২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

গ্লোবাল ক্রাইম : গ্লোবাল আতঙ্ক

-

এক অসম্ভব আতঙ্কে দিন কাটাছে পৃথিবী নামে এ গ্রহের অধিবাসী মানুষ। কিন্তু যথেষ্ট স্বাচ্ছন্দ্যে ও নির্ভয়ে আকাশে ডানা মেলে উড়ছে মিথুনরা, সমুদ্রে সাঁতার কাটছে ডলফিনরা। বাগানের গাছে গাছে রঙিন প্রজাপতি আর পায়ের নিচে ঘাস ফড়িংয়ের প্রাণোচ্ছল ছোটাছুটি। কিছু দিন আগেও এ দৃশ্য বিরল ছিল; বলা হয় বৈরী পরিবেশে প্রাণিকুল তাদের অস্তিত্ব হারাতে বসেছিল। এখন তারা নির্ভয়, নিঃশঙ্ক। শুধু মানুষই ব্যতিক্রম। দিনে-রাতে, শয়নে-স্বপনে, ঘরে-বাইরে, কর্মে-অবসরে প্রতিটি মুহূর্তেই তাড়া করে ফিরছে এক দুঃসহ আতঙ্ক! আমি , আপনি, সে, আমির -ফকির, ধনী-গরিব, শ্রমিক-মালিক, রাজা-প্রজা, হাজার কোটি টাকার মালিক কিংবা পথের কাঙ্গাল; সবাই এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। কবে আবার প্রাণ খুলে হাসবে-গাইবে পৃথিবীর এই সর্ব জান্তা, পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী, চন্দ্র বিজয়ী, দাম্ভিক, মহা ক্ষমতাধর (?) মানুষেরা, সেই অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে দিন কাটছে সবার। চেয়ে আছে চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের দিকে একটা ভ্যাসকিন কবে দিতে পারবেন তারা। তারাও গলদঘর্ম হয়ে চেষ্টা করছেন, যদিও তারা ইতোমধ্যে প্রায় অমরত্ব ছুঁয়ে ফেলেছিলেন বলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার অপেক্ষায় ছিলেন। কী এক ক্ষুদ্র ভাইরাস কোথা থেকে এসে শতাব্দীর সব গর্ব অহঙ্কার, সব আবিষ্কার আর অর্জনকে বুড়ো আঙুল প্রদর্শন করেই যাচ্ছে। কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না এই ভাইরাসকে । তার নিত্যনতুন রূপ বদল আর ডিগবাজি দেখে ডিজিটাল যুগের এই অসম্ভব রকমের জ্ঞানীগুণী চিকিৎসাবিজ্ঞানীরাও তাজ্জব হয়ে যাচ্ছেন!
কেন এমন হচ্ছে , কেন এমন হলো? এর আগেও দুনিয়াতে ভাইরাস এসেছে, মহামারী হয়েছে, হাজারো লাখো মানুষ মারা গেছে। কিন্তু এবারের মতো একসাথে এই গ্রহের সর্বত্র আতঙ্কে ছেঁয়ে গেছে এমনটি বোধ হয় আর হয়নি। বলা যায় গ্লোবাল আতঙ্ক। আমরা যারা একটু সেকেলে; আল্লাহ, রাসূল, পরকাল, পাপ-পুণ্য প্রভৃতিতে বিশ্বাসী তারা কম-বেশি এ সত্য জানি যে, পৃথিবীতে যখন জুলুম-নির্যাতনের অপরাধ মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, অশ্লীলতা আর বেলেল্লাপনা জীবনের সব ক্ষেত্রে বাসা বাঁধে তা শিল্প সংস্কৃতির নামেই হোক আর বিনোদনের নামেই হোক, তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে এ ধরনের নতুন নতুন ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে। আমরা আমাদের বিশ্বাসের আলোকেই বলতে চাই অপরাধ যেহেতু গ্লোবাল; আতঙ্কও তাই গ্লোবাল! দুনিয়াজুড়েই অপরাধের বিস্তৃতি; দুনিয়াজুড়েই প্রকৃতির চাবুক আঘাত করছে। আসুন দেখে নেই কেমন সে অপরাধ : এক) প্রায় পৌনে এক শতাব্দী পর্যন্ত এরকমই এক প্রচণ্ড আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে ফিলিস্তিনের মানুষ। কখন কোন মুহূর্তে হানাদার ইহুদিবাদের নিক্ষিপ্ত বোমা, গোলা, মিসাইল, রকেট এসে আঘাত করবে, কখন কার জীবন প্রদীপ নিভে যাবে; কেউ জানে না। শুধু সন্তানহারা মায়ের গগণবিদারী চিৎকার, স্বামীহারা বিধবার বুকভাঙা কান্না, পিতৃহারা এতিম শিশুদের অবুঝ কান্নায় গুমড়ে মরে ফিলিস্তিনের আকাশ-বাতাস । কিন্তু কে শুনে সেই কান্না। সভ্যতাগর্বী দুনিয়া তার নতুন নতুন মারণাস্ত্রের পরীক্ষা, বিত্তবৈভব বাড়ানোর অশুভ প্রতিযোগিতা, উৎপাদিত সম্পদ কুক্ষিগত করা আর নিজেদের লালসা পূরণে ব্যস্ত। উন্নয়নের নেশায় পাগলপারা এ দুনিয়ার সময় কোথায় ফিলিস্তিনের অসহায় বনি আদমের আর্তচিৎকার শোনার? ক্ষমতাদর্পী দাম্ভিক যেই শক্তিগুলো এই হত্যাযজ্ঞে ইন্ধন জুগিয়ে যাচ্ছে আর নির্বিকার বাকি বিশ্ব এই ভয়াবহ জুলুম দেখে মুখ বুজে শক্তিমান পক্ষের লেজুড়বৃত্তি করছে, করোনা কোভিড-১৯ ভাইরাস আতঙ্কে তাদের সবার ঘুম হারাম হয়ে গেছে সব কিছু থাকতেও। সশস্ত্র প্রহরী বেষ্টিত দুর্ভেদ্য প্রাসাদে বসেও মৃত্যুর কালো ছায়া দেখে আঁতকে উঠছে প্রচণ্ড ক্ষমতাধর এই জালিম বিশ্ব নেতারা। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজে আসছে না তাদের শক্তিশালী সব অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র। দুই) অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর (খনিজ, বনজ ও জলজ) আফ্রিকার সম্পদ লুণ্ঠন করে গোটা এলাকাটাকে ফোঁকলা করে দিয়েছে লুটেরা এই সভ্যতার দাবিদাররা। আজকে অপুষ্টি আর নানা রোগব্যাধিতে জর্জরিত আফ্রিকার কঙ্কালসার শিশুদের হাড় জিরজিরে ছবি দেখেও তাবৎ বিশ্ব সেই লুটেরাদের তোষণেই ব্যস্ত। মাঝে মধ্যে লুটের সম্পদ থেকে যৎকিঞ্চিৎ খয়রাত দিয়ে তারা নিজেদের বদান্যতার ঢোল বাজাতে পছন্দ করে, আর বাকি বিশ্ব আমরা সেই ঢোলের বাড়িতে নাচতে থাকি, লুটেরাদের বদান্যতার জয়গানে উচ্ছ্বসিত হই। তিন) লালসার অন্ধ দাসত্বে লিপ্ত হয়ে সভ্য (?) এই পৃথিবীর দিকে দিকে যখন সমকামিতার মতো ঘৃণ্য, জঘন্য ও বিকৃত রুচির আইন পাস করা হয় মানবাধিকারের নামে, যা মানব প্রকৃতিই শুধু নয় গোটা সৃষ্টি প্রকৃতিরও বিরোধী, আর তাবৎ দুনিয়া এটিকে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য বলে চিৎকার করতে থাকে সেটি আসলেই মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে? এটি মানবাধিকার হলে খুন করার অধিকার কেন মানবাধিকার হবে না সে প্রশ্ন করাই যেতে পারে। ফিরিস্তি লম্বা করে কি লাভ হবে?
এমনি করে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, কাশ্মির, চেচনিয়া, বসনিয়া, উইঘুর, রোহিঙ্গা কিংবা রেড ইন্ডিয়ান যাদের কথাই বলি না কেন সীমাহীন জুলুমে নিষ্পেষিত এরা। জুলুম, শোষণ আর বঞ্চনার ইতিহাস অনেক দীর্ঘ । এর প্রতিটিই মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, প্রতিটিই গ্লোবাল অপরাধ । সুতরাং আতঙ্কও গ্লোবাল। কেউ বলতেই পারেন, এগুলোর জন্য তো পৃথিবীর সাধারণ আম জনতা দায়ী নয়, দায়ী হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী কয়েকটি পরাশক্তি। আমিও স্বীকার করি। কিন্তু আমজনতার দায় কি মোটেই নেই? বঞ্চিত মজলুম এসব মানুষ যখন ন্যূনতম মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত, তখন কি আমজনতা আমরা সামান্যতমও শব্দও করেছি?
ফিলিস্তিনের মাটিতে যখন হানাদারদের গুলিতে লুটিয়ে পড়ছে ১২ বছরের কিশোর, তার অপরাধ ছিল হানাদারদের বিরুদ্ধে সে পাথর ছুড়েছিল, তখনো কি বাকি পৃথিবীর আমজনতা ক্রীড়া, কৌতুক, টুর্নামেন্ট আর কনসার্ট কিংবা সুন্দরী প্রতিযোগিতার নামে উলঙ্গ নৃত্যের আয়োজন করেনি? আমরা আমজনতা কি আমাদের সুসজ্জিত ড্রয়িং রুমে বসে সেসব প্রতিযোগিতা দেখে নয়ন জুড়ায়নি?
প্রতিটি ছক্কা আর চারের মারে উত্তেজিত হয়ে লাফিয়ে উঠিনি? ফিলিস্তিন কিংবা কাশ্মির কিংবা উইঘুর অথবা ভূমধ্যসাগর কিংবা নাফ নদীর তীরে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা আয়লানদের লাশ কি আমাদের আনন্দানুভূতিতে একটুও ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পেরেছে? পৃথিবীর তাবৎ শান্তিপ্রিয় ও নিরীহ আমজনতা কি এর প্রতিবাদে সামান্যও সরব হয়েছে? আমরা তো উদরপূর্তি করে আমাদের আহার্য গলাধঃকরণ করেছি, কন্যা জায়াদের নিয়ে আনন্দ ভ্রমণে ব্যস্ত থেকেছি, তাদের প্রসাধনচর্চিত বদন ফেসবুকে আপলোড করে এক মহা তৃপ্তির স্বাদ উপভোগ করেছি। এর প্রতিটি কাজই কি নৈতিকভাবে অপরাধ নয়? এখন কোভিড-১৯ হয়তো সামান্য সময়ের জন্য একাকার করে দেখিয়ে দিচ্ছে, ফিলিস্তিনের মানুষগুলো প্রায় শতবর্ষ কি নিদারুণ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। আমরা যারা নিজেদেরকে যথেষ্ট দ্বীনদার মনে করি এবং নিশ্চিত যে, জান্নাত আমাদের জন্য মোটামুটি রিজার্ভ হয়েই আছে, তারাও তো জানি, রাসূল সা:-এর পরিষ্কার নির্দেশনা : ‘অপরাধ সংঘটিত হতে দেখলে তা হাত দিয়ে প্রতিরোধ করো, না পারলে মুখ দিয়ে প্রতিবাদ করো; তাও সম্ভব না হলে মনে মনে পরিকল্পনা করো কিভাবে অপরাধ প্রতিহত করা যায়। এটা ঈমানের তৃতীয় বা শেষ স্তর। আমরা কি এই শেষ স্তরের ভূমিকাটাও পালন করতে পেরেছি? আমরা কি ওই সব মজলুম, নির্যাতিত ও অসহায় বনি আদমের কষ্টে সমবেদনা জানিয়ে অন্তত জালিম সভ্যতার সাজানো ক্রীড়া-কৌতুক থেকেও নিজেদের বিরত রেখেছি কখনো। ভুলেও কি কখনো মনে করেছি যে, আমার মতোই লাখো বনি আদম মৃত্যুর যন্ত্রণা আর আতঙ্ক নিয়ে দিন কাটাচ্ছে তাদের প্রতি সহানুভূতি ও জালিম সভ্যতার জুলুমের প্রতিবাদে আমি এসব বাজে কাজ থেকে বিরত থাকি। এতটুকু হলেও তো আল্লাহর কাছে, বিবেকের কাছে বলা যেত যে, আমার পক্ষে যতটুকু করা সম্ভব ছিল তার কিছু তো করেছি। অনেকে রবীন্দ্রনাথের কথাকে মেনে নেয়াকে উপাসনার মতো মনে করেন। তিনিও তো বলেছেন, ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।’ কই অন্যায়কারী জালিমদের বিরুদ্ধে আপনার ঘৃণা কোথায়? আপনি তো সেই অন্যায়কারীর উচ্ছিষ্ট পাওয়ার লোভে আপনার মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে চলেছেন।
কোভিড-১৯ তাই গোটা বিশ্বকে সতর্ক করে দেয়ার জন্য এসেছে। স্বার্থান্ধ মানুষ নিজের ভোগবিলাসচরিতার্থ করতে গিয়ে প্রকৃতি পরিবেশকে বিপন্ন করে ফেলেছে, অস্তিত্বের হুমকিতে গোটা দুনিয়া। অথচ দুনিয়াতে মানুষ ছাড়াও তো লাখ লাখ সৃষ্টি জীব রয়েছে। বিশ্ব স্রষ্টা তো তাদেরও প্রতিপালক। মানুষ সতর্ক হলে ভালো, কোভিড-১৯ একসময় থাকবে না, চলে যাবে। মানুষ যদি তাদের পুরনো খাসলতেই ফিরে যায়, এর পর কোভিড ২১ বা ২২ বা আরো কিছু এসে তাদেরকে আরো বড় চাবুক হানবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা এ বিশ্বের একজন নিয়ন্ত্রক ও পরিচালক আছেন, তিনি অবসরে যাননি অথবা পৃথিবী কাউকে ইজারাও দেননি। অতএব সাধু সাবধান!!
আসুন আমরা করোনা-পরবর্তী একটি সুন্দর, সুবিচারপূর্ণ, পরিবেশবান্ধব ও মানবিক পৃথিবী গড়ে তুলি। বর্তমান লোভী, দুর্নীতিপরায়ণ ও অহঙ্কারী, একগুঁয়ে ও দাম্ভিক নেতৃত্বকে না বলি।হ

 


আরো সংবাদ



premium cement