২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

জিয়াউর রহমান : ক্ষণিকের স্মৃতি

দেশ জাতি রাষ্ট্র
-

সম্ভবত এটি ১৯৭৮ সালের ঘটনা। প্রেসিডেন্ট জিয়া জাতির ঐক্যের ভিত্তি সম্প্রসারণে ব্যস্ত। পেশাজীবীদের দিকে তার মনোযোগ। বিশেষত সাংবাদিক সমাজের আস্থা ও বিশ^াস অর্জনে তিনি অধিকতর আগ্রহী। আমি তখন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র। সাথে সাথে পেশার কারণে নয়, নেশার কারণে দৈনিক আজাদে কর্মরত। খণ্ডকালীন সাব-এডিটর বা সহ-সম্পাদক আমি। সেই সুবাদে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নÑ ডিইউজের সদস্য। তখনো সাংবাদিকদের বিভেদের দেয়াল তৈরি হয়নি। অখণ্ড সাংবাদিক ইউনিয়ন। গণমাধ্যমে তাদের প্রবল প্রতাপ। সে দিনের সাংবদিকদের গুরুত্বপূর্ণ নেতা আনোয়ার জাহিদ। সম্ভবত ডিইউজের সভাপতি তিনি। দৈনিক আজাদে এলেন। ইউনিট সভায় বুদ্ধিবৃত্তিক বক্তব্য রাখলেন। তিনি জানালেন, প্রেসিডেন্ট জিয়া সাংবাদিকদের সাথে বৈঠকে আগ্রহী। তখন রমজান মাস। তাই ইফতারের দাওয়াত দিয়েছেন। আমাদের জানানো হলো দিনক্ষণ। নির্দিষ্ট দিনে আমরা হাজির হলাম সেকালের গণভবনে। এটি এখন ‘পদ্মা’ নামে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন। মূল ভবনের লনে আয়োজন করা হলো অনুষ্ঠানের। এক মিনিটও দেরি না করে যথাসময়ে এলেন তিনি। চোখে কালো চশমা। পরনে পরিচিত সাফারি।
সেই প্রথম প্রেসিডেন্ট জিয়াকে সরাসরি দেখা। মনে আকুলতা-ব্যাকুলতা। আমি অবলোকন করছি তাকে প্রতি মুহূর্তের জন্য। একবার দেখলাম তিনি কাকে যেন কী ইশারা দিলেন। হাঁটু গেড়ে কান পেতে কথা শুনলেন একজন বড় সামরিক কর্মকর্তা। সামরিক পোশাকেই তিনি ছিলেন। পরে জেনেছি তিনি মেজর জেনারেল সাদেকুর রহমার চৌধুরী। তখন তিনি ছিলেন প্রেসিডেন্টের মিলিটারি সেক্রেটারি বা সামরিক সচিব। একটু পরে মাগরিবের আজান হলো। সবাই ইফতার গ্রহণে ব্যস্ত। আমার আগ্রহ ইফতারের দিকে নয়। প্রতি মুহূর্তে অপলক দৃষ্টি প্রেসিডেন্টের প্রতি। দেখলাম নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। জায়নামাজ নিয়ে অদূরে দাঁড়িয়ে একজন। বুঝলাম নামাজ পড়বেন তিনি। আমিও নামাজ পড়ব। অনুসরণ করলাম তাকে। আরো একজন এগিয়ে এলেন। দৈনিক কিষাণের সহকারী সম্পাদক তিনি। নাম মাহবুবুর রহমান। প্রেসিডেন্ট একটি ছোট্ট কক্ষে ঢুকলেন। আমরা দু’জনও গেলাম সেখানে। নামাজের শুরুতে ইমামতির প্রশ্ন। চোখাচোখি মুখোমুখি তিনজনে। এটাই স্বাভাবিক, প্রেসিডেন্ট জিয়া ইমামতি করবেন। আমরা তাকে অনুরোধ করলাম ইমামতির জন্য। তিনি দৃঢ়তার সাথে না বললেন। মাহবুব বলে আমাকে ইমামতি করতে। কিন্তু আমি ইমামতির জন্য উপযুক্ত মনে করি না নিজকে। অবশেষে মাহবুবের ইমামতিতে নামাজ শেষ হলো। এটি ক্ষণিকের স্মৃতি। কিন্তু চিরকালের অনুভূতি। ঘটনাটি ছোট। এর তাৎপর্য অনেক বড়। এভাবে নীরবে নিভৃতে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিতেন তিনি।
দুই. জিয়াউর রহমান ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন। এটাও সমসাময়িক ঘটনা। শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভের আয়োজন করেছিল। প্রেসিডেন্ট জিয়া সেই বিক্ষোভের মোকাবেলা করেছিলেন। তার নীরব অথচ প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমি। সবাই জড়ো হচ্ছিল টিএসসি প্রাঙ্গণে। জিয়াউর রহমান আসার আগেই পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ঠেলে দিলো ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে। বিশ^বিদ্যালয় লাইব্রেরি এবং আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণে। টিএসসির উত্তর দিকের রাস্তার পর এই প্রাঙ্গণ। জিয়াউর রহমান টিএসসির প্রবেশপথে এলেন। সাথে সাথে বিক্ষোভরত ছাত্ররা এগিয়ে গেল জিয়াউর রহমানের দিকে। জিয়াউর রহমান টিএসসিতে প্রবেশ না করে বিক্ষোভরত ছাত্রদের দিকে এগিয়ে এলেন। আমি অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করছিলাম রোকোয়া হলের গেট থেকে। অবশ্যই নিরাপদ দূরত্ব থেকে। সবাই দুরুদুরু বুকে আতঙ্কিত।
বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের পুলিশ হটিয়ে দেবে, লাঠিপেটা করবেÑ এটাই রেওয়াজ। জিয়াউর রহমান তখন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কর্র্ণধার। প্রধান সামরিক আইন প্রাশাসক। সুতরাং সর্বোচ্চ নিরাপত্তা তার প্রাপ্য। পুলিশ যদি অ্যাকশন নেয়, তাহলে তা অন্যায় কিছু হবে না। অথচ তেমন কিছুই ঘটল না। উল্টো প্রেসিডেন্ট এগিয়ে এলেন ছাত্রদের দিকে। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী তোমাদের কথা?’ আমরা দেখলাম, প্রেসিডেন্ট এগিয়ে যাচ্ছেন আর ওরা পিছিয়ে যাচ্ছে। আবার প্রেসিডেন্ট যখন ফিরে আসছেন, ওরা তখন তার পিছু নিচ্ছে। দু-একটা ইটও এসে পড়ল প্রেসিডেন্টের সামনে। আমরা এটাও লক্ষ করছিলাম, পুলিশ অফিসার এবং সামরিক কর্মকর্তারা প্রেসিডেন্টের নিকটবর্তী হচ্ছে বারবার। হয়তো বা আদেশের অপেক্ষা করছে তারা। ১০-১৫ মিনিট ধরে এভাবে চলতে থাকল। অপেক্ষমাণ লোকেরা বলাবলি করছে, পুলিশ কেন অ্যাকশন নিচ্ছে না। বাংলাদেশের লোকজন সততই সরকারবিরোধী। অথচ অপেক্ষমাণ লোকেরা প্রেসিডেন্ট জিয়ার ধৈর্য ও সাহস দেখে তাৎক্ষণিকভাবে তার পক্ষে চলে গেছে। ছাত্ররা অবশেষে পিছু হটল। জয় হলো মহানুভবতার।
প্রেসিডেন্ট নিরাপদে প্রবেশ করলেন সভাস্থলেÑ টিএসসিতে। শুনেছি সেখানেও কোনো কোনো শিক্ষকের তির্যক বাক্যবাণের শিকার হয়েছেন তিনি। আজকের বিএনপির শীর্ষনেতা প্রফেসর খন্দকার মোশাররফ হোসেন এই প্রতিবাদীদের একজন। তিনি বলেছিলেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা। জিয়া পরে বঙ্গভবনে তাকে ডেকে নিলেন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা চাইলেন। ‘শত্রু হতে চেয়ে তিনি বন্ধু বলে গণ্য হলেন’। এত দিনে ক্ষমতার অনেক রদবদল হয়েছে। বদল হননি খন্দকার মোশাররফ। অতীতের দুর্দিনে এবং আজকের দুর্যোগে তিনি আছেন জিয়াউর রহমানের আদর্শের শীর্ষদেশে। জিয়াউর রহমানের এই ঔদার্যের ১৬ আনা ফসল তিনি পেয়েছিলেন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী তার ভক্ত-অনুরক্ত বনে যায়। পরবর্তীকালে জিয়া যখন লোকান্তরে তখন ছাত্রসমাজের মধ্যে লক্ষ জিয়া তৈরি হয়েছিল ঘরে ঘরে। সময়ের পরীক্ষায় তার প্রমাণ রয়েছে।

তিন. সমাজতান্ত্রিক চীনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মাও জে দুং ‘লংমার্চ’ করেছিলেন। হেঁটে হেঁটে জনগণকে সাথে নিয়ে অতিক্রম করেছিলেন মাইলের পর মাইল। এভাবে গ্রাম থেকে শহর অধিকার করেছিলেন তিনি। আর জিয়াউর রহমান রাজধানী থেকে ‘লংমার্চ’ করেছিলেন গ্রামের দিকে। জয় করেছিলেন গ্রামীণ মানুষের হৃদয়। তেমনি এক কর্মসূচিতে পটুয়াখালীর খেপুপাড়ার বালিয়াতলিতে গিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। দীর্ঘ পথ হেঁটে খাল কাটা কর্মসূচি পরিদর্শন করেছিলেন তিনি। এরপর পার্টি কর্মসূচির অংশ হিসেবে এলেন পাশের গলাচিপায়। তখনকার গলাচিপা থানা উন্নয়ন পরিষদের এক সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন জিয়াউর রহমান। আর সভাপতি ছিলেন আমারই এক আপনজন। তার সুবাদে ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলাম। সভা শুরু হলো। নেতারা জিয়ার প্রশংসা ও প্রশস্তি গাইছিলেন। জিয়াউর রহমান ধমক দিয়ে প্রশস্তি বন্ধ করলেন। বললেন, সমস্যার কথা বলুন, জনগণের কথা বলুন। আমরা যারা বক্তৃতা মানেই বুঝি বন্দনা, তাদের জন্য এটি এক শিক্ষা।

চার. গত বছর শীতকালে বগুড়া গিয়েছিলাম। বগুড়া বিএনপির সভাপতি ও দৈনিক বগুড়ার সম্পাদক বাদশা ভাইয়ের আমন্ত্রণে। সেখানে তারেক রহমানের জন্মদিন উপলক্ষে একটি সুন্দর সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছিল। খুব স্বাভাবিকভাবেই জিয়াউর রহমানের জন্মস্থান দেখার সাধ হলো। বগুড়া শহরের অদূরে গাবতলী উপজেলার বাগবাড়ি গ্রামে তার জন্ম। আমার উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের নন্দিত নেতা জিয়াউর রহমানের উৎসমূল খোঁজা। বস্তুত উৎসমূলে নিহিত রয়েছে তার রক্তের উত্তরাধিকার, পারিবারিক ঐতিহ্য ও যাপিত জীবন সংস্কৃতি। আমি অবাক হলাম, যেখানে অনেক নেতার বাড়িতে ছিল না চালচুলা (না থাকা অগৌরবের নয়) সেখানে ব্রিটিশ আমল থেকেই তার পূর্বপুরুষ বাস করতেন পুরোপুরি পাকা বাড়িতে। না, বাড়িটা দালানকোঠা নয়। প্রাসাদোপমও নয়। তবে সম্মানজনক।
দেয়ালে ক্ষোদিত আছে নির্মাণের সাল, তারিখ। ১৮৯৫ সাল। জিয়াউর রহমান বাড়ির তেমন কোনো সংস্কার করেননি। তারেক রহমান বাড়িটি বাস উপযোগী করেছেন। তাও আহামরি কিছু নয়। তারেক রহমান যখন এলাকায় যেতেন, থাকতেন সেখানে। সার্কিট হাউজ বা কোনো বালাখানায় থাকতেন না তিনি। পাশাপাশি কয়েকটি বাড়ি। আগে দেয়াল ছিল না, এসব বাড়ির মধ্যে। এখন দেয়াল উঠেছে। তবে জিয়া পরিবারের পক্ষ থেকে নয়। খোঁজ নিয়ে জানলাম, জিয়া পরিবারের প্রায় সবাই সম্মানজনক অবস্থানে রয়েছেন। জিয়াউর রহমানের সময়কালে আমরা তার আত্মীয়-স্বজনের কথা শুনিনি। পরের শাসকদের সৌজন্যে তাদের কারো কারো নাম শুনেছিলাম। সে আরেক কাহিনী।
এই সে দিন পর্যন্ত এটি ছিল অজোপাড়া গাঁ। সেখানে পৌঁছতে লাগত অনেক ধকল। নৌকায় আর হেঁটে যেতে হতো বাড়িতে। এখন সেখানে গাড়ি যায়। বাংলাদেশের আর সব গ্রামের মতো সেখানেও রাস্তাঘাট হয়েছে। জিয়াউর রহমান যখন প্রেসিডেন্ট হন তখন সবাই আশা করেছিল, সড়ক-মহাসড়ক অনুগামী হবে এই বাড়ির। যেমটি হয়েছে অন্যত্র। রাজাবাড়ির পারিষদরা নানা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু বাদ সাধেন জিয়াউর রহমান নিজে। এ রকম উদ্যোগের জবাবে জিয়া বলেছিলেন, বাংলাদেশের সব গ্রামের রাস্তার পরে এখানে রাস্তা পৌঁছবে। অথচ আমাদের রাজা-উজিররা সবটুকু নিয়ে নেন, নিজ ঠিকানায়। ম্যাডাম খালেদা জিয়া যখন প্রধানমন্ত্রী তখনো তাকে নৌকা করে যেতে হয়েছে ওই বাড়িতে। বাগবাড়ি গ্রামে সব কিছু হয়েছে স্বাভাবিক গতিতে। অস্বাভাবিক হস্তক্ষেপে নয়। জিয়াউর রহমানের নামে তার গ্রামে একটি কলেজ আছে। বগুড়ায় হয়েছে মেডিক্যাল কলেজ। সবই তার শাহাদতের পরে। বেঁচে থাকতে হতে দেননি কিছু নিজ নামে।
গত ৩০ মে ছিল জিয়াউর রহমানের ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। তাই ক্ষণিকের স্মৃতি রূপ নিয়েছে চিরকালের। বাংলাদেশের আকাশে ক্ষণিকের ঝড় তুলেছিলেন তিনি। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ অল্প সময়। বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে সেই অল্প সময় এমন সব ছাপ ফেলেছে, যা আধুনিক বাংলাদেশের ভিত তৈরি করেছে। আমার মতো ক্ষণিকের স্মৃতি তাই ধারণ করে আছে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ। জিয়া তুমি, ‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ, মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান’।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
গধষ৫৫লঁ@ুধযড়ড়.পড়স


আরো সংবাদ



premium cement