২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
সময়-অসময়

‘একটি বাড়ি, একটি খাদ্যভাণ্ডার’ এখন সময়ের দাবি

-

অদৃশ্য করোনাভাইরাসের কারণে মৃত্যুর মিছিলের আতঙ্কে বিশ্বব্যাপী সর্বক্ষেত্রে চলছে মন্দাভাব। অর্থনীতি, উৎপাদন, শিল্প, ব্যবসা, বাণিজ্য একটি অপরটির সম্পূরক। ফলে করোনা যত দিন চলবে এর চেয়ে বেশি দিন চলবে মন্দাভাব। এমনও দিন আসতে পারে যেখানে সরকার বা মানুষের হাতে টাকা থাকবে, কিন্তু খাদ্য পাওয়া যাবে না। এর আগে অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলায় কোনো কোনো রাষ্ট্র ‘কাগজি নোট’ ছাপিয়ে ফল পেয়েছে উল্টো। কারণ এতে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়, তখন বাজারদর নাগালের বাইরে চলে যায়। মানুষের প্রাথমিক চাহিদা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যÑ এগুলোর জন্যই জীবিকা। সব কিছুরই বিকল্প হতে পারে, কিন্তু খাদ্যের কোনো বিকল্প নেই। কোনো কারণে যদি বাঙালির খাদ্যের প্রধান উপাদান ‘ধান’ চাষের ঘাটতি ঘটে, তখন বিদেশ থেকেও চাল আমদানি করা দুরূহ হয়ে পড়বে। কারণ পৃথিবীব্যাপীই চলছে এখন মন্দাভাব, যা কাটিয়ে উঠতে গিয়ে বড় রাষ্ট্রগুলোই হিমশিম খাচ্ছে। সরকারের দায়িত্ব, নাগরিকের খাদ্যের চাহিদা মেটানো। কিন্তু প্রয়োজনমতো খাদ্যই যদি মজুদ না থাকে তবে সরকার খাদ্যের চাহিদা মেটাবে কিভাবে? তখন সরকার ব্যর্থ হবে বটে, কিন্তু বাবার সামনে তো সন্তানরা না খেয়ে মরার করুণ দৃশ্য দেখতে হবে। ‘বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি’র বিশ্লেষণ মতে, করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী প্রায় ২৭ কোটি মানুষ মারাত্মক খাদ্যাভাবের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা। ফলে প্রকৃতির আচরণ পরিবর্তনের পাশাপাশি নাগরিকদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হবে। আগের ও বর্তমান খাদ্যাভ্যাস হচ্ছে তরকারি দিয়ে ভাত খাওয়া, এখন ভাত দিয়ে তরকারি খেতে হবে। অর্থাৎ ভাতের পরিমাণের চেয়ে তরকারির পরিমাণ বেশি হতে হবে। চিকিৎসকদের মতে, ভাতজাতীয় খাদ্য অর্থাৎ কার্বোহাইড্রেট একটি ‘চিনি’ জাতীয় খাদ্য উপাদান, যা বেশি খেলে ডায়াবেটিস ও স্থূলতা রোগের সৃষ্টি হয়। উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে বাঙালিদের মতো এত বেশি ভাত কেউ খায় না। ‘খনা’ নামক একজন পণ্ডিত ব্যক্তি কিছু বাণী দিয়ে গেছেন, যা ‘খনার বচন’ নামে পরিচিত। তার একটি ‘বচন’ বা বক্তব্যও আজ পর্যন্ত মিথ্যা প্রমাণিত হয়নি। খনার বচনের মধ্যে একটি বচন হলো ‘উনা ভাতে দুনা বল, অধিক ভাতে রসাতল।’ অর্থাৎ যে কম ভাত খায় তার শরীর দ্বিগুণ সবল থাকে এবং যে বেশি ভাত খায় সে যায় রসাতলে। অন্য দিকে সরকারি ত্রাণ বা খাদ্যসহায়তা সঠিকভাবে বিলি বণ্টন না হওয়ায় অভিযোগ ছাড়াও ‘মুখ দেখে সাহিদারি’ অর্থাৎ ত্রাণ বা সরকারি অনুদান নিজেদের লোকদের মাঝে বিতরণ, অধিকন্তু রয়েছে সরকারি লোকের ত্রাণ চুরির ঘটনার পাশাপাশি কালোবাজারি ও মুনাফাখোরদের ভয়াল থাবা। ‘ফটোসেশনের ত্রাণ’ নেয়াও অনেক কষ্টকর। আগে থেকে স্লিপ সংগ্রহ করে প্রধান অতিথি আসার অপেক্ষায় রোদে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। অন্য দিকে অনেক পরিবার না খেয়ে থাকে, অথচ লোকলজ্জার ভয়ে ত্রাণের জন্য লাইনে দাঁড়াতে বা কারো কাছে কোনো কিছু চাইতে পারে না। এ মর্মে পবিত্র কুরআন শরিফে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ পাক বলেছেন, ‘(দান) অভাবগ্রস্ত লোকদের প্রাপ্য, যারা আল্লাহর পথে এমনভাবে ব্যাপৃত যে, জীবিকার সন্ধানে ভূপৃষ্ঠে ঘোরাফেরা করতে পারে না। তারা কিছু চায় না বলে, অবিবেচক লোকেরা তাদেরকে অভাবমুক্ত মনে করে। তুমি তাদেরকে তাদের লক্ষণ দেখে চিনতে পারবে, তারা লোকদের কাছে নাছোড়বান্দা হয়ে যাঞ্জা করে না।’ (সূরা বাকারাহ, আয়াত-২৭৩) বর্তমানে সবচেয়ে খাদ্যাভাবে রয়েছে ওই সব পরিবার, যারা মানুষের কাছে কিছু চাইতে পারে না বা চক্ষুলজ্জার কারণে কারো কাছে কোনো সাহায্য চাইতে পারে না। কুরআনের নির্দেশনা মোতাবেক দান বা ত্রাণে তাদের অগ্রাধিকার রয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, এই শ্রেণীর পরিবারগুলোই এখন ত্রাণ থেকে বঞ্চিত।
যখন মানবজাতি অবিচার, অত্যাচার, ব্যভিচার, অন্যের অধিকার হরণ, অশ্লীলতার সীমা লঙ্ঘন করছে তখনই আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে করোনার মতো গজব নাজিল হয়ে থাকে। এ কথা জোরেশোরেই আল্লাহ পাক আল কুরআনে বলেছেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জাতিকে বর্ণিত কারণে ধ্বংস করেছেন বলে নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি এ কথাও ঘোষণা দিয়েছেন, এ ধ্বংসলীলা শুরু ও শেষ হওয়ার দিনক্ষণ তিনিই নির্ধারণ করেন।
এখানে বিবেচ্য বিষয় দু’টি। প্রথমত; যে কারণে ইতোপূর্বে বিভিন্ন জাতিকে আল্লাহ ধ্বংস করেছেন, সে কারণগুলো বর্তমান বিশ্বে চরমভাবে বিদ্যমান। দ্বিতীয়ত; যেহেতু ধ্বংসলীলা শুরু ও শেষ হওয়ার দিনক্ষণ তিনি (আল্লাহ) নির্ধারণ করবেন সেহেতু মরণব্যাধি করোনা থেকে বিশ্ব কখন মুক্তি পাবে, তা এখনো আঁচ করা যাচ্ছে না। বিজ্ঞানীরা আগামী জানুয়ারি-২০২১ সালের কথা বলাবলি করছেন। কিন্তু নির্ভর করার মতো আশ্বাস কেউ দিতে পারছেন না। তবে করোনায় মৃত্যু যদি এমনিভাবে হতে থাকে ২০২১ সাল আসতে আসতে বিশ্ব সভ্যতা উজাড় হয়ে যেতে পারে। দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই আমাদের মাফ করে দেবেন। কারণ মাফ করাই আল্লাহ পাকের প্রধান বৈশিষ্ট্য। তবে কায়মনোবাক্যে পরিষ্কার ভাষায় অপরাধ স্বীকার করে, আবার অনুরূপ অপরাধ না করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়েই আল্লাহ পাকের দরবারে মাফ চাইতে হবে।
সার্বিক বিষয় মাথায় রেখেই আমাদের জীবন যুদ্ধে বেঁচে থাকার পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে। ত্রাণ নিয়ে জটিলতা আমাদের দেশে নতুন কিছু নয় এবং অন্য দিকে একটি পরিবারের খাদ্যপুষ্টি ত্রাণ থেকে কতটুকু জোগান পাওয়া যেতে পারে? অফিস আদালত সবই বন্ধ, দেশবাসী এখন লকডাউনে আছে, চলছে সামাজিক দূরত্ব।
করোনার কারণে প্রাপ্ত ‘অবসর’ সময়টি দু’ভাবেই কাটানো যায়Ñ ১. আড্ডা মেরে, টিভিতে সিনেমা নাটক প্রভৃতির মাধ্যমে অবসর সময় কাটানো যায় অথবা ২. দেশ ও জাতির এবং নিজেদের পরিবারের জন্য এ করোনাযুদ্ধে কিভাবে টিকে থাকা যায় তার জন্য নিজেদের গণ্ডির মধ্যে থেকেই আমরা পরিবারকে সহায়তা করার জন্য কে কতটুকু ‘অবদান’ রাখতে পারি তার উপায় উদ্ভাবন বা চেষ্টা ফিকিরের মাধ্যমে ‘অবসর’ সময়ের সদ্ব্যবহার করা যায়। ‘যারা অসার ক্রিয়াকলাপ থেকে বিরত থাকে’ আল্লাহ তাদের ‘সফলকাম’ হিসেবে সূরা আল মুমিনুনের তৃতীয় আয়াতে উল্লেখ করেছেন। অথচ আমাদের অনেকেরই সময় কাটে পরনিন্দায়, পরচর্চা ও চোগলখুরি করে যা মহান সৃষ্টিকর্তা মোটেই পছন্দ করেন না। ‘অবসর’ সময়কে আমরা অভিশাপ না আশীর্বাদ হিসেবে গ্রহণ করব, ব্যক্তি বিশেষের নিজস্ব ব্যাপার। তার পরও প্রতিটি ব্যক্তির কাছে পরিবার, জাতি ও রাষ্ট্রের একটি চাহিদা থাকে; কারণ পরিবার ও রাষ্ট্রই ব্যক্তিটিকে প্রতিপালন করে। স্মরণ রাখা দরকার, ইমাম বুখারির বর্ণনা মতেÑ রাসূল সা: বলেছেন, ‘সুস্থতা ও অবসরতা’ মানবজাতির জন্য নিয়ামত। বাংলাদেশে পলিমাটির দেশ, আবহাওয়া ও মাটির উর্বর শক্তি উৎপাদন সহায়ক, কিন্তু দেশবাসীর চরিত্র বৈচিত্র্যময়। দাদা যে চারা রোপণ করে গেছেন সে গাছটি নাতি কেটে বিক্রি করে দিয়েছে বা কাঠ বা লাকড়ি হিসেবে ব্যবহার করে নিজে উপকৃত হয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা বিবেচনা করে কর্তনকৃত জায়গায় অনুরূপ একটি গাছের চারা রোপণ করার উপলব্ধি নাতির মাথায় আসে না। তবে ক্ষেত্রবিশেষে তা ভিন্ন হতে পারে। হজরত মুহাম্মদ সা: বলেছেন, ‘আগামীকাল কেয়ামত হবে জানলেও যদি সুযোগ পাও তবে একটি গাছের চারা রোপণ করো।’ অথচ রাস্তা দিয়ে চলার পথে গাছের চারা দেখলে অনেক মানুষ আছে যারা তা মাড়িয়ে চলে যায়, ঘূর্ণাক্ষরেও তার বিবেক বলে না, চারাটি একদিন ছায়া, ফল, জ্বালানি, অক্সিজেন ও কাঠ উপহার দিতে সক্ষম হবে। বিষয়গুলো সম্পূর্ণ মানবিক চিন্তা-চেতনার ওপর নির্ভরশীল। চিন্তাশীল ব্যক্তিরা সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে অবশ্যই চিন্তা করছেন। তবে চিন্তাশীলের চেয়ে বাকপটুদের অবস্থান রাষ্ট্রীয়ভাবে সুদৃঢ় বিধায় চিন্তাশীলদের পরামর্শ কোথাও ধোপে টিকে না। অন্য দিকে চিন্তাশীলদের একটি অংশ সরকারের তাঁবেদারি করে ভোগবিলাসে ব্যস্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ শিক্ষক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীরা এখন চামচাগিরিতে ব্যস্ত।’
চিকিৎসকরা মন্তব্য করছেন, ফ্যাট বা চর্বি সৃষ্টি করে এমন খাদ্যাভ্যাসের চেয়ে সবজি খাদ্য অভ্যাস স্বাস্থ্যের জন্য অনেক নিরাপদ। গ্রামাঞ্চলে একটি বাড়ির আঙিনার চার পাশে যে পতিত জায়গা থাকে সে মাটিতে অনায়াসেই পরিমিত সবজি চাষ করা যেতে পারে। কিছু সবজি গাছ আছে, ঘরের চালের নিচে বীজ বপন করলে গাছটি উঠানের জায়গা দখল না করে ঘরের চালে উঠিয়ে দেয়া যেতে পারে। অনেক পরিবারে দেশপ্রেমিক ও সচেতন শিক্ষিত মহিলা আছেন যারা শহরের বাড়ির ছাদ ব্যবহার করে সবজি উৎপাদন করে এক দিকে পরিবারের সুস্বাস্থ্যের জোগান দিচ্ছেন, অন্য দিকে পরিবারটির অর্থনৈতিক সাশ্রয় হচ্ছে। এ পদক্ষেপে সংশ্লিষ্ট পরিবারটি শুধু নয়, লাভবান হচ্ছে জাতি। কারণ প্রতিটি মানুষই জাতির একটি অংশ। একজন মানুষ, একটি পরিবার যখন লাভবান হয়, তখন এটা জাতিরই লাভ, কারণ এতে কিছুটা হলেও জাতির বোঝা লাঘব হয়।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে গণমানুষের অনেক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কিন্তু যে রাজনৈতিক দলগুলো একবার ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করছে, সে দলগুলো সুবিধাবাদী ও সুবিধাভোগীদের খপ্পরে পড়ে নিজস্বতা হারিয়ে গণদাবি বাস্তবায়নের প্রশ্নে দেউলিয়া হয়ে পড়েছে। দলগুলোর সাংগঠনিক কার্যক্রম আদর্শভিত্তিক না হয়ে হয়েছে তদবিরভিত্তিক। মোসাহেবি এবং অর্থের প্রভাবে দলীয় নেতারা প্রভাবিত বিধায় জনস্বার্থে রচিত দলীয় ম্যানিফেস্টো নিয়ে দলগুলো জনগণের গোরগোড়ায় পৌঁছার পরিবর্তে ক্ষমতাসীন দল প্রতিপক্ষ দলের প্রতি প্রতিহিংসামূলক আচরণ করে থাকে। ফলে জনগণের কাছে রাজনৈতিক দলের ম্যানিফেস্টো নামক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন থেকে জনগণ হচ্ছে বঞ্চিত। মরণঘাতী করোনাভাইরাসের সময়ও জনস্বার্থ বিবেচনা করে রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। এর কারণ ক্ষমতাসীনদের আত্মগরিমা (Over Confidence), নতুবা প্রতিপক্ষ কর্তৃক গদি খেয়ে ফেলার ভয় (!)। রাজনৈতিক দলগুলোর ম্যানিফেস্টো কার্যকর না হওয়ার অন্যতম কারণ ম্যানিফেস্টোতে প্রদত্ত কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য দল থেকে কোনো প্রকার চাপ বা মনিটরিং করা হয় না। ক্ষমতায় গেলে দলগুলো আমলানির্ভর হয়ে পড়ে এবং প্রশাসনের সহায়তায় শুরু করে প্রতিপক্ষের প্রতি অমানুষিক ও অনৈতিক নির্যাতন। ফলে প্রশাসনিক আমলাদের হয় প্রমোশন; তৃণমূলের রাজনৈতিক কর্মীরা পরিণত হয় কামলায় এবং ক্ষমতার সন্নিকটে যারা থাকে তারা আর তাদের পালিত সুবিধাবাদী ও সুবিধাভোগীরা হয়ে যায় আঙুল ফুলে কলাগাছ।
তদানীন্তন পাকিস্তানের পুঁজিপতি ২২ পরিবারের স্থলে বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছে ২২ হাজার পুঁজিপতি পরিবার। ফলে গরিব দিন দিন নিঃস্ব হচ্ছে, ধনিক শ্রেণী হয়ে যাচ্ছে আরো ধনী। যে ব্যক্তি ৫-১০ বিঘার জমির মালিক ছিল, সংসারের ঘানি টানতে টানতে জমি বিক্রি করে সে পরিবার হয়ে পড়েছে ভূমিহীন নিঃস্ব, অন্য দিকে যে পরিবার ছিল ২০০ বিঘা সম্পত্তির মালিক তারা হয়েছে ৫০০-১০০০ বিঘা সম্পত্তির মালিক। ব্যাংকগুলো পুঁজিপতি পরিবারের সেবাদাসে পরিণত হয়েছে। ব্যাংক কর্র্তৃপক্ষই ব্যাংক লুটের সুযোগ করে দিচ্ছে। ব্যাংক পাহারা দেয়ার জন্য সরকারি ঘরানার লোকদের পরিচালক নিযুক্ত করায় স্বনামে-বেনামে ব্যাংক লুট করার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় অর্থনীতির সংজ্ঞানুসারেই মধ্যবিত্তরা দিন দিনে নিম্নবিত্ত বা নিঃস্ব এবং উচ্চ অবস্থাশালীরা ধনিক শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। এরই সরলরেখা টেনে গড়পড়তা হিসাব করে সরকার গাল ফুলিয়ে বলছে, দেশে মাথাপিছু মানুষের গড় আয় ‘বৃদ্ধি পেয়েছে।’ এ বড় মিথ্যাকে যারা যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করবেন, সেসব বুদ্ধিজীবীও এখন সরকারের তাঁবেদারি করে টু-পাইস ইনকাম করছেন, তারাও এখন পাজারো গাড়িতে চড়ে না। কারো কারো ব্যাংক লোন রয়েছে, ইতোমধ্যে অনেকে খেলাপি হয়ে পড়েছেন। মাথাপিছু গড় আয় যদি এতই বেড়ে থাকে তবে সাগরের মধ্যে বাঙালিদের সলিল সমাধি হচ্ছে কেন? কেনই বা ২৬ জন বাঙালিকে লিবিয়ায় নৃশংসভাবে হত্যা এবার হলো? সরকারের বাকপটুরা এর ব্যাখ্যা দেবেন কি?
অন্য দিকে দেশের আলেম সমাজ জাকাত, ফিতরা ছাড়া হজরত মুহাম্মদ সা:-এর রেখে যাওয়া ইসলামী অর্থনৈতিক দর্শন সম্পর্কে মাথা ঘামান না বলেই লুটেরাদের আজ পোয়াবারো। মসজিদ-মাদরাসায় মোটা অঙ্কের অর্থ দান করলেই আমাদের দেশের আলেমদের একটি অংশ দাতাকে বেহেশতে একটি স্বর্ণের বাড়ি বানিয়ে দেয়। বৈধ উপার্জন ছাড়া ইবাদত কবুল হয় না, এ কথা তখন তারা বেমালুম ভুলে যান। দাতার অর্থ উপার্জনের উৎস বৈধ কি অবৈধ, খোঁজ নেয়ার প্রয়োজন মনে করা হয় না বা বৈধ উপার্জনের জন্য উৎসাহ বা কঠোর নির্দেশনা প্রদান করা হয় না। এ বিষয়টি ইসলামী অর্থনীতির দর্শনের পরিপন্থী (ইসলামিক অর্থনীতির দর্শন সম্পর্কে পরবর্তী লেখাগুলোতে আলোচনার চেষ্টা করব, ইনশা আল্লাহ)।
সম্প্রতি এক্সিম ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং সংরক্ষিত আসনের এমপি পারভীন হকের অভিভাবকদের মালিকানাধীন পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের ঋণসংক্রান্ত ঘটনা, মামলার এজাহার, বিবৃতি, পাল্টা বিবৃতি পর্যালোচনা করলেই ব্যাংক লুট করার জন্য সরকারের সুকৌশল পদ্ধতি পাঠকের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। তা ছাড়া ফারমার্স ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক লোপাট, বিভিন্ন বড় বড় ব্যাংকের লুটের কাহিনী তো আছেই। এক ব্যাংকের পাহারাদার, অন্য ব্যাংকের বর্গাদার। ক্ষমতাসীনদের সেবাদাস হিসেবে ব্যাংকিং এমনি হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, ‘ওলটপালট করে দে মা লুটে পুটে খাই।’
জনসংখ্যার প্রেক্ষাপটে খাদ্য চাহিদা মিটানোর বিষয়টি মাথায় রেখেই বিগত সরকারগুলো উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি ম্যানিফেস্টোতে উল্লেখ করেছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, নৈতিকতা, প্রশিক্ষণ ও সরকারের বাস্তবায়নমুখী রাজনৈতিক সাংগঠনিক পদক্ষেপের অভাবে লক্ষ্যে পৌঁছা যায়নি, তবে নাগরিকদের একটি অংশ বৃক্ষরোপণে উৎসাহী হয়েছে। দ্বিতীয় বিপ্লব বা সবুজ বিপ্লব সম্পর্কে যার একটুও চিন্তা-চেতনা ছিল না এমন ব্যক্তি এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন। স্বনির্ভর বাংলাদেশ তথা ১৯ দফা কর্মসূচি বা পরবর্তী সরকারের ১৮ দফা কর্মসূচিতে কী লেখা আছে যে বলতে পারবে না এমন ব্যক্তিও সংশ্লিষ্ট সরকারের এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন। ফলে দলীয় ম্যানিফেস্টো মোতাবেক রাজনৈতিক দলগুলোর সাংগঠনিক ভূমিকা যেভাবে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল, তা না হলেও সরকারি বাজেট পুরোটাই খরচ হয়েছে।
বঙ্গুবন্ধু শেখ মুজিব নিজে মাটি কেটে তার দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি উদ্বোধন করেছিলেন, যা নস্যাৎ হয়ে গেছে মর্মান্তিক ১৫ আগস্টের পরে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালের ১ ডিসেম্বর যশোরের উলশী যদুনাথপুরের বেতনা নদী স্বেচ্ছাশ্রমে খননের মাধ্যমে স্বনির্ভর আন্দোলনের কর্মসূচি উদ্বোধন করে জনগণকে উদ্বুুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। তিনি স্বেচ্ছাশ্রমে ৯০০ মাইল খাল খনন করেছেন। দেশের যুবশক্তিকে কাজে লাগানোর জন্য উপ-সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে শহীদ জিয়া দুই দিনব্যাপী শেরেবাংলা নগরে জাতীয় সংসদ প্রাঙ্গণে একটি যুব সমাবেশের আয়োজন করেন ১৯৭৭ সালের ১৮-১৯ ফেব্রুয়ারি। একজন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে সমাজ কল্যাণ বিভাগের মনোনীত প্রতিনিধি হয়ে ওই জাতীয় সম্মেলনে একজন তালিকাভুক্ত ডেলিগেট হিসেবে অংশ নিয়েছি। সমাজসেবা অধিদফতরের নথিতে নিশ্চয়ই এর রেকর্ড পাওয়া যাবে। পরের বছর তিনি যুব মন্ত্রণালয় গঠন করেন। ১৯৮০ সালের ৩০ মে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রাম সরকার চালু করার ঠিক এক বছর পর একই দিনে শাহাদত বরণ করেন। জেলায় জেলায় যে যুব কমপ্লেক্স তিনি চালু করেন তা-ও পরবর্তী সময়ে উদ্যোগ ও উদ্যমের অভাবে ফলপ্রসূ হয়নি। উভয় রাষ্ট্রপতিই নিহত হয়েছেন দেশরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু লোকের নির্মম বুলেটে। উভয় রাষ্ট্রপতির দলই পরবর্তীতে ক্ষমতায় এসেছে, কিন্তু জনগণকে আর সেভাবে উদ্বুুদ্ধ করা হয়নি। কারণ একদল আরেক দলকে ঠেকানোর ব্যস্ততা।
এখন জনগণকে অবশ্যই রাজনীতি সচেতন হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কিন্তু শুধু সরকার বা বিরোধী দলের ওপর নির্ভরশীল হয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে হবে না। জনগণের একটি অংশ রয়েছে যারা ভাবাবেগে বা অলস জীবনযাপন করেন না। নারায়ণগঞ্জ জেলায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান লাঙ্গলবন্দ এলাকায় দক্ষিণে সরকারি রাস্তার দু’পাশে পতিত জায়গায় ফুলগাছ লাগিয়ে একদল ফুলচাষি জীবিকা নির্বাহ করতে দেখেছি। একটি এলাকায় দেখেছি, সরকারি রাস্তার উভয় পাশে শিম গাছের ঝাঁকা, দেখেছি রাস্তার উভয় পাশে সরকারি পচা ডোবায় কচুরিপানার স্তূপ করে সামান্য কিছু মাটি ফেলে লাউ, কুমড়া চাষ করতে। বাংলাদেশের মাটি সোনার মতো খাঁটি। দেশে সরকারি অনেক পতিত জমি রয়েছে, যাতে বিনামূল্যে বা বিনা লিজ মানিতে সবজি
উৎপাদন করতে জনগণকে উৎসাহিত করা গেলে খাদ্যঘাটতি পূরণে সহায়ক হবে। উৎপাদিত কোনো ফসলের কোনো ভাগ বা অংশ সরকার যদি দাবি না করে তবে প্রান্তিক চাষিরা এ মর্মে বেশি উৎসাহিত হবেন। প্রান্তিক চাষিদের মাঝে পতিত জমি চাহিদামতো বণ্টন করার জন্য স্থানীয় চেয়ারম্যানকে দায়িত্ব দিতে হবে, যাতে সরকারি অফিসে যাতায়াতে হয়রানি না হয়। স্থলপথ ও রেলপথের পতিত জমি ও ডোবা, এমনকি নদীর দুই পাশে পতিত জমি বার্ষিক বণ্টননামার ভিত্তিতে প্রান্তিক চাষিদের বিনা দাবিতে বর্গা দেয়া হোক দু’টি শর্তেÑ ১. বণ্টনকৃত স্থানে শুধু সবজি ও মাছ চাষ চলবে; ২. বণ্টনকৃত জায়গার অবস্থান পরিবর্তন বা স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ করা যাবে না। অন্য দিকে বণ্টন নিয়ে চাষাবাদ না করে জমি ফেলে রাখলে একটি জরিমানার বিধান রাখা যেতে পারে।
আসুন আমরা সবাই পরিবার, দেশ ও জাতির জন্য আমাদের মূল্যবান সময় ও চিন্তা-চেতনা উৎসর্গ করার ভূমিকাসহ ত্রাণের সাথে ফলমূল, সবজি প্রভৃতির বীজ ত্রাণ গ্রহীতাদের কাছে পৌঁছে দিয়ে উৎপাদনে তাদের উৎসাহিত করি। নিজেদের বাঁচার কথা চিন্তা করে প্রতিটি পরিবার থেকে নিজ উদ্যোগেই এ কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত নিজেদের স্বার্থে। তবেই ১৮ কোটি হাত ৩৬ কোটি হাতের শক্তির জোগান দেবে, ফলে সবাই হবো উৎপাদনের অংশীদার, ইনশা আল্লাহ।
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement