১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রাজনীতি ও করোনা ব্যাধি কী?

-

গত ২৮ জুলাই রাতে দৈনিক ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্তের সঞ্চালনায় আরটিভিতে ‘রাজনীতি কি আলাদিনের চেরাগ’ বলে প্রশ্নকেন্দ্রিক টকশো হয়ে গেল। এর পরে ২৩ আগস্ট রাতে খান মোহাম্মদ রুমেলের সঞ্চালনায় এবার সময় টিভির সম্পাদকীয় বিষয় হিসেবে চেরাগ শব্দের পুনঃব্যবহারে ‘করোনা চেরাগ’ বলে টকশো অনুষ্ঠিত হয়েছে। ফলে রাজনীতি, করোনাব্যাধি ও চেরাগের অর্থগত পার্থক্যে এখানে ব্যবহারিক অসঙ্গতির বিষয়টি হয়েছে উপেক্ষিত।
রাজনীতি কী, কেন ও নিজের খেয়ে-পরে কী জন্য করার ক্ষেত্রেও প্রশ্নোত্তরেও সচেতন প্রধান ও অসচেতন নবীন-প্রবীণদের মধ্যে থাকবে মতভেদ। বর্তমান বিশ্বের বহু দেশেই পরাধীনকালের সাথে স্বাধীনতা- উত্তরকালের রাজনীতির গুণগত মানের ক্রমাগত অধঃগতির তুল্যতায় বুঝা যায় যে, আগেরটি আত্মবিসর্জনের এবং পরেরটি আত্মতোষণের, যার সহজ উপায়স্বরূপ অধিকাংশেরই ব্যবসায়িক পেশায় রাজনীতিকে নেশা রূপে গ্রহণের ঘটনা ঘটেছে। স্যামসন অভিধানে ঢ়ড়ষরঃরপড় শব্দের এক অর্থে রাষ্ট্রনীতিক এবং অন্যটিতে (নিন্দার্থে) রাজনৈতিক কার্যাদিতে উৎসাহী বা লিপ্ত ব্যক্তি বলা হয়েছে। গণতান্ত্রিক অধিকার ও দল গঠনের প্রয়োজনীয়তার সুযোগে তাদের উৎসাহী হওয়া স্বাভাবিক। একসময় ইংল্যান্ডে এমন অবস্থার সমালোচনায় সে দেশের লেখক রবার্ট লুইস স্টিভেনসন (১৮৫০-১৮৯৪) বলেছিলেন, ‘চড়ষরঃরপং রং ঢ়বৎযধঢ়ং ঃযব ড়হষু ঢ়ৎড়ভবংংরড়হ ভড়ৎ যিরপয হড় ঢ়ৎবঢ়ধৎধঃরড়হ রং ঃযড়ঁমযঃ হবপবংংধৎু.’ (রাজনীতিই হয়তো একমাত্র পেশা, যার জন্য কোনো প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে বলে মনে করা হয় না)। রাজনৈতিক অসচেতনতা, অজ্ঞতা ও দরিদ্রতা অধ্যুষিত দেশেই বিশেষত বেকার, সুবিধাবাদী ও সুযোগ-সন্ধানীরা কার্যত রাজনীতির সদুদ্দেশ্যে নয়, বরং নানা প্রত্যাশায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বা তার পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার সম্ভাব্য দল পছন্দে বেশি আগ্রহী হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে, অর্থাভাব ছাড়াও ক্ষমতা না পাওয়া কিংবা যাওয়া দলের নীতি-আদর্শ যতই মহৎ হোক, এর উৎসাহী অনুগামী মেলা ভার।
ব্রিটিশ লেখক সমালোচক জোনাথন সুইফট (১৬৬৭-১৭৪৫) বলেছিলেন, ‘চধৎঃু রং ঃযব সধফহবংং ড়ভ সধহু ভড়ৎ ঃযব মধরহ ড়ভ ধ ভব.ি’ (দল হল অল্প কয়েকজনের লাভের জন্য অনেকের পাগলামি)। এর প্রায় শত বছর পরে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন ডিজরেইলি (১৮০৪-১৮৮১) বলেছিলেন, ‘চধৎঃু রং ড়ৎমধহরুবফ ড়ঢ়রহরড়হ.’ (দল হচ্ছে, সংগঠিত মতামত)। অবশ্য সকল সদস্যের রাজনৈতিক জ্ঞানসাপেক্ষে উন্নত বিশ্বে কথাটি সত্য হলেও, উন্নয়নশীল বিশ্বে তা নয়। এর অনেক দেশেই ক্ষমতার লক্ষ্যে দলীয় শক্তি-সমর্থনের জন্য সংগঠন বিস্তৃত করে পূর্বোল্লিখিত দুই মতের সমন্বয়ে দলকে সুসংগঠিত ও পরিচালন করা হয়। অর্থাৎ ‘দলীয় সবার লাভের জন্য সংগঠিত মত’। অন্যথায় এসব দেশে অনেকেরই ক্ষমতার লাগামহীন অপব্যবহারে অবৈধ অর্থ অর্জন এবং তা বিদেশে পাচারপূর্বক কারো কারো বিদেশের ব্যাংকে জমা করে নিজ নিজ দেশ ও জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়।
কোনো কোনো আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মোদ্দাকথায়, সরকারি দৈনন্দিন কাজের পর্যালোচনাই রাজনীতি। কিন্তু আরো একটা অত্যাবশ্যকীয় বিষয় হলো, রাজনীতি অতীতের সাথে বর্তমানের নিরিখে ভবিষ্যৎ নির্ণয়ের জ্ঞান। এ কারণেই রাজনৈতিক বিতর্কে ইতিহাস টানা হয়। প্রায় ২৪ শত বছর আগে গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস (৪৭০-৩৯৯ খ্রি: পূর্ব) শাসক দলের স্বার্থ রক্ষায় আইন প্রণয়নকে ন্যায়পরায়ণতা মনে করার ধারণা খণ্ডন করে বলেছিলেন, “অং ধ ঢ়যুংরপরধহ ংঃঁফরবং ধহফ বীবৎপরংবং যরং ঢ়ড়বিৎ হড়ঃ রঃ যরং রহঃবৎবংঃ নঁঃ রং ঃযব রহঃবৎবংঃ ড়ভ ধ ঢ়ধঃরবহঃ. ঞযব মড়াবৎহসবহঃ ড়ভ ধহু শরহফ ংযধষষ ফড় যিধঃ রং মড়ড়ফ ভড়ৎ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব ভড়ৎ যিড়স রঃ বীবৎপরংবং ধৎঃ.” (একজন চিকিৎসক তার ক্ষমতা যেমনি স্বীয় স্বার্থ ব্যতিরেকে চর্চা করেন রোগীর স্বার্থে, তেমনি যেকোনো পদ্ধতির সরকার যা ভালো তাই করবে জনস্বার্থে, যাদের জন্য চর্চিত হয় ক্ষমতা)। কথাটির অনস্বীকার্য গুরুত্ব আজো কোথাও হচ্ছে বিবেচ্য-কোথাও বা না। একজন চিকিৎসক অর্জিত জ্ঞানের যোগ্যতায় এমন ক্ষমতা লাভ করেছেন; তদ্রƒপ প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক জ্ঞান যদি কোনো সরকার বা রাজনীতিকের না থাকে, তবে তাকে নির্বাচিত বা রাজনীতিক বিবেচনায় সমর্থনের দায় জনগণ এড়াতে পারে না। দেশ, সমাজ ও জনহিতকর মহান ব্রতের নাম ‘রাজনীতি’, যার সাথে দরিদ্রনীতি বেমানানÑ এর প্রাপ্তি হলো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা।
আরব্য উপন্যাসের ‘আলাদিন ও আশ্চর্য প্রদীপ’ নামক গল্পে হাতে থাকা এই প্রদীপ বা চেরাগে ঘর্ষণ করা মাত্র তার ‘অদৃশ্য দায়’ উপস্থিত হয়ে আলাদিনের হুকুম শুনে তা তামিল করে। একজন চাকরিজীবী পদাধিকার বলে প্রাপ্ত ক্ষমতার অপব্যবহারে বিত্ত-বৈভব অর্জন করতে পারেন, যা করোনার সুযোগে সংশ্লিষ্ট অনেকে হয়তো করেছেন। কিন্তু একজন রাজনীতিক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বা এর পৃষ্ঠপোষকতা ব্যতীত তা করা দূরের কথাÑ নুন আনতে তার পান্তা ফুরাবারই কথা। তাই চেরাগ যখন শক্তি বা ক্ষমতা, তখন রাজনীতি ও করোনা ব্যাধিকে চেরাগ বলা যায় না। শব্দটির যথার্থ প্রয়োগে গত ২৭ আগস্ট দৈনিক মানবজমিনের একটা সংবাদ শিরোনাম হয়েছে, ‘৩০ হাজার টাকা বেতনের চাকরি ছিল আলাদিনের চেরাগ।’
মিডিয়ার এক বড় দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো, শিক্ষকের ভূমিকা পালন। কারণ তাদের মাধ্যমেই দর্শক, শ্রোতা ও পাঠকরা সহজে অনেক কিছু জানতে ও শিখতে পারেন। তাই এ ব্যাপারে সতর্কতা কাম্য। উল্লেখ্য, প্রকাশিত বইয়ে মনগড়া তথ্য এবং মিডিয়ায় প্রচারিত ভুল তথ্যের ব্যাপারে আরো কয়েকবার লিখেছি। হ


আরো সংবাদ



premium cement