২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ক্ষয়প্রাপ্ত মূল্যবোধ ও অপমানিত মানবিকতা

-

১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের শেষ মরণ কামড় খেয়ে আত্মসমর্পণের শেষ মুহূর্তে ১৩ ডিসেম্বর থেকে এ দেশের জ্ঞানী-গুণী, মেধাবী মনীষীদের হত্যা শুরু করেছিল। ঢাকা শহরের রায়েরবাজার ছিল এই কুখ্যাত বধ্যভূমি। ঢাকার বাইরেও মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে সারা বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় পাকিস্তানি সেনা ও তাদের অবাঙালি এবং বাঙালি দোসররা এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল। এই হত্যাযজ্ঞ শুধু তাদের আত্মসমর্পণের প্রাক্কালে নয়, ৯ মাসের সারাটা মুক্তিযুদ্ধকালে এরা বাংলাদেশের গঞ্জ-গ্রামে, পাড়া-মহল্লায় এ দেশের নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন ৯ মাসে পাকিস্তানি বর্বর পশুদের হাতে নিহত এ দেশের নারী-পুরুষ, গবাদিপশু, জন্তু-জানোয়ারের লাশ বাংলার পথেঘাটে বেওয়ারিশ হিসেবে পড়ে থেকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পরিবেশ দূষিত করেনি। স্বাধীনতা যুদ্ধের ৯ মাসে পাকিস্তানি পশুদের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষেরা বাংলার পথেঘাটে নিহত ওয়ারিশ-বেওয়ারিশ নারী-পুরুষসহ সব গবাদিপশু বা জন্তুর লাশ স্বতঃস্ফূর্তভাবে দাফন বা সৎকার করেছিল। এ কাজ করতে গিয়ে মানুষ তখন মনুষ্যত্ববোধের পরিচয় দিয়েছিল, দিয়েছিল মূল্যবোধ আর মানবতার। এই দাফন বা সৎকার কাজ করতে গিয়ে মানুষ পাকিস্তানিদের প্রতি তাদের অন্তরের তীব্র অভিশাপ বর্ষণ করেছিল ঠিকই, তবে এই কাজে তারা কখনো ঘৃণা বোধ করেনি। বরং স্বাধীনতার জন্য জীবনদানকারী এসব মানুষের আত্মত্যাগকে তারা অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখেছে এবং এসব ওয়ারিশ-বেওয়ারিশ মৃত মানুষের দাফনের কাজটিকে অত্যন্ত সম্মানজনক হিসেবে বিবেচনা করেছে। তা ছাড়া এ কাজটিকে এ দেশের আবহমানকালের ঐতিহ্য অনুযায়ী সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক কাজ হিসেবে ভেবেই এই দাফন ও সৎকারের কাজগুলো করতে তাদের মধ্যে কোনো দ্বিধা, সঙ্কোচ, হীনম্মন্যতাবোধ বা ঘৃণার লেশমাত্র ছিল না। ১৯৯১ সালের এপ্রিলে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় এক লাখ লোক প্রাণ হারিয়ে ছিল। তখন কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের মানুষ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এসব গলিত লাশ দাফন করেছিল। আমরা ছেলেবেলা থেকে জেনে এসেছি যে, ধনী-নির্ধন, চাষা-ভূষা, কামার-কুমার, মজুর শ্রমিক যারই মৃত্যু হোক না কেন, তার দাফন বা সৎকার করা হয়। দীন-ভিখারি কারো মৃত্যু হলেও দরিদ্র হওয়ার কারণে তার লাশ ফেলে দেয়া হয় না। ধর্মীয় বিধান মেনে তারও দাফন বা সৎকার হয়।
কিন্তু আজ অত্যন্ত বেদনাবিধুর মন নিয়ে বলতে হচ্ছে, আমরা আমাদের বক্তৃতায়, বিবৃতিতে লেখনীতে সবসময় নিজেদের বীর বাঙালি বলে প্রশংসায় মেতে উঠি। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে আমরা সত্যিকার অর্থে বীর বাঙালি ছিলাম। কিন্তু গত ৪ মাসের করোনাকালে আমরা নিজেদের ভীতু এবং ভেতো বাঙালিতে পরিণত করেছি। এই করোনাকালে মারা যাওয়া আত্মীয়কে দাফনের আগে অন্য ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা দেখতে যান না। বাবার লাশ দাফনে বা সৎকারে ছেলেরা, ছেলেদের দাফনে বা সৎকারে অন্য ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা কবরস্থানে, শ্মশানে বা গির্জায় যান না। এখন কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে করোনায় আক্রান্ত বা করোনা সন্দেহে মৃতদের দাফন করার কাজটি করা হচ্ছে। এমনও দেখা গেছে, নিজস্ব পারিবারিক কবরস্থানেও তথাকথিত করোনা আক্রান্ত মৃত ব্যক্তির দাফন করতে অন্য শরিকরা বাধা দিচ্ছে। করোনায় আক্রান্ত বা করোনা সন্দেহে মৃত ব্যক্তিদের দাফন-সৎকারের ব্যবস্থা না করে লাশ ফেলে আত্মীয়স্বজনদের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও আমাদের সামনে রয়েছে। করোনা আক্রান্ত মৃত ব্যক্তির শরীরে করোনার জীবাণু থাকে না বলে প্রচারমাধ্যমে অনেকবার প্রচার করা হয়েছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে অন্য সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে মৃত ব্যক্তির নামাজে জানাজা সম্পন্ন করে তার দাফনকর্ম সম্পন্ন করা যায়।
জীবিতকালে যে বাবা-মা নিজেদের সর্বস্ব দিয়ে সন্তানের ভালোর জন্য যা যা করা দরকার তা করেছেন, সেই মা-বাবার মৃত্যুতে সন্তান-সন্ততিরা মা-বাবার কাছে যাবেন না বা দাফনস্থলে উপস্থিত থাকবেন নাÑ এর মতো মর্মবেদনার বিষয় পৃথিবীতে আর আছে কি না তা কারো জানা আছে কি? করোনা রোগে আক্রান্তের ভয়ে আমরা মৃত বাবা-মা, ভাইবোন বা অন্য আত্মীয়-পরিজনদের সংশ্রব এড়িয়ে চলছি। আমরা যারা এটা করছি, এই দুঃসহ বেদনার বিষয়টির পালা আমাদের জীবনেও আসতে পারে। যে দিন আমাদেরও জীবন প্রদীপ নিভে যাবে, সে দিন হয়তো আমাদের কাছের মানুষেরাও আমাদের কাছে ঘেঁষবে না।
করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে আমরা মৃত আত্মীয়-পরিজনদের প্রতি যে আচরণ করছি, তা হলো নিকটাত্মীয় পরিজনদের পরস্পরের প্রতি রক্তের সম্পর্কের ফলে সৃষ্ট চিরন্তন স্নেহ, ভালোবাসা, মায়া-মমতাকে পদদলিত করা, যা মানবিকতার চরম অপমান। এই পৃথিবী থেকে শেষ বিদায়ের দিনে আমাদের কাছ থেকে ন্যায্য সম্মান পাওয়ার হক বা অধিকার তাদের রয়েছে। আজ আমরা করোনার ভয়ে তাদের প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত করছি। আগামী দিনে আমাদের উত্তরসূরিরাও আমাদের প্রতি এ আচরণই করবে। ক্ষয়ে যাওয়া মূল্যবোধ আজ আমাদের চরম ভীতু আর স্বার্থপর করে তুলেছে। যেসব নিকটাত্মীয় পরিজনের শরীরের রক্তধারা আমাদের শিরায় শিরায় বহমান, মৃত্যুর পরে তাদের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন না করে আমরা যেমন তাদের রক্তের সাথে বেঈমানী করছি, তেমনি আমরা নিজেদেরকে চরম কাপুরুষ ও স্বার্থপর হিসেবেও প্রমাণ করছি।
লেখক : সমাজকর্মী
mamasud102@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement