২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

করোনাকালে আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্যচিন্তা

-

বর্তমান পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্যবিধি মানার জন্য সুরক্ষা উপকরণ (পিপিই) যেমন প্রয়োজন তেমনি নিজেকে সমাজ ও রাষ্ট্রকে সুরক্ষার জন্যও আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্য উপকরণ অপরিহার্য।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্যকে স্বাস্থ্যের সংজ্ঞায় চতুর্থ পরিসীমায় অন্তর্ভুক্ত করলেও এখন পর্যন্ত বিশ্ব আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্য হিসেবে কোনো দিবস ঘোষিত হয়নি। বিশ্বের সব উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থাসহ সারা বিশ্বব্যবস্থাকে জেনেটিক পরিবর্তিত কোভিড-১৯ লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে।
অন্য দিকে বাংলাদেশে আধ্যাত্মিক সচেতন একজন চিকিৎসক সহকারী অধ্যাপক ডা: মো: মঈন উদ্দিন করোনা রোগীর চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে নিজেই করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এই দেশ বা আমাদের রাষ্ট্র তাকে কী সম্মান দেবে জানি না। তবে আল্লাহতায়ালা কুরআনে ঘোষণা করেন, উত্তম কাজের প্রতিদান উত্তম পুরস্কার ছাড়া আর কী হতে পারে? (সূরা আর-রহমান : আয়াত-৬০)।
বর্তমান উন্নত বিশ্ব যোগাযোগ ব্যবস্থা, চিকিৎসাব্যবস্থা, বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও তথ্যপ্রযুক্তিতে অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটেছে। অন্য দিকে মানুষের মধ্যে জাতিগত বিভেদ, ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের মধ্যে যে পাহাড়সম প্রাচীর সৃষ্টি করে একটি দীর্ঘস্থায়ী ক্রমবর্ধমান যুদ্ধের সূচনা করা হয়েছে, যা আমাদের স্বপ্নের পৃথিবীকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে। ক্রমাগতভাবে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার অপরাধপ্রবণতা হত্যা আত্মহত্যা বিভিন্ন তুচ্ছ কারণে ঘটে থাকে।
উন্নত ও অনুন্নত সব দেশে সমাজের ভিত্তি পরিবার ভেঙে পড়েছে। মানুষের মধ্যে ধৈর্য, দয়ামায়া, মানবতাবোধ একেবারে শূন্যের কোঠায় চলে এসেছে। বস্তুগত উন্নতি যত হচ্ছে মানুষের মধ্যে তত বেশি অস্থিরতা, পীড়ন, হতাশা উদ্বেগ বাড়ছে। ইদানীং বিশ্বে একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীকে নির্বিচারে হত্যা ও দেশান্তরী করা এখন শক্তিশালী দেশগুলোর এজেন্ডায় পরিণত হয়েছে। এদের আর্তনাদ আহাজারি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বা কোনো দেশ এর সমাধানে এগিয়ে আসছে না। রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের এমন আচরণ বিশ্ববাসী শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছে। একই অবস্থা মধ্যপ্রাচ্যে ও অফ্রিকাতেও অব্যাহত রয়েছে।
পৃথিবীর এক একটি ইকোসিস্টেমে লক্ষাধিক উদ্ভিদ, প্রাণী প্রজাতি অণুজীব সহ-অবস্থানে বসবাস করে। এদের মধ্যে একটি অপূর্ব শৃঙ্খলা দেখা যায়। কেউ কাউকে সমূলে ধ্বংস করে না। এটাকে বলা হয় জীব বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য। মানুষ একটি উন্নত বুদ্ধিমান প্রাণী জাতি। অথচ এদের সহ-অবস্থানের মধ্যে কোনো ঐক্য খুঁজে পাওয়া যায় না। সে জন্য কোনো এক প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি বলেছিলেন, যতই আমি মানুষকে দেখি ততই প্রাণীদের প্রতি সম্মান বেড়ে যায়। মানুষ নিজেরা নিজের প্রতি সুবিচার করতে পারছে না। নিজেদের তারা হত্যা করে উৎখাত করছে। সামান্য স্বার্থের জন্য যা খুশি তা করছে।
আল্লাহর গুণবাচক নামের মধ্যে দু’টি হচ্ছে তিনি শক্তিপ্রয়োগ প্রবল, সংশোধনকারী ও মহারক্ষক। একটি আয়াতে আল্লাহ বলেনÑ আর আমি তাদের সময় দিয়ে থাকি, নিশ্চয় আমার কৌশল অত্যন্ত শক্ত। (সূরাÑ আল-কলম : আয়াত-৪৫) আমাদের সময় আসলে শেষ হয়ে গেছে। সৃষ্টিকর্তার অ্যাকশন কি তাই শুরু হয়ে গেল? করোনা মহামারী দিয়ে আমাদের সংশোধন হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। পরে আমরা দেখতে পাব কী ধরনের বিশ্বনেতৃত্ব আমাদের আসে।
ভ্রƒণতত্ত্বেও আধুনিক জ্ঞানের মাধ্যমে জানা যায়, মানবদেহ একটি টিউব থেকে ক্রমবিকাশ ঘটে। টিউবটি পাঁচটি স্তরে বিভক্ত। স্থূলদেহ, প্রাণসত্তা, কেন্দ্রীয় অক্ষ, মন ও আত্মা। এই প্রাণসত্তা ভালো ও মন্দের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ভালো ও মন্দের কাজগুলোকে মন কার্যকরী করে। মনকে ভাগ করা হয়েছে তিনটি ধারণাসংক্রান্ত উপস্তরে। সৃষ্টিকর্তার সচেতনতার স্তর, আত্মসচেতনতা স্তর, জড়বাদী স্তর।
অনুক্রমিকভাবে সুস্থ মনের তিনটি অত্যাবশ্যকীয় গুণাবলি : স্পষ্টতা, বুদ্ধিমত্তা, সংলগ্নতা যুক্তিসঙ্গত অনুক্রম ও সৃজনশীল কর্ম। সৃজনশীল কর্মই স্বাস্থ্যের একটি এমন গুণাবলি যা অনুপস্থিত থাকলে তাকে সুস্থ মনের অধিকারী বলা যাবে না।
স্বাস্থ্যের সংজ্ঞার মধ্যেই আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্যের স্বরূপটি অন্তর্নিহিত। স্বাস্থ্য হচ্ছে শারীরিক রোগ থেকে মুক্তি; যাতে দৈহিক স্বাচ্ছন্দ্য অর্জিত হয়। স্বাস্থ্য হচ্ছে আবেগ স্তরে আবেগের আতিশয্য থেকে মুক্তি, যাতে দেহ ও মনের মধ্যে এক অনাবিল ধীরতা ও প্রশান্তি অর্জিত হয়। স্বাস্থ্য মানসিক স্তরে স্বার্থপরতা হতে মুক্তি, যার ফলে চিরসত্যের প্রতি পূর্ণ মিলন ঘটে। অনেক মনীষী বলেন, আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ক আংশিক বুদ্ধি স্তরে এবং আংশিক আবেগ স্তরে। মানুষ বুদ্ধি স্তরে ও আবেগ স্তরে বিশুদ্ধ হলেÑ যেকোনো কঠিন সমস্যায় পতিত হলে সঠিক সত্যকে উপলব্ধি করে, সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হন।
আধ্যাত্মিক আলো মানসিক ও প্রাকৃতিক আলো থেকে ভিন্ন। মানসিক ও প্রাকৃতিক আলো ইন্দ্রিয়ের জগৎকে দেখতে সাহায্য করে। অন্তর্দৃষ্টির সম্পর্ক Ñ আত্মার (রূহ) সাথে, বোধশক্তির সম্পর্ক মেধার (বুদ্ধির) সাথে এবং অগ্রগতি ও পশ্চাতগতি দু’টির সম্পর্ক হৃদয়ের (আবেগ) সাথে। হৃদয়ের যে আলো পুঞ্জীভূত হয়, তা মহাবিশ্ব জগতের ভাণ্ডার থেকে সেগুলো নেমে আসে। চার্জবিহীন মোবাইলে কোনো মেসেজ যেমন আসে না তেমনি আধ্যাত্মিক চেতনাবিহীন মন কখনো মহাজগৎ থেকে কোনো মেসেজ পায় না।
জীবদেহ কোনো কোষকলার বিরুদ্ধে (অতি আনবিক স্তরের নিচে) শত্রুর (অ্যান্টিবডি) জন্ম দিয়ে সেই শত্রুর আক্রমণে অসংখ্য দুঃসাধ্য রোগের জন্ম দেয়। এদেরকে অটোইমিউন রোগ বলে। অটোইমিউন রোগের অনেক কারণের মধ্যে বিপথগামী মন বা কলুষিত মনকেও সমানভাবে দায়ী করা হয়। ভারতে সরেজমিন একটি সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয় যে, ৬৫.৬৫ শতাংশ চিকিৎসক আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্য গভীরভাবে বিশ্বাস করেন এবং ৫৫.৩৩ শতাংশ আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্য রোগ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে।
আমার প্রস্তাবিত একটি আবেদন বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ২০১১ জাতিসঙ্ঘ বাংলাদেশ দূতাবাসে ১০ এপ্রিলকে বিশ্ব আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্যদিবস হিসেবে ঘোষণা করার জন্য প্রেরণ করা হয়। এ বিষয়টির পরবর্তী অগ্রগতি কী হয়েছে জানার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গমন করি।
এই মন্ত্রণালয় একজন সম্মানিত পরিচালক আমাকে বললেন, এ দিবসটি পালন করলে আর্থসামাজিক উন্নতি কী হবে। আমি তাকে বললাম, দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে আবদ্ধ ব্যক্তি কখনো দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না, তেমনি দুর্নীতির দুষ্টচক্রে আবদ্ধ ব্যক্তি কখনো দুর্নীতি থেকে বের হয়ে আসতে পারে না। আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্যবান ব্যক্তিদের দ্বারা কোনো কর্মকাণ্ডে দুর্নীতি হবে না এবং সর্বক্ষেত্রে জবাবদিহিতা থাকবে।
ঢাকায় ২০১৪ সালে ‘বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ ইন হোমিওপ্যাথির উদ্যোগে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এই সেমিনারে প্রধান অতিথির আসন অলঙ্কৃত করেন মরহুম জাতীয় অধ্যাপক এম আর খান। এতে বিশেষ অতিথি হিসেবে চার ধর্মের চারজন বিশিষ্ট ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। ‘বিশ্ব আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্যদিবস’ শীর্ষক সেমিনারে একটি স্মরণিকা প্রকাশ করা হয়। এ দিবসের গুরুত্ব সব ব্যক্তি এই সেমিনারে উপস্থাপন করেন।
আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্য পরিমাপক মানদণ্ডকে শনাক্ত করার জন্য ছয়টি কাঠামো শনাক্ত করা হয়েছে। জীবনের শতভাগ পরিশুদ্ধির জন্য একটি ব্যাপক সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির চর্চা, নিজের ভেতর থেকে আত্মসমৃদ্ধির দিকে নিজেকে নিয়ে যাওয়ার চেতনাবোধ, জীবনের গভীরতম উদ্দেশ্য নিয়ে সর্বক্ষণ দৃষ্টি রাখা, জাগতিক আকর্ষণের ঊর্ধ্বে উঠে জীবনের মূল্যবোধকে অসীম সার্বজনীন ভালোবাসায় আত্মসমর্পণ করা সব কিছুতেই শর্তহীন ভালোবাসা এবং সব ধরনের ঈর্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করে নিজেকে সর্বশক্তিমানের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা, এমন একটি চেতনাবোধ যা অখণ্ডের মধ্যে নিজেকে একটি অংশ হিসেবে বিবেচনা করা।
একটি পরিশুদ্ধ সুন্দর জীবনগঠন একটি প্রক্রিয়া শুধু চেতনার নাম নয়। এর একটি রোডম্যাপ রয়েছে কিন্তু এর শেষ সীমা নেই। কুরআনে বর্ণিত রোডম্যাপটি যেটা নবীগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ ও সৎকর্মপরায়ণগণ অনুসরণ করেছেন। এই রোডম্যাপটির অনুক্রম হচ্ছে ঈমান, ইসলাম, তাকওয়া, সৎকর্ম। এই মান অর্জনে সর্বাত্মক চেষ্টা আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্য একমাত্র মাপকাঠি। ব্যক্তি সমাজ রাষ্ট্র গঠন বিনির্মাণে আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্যে শতভাগ অর্জন করার চেষ্টা করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। ক্রমবর্ধমান সীমাহীন অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামাজিক অবিচার, পাপাচার, বিচারহীনতা মুক্ত দেশ গঠনে সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্য অর্জন অপরিহার্য।
আল্লাহ কুরআনে বলেন, যদি জনপদের লোকেরা ঈমান আনত এবং তাকওয়ার নীতি অবলম্বন করত, তাহলে আমি তাদের জন্য আকাশ ও পৃথিবীর বরকতগুলোর দুয়ার খুলে দিতাম। কিন্তু তারা তা প্রত্যাখ্যান করেছে। (সূরা-আরাফ : আয়াত-৯৬)
আল্লাহ পুরো কুরআনের মূল সারাংশ তিনটি আয়াতে মানবজাতির পরিত্রাণের জন্য পেশ করেছেন, কালের কসম নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। কিন্তু তারা নয়, যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দিয়েছে ও ধৈর্যের উপদেশ দিয়েছে। (সূরা : আসর)
মানবজাতির পরিত্রাণের জন্য বিশ্ব আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্য দিবস সবচেয়ে মূল্যবান ও মর্যাদাবান দিবস হিসেবে বিবেচিত হবে। ১০ এপ্রিলকে বিশ্ব আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্য দিবস হিসেবে ঘোষণা করা এখন সময়ের দাবি। হ
লেখক : আহ্বায়ক, বিশ্ব আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্য দিবস বাস্তবায়ন কমিটি ও সভাপতি, বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ ইন হোমিওপ্যাথি (বিকাশ)।


আরো সংবাদ



premium cement
মহানবীকে কটূক্তির প্রতিবাদে লালমোহনে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ক্রিমিয়া সাগরে বিধ্বস্ত হলো রুশ সামরিক বিমান জর্ডান আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশী বিচারক এবারের আইপিএলে কমলা ও বেগুনি টুপির লড়াইয়ে কারা সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে সন্ত্রাসনির্ভর হয়ে গেছে : রিজভী রাশিয়ার ৯৯টি ক্ষেপণাস্ত্রের ৮৪টি ভূপাতিত করেছে ইউক্রেন আওয়ামী লীগকে ‘ভারতীয় পণ্য’ বললেন গয়েশ্বর দক্ষিণ আফ্রিকায় সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে দাগনভুঞার যুবক নিহত কাশ্মিরে ট্যাক্সি খাদে পড়ে নিহত ১০ অবশেষে অধিনায়কের ব্যাপারে সিদ্ধান্তে পৌঁছল পাকিস্তান জাতিসঙ্ঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থাকে আবার অর্থায়ন শুরু করবে জাপান

সকল