২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

স্মরণীয় বরণীয় মাহবুব আলী খান

-

সাহসিকতা, নির্ভীক দেশপ্রেম আর জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন মরহুম রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খান। তার জন্ম ১৯৩৪ সালের ৩ নভেম্বর সিলেটের বিরাহিমপুরে। বাবা ছিলেন অবিভক্ত ভারতের প্রথম মুসলিম ব্যারিস্টার আহমেদ আলী খান ও মা জুবাইদা খানম। দাদা ছিলেন তৎকালীন ভারতের বিশিষ্ট চিকিৎসক খানবাহাদুর আজদার আলী খান। শৈশবের অনেকটা সময় কাটে সিলেট এবং বাবার কর্মস্থল কলকাতায়। সেখানেই প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু। পরবর্তীতে চলে আসেন ঢাকায়। ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। শিক্ষাক্ষেত্রে জীবনে তিনি কোনো পরীক্ষায় দ্বিতীয় হননি। ১৯৫২ সালে ক্যাডেট হিসেবে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগ দেন। পরে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাজ্যে যান। সেখানকার ডারমাউথ রয়্যাল নেভাল কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেন। ১৯৬৩ সালে মাহবুব আলী খানকে ব্রিটেনের ‘রানী এলিজাবেথ বিশেষ পুরস্কারে’ ভূষিত করেন।
১৯৭১ সাল। মাহবুব আলী খান তখন সপরিবারে কর্মস্থল করাচিতে। পাকিস্তানিরা তখন বাঙালি অফিসারদের অবিশ্বাস ও সন্দেহ করতো। মাহবুব আলী খান যখন দেশ মাতৃকার টানে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, ঠিক তখনই তাকে সপরিবারে নজরবন্দী করা হয় ক্যান্টনমেন্টে। কিন্তু তিনি ব্যাকুল হয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে। সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। একদিন আসে পাকিস্তানি বাহিনীর আগলমুক্ত হওয়ার সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সুযোগ পেয়েই প্রথমেই বাংলাদেশের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েন। সাথে নারী ও শিশুদের নিয়ে কখনো হেঁটে, কখনো খচ্চরের পিঠে চড়ে পৌঁছালেন আফগানিস্তান। সেখান থেকে ভারত হয়ে অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে ফিরে আসেন প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে।
দেশে ফিরেই বিধ্বস্ত দেশকে নতুনভাবে গড়ে তোলার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে চট্টগ্রামের মার্কেন্টাইল একাডেমিতে কমান্ড্যান্ট হিসেবে যোগ দেন তিনি। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ নেভির অ্যাসিস্ট্যান্ট চিফ অব নেভাল স্টাফে উন্নীত হন। তিনি হন বাংলাদেশ নেভাল শিপ ‘ওমর ফারুকের’ ক্যাপ্টেন। তার নেতৃতে বিএনএস ‘ওমর ফারুক’ আলজেরিয়া, যুগোস­াভিয়া, মিসর, শ্রীলঙ্কা, সৌদি আরবসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নৌবন্দরে ভ্রমণ করে এবং তিনি বাংলাদেশের নৌশক্তিকে বিশ্বে পরিচয় করান। ১৭৭৯ সালে চিফ অব নেভাল স্টাফ হন। ১৯৮০ সালে রিয়ার এডমিরাল পদমর্যাদা লাভ করেন মাহবুব আলী খান।
নৌবাহিনীকে নেতৃত্ব দেয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক কাজে নিয়োজিত থেকেছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করেছেন বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল। সমাজের অবহেলিত শিশুদের কল্যাণে প্রতিষ্ঠিত ‘সুরভি’ তারই অনুপ্রেরণায় গড়ে উঠেছে। স্ত্রী সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানু এবং বড় মেয়ে শাহিনা খান জামানের ‘সুরভি’র মাধ্যমে ছিন্নমূল অসহায় শিশুদের সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করেছেন।
পারিবারিক জীবনে ছিলেন খুবই অমায়িক। স্বামী হিসেবে স্ত্রীর কাছে ছিলেন একজন বন্ধুর মতো। পরিবারের প্রত্যেকের মতামতকে খুবই গুরুত্ব দিতেন। বড় ভাই এবং বড় বোনের প্রতি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। ছোট বেলায় মা মারা যাওয়ায় শাশুড়িকে খুবই সম্মান করতেন। স্নেহশীল একজন বাবা হিসেবে সন্তানদের নিয়মানুবর্তিতা শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতেন। তার বিশ্বাস ছিল, শিক্ষার পাশাপাশি নিয়ম মেনে চলা সুন্দর চরিত্র গঠনে সহায়ক। তাই মানবকল্যাণে সন্তানদের ছোটবেলা থেকেই উৎসাহিত করতেন তিনি। বিনয়-নম্রতা ছিল বড় গুণ। সন্তানদের সর্বদা বিনয়ী হওয়ার শিক্ষাই দিয়েছেন তিনি। ছোট-বড় সবার সাথে সমানভাবে মেশার শিক্ষাও দিয়েছেন সন্তানদের।
নারী শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতেন বলেই স্ত্রী সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানুকে বিয়ের পরও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে উৎসাহ যুগিয়েছেন। তারই অনুপ্রেরণায় স্ত্রী ফাইন আর্টসে পড়াশোনা শেষ করেন। শিল্প ও সঙ্গীত অনুরাগী জনাব খানের আগ্রহে স্ত্রী শিখেছেন পিয়ানো বাজানো। তার ছোট মেয়ে জুবাইদা রহমান পেশায় একজন চিকিৎসক। তিনি লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজ অব মেডিসিন থেকে রেকর্ড মার্কস পেয়ে কার্ডিওলজিতে মাস্টার্স পাস করেন। মাহবুব আলী খানের বাবা আহমেদ আলী খান ১৯০১ সালে প্রথম মুসলিম হিসেবে ব্যারিস্টার হন। সম্প্রতি ব্যারিস্টারি পাস করেছেন মাহবুব আলী খানের নাতনী জাইমা রহমান।
খেলাধুলার প্রতি ছিল মাহবুব আলী খানের প্রচণ্ড আসক্তি। তরুণ বয়সে খেলেছেন ফুটবল, ব্যাডমিন্টন। টেনিস আর সুইমিংয়ের প্রতি তার ছিল আলাদা টান। তিনি ছিলেন হ্যান্ডবল অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান। বাংলাদেশে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার সফল আয়োজন করেন তিনি।
পড়াশোনার পাশাপাশি মাহবুব আলী খান তার মেয়ে শাহিনা খান জামান ও জুবাইদা রহমানকে সবসময় খেলাধুলা, সঙ্গীতচর্চায় উৎসাহ দিয়েছেন। স্ত্রী ইকবাল মান্দ বানু স্বাধীনভাবে সমাজকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছেন তারই অনুপ্রেরণায়। সাংসারিক কাজের পাশাপাশি জাতীয় মহিলা সংস্থার প্রেসিডেন্ট, সুরভির প্রতিষ্ঠাতা ও নৌবাহিনী প্রধানের স্ত্রী হিসেবে অনেক সামাজিক দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে সর্বপ্রথম নারী অফিসার নিয়োগের ক্ষেত্রে রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খানের অবদান সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে আধুনিক করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মাহবুব আলী খানের অবদান অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের জলসীমা রক্ষা, তালপট্টি দ্বীপের দখল নিশ্চিত করা, বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূল জলদস্যুমুক্ত করার নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ নৌবাহিনী একটি শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে মর্যাদা লাভ করে।
১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সালের জুন পর্যন্ত যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মাহবুব আলী খান। এ সময় শাহজালাল সেতু, লামাকারী সেতু ও শেওলা সেতুসহ অসংখ্য ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ করে যোগাযোগের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সরকারের কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালে ৬ আগস্ট সকালে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনা তদন্তে বিমানবন্দরে গেলে কর্তব্যরত অবস্থায় হৃদযন্ত্রের ব্যথা অনুভব করলে তাকে সিএমএইচে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন তিনি। জনাব খান তার দেশপ্রেম, বীরত্ব, সাহসিকতা, জনকল্যাণমূলক কাজ ও মহানুভবতার জন্য দেশের মানুষের হৃদয়ে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবেন বলেই আমাদের বিশ্বাস।হ
লেখক : যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক


আরো সংবাদ



premium cement