২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বিদ্যুৎখাত : ভেতর-বাহির

-

এবারে ২০২০-২১ অর্থবছরে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগে বাজেটে ২৬ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী বিদ্যুৎ খাতের এই বাজেট উপস্থাপনের সময় মুখরোচক বেশকিছু কথা বলেছেন, কিন্তু এই খাতে যে ভয়ঙ্কর দুর্নীতি লুটপাট চলছে সে বিষয়ে টু শব্দটি করেননি। আমরা জানি, বাজেটে বরাদ্দ করা অর্থের একটি বড় অংশ যাবে সাধারণ মানুষের পকেট কেটে ব্যক্তিখাতের ভর্তুকিতে। যার সাথে যুক্ত হবে বৃহৎ মাপের দুর্নীতি। বিদ্যুৎখাত জাতীয় অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। অর্থনীতির সঞ্চালক হিসেবে এই খাতের ভূমিকা অগ্রগণ্য। দেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন ও সঞ্চালনের গতিময়তার ওপর রাজনীতির ব্যারোমিটারও ওঠানামা করে। বিদ্যুৎ ব্যবহারে অভ্যস্ত মানুষ বিদ্যুৎহীনতায় অসহায় বোধ করে, ক্ষুব্ধ হয়। বর্তমানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার যুগেও এখনো বাংলাদেশের বেশ কিছু মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধাবঞ্চিত। ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে বিদ্যুৎ নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের ঢাকঢোলের আওয়াজে কান ঝালাপালা। সরকারের পক্ষ থেকে সমস্বরে যা বলা হয়েছে তার নিহিতার্থ হচ্ছে ডান-বামে কী ঘটছে সেটা দেখা যাবে না বরং বিদ্যুৎ প্রাপ্তিটাই বড় কথা। সেজন্য আমরা দেখেছি ২০১০ সালে বিনা টেন্ডারে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সুযোগ রেখে জাতীয় সংসদে নতুন ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) আইন পাস করা হয়। এই আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ। অর্থাৎ উদ্দেশ্যের খুব গভীরে না গিয়েও বোঝা যায় এই আইনের মাধ্যমে নগ্ন দুর্নীতিকে আইনি মোড়কে ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখা। এই আইনের বিধানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিনা টেন্ডারে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে জড়িতদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা যাবে না।
অস্বচ্ছ ও দুর্নীতিতে সহায়তাকারী কোনো আইনের দ্বারা রাষ্ট্রের কোনো খাতের উন্নতির গালগল্পের মধ্যে একটা শুভঙ্করের ফাঁকি থাকবেই। তা না হলে বিজ্ঞান চর্চা ও এথিক্সের ধারণা পৃথিবী থেকে মুছে যেত।
দেশের বিদ্যুৎ সঙ্কট মোকাবেলার কথা বলে সরকার কুইক তথা জরুরি ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দেয়। এর নেপথ্যের কাহিনী মানুষের কাছে অস্পষ্ট নয়। শুধু বিরোধীদের সমালোচনা নয়, দেশের বিদ্ব্যৎজন, বুদ্ধিজীবী ও বিদ্যুৎখাত নিয়ে বিশ্লেষকদের অভিমত, ঘনিষ্ঠজনদের টাকার জোয়ারে ভাসাতেই রেন্টাল, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দেয়া হয়েছে। আর এ নিয়ে স্বজনপ্রীতি ও যথেচ্ছারের বিরুদ্ধে যাতে কোনো মামলা না হয় সেজন্য দায়মুক্তির আইনি প্রটেকশনও রাখা হয়েছে। এখনো ওই আইন বলবৎ। বিদ্যুৎ খাতে উন্নতির নামে শুভঙ্করের ফাঁকির বিষয়টিতে আমরা যদি দৃষ্টি নিক্ষেপ করি তাহলে সেটি স্পষ্ট হবে। কুইক রেন্টালের মেয়াদ আর বাড়বে না, এর মেয়াদ নাকি ফুরিয়ে গেছে! সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, আগামী আঠারো মাসের মধ্যে তিন হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হবে। এগুলোর ৯০ শতাংশ রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্র। সরকারি পুরনো কেন্দ্রগুলোও নাকি বন্ধ করা হবে। বেসরকারি অলস বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে জামাই আদর করতে গিয়ে গত বছর সরকারকে গুনে গুনে ৬২ হাজার কোটি টাকা অ্যানার্জি পেমেন্ট ও ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে হয়েছে, এসব কেন্দ্রের ৩০ শতাংশ চালানো সম্ভব হয়নি। এতে জনগণের বিপুল পরিমাণ টাকার অযথা অপচয় হয়েছে। সুতরাং এখন প্রমাণিত যে, দায়মুক্তির আইন প্রণয়নের সময় উত্থাপিত অভিযোগগুলো কত অকাট্য সত্য ছিল। জনগণের কাছ থেকে সংগ্রহ করা বিশাল অঙ্কের টাকা নির্দ্বিধায় তুলে দেয়া হয়েছে গোষ্ঠীস্বার্থে। মোট উৎপাদন সক্ষমতার ৩৩ শতাংশ এবং শীতকালে চাহিদা কমে যাওয়ায় উৎপাদন সক্ষমতার শতকরা ৬০ ভাগ অব্যবহৃত থাকে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে লোকসানি মূল্যে জ্বালানি তেলও সরবরাহ করতে হচ্ছে। চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি করা হলো কার স্বার্থে? অব্যবহৃত উৎপাদিত বিদ্যুতে যে খরচ হলো তার দায় কে নেবে?
দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, শিক্ষা ও জনকল্যাণে টাকাগুলো কাজে লাগানো যেত, অথচ তা না করে এই বিপুল পরিমাণ টাকা জলাঞ্জলি দেয়া হলো। গোষ্ঠীস্বার্থে ‘পাবলিক মানি’ খরচে কোনো মায়া-মমতা থাকে না। মূল্যবান কিছু হাতছাড়া হওয়ার ভয় থেকে জবাবদিহি করতে অনিচ্ছুক সরকারের মধ্যে একটা তাড়াহুড়োর মনোভাব সবসময় ক্রিয়াশীল থাকে। সেজন্য আমরা দেখেছি-পছন্দের লোককে খাতির করার জন্য রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল প্ল্যান্ট স্থাপনে কোনো প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক রীতি-নীতি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে। অথচ প্রতিযোগিতায় সর্বনি¤œ দর দাতাকে প্ল্যান্ট প্রদান করা হলে উৎপাদন ব্যয়ও কম হতো। তাতে সাধারণ মানুষও কিছুটা স্বস্তি পেত। বিদ্যুৎ খাতে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি মেটাতে জনগণের পকেট কাটা হচ্ছে জোর জবরদস্তিমূলক। জনগণের কষ্টের কথা বিবেচনা না করে এই সরকারের আমলে ঘন ঘন বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। সম্প্রতি সংসদে উত্থাপিত নতুন আইনে বছরে কয়েকবার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এটি স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর জুলুমেরই বহিঃপ্রকাশ। এর ওপর বিদ্যুতের ভুতুড়ে বিলের প্রতাপে ভুক্তভোগীরা চরম সঙ্কটে দিন কাটাচ্ছেন। যেকোনো দেশে অর্থনীতির উন্নয়নের চাকা সচল রাখতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রাণভোমরা হিসেবে কাজ করে। দেশের নিজস্ব নির্ভরতার ওপর গুরুত্ব না দিয়ে অতিমাত্রায় বিদেশনির্ভর হলে যেকোনো সময় সামান্য ধাক্কায় বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে আমাদের দেশে বিদ্যুতের ব্যবহার শুরু হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণের পরিসর তখন ছোট হলেও ছিল একটি নিজস্বতা। ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর, ‘৪৭ সাল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে নতুন ডাইমেনশন ও গতি বৃদ্ধি পেতে থাকে। কাপ্তাইয়ে পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন তার মধ্যে অন্যতম। গত কয়েক বছর ধরে ভারত থেকে বিদ্যুৎ কেনার হিড়িক শুরু হয়েছে। আমাদের বিদ্যুৎ খাত ক্রমান্বয়ে ভারতমুখী করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এতবড় একটি জরুরি ও জাতীয় অর্থনীতির চালিকাশক্তি অন্য দেশের ওপর নির্ভরশীল করে তোলা সুবিবেচনাপ্রসূত নয়। তাতে স্বনির্ভরতার গতি ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকবে। বিদ্যুৎ সেক্টরের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে ভিন্ন দেশের প্রভাব নিজ দেশে মারাত্মক ঝুঁকি ডেকে আনতে পারে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, এখন থেকে আগাম কর্মকৌশল নির্ধারণ করা না হলে বিদ্যুৎখাত পরদেশ নির্ভর হয়ে পড়বে। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা জোর দেন- জ্বালানি খাতে নিজেদের সক্ষমতা অর্জনের ওপর। তা না হলে জাতীয় স্বার্থের ক্ষতি হবে। বড় দেশগুলোর সাধারণ নীতি হলো, স্বার্থ। সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী পামারস্টোন বলেছিলেন, ঞযধঃ এৎবধঃ ইৎরঃধরহ যধফ হড় ভৎরবহফ, নঁঃ রহঃবৎবংঃ.
ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হয় ২০১৩ সালে। ভারতের সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানির কাছ থেকে এ পর্যন্ত ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করেছে বাংলাদেশ। সামনের দিনগুলোতে আরো বিদ্যুৎ আমদানির কথাবার্তাও অব্যাহত আছে। বাংলাদেশে মোট উৎপাদনের মধ্যে এখন শতকরা ৭ ভাগ আসছে আমদানি থেকে। চাহিদা ও উৎপাদনের প্রেক্ষিতে বর্তমানে ভারতের বিদ্যুৎ ঘাটতি ৫০ হাজার মেগাওয়াট। ২০৩০ সালের মধ্যে এর ঘাটতি দাঁড়াবে চাহিদার তুলনায় ২ লাখ মেগাওয়াট। যেখানে নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমার থেকে ভারতের বিদ্যুৎ আমদানির সম্ভাবনা রয়েছে সেখানে তারা বাংলাদেশে কতদিন বিদ্যুৎ রফতানি করতে সক্ষম হবে তা বলা মুশকিল। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত থাকলে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি ফিজিবল হয় কী করে? ভারতের বেসরকারি উদ্যোক্তা ‘আদানি পাওয়ার লিমিটেড’ কোম্পানির কাছ থেকে ১৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির প্রকল্পটি অনুমোদন দিয়েছে সরকার। ভারতে ঝাড়খ- রাজ্যে তাদের স্থাপিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়। এ জন্য উক্ত জেলার রহনপুর থেকে শিবগঞ্জ ২৮ কিলোমিটার ডাবল সার্কিট লাইন নির্মাণের কাজ পুরোদমে চলছে। যতটুকু জানা যায়, বিদেশে ওই কোম্পানির কাজ করার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। আর একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে কয়লা ও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতি ইউনিটের দাম ভারতের বেসরকারি কোম্পানির কাছ থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের প্রতি ইউনিটের দামের চেয়ে কম। আসলে একটি দেশে মনুমেন্টাল ইনজাস্টিস ও মিস ম্যানেজমেন্ট পরিব্যাপ্ত হলে পরনির্ভরতা ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাত নির্বিঘেœ হরিলুটের অভয়ারণ্য।
জাতীয় আর্থিক সঙ্কট, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় নি¤œ আয়ের দিশেহারা মানুষের অর্থনৈতিক স্তর নেমে গিয়ে দারিদ্র্য গ্রাস করে এবং তাদের সামাজিক অবস্থানেরও অবনতি হয়, ইতিহাসে তার অনেক প্রমাণ রয়েছে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর বিপর্যয়ের পর থেকে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী ধ্বংসের কিনারে চলে আসে। বাংলার নবাব প্রশাসনের কর্মকর্তা, উকিল, আমলা, কাজী, চাকলাদার, পাটোয়ারী বিভিন্ন পদ থেকে অপসারিত হয়ে বিশেষভাবে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মুসলমানরা কৃষিজীবীসহ ক্রমান্বয়ে পশ্চাৎপদ দারিদ্র্যক্লিষ্ট সম্প্রদায়ে পরিণত হয়।
বিদ্যুৎ খাতে জনগণের টাকা নিয়ে যথেচ্ছাচার, ভর্তুকি দিতে জনগণের কাছ থেকে চড়া মূল্যে টাকা আদায় ইত্যাদি কারণে দুদর্শায় পড়ে অসহায় মানুষরা বিদ্যুৎ ব্যবহার বন্ধ করে তেলের বাতিতে ফিরে যেতে পারে। যেমন এখন এই করোনাভাইরাস সঙ্কটে নি¤œ আয়ের মানুষের হাতে টাকা না থাকায় বাসাভাড়া না দিতে পেরে ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। অসৎ উদ্দেশ্যে প্রণীত আইন অবৈধ ক্ষমতার বাই-প্রোডাক্ট। তবে সেই আইন অন্যায় অপকর্মকে বেশি দিন ঘিরে রাখতে পারে না। বিদ্যুৎখাতে জনগণের টাকা যেভাবে খোলামকুচির মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে নষ্ট করা হয়েছে তা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের বাণী প্রচারকদের ম্যানুফ্যাকচার্ড জনমত গঠনের প্রচেষ্টা। কিন্তু তা সফল হয়নি। হ
লেখক : বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব


আরো সংবাদ



premium cement