২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের এখনই সময়

-

৫ জুন ছিল বিশ্ব পরিবেশ দিবস। এ বছর দিবসটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল টাইম ফর নেচার।’ অর্থাৎ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের এখনই সময়। চীনে প্রথম করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে গত ৩১ ডিসেম্বর। হুবেই প্রদেশের উহান শহরের একটি সামুদ্রিক খাবার ও পশুপাখির বাজার থেকে সংক্রমণ শুরু। এর জন্য বিশ্ব দায়ী করতে শুরু করেছিল চীনাদেরকেই। কারণ, বিশ্বের চোখে, তারা ‘আজেবাজে’ খাবার খায়। তখন অনেক মসজিদে বয়ান করতে শুনেছি, ‘ভয় নেই, এই রোগ শুধু চীনাদের জন্য’। তবে তা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে ইউরোপ আমেরিকায়। তখনও আমরা নির্বিকার। ভাষা পরিবর্তন করে বলা হলো, ‘করোনা শীতপ্রধান দেশের রোগ। গ্রীষ্মপ্রধান দেশের কিচ্ছু হবে না’। আক্রান্ত দেশ ছেড়ে নিজ নিজ দেশে ফিরতে শুরু করে প্রবাসীরা। এক সময়ে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বে। রোগাক্রান্ত মানুষ যখন হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘুরে; বেঘোরে রাস্তায় মরতে শুরু করেছে তখনও বলা হচ্ছে, ‘করোনায় কিছুই হবে না আমাদের।’
পরাশক্তিদের কাদা ছোড়াছুড়ি শুরু হয়। বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর অন্যতম, আমেরিকা করোনার জন্য চীনকে দায়ী করে নাম দিয়েছে ‘চীনাভাইরাস’। অন্যদিকে চীনের দাবি, আমেরিকাই এই ভাইরাসের জন্মদাতা এবং এই মহামারীর জন্য তারাই দায়ী। ইরান সমর্থন করছে চীনকে। বিশ্বের দুই পরাশক্তি ব্রিটেন ও রাশিয়া সরাসরি চীন ও আমেরিকাকে সমর্থন না করলেও ‘কায়া কোনদিকে ঝুঁকছে ছায়া দেখলেই টের পাওয়া যায়’। সেই ‘চিরাচরিত’ নীতি অনুসারে, রাশিয়া চীনকে সমর্থন করলে ব্রিটিশ সমর্থন করবে আমেরিকাকে। ডোনাল্ড ট্রাম্প এ বছরের শেষে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। রিপাবলিকান দল থেকে পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কাজ শুরু করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাসের মহামারী মোকাবেলার বিষয়ে সমালোচিত ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকার জন্য যদি যুদ্ধ বাধানোর অজুহাত খোঁজেনÑ তখন কী হবে?
আজকে কয়েকটি দেশের হাতে যে পরিমাণ পারমাণবিক বোমা রয়েছে, তা দিয়ে পৃথিবীকে কয়েকবার সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে ফেলা সম্ভব। পারমাণবিক বোমার অন্যতম কারিগর, বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছিলেন, ‘জানি না তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে কী ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হবে। তবে এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত যে, চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধে আবার আদিম যুগের লাঠি ও পাথর ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। আমি বলতে পারছি না, ওই লাঠি ও পাথর ব্যবহার করার মতো কোনো মানুষ তখন পৃথিবীতে থাকবে কি না।’
বিশ্বের পরিবেশ দূষণ, জীববৈচিত্র্য ধ্বংসসহ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির পরিণাম সম্পর্কে গত দুই দশক আগে থেকে বৈজ্ঞানিকদের সতর্কবাণী কেউ কানে তুলছিল না। বিশেষ করে, চীন প্রথম এবং যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর গ্রিন হাউজ গ্যাসের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস। তার পরেও, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব সংক্রান্ত সাম্প্রতিক গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞদের কোনো ‘বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য’ রয়েছে।’ ট্রাম্প বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে চীনের হাতের পুতুল উল্লেখসহ অবিশ্বাস শুরু করেছেন। কোভিড-নাইনটিন ইস্যুতে। সংস্থা থেকে মহামারী মোকাবেলায় ধাপে ধাপে যেসব কার্যক্রম চালিয়েছে তারও তীব্র সমালোচনা করেছেন।
বিশেষজ্ঞের মতামত কেন? সব বিষয়ে সমান জ্ঞান নিয়ে কোনো মানুষ জন্মায় না। যে কারণে একজন ইঞ্জিনিয়ার অসুস্থতার জন্য চিকিৎসকের কাছে এবং একজন চিকিৎসক নির্মাণকাজের জন্য যেতে হয় ইঞ্জিনিয়ারের কাছে। ঠিক তেমনভাবে প্রকৃতির অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ডের জন্য যাওয়া উচিত পরিবেশ বৈজ্ঞানিকের কাছে। কারণ, ‘পরিবেশ প্রযুক্তি, সবুজ প্রযুক্তি বা পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তি (ঊহারৎড়হসবহঃধষ ঃবপযহড়ষড়মু, ক্লিন টেক নামে পরিচিত) বলতে পরিবেশের সাথে মানুষের নেতিবাচক সংশ্লিষ্টতার ক্ষতি কাটিয়ে উঠার মাধ্যমে প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং সম্পদ সংরক্ষণের জ্ঞানই পরিবেশ বিজ্ঞান।’ জীববিজ্ঞান আর পরিবেশবিজ্ঞানের অভিন্ন বক্তব্য-ঊাবৎু ষরারহম ড়ৎমধহরংস ধৎব ষরহশবফ রিঃয বধপয ড়ঃযবৎ ধহফ যঁসধহ ফবাবষড়ঢ়সবহঃ ধহফ নরড়ফরাবৎংরঃু ধৎব রহঃবৎৎবষধঃবফ.এ বক্তব্য সমর্থন করে ২০০২ সালে দ্য ওয়ার্ল্ডওয়াইড ফান্ড ফর নেচার এক পরিসংখ্যান তৈরি করে দেখিয়েছিল, ব্যবহারযোগ্য স্থলভূমির ৯৭% মনুষ্যজাতির দখলনিয়ন্ত্রণে। অবশিষ্ট মাত্র তিন ভাগ থেকেও বিপন্ন হওয়ার পথে বিশ্বের অন্য সব প্রাণী।
‘কোনো কৃত্রিম উপায়ে করোনাভাইরাস তৈরি করা হয়নি। মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্ক্রিপস রিসার্চ ইনস্টিটিউট এ দাবি করেছে। সংশ্লিষ্ট একটি গবেষণাপত্র সম্প্রতি নেচার মেডিসিন নামক জার্নালে প্রকাশিত হওয়ার পরও চীন ও আমেরিকা পরস্পর বিষোদগার থেকে বিরত না হওয়ার কারণে প্রকৃত তথ্য থেকে দূরে সরে পড়ছে বিশ্ব।
বছর তিনেক আগে ‘জাতিসঙ্ঘের আশঙ্কার চেয়েও ভয়াবহ’ শিরোনামে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সতর্কীকরণ বার্তায় বলা হয়েছে, হাজার বছরের সাজানো মানবসভ্যতা চোখের পলকে দুমড়ে-মুচড়ে যাবে। এই ধ্বংসযজ্ঞের হাত থেকে রক্ষা করার ক্ষমতা আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তিসহ বিজ্ঞানের নেই।
বিশ্বের ক্রমবর্ধমান উষ্ণতা রোধ করা না গেলে অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলে যাবে। এ মহাদেশের শতকরা ৯৮ ভাগই প্রায় দুই কিলোমিটার পুরু বরফাবৃত। গত ২৫ বছরে গলেছে ৩ লাখ কোটি টন বরফ! এই গতিতে অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলতে থাকলে আগামী পৃথিবীতে দেখা দিতে পারে মহাপ্লাবন। এখন পৃথিবীর অন্তত ৭০ শতাংশ তলিয়ে যাবে পানির নিচে।
প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানই কোনো না কোনো শৃঙ্খলের অন্তর্ভুক্ত। এরা একে অন্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই কোনোভাবে এই উপাদানগুলোর কোনো একটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে, বিনষ্ট হয় পরিবেশগত ভারসাম্য। কখনো কখনো সে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার গুরুদায়িত্ব প্রকৃতিই নিজ কাঁধে তুলে নেয়।
প্রকৃতি স্থবির নয়’ বরং সজীবÑ এ কথা প্রায় সোয়া শ’ বছর আগে আমাদের জানিয়ে গেছেন বাঙালি বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু। বিষয়টি নিয়ে খুবই মর্মস্পর্শী, হৃদয়গ্রাহী ও অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন আলোচনা করেছেন এক সময়ের দায়রা জজ নরেন্দ্র কুমার দাস। এক মামলার রায় শুনানিতে তিনি বলেন, ‘আমাদের সমাজ-রাষ্ট্র নানাবিধ প্রতিকূলতা ও সীমাবদ্ধতার কারণে অপরাধের প্রতিবিধান করতে পারে না। নানারকম সীমাবদ্ধতার কারণে আদালত সব ক্ষেত্রে অপরাধীদের শাস্তি দিতে পারে না। কিন্তু অপরাধীরা কখনো প্রকৃতির রূঢ়তা ও নির্মম প্রতিশোধ থেকে বাঁচতে পারে না। কোনো না কোনোভাবে প্রকৃতিগতভাবেই অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত হয়। অপঘাত, অপমৃত্যু, দীর্ঘ যন্ত্রণাদায়ক ও দুরারোগ্য রোগভোগ, দুর্ঘটনা, পারিবারিক ও সামাজিক কলহবিবাদ, গণমানুষের রুদ্ররোষ, রাষ্ট্রাচারের বিচ্যুতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারীসহ নানাবিধ প্রতিকূলতায় শাস্তি পায়। আর এই প্রাপ্য শাস্তি হয় মানুষের কল্পনারও অতীত।’ ইতিহাসস্বীকৃত দুটি প্রমাণ : ১৯৪৯ সালে চীনের ক্ষমতা গেল কমিউনিস্ট পার্টির হাতে। মাও সে তুংয়ের নেয়া প্রাথমিক পদক্ষেপগুলোর একটি ছিল, ফসল রক্ষা করা। চীনা বিজ্ঞানীদের দেয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, চড়ুই মাত্র এক বছরে আনুমানিক ৬০ হাজার মানুষের খাদ্য খায়। আর তাই দেশ থেকে সব চড়ুই পাখি মেরে ফেলার নির্দেশ দিলেন মাও। শুরু হলো দ্য গ্রেট স্প্যারো ক্যাম্পেইন! প্রায় ৯৬ লাখ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দেশ থেকে নানা কৌশলে ‘হত্যা করা হয় শেষ চড়ুইটাকেও’। এই যুদ্ধে এক বছরে দুই বিলিয়ন চড়ুইসহ অন্যান্য ছোট পাখি হারিয়েছে প্রকৃতি। চীনারা আনন্দিত হয়েছিল, জয় উদযাপন করেছিল।
ততক্ষণে প্রকৃতিতে বাড়তে শুরু করেছিল মশা-মাছিসহ অনিষ্টকর কীটপতঙ্গ। চড়ুই পাখি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় জ্যামিতিক হারে বেড়ে গেল সেসব পোকামাকড়ের সংখ্যা। এতে করে ফসলের ক্ষেত ছেয়ে যেতে লাগলো ক্ষতিকর পোকামাকড়ে। ফলস্বরূপ, যে শস্য বাঁচানোর জন্য এত কিছু করা হলো, সেই শস্য গেল পোকামাকড়ের পেটে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই শস্যভাণ্ডার খালি হয়ে গেল। সাধারণ মানুষের মজুদ করা খাদ্যেও ঘাটতি দেখা দেয়। খাদ্য সঙ্কটের মুখে পড়লো কোটি কোটি মানুষ। দেখা দিয়েছিল দুর্ভিক্ষ। এ দুর্ভিক্ষ ‘দ্য গ্রেট ফেমিন’ নামে পরিচিত। চীনা সরকারের অফিসিয়াল নথি অনুযায়ী, খাদ্য সঙ্কটে প্রাণ হারানো মানুষের সংখ্যা ছিল ১৫ মিলিয়ন। তবে চীন দেশটির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের মতে, সংখ্যাটা ৪৫ মিলিয়ন কিংবা ৭৮ মিলিয়নেরও বেশি।
দ্বিতীয় প্রমাণ : ‘আমেরিকার দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান হলো ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক। এর ভিতরে রয়েছে পর্বতমালা, সক্রিয় আগ্নেয়গিরি, গিরিখাত, নদী ও হ্রদ। এটি ১৮৭২ সালের ১ মার্চ রাষ্ট্রপতি ইউলিসিস এস. গ্র্যান্টের স্বাক্ষরানুক্রমে মার্কিন কংগ্রেসে একটি আইন পাস করে স্থাপিত হয়েছিল। পার্কটি মূলত ওয়াইওমিং রাজ্যে অবস্থিত হলেও মন্টানা ও আইডাহো রাজ্যেও এর কিছু অংশ রয়েছে। জীববৈচিত্র্য ও জিওথার্মাল বৈশিষ্ট্যের জন্য পার্কটি খুবই বিখ্যাত। আয়তন ৮,৯৮০ বর্গকিলোমিটার। ছিল ইয়েলোস্টোন পার্ক বাইসন। এরা দল বেঁধে থাকত এবং পার্কের চারপাশে অবাধে ভ্রমণ করত। পার্কের অন্যান্য বন্যপ্রাণীর মধ্যে ছিল ঈক, কালো ভাল্লুক, বিশেষ ধরনের নেকড়ে, প্রোঙ্গহর্ন অ্যান্টিলোপ (এক ধরনের হরিণ), বড় শিংওয়ালা ভেড়া, উইন্তা মেঠো কাঠবিড়ালি, পালকহীন ঈগল, ব্যাজার, লাল শিয়াল, গলজাতীয় পক্ষী, ছাই বর্ণের ঘুঘু প্রভৃতি।
যে দিন থেকে মানুষ সে অরণ্যের ওপর নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা শুরু করল, তখন থেকেই প্রকৃতি তার ভারসাম্য হারাতে শুরু করে। প্রথমে লোপাট হলো নেকড়ে। তাদের অবর্তমানে বহুগুণে বেড়ে গেল এল্ক বা বাঁকানো লম্বা শিংওয়ালা হরিণ। তারা চড়াও হলো সে অরণ্যের এসপেন, উইলোসহ পত্রবহুল উদ্ভিদগুলোর ওপর। তাদের আক্রমণে দ্রুত কমতে থাকল বৃক্ষরাজি। ফলে খাদ্যের খোঁজে সে অরণ্য থেকে পালাতে শুরু করে অন্য সব পশু ও পাখি। বিরান হয়ে ওঠে একসময়ের বিস্তীর্ণ অরণ্য। ১৯২০ সালে ইয়েলোস্টোনকে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় উদ্যান ঘোষণার পর পরিকল্পিতভাবে ফিরিয়ে আনা হলো নেকড়েগুলো। ক্রমেই সজীব হলো বৃক্ষরাজি, ফিরে এলো পশু-পাখি। নতুন জীবন ফিরে পেল ইয়েলোস্টোন। ওলেনবেনের কথায়, ‘প্রকৃতির রক্ষক হিসেবে কখনও কখনও মানুষের চেয়ে নেকড়ে অনেক বেশি যোগ্য।’
প্রকৃতি সংক্ষুব্ধ হয়ে ওঠার কারণ : ‘আইপিবিইএস’-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে প্রফেসর জোসেফ সেটেলি, সান্দ্রা ডায়াজ, এডুয়ার্ডো ব্রোনদিজিও ও ড. পিটার দাসজাকের আশঙ্কা, ‘করোনাভাইরাসের মূল কারণ অনবরত প্রকৃতি বিনাশ। যেকোনো মূল্যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে গিয়ে মানুষের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডেরই প্রত্যক্ষ পরিণতি এই মহামারী। বন বিনাশ, অনিয়ন্ত্রিত কৃষি ও খামার সম্প্রসারণ, খনি ও অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি বন্যপ্রাণীর নির্মূল হওয়া এই রোগ ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে নিখুঁত গতি তৈরি করেছে।’ সূত্র ভিয়েতনাম নিউজ অ্যাজেন্সি, বিবিসি, আলজাজিরা, সিএনএন, গার্ডিয়ান, এনডিটিভি, রয়টার্স, ইরনা, আরব নিউজ, বার্নামা, আনাদোলু এজেন্সি, ফিন্যান্সিয়াল টাইমস, এক্সপ্রেস ইউকে ও ওয়ার্ল্ডোমিটারস।’ প্রকৃতি তার আপন গতিতে বয়ে চলে পাহাড়ি ঝর্ণার মতন। ক্রমাগত পরিবর্তনশীল প্রকৃতির নিয়মের সাথে মানিয়ে নিতে যোগ্যতার প্রয়োজন। যোগ্যতার অভাবে হারিয়ে গেছে ডাইনোসর, ম্যামথসহ দানবীয় সব প্রাণী। আবার বহাল তবিয়তে রয়ে গেছে তেলাপোকা ও পিঁপড়ার মতো ক্ষুদ্র প্রাণীরা।
প্রকৃতি দূষণের জন্য বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী ও সমাজতন্ত্রীÑএই সাবেক দুই শিবিরই দায়ী। প্রকৃতিকে মিত্র না বানিয়ে তার সঙ্গে শত্রুতা করে বিশ্বের মানুষ যদি শুধু নিজের স্বার্থ ও সুবিধা দেখে, তাহলে প্রকৃতি যে তার প্রতিশোধ নেবে এবং নিচ্ছে, এটা দৃশ্যমান। ভারাক্রান্ত প্রকৃতি ভারমুক্ত হওয়ার জন্য শুরু করে অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ডÑ যেমন, ঝড়, বন্যা, ভূমিকম্প, দুর্ভিক্ষ, মহামারী। মহামারীর জন্য জন্ম নেয় নিত্যনতুন রোগ-জীবাণু।
সেই আদিকাল থেকে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে গাছ কাটা এবং খাল-বিল-নদী ভরাট করে ফেলা হচ্ছে। পাহাড় কেটে ফেলা। পলিথিনসহ নানা বর্জ্যদ্রব্যে পরিবেশের দম বন্ধ করা; বারবার বিজ্ঞানীদের সতর্কবাণী উপেক্ষা করে বছরের পর বছর সমুদ্রের জলে পরীক্ষামূলকভাবে আণবিক বোমার বিস্ফোরণ এবং তেজস্ক্রিয় বর্জ্য থেকে বিষাক্ত রাসায়নিকের সংক্রমণে ক্যান্সার, নিউকোমিয়া ইত্যাদি ঘাতক রোগের বিস্তার ঘটছে।
ভোগবাদী মানুষের কারণে নিঃশেষিত হচ্ছে অরণ্য প্রকৃতি। এ ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে মানবসৃষ্ট দূষণের ফলে লুপ্ত হওয়া সহস্র প্রজাতির পতঙ্গকুলের; বনাঞ্চল ধ্বংস করায় অরণ্যনির্ভর জীবগুলোর এবং অতি শিকারে ফুরিয়ে যাওয়া হাজার রকম মৎস্যসম্পদের। এ প্রসঙ্গ এখানে অবশ্যই উত্থাপিত হতে পারে যে, পরিবর্তিত জলবায়ুতে বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ হয়তো বা সমর্থ হবে মানিয়ে চলতে। প্রকৃতির রক্ষক হওয়ার বদলে আমরা যখন ভক্ষক হয়ে দাঁড়াই, তখন তার ফল কী ভয়াবহ হতে পারে, এর আরেক উদাহরণ করোনাভাইরাস। এই অদৃশ্য ভাইরাসের আক্রমণে সারা বিশ্ব এখন এক অভাবিত বিপর্যয়ের মুখে।
উদ্ভিদ ও প্রাণীর মধ্যে অক্সিজেন ও কার্বনের কী বিস্ময়কর সমন্বয়। অক্সিজেন ও কার্বন-ডাই অক্সাইডের মতো প্রকৃতির অপরাপর বস্তু ও পদার্থের মধ্যেও রয়েছে সুষম সমন্বয় । সুষম সমন্বয় তছনছ করে প্রযুক্তিনির্ভর মানুষের ভেতর জেঁকে বসেছিল অবাঞ্ছিত এক অহঙ্কার যা মানবজাতিকে অন্ধ করে রেখেছিল। প্রকৃতির কাছে মানুষের চাহিদার কমতি ছিল না। নিজস্ব ভুবনকে নিজের মতো করে পাওয়ার জন্য মানুষ প্রতিনিয়ত অত্যাচার করে চলছে প্রকৃতির ওপর। একের পর এক চাপ সহ্য করে, প্রকৃতি যখন খুব বেশি ক্লান্ত, তখন তার অসহনীয় এক আচরণের বহিঃপ্রকাশ, করোনার মাধ্যমে সে জানান দিলো তার নিজস্ব সত্তা।
অসহায় মানুষ যখনই ভয়াবহ মহামারীর কবলে পড়ে তখনই নিজ নিজ বিশ্বাস অনুসারে সর্বশক্তিমান স্রষ্টার কাছে আত্মসমর্পণ করতে শুরু করে। প্লেগ বা ব্ল্যাক ডেথের ভয়াবহ বাস্তবতার জন্য ইউরোপীয়রা প্রস্তুত ছিল না। প্লেগ হলে অদ্ভুতভাবে ফুলে রক্ত ও পুঁজ বের হয়ে আসে শরীর থেকে। তারপর জ্বর, সর্দি, বমি, ডায়রিয়া, ভয়াবহ ব্যথার মতো লক্ষণ প্রকাশ পায়। ফলাফল অল্প কিছুদিন পরই মৃত্যু। রোগটি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, ঘুমাতে যাওয়ার সময় পুরোপুরি সুস্থ মানুষকে সকালে মৃত অবস্থায় পাওয়া যেত।
আতঙ্কে সুস্থরা অসুস্থদের এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতেন। চিকিৎসকরা রোগীদের দেখতেন না, পুরোহিতরা শেষকৃত্য পরিচালনা করতেন না, দোকানদাররা নিজেদের দোকান বন্ধ করে দিয়েছিলেন। অনেক মানুষ শহর থেকে পালিয়ে গ্রামে চলে গিয়েছিল। গ্রামে গিয়েও তারা বাঁচতে পারেনি। ধর্মগুরুদের মতে, ‘ব্ল্যাক ডেথ’ ঈশ্বরের দেয়া শাস্তি। তাদের ধারণা ছিল লোভ, পরনিন্দা, ধর্মবিরোধিতা ও ব্যভিচারের মতো পাপের ফল ছিল এই রোগ। এই যুক্তি অনুযায়ী, প্লেগ কাটিয়ে ওঠার একমাত্র উপায় ছিল ঈশ্বরের ক্ষমা পাওয়া। কিছু মানুষ বিশ্বাস করত, ঈশ্বরের ক্ষমা পাওয়ার উপায় হলো তাদের ধর্মাবলম্বীদের শুদ্ধ করা এবং অন্য ধর্মের মানুষদের মেরে ফেলা। ফলে ১৩৪৮ ও ১৩৪৯ সালে হাজার হাজার ইহুদি গণহত্যার শিকার হয়েছিল।
করোনাভাইরাস ঈশ্বরের দেয়া শাস্তি মনে করে হিন্দু ধর্মের অনেক অনুসারীও এ নিয়ে তাদের ব্যাখ্যা হাজির করেছেন। অল ইন্ডিয়া হিন্দু মহাসভার সভাপতি স্বামী চক্রপাণি এই ভাইরাসকে একটি ‘রাগী দেবতা’ বলে অভিহিত করেছেন। ‘করোনাভাইরাস নয়, এটি নিরীহ প্রাণীকে রক্ষার অবতার। যারা এদের ভক্ষণ করেন, তাদের মৃত্যু ও সাজার শাস্তি শোনাবার জন্য এরা এসেছে,’ বলেন তিনি। ভারতের নানা স্থানে ‘করোনা দেবী’র আবির্ভাব ঘটেছে’, চলছে পূজা-অর্চণা।
ড. ক্রেইগ কনসিডাইন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের রাইস ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞান বিষয়ের অধ্যাপক। তানের মতে, তিনি (হজরত মুহাম্মদ সা:) কোনোভাবেই প্রাণঘাতী রোগের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছিলেন না। তথাপি মুহাম্মদ সা: প্রাণঘাতী রোগ ও মহামারী মোকাবেলায় যেসব উপদেশ দিয়েছেন সেগুলো কভিড-১৯, তথা করোনাভাইরাস প্রতিরোধে যথেষ্ট প্রজ্ঞাপূর্ণ ও সুবিবেচনাপ্রসূত বলে বিবেচিত হতে পারে। রসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমরা যদি শুনতে পাও, কোনো ভূখণ্ডে প্লেগ দেখা দিয়েছে, তাহলে সেই ভূখণ্ডে প্রবেশ করো না; কিন্তু তুমি যদি দেখতে পাও, তুমি যেখানে বাস করো সেখানে প্লেগ দেখা দিয়েছে, তাহলে সেই স্থান ত্যাগ কোরো না। ’ কোভিড-১৯ করোনাভাইরাস মোকাবেলায় আজ বিশ্বব্যাপী যে ‘কোয়ারেন্টিন’ অর্থাৎ করোনা রোগী ও ভাইরাস বহনকারীদের আলাদা করা ও থাকার কথা বলা হচ্ছে, তার সঙ্গে কি মুহাম্মদ সা:-এর এই প্রাজ্ঞ নির্দেশনার মিল পাওয়া যাচ্ছে না?
প্রকৃতি ফিরে আসছে আগের অবস্থায় : বিশেষজ্ঞসহ বিশ্ববাসী স্বীকার করেছে, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় যে তাগিদ দুনিয়াব্যাপী আলোচিত হচ্ছিল মানুষের অতিপ্রয়োজনীয়তা তাতে বাদ সাধছিল। করোনা মানুষের অতিপ্রয়োজনীয়তা কমিয়ে জীববৈচিত্র্য রক্ষা করছে। বিশ্ব পরিবেশ দিবসে ঢাকার বাতাসেও যেমন কমেছে সিসা বিষ, তেমনি শব্দের দূষণও কমেছে। ঢাকার ব্যস্ত সড়ক মানিকমিয়া এভিনিউতে এখন শালিক উড়ে বেড়ায়। আপন মনে তারা খুঁটে খুঁটে খাবার খায়। হাতির ঝিলে বাড়ছে সবুজ; উড়ে আসছে কিছু বিরল প্রজাতির পাখি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শোনা যায় পাখিদের কিচির-মিচির, রাজধানীর অট্টালিকায় থাকা মানুষের ঘুম ভাঙে এখন পাখির ডাকে।
কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে কখনো ডলফিন খেলা করতে দেখা যায়নি। সৈকতে দূষণ ও পর্যটক না থাকায় ডলফিন এসেছে বলে ধারণা করা হয়েছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপে আগের মতো ডিম পাড়তে আসে কাছিম।
পৃথিবী আবারো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের প্রকৃতিতে ফিরে গেছে। ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে আসা সবুজ, ধ্বংস হয়ে যাওয়া আধমরা বন, গলে যাওয়া বরফ, সাগর ভরা প্লাস্টিকের রাশি, হারিয়ে যাওয়া বনের পশু, বিলুপ্তপ্রায় পাখিরাÑ ক্রমেই যেন কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। মানুষের আরো চাই, আরো চাই। এই সীমাহীন চাহিদার কারণে কিছুতেই থামানো যাচ্ছিল না পৃথিবীর দূষণ। তাই বোধহয় আচমকা এমন প্রতিশোধ, মানুষের বিরুদ্ধে এ যেন প্রকৃতির যুদ্ধ ঘোষণা। আপাতত মানুষ আছে ঘরবন্দী আর প্রকৃতি নিজেকে সাজিয়ে নিচ্ছে নিজের আপন চিরচেনা রূপে। সারিয়ে নিচ্ছে দগদগে ক্ষতগুলো। মানুষ বনাম প্রকৃতির এই লড়াইটা যখন শেষ হবে, তখন প্রকৃতি যতটা সেজেছে তার উপকার ভোগী হবে মানুষই। হ
লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক


আরো সংবাদ



premium cement