২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দুর্দশার শেষ নেই

-

করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারীর পরিণামে বিশ্ব যখন অচল হয়ে পড়েছে এবং সংবাদমাধ্যম যখন মহামারীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব নিয়ে আলোকপাত করছে, তখন রোহিঙ্গারা একটি নিষ্ঠুর সরকারের অধীনে তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে এবং বাংলাদেশের সঙ্কীর্ণ তথা অপ্রশস্ত শরণার্থী শিবিরে অত্যন্ত কষ্টে জীবনযাপন করছে। করোনাভাইরাস তাদের দুঃখ দুর্দশাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। আর একটু ভালো জীবন যাপনের আশায় অনির্ভরযোগ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ নদী পাড়ি দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা কোনো পন্থা হতে পারে না। গত সপ্তাহে জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ৪৪তম অধিবেশনে দেয়া এক বিবৃতিতে মানবাধিকারবিষয়ক জাতিসঙ্ঘ হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিএইচআর) মিশেল বেশলে বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থী সঙ্কট কার্যত দীর্ঘায়িত হয়ে পড়েছে। এখনো এই সঙ্কট সমাধানের কোনো পথ দেখা যাচ্ছে না। তিনি আরো বলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গারা যে মানবাধিকার পরিস্থিতির শিকার হয়েছে তার কোনো উন্নতি হয়নি এবং বাংলাদেশ থেকে নিরাপদে, সম্মানজনকভাবে ও শক্তিশালী তথা টেকসইভাবে ফিরে যাওয়ার জন্য যে অবস্থার দরকার, সে ধরনের কোনো পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়নি। তিনি আরো বলেন, মহামারীর কারণে মানবিক প্রবেশাধিকার এবং স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার ওপর বিধিনিষেধ আরোপের কারণে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে। শত শত রোহিঙ্গা জীবনমৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে নৌকাযোগে নদী ও সাগর পাড়ি দিয়ে অন্য দেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সেসব দেশের কর্তৃপক্ষ করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে এই আশঙ্কায় শরণার্থীদের কয়েক মাস ধরে সাগরে আটকে রেখেছে। এ দিকে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে বহু লোকের একসাথে গাদাগাদি করে বসবাস এবং অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের কারণে ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে। সেখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা একেবারেই অসম্ভব। এসব শরণার্থী পরিবারকে বাঁশের নির্মিত ঠুনকো চালাঘর বা কুঁড়েঘরে থাকতে হয়। তাদেরকে অভিন্ন পায়খানা এবং গোসল, কাপড় ধোয়া ও অন্যান্য পারিবারিক কাজের জন্য একই উৎস থেকে পানি ব্যবহার করতে হচ্ছে। সব সময় এসব উৎস থেকে পাওয়া পানি পরিষ্কার ও দূষণমুক্ত থাকে না। এমনকি অত্যন্ত মৌলিক আইটেম সাবানও তারা ঠিকমতো পান না।
অবশ্য উদ্বাস্তুবিষয়ক জাতিসঙ্ঘ হাইকমিশনার শরণার্থীদের কোভিড-১৯ থেকে রক্ষা করার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন এবং সেখানে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার নিরাপত্তাজনিত কারণে ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় শরণার্থীদের দুর্দশা বৃদ্ধি পেয়েছে। ইন্টারনেট নিষেধাজ্ঞার কারণে বহির্বিশ্বের সাথে তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং মহামারী সংক্রান্ত খবর এবং বিশ্বাসযোগ্য তথ্যও তারা পাচ্ছে না। আর এ কারণে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে গুজব। করোনাভাইরাসে আক্রান্তের নিশ্চিত সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় জাতিসঙ্ঘ শরণার্থী সংস্থার ওপর যথেষ্ট যন্ত্রপাতি, আইসোলেশন সুবিধা এবং চিকিৎসা, খাদ্য, পানি ও মেডিক্যাল পরীক্ষা চালানোর সামর্থ্য বা সক্ষমতার ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমানভাবে চাপ তৈরি হচ্ছে। তাদের তহবিল এবং মানবসম্পদ ফুরিয়ে যাচ্ছে।
এ দিকে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ কয়েক শত শরণার্থী বহনকারী একটি নৌকাকে বাধা প্রদান করে একটি দুর্গম দ্বীপে সেটিকে ঘেরাও করে রেখেছে। কক্সবাজারে এসব শরণার্থী যাতে ভাইরাস ছড়িয়ে দিতে না পারে সে জন্য, অর্থাৎ ভাইরাসের ঝুঁকি হ্রাস করার জন্যই তাদের সেখানে আটকে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ তার সীমিত সম্পদ দিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তার জন্য সম্ভব সব কিছু করছে। সারা বাংলাদেশে ইতোমধ্যে বহু করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে এবং ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বহু স্বাস্থ্যকর্মী মৃত্যুবরণ করেছে।
রাখাইন প্রদেশ বা রাজ্য যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ রোহিঙ্গা মুসলিমদের বসবাস সেখানে তাতমাদাউ নামে আখ্যা দেয়া সামরিক বাহিনী এবং আরাকান আর্মির মধ্যে সশস্ত্র সঙ্ঘাত অব্যাহত রয়েছে। আরাকান আর্মি হচ্ছে সরকারবিরোধী একটি গ্রুপ। রাখাইনের বৌদ্ধরা বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসন এবং রাখাইনের উন্নয়নের জন্য যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে আরাকান আর্মি তার সমর্থক। কিন্তু সরকার তাদেরকে ‘সন্ত্রাসী’ গ্রুপ বলে মনে করে। তাতমাদাউ বা সামরিক বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত তথাকথিত ক্লিয়ারেন্স অপারেশনের সময় অধিবাসীদের বাড়িঘর ছেড়ে চলে যেতে বলা হয়। কেউ বাড়িঘরে অবস্থান করলে তাদেরকে আরাকান আর্মির লোক হিসেবে বিবেচনা করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়। পরবর্তী সময়ে তীব্র যুদ্ধের ফলে হাজার হাজার মানুষ সেখান থেকে চলে যায়।
মানবাধিকারবিষয়ক জাতিসঙ্ঘ হাইকমিশনারের মতে, সেখানে বিমান হামলা, বেসামরিক এলাকায় গুলিবর্ষণ এবং গ্রামের পর গ্রাম আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর মাধ্যমে মারাত্মকভাবে মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে। গত মাসে তাতমাদাউ বুথিডং শহরতলীর বিশাল এলাকা অগ্নিসংযোগ করে জ্বালিয়ে দিয়েছে বলে জানা গেছে। সামরিক বাহিনীর নিষ্ঠুর ও বর্বরোচিত দমনাভিযানের মাধ্যমে ২০১৭ সালে ৭ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়। জাতিসঙ্ঘ এই বর্বরোচিত হামলাকে ‘গণহত্যা’ বলে আখ্যায়িত করেছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় এবং স্যাটেলাইটে ধারণকৃত ছবিতে দেখা যায়, অসংখ্য রোহিঙ্গা গ্রাম পুড়িয়ে দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। এসব গ্রামে যেসব ঘরবাড়ি ছিল, রোহিঙ্গারা একদিন তাদের সেই ভিটেমাটিতে ফিরে আসবে বলে আশা করেছিল। এসব গ্রাম আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়ার ৫ মাস আগে আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে (আইসিজে) গণহত্যা হিসেবে প্রমাণিত হয়, এমন অভিযোগ গঠনে সহায়ক কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল।
২০১৯ সালে গাম্বিয়া ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) পক্ষে রোহিঙ্গা ইস্যুটি আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে উত্থাপন করে। আফ্রিকান রাষ্ট্রটি আইসিজের কাছে গণহত্যার অভিযোগ উত্থাপন করে এবং হত্যাকাণ্ডের অবসান ঘটানোর জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ এবং দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দেয়ার দাবি জানায়। গণহত্যার সমর্থনে তারা আদালতে প্রমাণ উপস্থাপন করেছে। তারা গণহত্যার প্রমাণ তাদের নিজেদের কাছেও সংরক্ষণ করে।
চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি আইসিজে ওই সব সাময়িক পদক্ষেপ বা ব্যবস্থার ব্যাপারে একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। ১৭ জন বিচারকের সবাই সর্বসম্মতভাবে এসব ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি অনুমোদন করেন। মিয়ানমারের প্রতি জারি করা এই রুলিং হচ্ছে; রোহিঙ্গাদের ওপর আর কোনো নির্যাতন এবং তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করা যাবে না। এসব বন্ধ করার দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সব ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ ও ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে হবে এবং এ ব্যাপারে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, তা নিয়মিতভাবে আইসিজিকে অবহিত করতে হবে। যেসব নির্দেশ প্রতিপালিত হয়েছে সেগুলো সম্পর্কেও আইসিজিকে নিশ্চিতভাবে জানাতে হবে।
কিন্তু মিয়ানমার কোনো গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার কথা দৃঢ়তার সাথে অস্বীকার করা অব্যাহত রেখেছে। অপর দিকে তারা মিয়ানমারের ব্যাপারে জাতিসঙ্ঘের বিশেষ র্যাপোর্টিয়ারকে সহযোগিতা করতে এবং আইসিজের নির্দেশগুলো মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও তাদের ওপর নির্যাতনের মূল কারণ এখনো বিদ্যমান। এগুলোর অবসান ঘটেনি। এসবের মধ্যে রয়েছে সরকারের আইন ও নীতির বৈষম্য। যেমন ১৯৮২ সালে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার বাতিল করা হয়। এই আইনের মাধ্যমে তাদেরকে রাষ্ট্রহীন করা হয়েছে এবং মৌলিক মানবাধিকার চর্চার ব্যাপারে তাদের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। মুক্তভাবে তাদের চলাফেরা করার অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। ২০১৭ সালে জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কাউন্সিল তিন বছরের মধ্যে রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধানের জন্য একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল। কিন্তু আড়াই বছর পর রোহিঙ্গা পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে গেছে।
এই সঙ্কট এবং আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার ব্যাপকভাবে লঙ্ঘনজনিত অন্যান্য বিষয় সমাধানে সহযোগিতার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই একটি পথ বের করতে হবে। অন্যথায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতা এবং ওই সব সংস্থার মান নিয়ে সন্দেহ ও আস্থার সঙ্কট তৈরি হবে। আমরা ইতোমধ্যে ফিলিস্তিনি ইস্যু এবং কাশ্মির ইস্যুর মতো অন্যান্য নিরাপত্তা বা সুরক্ষা ইস্যুর ব্যাপারে অনেক বেশি পরিচিত। এসব ইস্যুতে একটি দেশের ইচ্ছা অনুযায়ী আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সিদ্ধান্তকে পদদলিত করা হচ্ছে।হ
লেখক : জেদ্দাভিত্তিক একজন সৌদি লেখক
আরব নিউজ থেকে ভাষান্তর মুহাম্মদ খায়রুল বাশার

 


আরো সংবাদ



premium cement
থামছে না পুঁজিবাজারে পতন বিনিয়োগকারীদের আর্তনাদ ভারতের লোকসভা নির্বাচনে ভোট শুরু: নাগাল্যান্ডে ভোটার উপস্থিতি প্রায় শূন্য কারাগার এখন বিএনপি নেতাকর্মীদের স্থায়ী ঠিকানা: রিজভী আন্দোলনে ব্যর্থ বিএনপির হাল ধরার কেউ নেই : ওবায়দুল কাদের পাবনায় ভারতীয় চিনি বোঝাই ১২টি ট্রাকসহ ২৩ জন আটক স্বচ্ছতার সাথে সরকারি অনুদানের চলচ্চিত্র বাছাই হবে: তথ্য প্রতিমন্ত্রী মিয়ানমার বিজিপির আরো ১৩ সদস্য পালিয়ে এলো বাংলাদেশে শ্যালকের অপকর্মে দুঃখ প্রকাশ করলেন প্রতিমন্ত্রী পলক মন্দিরে অগ্নিসংযোগের অভিযোগ তুলে ২ ভাইকে হত্যা ইরানে ইসরাইলি হামলার খবরে বাড়ল তেল সোনার দাম যতই বাধা আসুক ইকামাতে দ্বীনের কাজ চালিয়ে যাবো : ডা: শফিকুর রহমান

সকল