেসবুক ইত্যাদি ডিজিটাল প্লাটফর্মের কাছে চলে গেছে এবং ক্রমেই আরো বেশি মাত্রায় যাচ্ছে, তখন ভাবা হচ্ছে, সংবাদমাধ্যমের আয়ের প্রধান উৎস হবেন এর পাঠক-দর্শক শ্রোতা। আগামী দিনে গণমাধ্যম নির্ভর করবে নিজস্ব ভোক্তার ওপর, মানে পাঠকই হবে আয়ের প্রধান উৎস। দিন শেষে পাঠক, দর্শক-শ্রোতাই হবেন টিকে থাকার অবলম্বন। এই নমুনা টেকসই হলে গণমাধ্যমের ওপর বিজ্ঞাপনদাতাদের অযাচিত হস্তক্ষেপ খানিকটা কমবে বলে আশা করা যায়। সে ক্ষেত্রে পাঠকের অধিকার সংরক্ষণে সংবাদমাধ্যমকে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতায় যতœশীল হতে হবে। এতে সাংবাদিকতার গুণগতমানও বাড়বে। সমাজে সাংবাদিকের মর্যাদা মজবুত ভিত পাবে।
খবরের কাগজের সবচেয়ে বড় সম্পদ এর বিশ্বাসযোগ্যতা। এখনো ছাপা পত্রিকার খবর সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য উৎস। এর পরই রয়েছে বেতার। গণমাধ্যম পরামর্শক প্রতিষ্ঠান অরম্যাক্স মিডিয়ার সাম্প্রতিক এক জরিপে এমন তথ্যই জানানো হয়েছে। বিশ্বাসযোগ্যতার সূচক অনুযায়ী, ৬২ শতাংশ মানুষ ছাপা পত্রিকার খবর বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে করেন। ৫৭ শতাংশ বেতারের খবরে। আর ৫৬ শতাংশ টিভির খবরে আস্থা রাখে। দেখা যাচ্ছে, বিশ্বাসযোগ্যতার দিক দিয়ে ছাপা পত্রিকার স্থান প্রথম। অন্য দিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খবর ও কল্পকাহিনীর মধ্যে পার্থক্য করাটা সম্প্রতি কঠিন হয়ে উঠেছে। ভুয়া খবর যেভাবে বাড়ছে, তা-ও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। অরম্যাক্সের জরিপের এমন তথ্য ছাপা পত্রিকার সাংবাদিকদের জন্য মস্ত বড় একটি সুসংবাদ।
এখন ডিজিটাল ও সামাজিকমাধ্যমের বিস্তার ঘটেছে। তবে বিশ্বাসযোগ্যতা সেই হারে বাড়েনি। ওই জরিপে আরো দেখা যায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের খবরের বিশ্বাসযোগ্যতার হার ৩২ শতাংশ। আর হোয়াটসঅ্যাপের মতো মেসেঞ্জার অ্যাপের খবর ২৯ শতাংশ মানুষ বিশ্বাসযোগ্য মনে করে। ডিজিটাল অ্যাপগুলোর মধ্যে টুইটারের খবরের বিশ্বাসযোগ্যতা বেশি। ৫৩ শতাংশ মানুষ টুইটারের খবর বিশ্বাস করে। অন্য দিকে ৩১ শতাংশ টেলিগ্রামে, ৩০ শতাংশ ফেসবুকে, ২৯ শতাংশ ইনস্টাগ্রামে ও ২৮ শতাংশ হোয়াটসঅ্যাপের খবরে বিশ্বাস করে।
জরিপের পর গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বের প্রতিক্রিয়া হলোÑ আরো বহু বছর ধরে ছাপা পত্রিকাই যে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাসযোগ্য গণমাধ্যম হিসেবে থাকবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ছাপা পত্রিকার খবর সবচেয়ে বেশি যথার্থ ও সঠিক। মানুষ ডিজিটাল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা সম্প্রতি প্রকাশ করা হচ্ছে, তা আদৌ সঠিক কি না জানতে ছাপানো পত্রিকা হাতে আসার জন্য অপেক্ষা করেন। ছাপা পত্রিকা কেবল সংবাদ সরবরাহ করে না। এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ইকোনমিক টাইমসের খবরে জানানো হয়, জরিপের ফল অনুযায়ী, ৬১ শতাংশ মানুষ ভুয়া সংবাদ নিয়ে উদ্বিগ্ন। ভুয়া খবরের বিষয়ে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শৈলেশ কাপুর বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে ভুয়া খবর ছড়িয়ে নির্বাচন প্রভাবিত করা হয়েছে। এটি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো অতটা না হলেও বর্তমানে ভারতের জন্যও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। নিয়ন্ত্রণ না করলে সামনের বছরগুলোতে আরো বড় বিষয় হয়ে উঠতে পারে।
অরম্যাক্স মিডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা শৈলেশ আরো বলেন, ভুয়া ‘সংবাদ নিয়ে উদ্বেগ ও আলোচনা বিশ্বজুড়ে চলছে। প্রতি মাসেই ভুয়া সংবাদ নিয়ে জটিলতা বাড়ছে। সংবাদ পাঠকদের ধারণা কেমন, তা বুঝতে প্রতি ছয় মাসে এ ধরনের জরিপ চালানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।’ ইকোনমিক টাইমসকে তিনি বলেন, টিভির খবরগুলো পত্রিকার মতো বিশ্বাসযোগ্য হওয়া উচিত। কিন্তু সে রকম হচ্ছে না। আর এটা টিভি সংবাদের জন্য বড় সমস্যা।
সব কিছুর পর এ কথা বলা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে ছাপা পত্রিকার ঘোর দুর্দিন চলছে এটি সত্যি, কিন্তু এরপরও দিন শেষে খবরের কাগজের পরিবেশিত প্রতিবেদনের প্রতি পাঠকের এই যে আস্থা, তাতে আগামী দিনেও প্রিন্ট মিডিয়া বহাল তবিয়তে থাকবে এটাই মূলধারার গণমাধ্যমের বাস্তবতা। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement