২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

চার্জশিট দেয়া ও বিচারের প্রশ্নই ওঠে না

-

সরকারি সম্পত্তি দখলের অভিযোগে দুদকের মামলায় পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক এমপি এ কে এম আওয়াল এবং তার স্ত্রী জেলা মহিলা লীগের সভানেত্রী লায়লা পারভীন হাইকোর্ট থেকে নেয়া আগাম জামিনের মেয়াদ শেষে গত ৪ মার্চ জেলা দায়রা জজ আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন প্রার্থনা করলে বিজ্ঞ জেলা দায়রা জজ আবদুল মান্নান তাদের আবেদন পর্যালোচনা করে এবং আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক শুনে জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করেন এবং তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এমপি দম্পতি অসুস্থ বিধায় কারা হাসপাতালে চিকিৎসা এবং ডিভিশন দেয়ার জন্য তার আইনজীবীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিজ্ঞ জেলা জজ সে আবেদন মঞ্জুর করে এজলাস ত্যাগ করেন।
জামিন নামঞ্জুর করায় অসন্তুষ্ট আওয়ামী লীগার আইনজীবীরা হট্টগোল শুরু করেন। আদালত বর্জনপূর্বক তারা মিছিল করায় এমপির সমর্থকরা তাতে উৎসাহিত হয়ে রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেন। তথ্যপ্রযুক্তির ডিজিটাল উন্নতির কল্যাণে রাস্তার অচল অবস্থা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নজর এড়িয়ে গেলেও আদালতের কার্যক্রমের প্রতি নজরদারিতে নিয়োজিত থাকা আইনমন্ত্রীর নজরে তা পড়ায় তিনি তার উপসচিবকে পিরোজপুরের জেলা দায়রা জজকে তাৎক্ষণিক ওএসডি করে ঢাকায় বদলি এবং যুগ্ম জেলা দায়রা জজ নাহিদ পারভীনকে ভারপ্রাপ্ত জেলা জজ করার আদেশ ফ্যাক্সযোগে পিরোজপুর পাঠানোর নির্দেশ দেন। উপসচিব ওই নির্দেশ পালন করায় ভারপ্রাপ্ত জেলা জজের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম জেলা জজ পদোন্নতি ব্যতিরেকেই একধাপ ওপরের পদের ক্ষমতা প্রয়োগ করে সাবেক এমপি দম্পতিকে কারাগারে পাঠানো এবং কারা হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়ার জন্য তিন ঘণ্টা আগে জেলা জজের দেয়া আদেশ বাতিলপূর্বক দেশ-বিদেশে নামকরা হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণের সুবিধার্থে তাদের জামিন মঞ্জুর করে এক নজিরবিহীন আদেশ দিলেন। এই ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে, তিন ঘণ্টা আগে জামিন নামঞ্জুর করে জেলা জজ যে উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিলেন, আইনমন্ত্রী দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকে উত্তপ্ত পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব হয়েছে বলে তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। দিল্লির দাঙ্গায় আহতদের চিকিৎসার সুবিধার্থে নিজ বাসায় রাতে বেঞ্চ বসিয়ে বিচারপতি এস মুরলিধর নজিরবিহীন আদেশ দিয়ে আহতদের হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন। এতে ভারত সরকারের বিরাগভাজন হওয়ায় ওই বিচারপতিকে বদলি হতে হয়েছে। পিরোজপুরের জেলা ও দায়রা জজ সাবেক এমপি দম্পতিকে তাদের পছন্দনীয় হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ দিতে অস্বীকার করে তাদের জামিন না দেয়ার কারণে তাকে ওএসডি এবং বদলি হতে হয়েছে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসা পিজি হাসপাতালেই সম্ভব যদি তিনি ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী উন্নত চিকিৎসা নিতে সম্মত থাকেন। তাই তিনি জামিন পাননি। মহামান্য রাষ্ট্রপতি, অনেক মন্ত্রী ও এমপি ঢাকার পিজি হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও নিয়মিত বিরতিতে চেকআপ ও চিকিৎসা গ্রহণের জন্য লন্ডন, সিঙ্গাপুর, জুরিখ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন হাসপাতালে গিয়ে থাকেন। তা তাদের পদাধিকার বলে প্রাপ্য হলেও তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সে অধিকার নেই। রোগীরা দেশের ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে বাধ্য হন যদি তার বিদেশে যাওয়ার সামর্থ্য না থাকে। উন্নত চিকিৎসাব্যয় বহনের সামর্থ্য রোগীর আছে কি না সে জন্য সাধারণত ডাক্তাররা রোগীর সম্মতি নিয়ে থাকেন। এ নিয়ম পাল্টে গেছে বলে পিজির বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা মনে করেন। বেগম জিয়ার জামিনের আবেদনের শুনানি চলাকালে বিএনপির কর্মীরা তার জামিনের জন্য রাস্তায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করায় পুলিশের কাজে বাধাদানের অভিযোগে পুলিশের করা মামলায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের আসামি করায় অনেকেই গ্রেফতারও হয়েছিলেন। তাদের জামিনের জন্য আপিল বিভাগ পর্যন্ত যেতে হয়েছে।
সাবেক এমপির জামিন নামঞ্জুরের ঘটনায় এজলাসে হট্টগোল ও আদালত বর্জন এবং রাস্তা বন্ধ করে দেয়া আদালত অবমাননা বা পুলিশের কাজে বাধা দানের পর্যায়ে পড়ে বলে মনে না করায় আদালত ও পুলিশ উভয়েই নিশ্চুপ থেকেছে। বেগম জিয়াকে দুই মামলায় পাঁচ ও সাত বছর কারাদণ্ড দেয়ায় জজকে তার সিনিয়রদের ডিঙ্গিয়ে পদোন্নতি দিয়ে হাইকোর্টের বিচারপতিরূপে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তারেক রহমানকে মানিলন্ডারিং মামলায় খালাসদানকারী বিচারক সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার মতো দেশ ত্যাগ করেও দুদকের মামলা থেকে রেহাই পাননি। নিম্ন আদালতের জজদের পোস্টিং ও পদোন্নতি সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রণে রেখে তাদের চাকরি বিধিমালা তৈরি না করে আইন মন্ত্রণালয়ের হাতে রেখে তা করায় সাবেক প্রধান বিচারপতি সিনহা আইন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তুতকৃত খসড়া অনুমোদন না করে সাত-আটবার ফেরত দেয়ায় সরকারের সাথে তার সম্পর্কের টানাপড়েন চলছিল। এ কারণে সরকার তার ওপর রুষ্ট ছিল। ছয়জন বিচারপতি সর্বসম্মতভাবে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় দিলেও প্রধান বিচারপতি ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে সরকারের আদালত নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে অপ্রিয় সত্য মন্তব্য করায় তাকে পদত্যাগ ও দেশত্যাগে বাধ্য করা হয় বলে অনেকে মনে করেন। এ ঘটনার মাধ্যমে একই সাথে উচ্চ আদালত ও নিম্ন আদালতের বিচারকদের বুঝিয়ে দেয়া হয়, ক্ষমতাবানদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো রায় দিলে তার করুণ পরিণতি কী হতে পারে। সরকার যে আইন তৈরি করে সেই আইন অনুযায়ী জজ সাহেবরা আদালত পরিচালনা করে থাকেন। ১৯৭৩ সালে একটি বিআরটিসি বাসের কন্ডাক্টরের উক্তি উল্লেখ করার মতো।
ওই সময় বিআরটিসির জন্য যে যাত্রীবাহী
বাস জাপান থেকে আমদানি করা হয়েছিল
তার বডি সরু হওয়ার কারণে বাম ও ডান
দিকের সিটের মাঝে জায়গা কম থাকায়
এক সারিতে যাত্রীরা দাঁড়ালেই কন্ডাক্টরের ভাড়া কাটতে অসুবিধা হতো। মিরপুর-গুলিস্তান
রুটের বাসে ঢাকা কলেজের একদল ছাত্র ওঠায় বাসে প্রচণ্ড ভিড় হয়েছিল। এ অবস্থায় ভাড়া কাটা নিয়ে ছাত্রদের সাথে বচসার কারণে ক্ষুব্ধ কন্ডাক্টর বাস থামানোর জন্য ড্রাইভারকে বারবার সঙ্কেত দেয়া সত্ত্বেও ড্রাইভার তাতে কর্ণপাত না করায় কন্ডাক্টর রেগে উচ্চৈঃস্বরে চেঁচিয়ে বলেছিলেন ‘আপনি বাস চালান আর আমি আপনাকে চালাই’। এ ক্ষেত্রে যেন হয়েছে তাই। জজ সাহেবরা আদালত চালান আর তাদেরকে আইন মন্ত্রণালয় চালিয়ে থাকে।’
উপরে বর্ণিত কারণে একজন জেলা জজের তাৎক্ষণিক ওএসডি হওয়ায়, তার দুর্ভাগ্য নিয়ে আমজনতা যতটা না উৎকণ্ঠিত, তার চেয়ে বেশি শঙ্কিত সরকারি দলের নেতাদের বা সরকারে পছন্দনীয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দুদকের চলমান তদন্ত ও মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে। দুদক এমপি দম্পতির বিরুদ্ধে মামলা করলেও এখনো তদন্ত সম্পন্ন করে চার্জশিট দেয়নি। এমপি দম্পতি কারাগারের বাইরে মুক্ত অবস্থায় থাকলে তদন্ত বিঘিœত হবে এবং কোনো সাক্ষী তদন্ত কর্মকর্তার কাছে সাক্ষ্য দিতে রাজি না-ও হতে পারে। এ বিষয়টি ভেবেই জজ সাহেব এমপি দম্পতিকে জামিন না দেয়ায় তিনি ওএসডি হয়েছেন। এতে, দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা স্বাধীনভাবে তদন্তকাজ সম্পন্ন করতে পারবেন কি? আর চার্জশিট সাহস করে দিতে পারলেও কোনো বিচারকের পক্ষে স্বাধীনভাবে বিচারকার্য পরিচালনা করা সম্ভব হবে কি? প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে গত সেপ্টেম্বর থেকে পরিচালিত দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে যুবলীগের সাবেক চেয়ারম্যানসহ যে সব নেতার বিরুদ্ধে তদন্ত চলমান রয়েছে, সেগুলো যাতে বেশি অগ্রসর না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক বার্তা হিসেবে পিরোজপুরের ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এর মাধ্যমে তদন্ত কর্মকর্তা, সাক্ষী ও বিচারকদেরকে আগাম যে সতর্কবার্তা দেয়া হলো তা হচ্ছেÑ সরকারি দল ও জাপার যে নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে তাদের জামিন দিতে হবে। আগে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। নতুন করে কোনো মামলা দেয়া চলবে না। বহুল আলোচিত জেনারেল মঞ্জুর হত্যা মামলায় ২০১০ সালে রায় দেয়ার তারিখ ঘোষণার পর বিচারককে বদলি করে নতুন যে বিচারককে পোস্টিং দেয়া হয়েছিল, তিনি মামলাটির পুনঃতদন্তের আদেশ দেয়ায় গত ১০ বছরেও পুনঃতদন্ত শেষ না হওয়ায় ১৯৯৫ সালে দায়েরকৃত মামলার বিচার ২৫ বছরেও শেষ না হওয়ায় ১ নম্বর আসামি জেনারেল এরশাদ বিচার থেকে রেহাই পাওয়ার সুযোগ পান। ১৯৮৮ সালে চট্টগ্রামে প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহরে পুলিশের গুলিবর্ষণে ২৪ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় ১৯৯৭ সালে দায়েরকৃত মামলার বিচার শুরু হলে, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদ, তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের আইজির নাম চলে আসতে পারে বিধায় দীর্ঘ ২২ বছর মামলার শুনানি স্থগিত রেখে এরশাদের মৃত্যুর পর তড়িঘড়ি বিচার শেষ করে পাঁচজন পুলিশকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে। কুমিল্লায় রাতে বাসে পেট্রলবোমা ছুড়ে ১০ জন নিহত হওয়ার মামলায় যদি অবরোধ আন্দোলনের ডাক দেয়ার অপরাধে বেগম জিয়া আসামি হতে পারেন, তাহলে চট্টগ্রাম ২৪ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় এরশাদ আসামি হবেন না কেন? পিরোজপুরের ঘটনায় আইনমন্ত্রী বলেছেন, ‘দুদক মামলা করলেও এখনো চার্জশিট দেয়নি।’
ঢাকঢোল পিটিয়ে কচ্ছপ গতিতে চলমান শুদ্ধি অভিযানে গ্রেফতারকৃত থানা ও জেলাপর্যায়ের নেতাদের বিত্ত-বৈভব অর্জনের কাহিনী শুনে ও তাদের দৈনিক আয়-ব্যয়ের হিসাব দেখে এবং বাড়ি থেকে উদ্ধারকৃত ৩১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ও পাঁচ কোটি টাকার এফডিআর ও প্রায় ১০ কেজি স্বর্ণালঙ্কার মজুদ দেখে আয় উপার্জনহীন আমজনতা নির্বাক হয়ে পড়েছে। একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে গণতান্ত্রিক শাসনামলে পরিবারের সবাইকে পদ দেয়ার কারণে বাপ-মা, স্ত্রী-পুত্র, কন্যা ও পুত্রবধূ সবাই মিলেমিশে দুর্নীতি করায় দুদককে সংশ্লিষ্ট পরিবারের সব সদস্যের সম্পত্তির হিসাব চাইতে হচ্ছে এবং তাদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করতে হচ্ছে। যুবলীগের সাবেক চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী, তার স্ত্রী, পুত্র-কন্যাসহ সবার বিরুদ্ধে পরিচালিত তদন্ত হঠাৎ থেমে গেল কেন? গ্রেফতার ও রিমান্ডে নেয়া দুদকের কাজ নয়। তা পুলিশের কাজ বলে প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ মন্তব্য করায় দুদক যেন একটু ঝিমিয়ে পড়েছে। তবে খুশির কথা হলো, দুদক মামলা করেছে এবং আদালত জামিন নামঞ্জুর করেছেন। আইনমন্ত্রী সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করায় তিনি জামিন পেয়েছেন। থানা লুট হলে জনগণের যেমন এজাহার দেয়ার জায়গা থাকে না, তেমনি আদালত নির্বাহী বিভাগে নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে জনগণ ন্যায়বিচার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়।


আরো সংবাদ



premium cement