১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

করোনাকালে বাড়িভাড়া নিয়ে সঙ্কট

চোখের আলোয়
-

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এখনো প্রবলভাবেই ঘটে চলেছে এবং প্রতিদিনই ৩০-৪০ জন করে মৃত্যুবরণ করছে। পরিস্থিতি এখনো চূড়ান্ত পর্যায়ে ওঠেনি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। চূড়ান্ত পর্যায়ে এর ভয়াবহতা কোথায় গিয়ে পৌঁছবে, কতটা বীভৎস হবে এর মারণ ছোবল আমরা সাধারণ মানুষ তা অনুমানও করতে পারছি না। কিন্তু চোখের সামনে যেটা দেখতে পাচ্ছি সেটি হলো মানুষের দুর্দশা। ২৬ মার্চ থেকে পরবর্তী ৬৬ দিন দেশে লকডাউন বা সাধারণ ছুটি ছিল। এই দীর্ঘ দুই মাসের বেশি সময়কালে মানুষের জীবনযাত্রা ছিল অচলপ্রায় এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিলো স্তব্ধ। প্রতিদিন আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় তিন হাজার ৩০০ কোটি টাকা। লাখ লাখ লোক চাকরি হারিয়েছেন। বিভিন্ন হিসাবে সেই অঙ্ক দেড় কোটি থেকে শুরু করে সাড়ে তিন কোটির ঘরও ছাড়িয়ে গেছে। বিপুলসংখ্যক মানুষ চাকরি না হারালেও বেতন পাচ্ছেন না। অনেকের বেতন কমিয়ে দেয়া হয়েছে কারণ তার প্রতিষ্ঠান চলছে না। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অচল হয়ে পড়েছে। অনিশ্চিত কাজে নিয়োজিত মানুষ শুধু বেকার হয়েছেন এমন নয়, তারা নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন এবং অপেক্ষাকৃত সচ্ছল মানুষের বা সরকারি ত্রাণ সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। নানা সূত্রে পাওয়া পরিসংখ্যান বলছে, দেশে করোনা পরিস্থিতির কারণে এরই মধ্যে পাঁচ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছেন।
লকডাউন বা সাধারণ ছুটিতে অচল হয়ে পড়া অর্থনীতির চাকা এখনো পুরো সচল হয়নি। দিনমজুর থেকে শুরু করে বড় বেতনের চাকুরে সবার জীবনেই কোনো না কোনোভাবে এর প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি বলেছে, সাধারণ ছুটির ৬৬ দিনে ছাঁটাই, প্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং কর্মহীনতা এসব কারণে দেশে চাকরি হারিয়েছেন প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষ। এই সংগঠনের বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি আছে। তারা অনেক সময় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক প্রতিবেদন করে বলেও অভিযোগ আছে। তবু বর্তমান পরিস্থিতিতে বেকার হয়ে পড়া মানুষের সংখ্যা কোনোভাবেই দেড় কোটির কম হবে না বলেই মনে হয়। গত এপ্রিলের মাঝামাঝি ব্র্যাক একটি জরিপের ফল প্রকাশ করে। এতে দেখা যাচ্ছে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে তখনই মানুষের আয়-রোজগারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আড়াই হাজার মানুষের ওপর করা জরিপ অবশ্য খুব বড় আঙ্গিকের নয়, তবুও জরিপে অংশ নেয়া ব্যক্তিদের উত্তরের ভিত্তিতে দেখা যাচ্ছে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর ঘোষিত সাধারণ ছুটির সময় এই অংশগ্রহণকারীদের ৯৩ শতাংশের আয় কমে গেছে।
শুধু চাকরিজীবী বা ব্যবসায়ীদের নয়, ঢাকার বস্তিবাসীদের অবস্থা আরো খারাপ। তারাও কাজ হারিয়ে ভাড়া দিতে না পেরে শহর ছেড়ে যাচ্ছেন। অনেককে ভাড়ার জন্য হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে এমন অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে। আবার কেউ ঘরের আসবাব ও ব্যবহারের জিনিসপত্র বিক্রি করেও ভাড়া শোধ করে চলে যাচ্ছেন।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) ও ব্র্যাকের সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এরই মধ্যে সারা দেশে নতুন করে আরো অন্তত পাঁচ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে, যারা আগে নিম্ন মধ্যবিত্ত ছিলেন, ছোট চাকরি বা ক্ষুদ্র ব্যবসা করতেন। এদের একটি বড় অংশের বসবাস ঢাকা শহরে। তবে ব্র্যাকের পর্যবেক্ষণ বলছে, করোনার শুরুর দিকে দিনমজুর ও রিকশাচালকদের যে খারাপ অবস্থা হয়েছিল তার উন্নতি হচ্ছে। শ্রমিকরা কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করে উপার্জন করতে পেরেছেন। এখন আবার তারা কিছু কাজ পাচ্ছেন। কিন্তু এখন কাজ হারানোর শীর্ষে আছেন পোশাক শ্রমিকরা। তারা গ্রামে চলে যাচ্ছেন। নন-এমপিও শিক্ষকরা বেতন পাচ্ছেন না। মাদ্রাসার শিক্ষকদের বড় একটি অংশ কষ্টে আছেন। মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেমরাও ভালো অবস্থায় নেই।
আমরা যারা ঢাকা শহরে অবস্থান করছি তারা দেখছি আশপাশের অনেক মানুষ পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকার মতো আর্থিক পরিস্থিতিতে নেই। কেউ বাড়িভাড়া দিতে পারছেন না। অনেকে সংসার চালাতে পারছেন না। বউ ছেলেমেয়ে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন এমন ঘটনাও শুনছি। গণমাধ্যমে শিরোনাম দেখছি, বাড়িভাড়া দিতে না পেরে পরিবারসহ গ্রামে ফিরে গেছেন, বাড়িভাড়া কমিয়েছেন বাড়িওয়ালা, অভিজাত এলাকা ছেড়ে অপেক্ষাকৃত কম ভাড়ার এলাকায় চলে যাচ্ছেন, ভাড়াটিয়ার অভাবে ফ্ল্যাটবাড়ি খালি পড়ে আছে। করোনা সংক্রমণ শুরুর পর থেকেই এ ধরনের নানা কাহিনী শোনা যাচ্ছে। এটা সত্যি যে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটে উভয়েই গভীর সঙ্কটে পড়েছেন।
নয়া দিগন্তের খবরে জানা যাচ্ছে, করোনার কারণে চাকরি বা ব্যবসা হারিয়ে অনেকেই ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন। চলে যেতে হতে পারে আরো অনেককে। ঢাকায় তাদের এখন আর কোনো কাজ নেই। তাই যেন আশ্রয়ও নেই। করোনা শুরুর পর বেতন কমিয়ে ৬৫ শতাংশ দেয়া হয় বলে এক বেসরকারি চাকুরের পক্ষে বাসা ভাড়া দিয়ে ঢাকায় থাকা সম্ভব হয়নি। এক মাস আগে তিনি বাসা ছেড়ে দিয়ে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যান। ঢাকার মালিবাগে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের পরিচালক এপ্রিল পর্যন্ত তিনি স্কুল টিকিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু এরপর আর পারেননি। স্কুল ভবনের ভাড়া, শিক্ষকদের বেতন তার পক্ষে বহন করা সম্ভব হচ্ছিল না। মে মাসে স্কুল স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেন। আর নিজেও জুনের ১০ তারিখ ঢাকা ছেড়ে সপরিবারে গ্রামের বাড়ি চলে যান। এরকম বহু দৃষ্টান্ত নামধামসহ তুলে ধরেছে আরো অনেক পত্রিকা।
ভাড়াটিয়া পরিষদের হিসাব অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ঢাকার ৫০ হাজার ভাড়াটে বাসা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এর চেয়েও আরো বেশিসংখ্যক মানুষ আগের বাসা ছেড়ে দিয়ে কম ভাড়ার বাসায়
উঠেছেন বা ওঠার চেষ্টা করছেন। যারা ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকায় ভাড়া থাকতেন তারা এখন ৮-৯ হাজার টাকার ভাড়া বাসা খুঁজছেন। আর যাদের মাসে আয় ছিল ২৫-৩০ হাজার টাকা তারা আর এ শহরে টিকতে পারছেন না। ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি পরিস্থিতি আরো খারাপ হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে সামর্থ্যহীন ভাড়াটেদের জন্য এপ্রিল, মে, জুন এই তিন মাসের বাড়িভাড়া যেকোনো উপায়ে মওকুফ করার দাবি জানিয়েছেন। একই সাথে তিনি এসব ভাড়াটের গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বিল ও হোল্ডিং ট্যাক্সও মওকুফের দাবি জানান।
ভাড়াটিয়া পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন রাজধানী ঢাকায় বাড়িভাড়া মওকুফের দাবি তুললেও এ নিয়ে সরকার বা সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কিছু বলা হয়নি। বাড়ির মালিকদের বিভিন্ন ধরনের কর ও সার্ভিস চার্জ মওকুফের মতো কোনো সিদ্ধান্তও সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হয়নি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র, একাধিক ভাড়াটে, বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়া পরিষদসহ সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন বলে পত্রিকান্তরের খবরে জানা যায়। তবে তাতে কোনো সমাধান মেলেনি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভাড়াটে ও বাড়ির মালিক দু’পক্ষেরই গ্রহণযোগ্য যুক্তি আছে। করোনা মহামারীর এই কঠিন সময়ে বেশির ভাগ ভাড়াটের আয়-রোজগার নেই। অনেককে ত্রাণের জন্য হাত পাততে হচ্ছে। এ অবস্থায় বাড়িভাড়া পরিশোধ করা তাদের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। অন্য দিকে এমন অনেক বাড়িওয়ালা আছেন যাদের আয়ের একমাত্র উৎস বাড়িভাড়া। অনেক বাড়িওয়ালার কাঁধে আছে বাড়ি নির্মাণের সময় নেয়া ঋণের বোঝা।
ব্যতিক্রমী ঘটনাও রয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অনেক বাড়িওয়ালা ভাড়া পরিশোধের জন্য ভাড়াটের ওপর অমানবিক চাপ প্রয়োগ করেছেন এবং এখনো করছেন। এরই মধ্যে বাড়িভাড়া নিয়ে বেশ কিছু অমানবিক ঘটনা ঘটে গেছে। ভাড়া দিতে না পারায় ভাড়াটেকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে, মারধরের ঘটনাও ঘটেছে। বেশ কয়েকটি ঘটনায় পুলিশকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। আবার বেশ কিছু বাড়ির মালিক মানবিক আচরণ করছেন। কেউ মওকুফ করেছেন। অনেকে বলেছেন, পরে দিলেও চলবে। আমাদের জানা মতে, বাড়িভাড়া নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিপাকে আছেন বস্তিবাসী মানুষ। এ দুর্যোগেও ঘরভাড়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন বস্তির নিয়ন্ত্রক প্রভাবশালীরা। দিন এনে দিন খাওয়া মানুষগুলো এমনিতেই কাজ হারিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে আছেন। ঠিকমতো ত্রাণও মিলছে না। তার ওপর ঘরভাড়া নিয়ে চাপের মুখে তারা দিশাহারা।
ভাড়াটিয়া পরিষদের তথ্য মতে, ঢাকায় বসবাসকারী আড়াই কোটি মানুষের মধ্যে বাড়ির মালিক ১০ শতাংশ। বাকি ৯০ শতাংশই ভাড়াটে। তাদের মধ্যে ৭০ শতাংশ ভাড়াটে মধ্যবিত্ত। সে হিসাবে ঢাকা শহরে মোট ভাড়াটের সংখ্যা দুই কোটি ২৫ লাখ। এর মধ্যে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত ভাড়াটের সংখ্যা ১ কোটি ৭৫ লাখ। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই শ্রেণীর ভাড়াটেরাই বেশি সঙ্কটে আছেন। পরিষদের সভাপতি জানান, আশুলিয়ার বাড়ির মালিকরা এরই মধ্যে বাড়িভাড়া অর্ধেক নিয়েছেন।
এ কথা ঠিক যে, ঢাকা শহরের অধিকাংশ বাড়ির মালিকই বাড়িভাড়ার টাকায় সংসার চালান। আবার বাড়ি নির্মাণের সময় নেয়া ঋণের কিস্তিও পরিশোধ করতে হয়। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বিল, হোল্ডিং ট্যাক্স এগুলোও বাড়িওলাকে শোধ করতে হয়। কিন্তু সবচেয়ে বড় সত্য হলো, করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত হননি এমন মানুষ কম। বাড়িওলা বা ভাড়াটে উভয় পক্ষকেই পারস্পরিক ভিত্তিতে ক্ষতির দিকটা ভাগ করে নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে বাড়িওলা যদি ভাড়া যৌক্তিক পর্যায়ে কমাতে প্রস্তুত থাকেন তাহলে ভাড়াটেকেও বলা যেতে পারে যে, তুমিও যেভাবে হোক ভাড়া দাও। এখন বাড়িওলার জন্য ভাড়ার পরিমাণ কতটা কমানো যুক্তিযুক্ত হবে সেটি আলোচনা করে সিদ্ধান্ত দিতে পারেন দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র ও সংশ্লিষ্টরা। তবে বিষয়টি জরুরি ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করার দাবি রাখে বলে আমরা মনে করি। হ


আরো সংবাদ



premium cement