২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ফয়েজ, ফিলিস্তিন ও ইমরান খান

-

ইউসুফ আস-সিবায়ি মিসরের অন্যতম প্রসিদ্ধ সাংবাদিক ও সাহিত্যিক ছিলেন। তিনি মিসরের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা আলআহরামসহ কয়েকটি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। আনোয়ার সাদাত মিসরের প্রেসিডেন্ট হলে তিনি ইউসুফ আস-সিবায়িকে তার সংস্কৃতিমন্ত্রী বানিয়ে দেন। মন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তিনি আফ্রিকান ও এশিয়ান সাহিত্যিকদের মুখপত্র ‘লোটাস’-এর অফিস ত্যাগ করেননি। এটি প্রগতিশীল সাহিত্যিকদের মুখপত্র ছিল যার খরচ বহন করত সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকার। তবে তার আরবি সংস্করণ কায়রো থেকে বের হতো। আর মিসর সরকারও এর পৃষ্ঠপোষকতা করত। ১৯৭৭ সালের নভেম্বরে ইউসুফ আস-সিবায়ি ওই প্রতিনিধিদলেও ছিলেন, যারা আনোয়ার সাদাতের নেতৃত্বে ইসরাইল সফর করেছিলেন। সাদাত ও আস-সিবায়ি উভয়ের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা শুরু হয়। ইউসুফ আস-সিবায়ি ১৯৭৮ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে আফ্রিকান ও এশিয়ান সাহিত্যিকদের এক কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করার জন্য সাইপ্রাস যান। সেখানে তাকে ফিলিস্তিন স্বাধীনতা সংগঠন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ‘আবু নিদাল গ্র“প’ হত্যা করে। তা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ইসরাইলের সাথে ক্যাম্প ডেভিডে সমঝোতায় স্বাক্ষর করেছিলেন। দুই বছর পর সাদাতকে সামরিক প্যারেড পরিদর্শনের সময় হত্যা করা হয়।
ইউসুফ আস-সিবায়ির হত্যার পর লোটাসের একজন নতুন সম্পাদকের প্রয়োজন দেখা দেয়। আফ্রিকার দেশ অ্যাঙ্গোলায় আফ্রিকান ও এশিয়ান সাহিত্যিকদের সংগঠনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বলা হলো, লোটাসের দায়িত্ব পাকিস্তানের বিখ্যাত কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজকে অর্পণ করা হোক। সমস্যা ছিল, মিসরের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনার পর ওই পত্রিকা কায়রো থেকে প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না। কেননা এ পত্রিকা মার্কিন ও ইসরাইলি নীতির সমালোচক ছিল। ওই বৈঠকে ফিলিস্তিনি কবি মুঈন বেসিসু বৈরুত থেকে লোটাস প্রকাশের প্রস্তাব করেন। তিনি পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাতের সাংস্কৃতিক উপদেষ্টাও ছিলেন এবং ১৯৭৯ সালে বৈরুতে আরাফাতের সাথে ফয়েজ সাহেবের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেন। আর এভাবে বৈরুত থেকে লোটাস প্রকাশ শুরু হয়। এটা ছিল লেবাননে গৃহযুদ্ধের সূচনাকাল। আর ফয়েজ আহমদ অসুস্থ শরীর নিয়েও নিজের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে ফিলিস্তিন স্বাধীনতা আন্দোলনের অংশ হয়ে গেলেন। কেননা তার দিনরাত ফিলিস্তিনি মুজাহিদদের সাথে অতিবাহিত হতে থাকে।
২০০৬ সালে লেবানন ও ইসরাইলের যুদ্ধ চলাকালে বৈরুতে আমার বেশ কিছু দিন থাকার সুযোগ ঘটেছিল। ওই যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহের সময় বৈরুতে আমার এমন কিছু সাংবাদিকের সাথে সাক্ষাৎ হয়, যারা ফয়েজকে কাছ থেকে দেখেছেন। তারা জানিয়েছিলেন, ফয়েজ সাহেব মিসরীয় কণ্ঠশিল্পী উম্মে কুলসুমের পক্ষ থেকে ইকবালের গীত কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে তাদের বলতেন, পাকিস্তানের জাতীয় কবি আল্লামা ইকবালের ফিলিস্তিনিদের প্রতি বেশ ভালোবাসা ছিল। বৈরুতে থাকাকালে ফিলিস্তিনের মুফতি আজম আমিন আল হোসাইনির কবরে আমার ফাতেহা পাঠের সৌভাগ্য হয়েছে। জানতে পারলাম, মুফতি আমিন আল হোসাইনি শুধু একজন আলেমে দ্বীন ছিলেন না, বরং তিনি ফিলিস্তিনিদের সশস্ত্র আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে শামিল ছিলেন এবং কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে তার সুগভীর সম্পর্ক ছিল। বৈরুত থেকে পাকিস্তান ফিরে এসে মুফতি আমিন আল হোসাইনি ও পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতার মাঝে লেনদেন হওয়া পত্রাবলি অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমি ইখওয়ানুল মুসলিমিনের নেতা হাসানুল বান্না ও কায়েদে আজমের মধ্যে আদান-প্রদানকৃত পত্রাবলিরও সন্ধান পেয়ে গেলাম; যা ড. যাওয়ার হোসাইন যায়দি সঙ্কলিত ‘জিন্নাহ পেপারস’-এ সংরক্ষিত আছে। বিস্মিত হলাম, ফিলিস্তিন সম্পর্কে আল্লামা ইকবাল ও কায়েদে আজমের দর্শনকে আমাদের পাঠ্যসূচিতে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়নি। সম্ভবত তার কারণ হচ্ছে, ফিলিস্তিন সম্পর্কে ইকবাল ও কায়েদে আজমের বক্তব্য ও পত্রাবলিতে ব্রিটেন ও আমেরিকার ব্যাপারে অনেক শক্ত ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। কিছু স্থানে ‘কায়েদে আজম’ ফিলিস্তিন সমস্যাকে কাশ্মির সমস্যার সাথেও সংযুক্ত করে দিয়েছেন। ফিলিস্তিন সমস্যা নিয়ে ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত অলইন্ডিয়া মুসলিম লিগ ১৮টি প্রস্তাব পাস করে। এগুলোতে ব্রিটিশ সরকারের কঠোর সমালোচনা করা হয়। এ প্রস্তাবাবলি ওই সব নামসর্বস্ব ইতিহাসবিদের মুখ বন্ধ করে দিতে যথেষ্ট, যারা মাঝে মধ্যে পাকিস্তান আন্দোলন ও কায়েদে আজমের সংগ্রামের পেছনে ব্রিটিশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা অনুসন্ধান করে বেড়ান। তবে ফয়েজ আহমদ ফয়েজের একনিষ্ঠ চিন্তাকে সালাম জানাই, যিনি আঞ্জুমানে তারাক্কিপাসান্দ মুসান্নিফিনের (প্রগতিশীল লেখক সংগঠন) নির্দেশে ইকবালের নিন্দা জানাতে অস্বীকার করেছিলেন। এটা রুশপন্থী লেখকদের সংগঠন ছিল। কিন্তু ফয়েজ রাশিয়াকে খুশি করার জন্য ইকবালের নিন্দা করতে অস্বীকার করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ইকবালের ফারসি কাব্যগ্রন্থের ‘পায়ামে মাশরিক’ উর্দু অনুবাদ করেন। এখন অনেক প্রগতিবাদী নিজেদের শুধুই লিবারেল দাবি করেন। প্রতি বছর ফয়েজ দিবস পালন করেন তারা। কিন্তু ফয়েজ দিবসে ফয়েজের ইকবালের প্রতি ভালোবাসার উল্লেখ করেন না। ওই বুদ্ধিজীবীদের কিছু ব্যক্তি আজকাল আমাদের ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করার উপকারিতা বর্ণনা করে যাচ্ছেন। যখন তাদের ইকবালের এ কবিতা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়Ñ হ্যায় খাকে ফিলিস্তিন পে ইহুদি কা আগার হাক/হাসপানিয়া পার হাক নাহি কিউঁ আহলে আরাব কাÑ অর্থাৎ ফিলিস্তিন ভূমির ওপর যদি থাকে ইহুদির অধিকার/তা হলে স্পেনের ওপর অধিকার নেই কেন আরব জাতির?
তখন জবাব আসে, ইকবাল একজন মৌলবাদী ছিলেন। ওই বুদ্ধিজীবীদের কাছে আগে ইকবাল ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের অনুগত তল্পিবাহক। আর আজকাল ইকবাল হয়েছেন ‘মৌলবাদী’। একই ব্যাপার ঘটেছে কায়েদে আজমের ক্ষেত্রেও। তার ব্যাপারে স্বয়ংক্রিয় বাস্তবতার নামে বলা হয়েছে যে, তিনি ২৩ মার্চ, ১৯৪০ সালের প্রস্তাব ইংরেজদের কথামতো মঞ্জুর করান। এ অভিযোগ আরোপকারীরা ভুলে গেছেন যে, ২৩ মার্চ, ১৯৪০ শুধু একটি পৃথক রাষ্ট্রের প্রস্তাব মঞ্জুর হয়নি, বরং আরো একটি প্রস্তাব ফিলিস্তিনিদের পক্ষেও মঞ্জুর করা হয়েছিল। ৩০ জুলাই, ১৯৪৬ কায়েদে আজম তার বক্তৃতায় ইহুদিদের পরিবর্তে ইহুদিবাদের সমালোচনা করে বলেন, এরা আমেরিকার নাক ধরে যে দিকে ইচ্ছা সে দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং আমেরিকা ও ব্রিটিশ ফিলিস্তিন থেকে বের হয়ে যাক এবং আরব ও ইহুদিদেরকে তাদের সমস্যা তাদেরকেই সমাধান করতে দেয়া হোক। ৩১ জুলাই, ১৯৪৬ সালের ডন পত্রিকায় এ বক্তৃতা বিস্তারিত রয়েছে। পাকিস্তান গঠনের পরপরই আইনপ্রণেতা অ্যাসেম্বলি ফিলিস্তিনিদের পক্ষে প্রস্তাব পাস করেছিল। আর ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ কায়েদে আজম মুফতি আমিন আল হোসাইনিকে পত্রে আশ্বাস দেন, আমরা আপনাদের স্বাধীনতার ব্যাপারে কোনো সমঝোতা করব না। কায়েদে আজমের চিন্তাভাবনাকে পাকিস্তানের প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো সার্বিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যান। আর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও খোলাখুলি বলে দিয়েছেন, ইসরাইলের ব্যাপারে পাকিস্তানের নীতি সেটাই বলবৎ থাকবে, যা কায়েদে আজমের ছিল। ইমরান খানের জন্য এ কথাগুলো বলা সহজ ছিল না। তিনিও তার পররাষ্ট্র দফতরের মতো গোলমেলে বক্তব্য দিতে পারতেন। পররাষ্ট্র দফতর ও ইমরান খানের অবস্থানের মাঝে স্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। এর দ্বারা বোঝা যায়, পাকিস্তানের ওপর চাপ রয়েছে। পাকিস্তানের উচিত, ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টিকারীদের বলা, আমরা অনেক কষ্টে উগ্রবাদ নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। যদি পাকিস্তানের ওপর এমন কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়, তা হলে তার প্রতিক্রিয়ায় উগ্রবাদ আবার ছড়িয়ে পড়বে। এ জন্য আমাদের আল্লামা ইকবাল ও কায়েদে আজমের পথে থাকতে দাও।
পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ২০ আগস্ট, ২০২০ সংখ্যা হতে উর্দু থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট, প্রেসিডেন্ট জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)


আরো সংবাদ



premium cement