২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

হুমকিতে ভূগর্ভস্থ পানি

-

প্রতিটি প্রাণীর জীবন ধারণে পানি অপরিহার্য। ভূগর্ভে এবং ভূপৃষ্ঠে অবস্থান করে পানি। ভূগর্ভস্থ পানি ভূপৃষ্ঠের নিচে সঞ্চিত সম্পদ, যা প্রধানত ভূপৃষ্ঠের পানিতে গঠিত। এই পানি মাটির নিচে গিয়ে সঞ্চিত হয়। পৃথিবীর স্বাদু প্রায় ৩০ শতাংশ পানি আসে ভূগর্ভ থেকে। তবে আহরণযোগ্য ৯৭ শতাংশই আসে ভূগর্ভস্থ পানি থেকে। নদী-জলাশয়ের এ পানির পরিমাণ এক শতাংশেরও কম। এর ৬৯ শতাংশ হিমবাহ আকারে সঞ্চিত আছে। ভূতাত্ত্বিকভাবে পানিচক্রের অন্যতম উপাদান ভূগর্ভস্থ পানি; যা ভূগর্ভস্থ জলস্তর নামে পরিচিত শিলাস্তরে জমা থাকে। বাংলাদেশে গ্রামের প্রায় শতভাগ মানুষ খাবারের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। শহরাঞ্চলের সরবরাহও প্রধানত ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। রাজধানী ঢাকায় মোট পানি সরবরাহের ৮৭ শতাংশ আসে ভূগর্ভ থেকে। বাকিটা ভূপৃষ্ঠস্থ পানি শোধনের মাধ্যমে আসে। ভূগর্ভস্থ পানি সেচকাজেও ব্যবহৃত হয়।
১৯৯৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, মোট সেচের ৭২ শতাংশ পানি উত্তোলিত হয় ভূগর্ভ থেকে। এক জরিপের তথ্য, বাংলাদেশে ভূগর্ভস্থ পানি মজুদ আছে দুই হাজার ৫৭৫ কোটি ঘনমিটার। এর মধ্যে ১৬৮ দশমিক ছয় কোটি ঘনমিটার উত্তোলনযোগ্য নয়। বাকি মজুদের ৯০ কোটি ঘনমিটার গৃহস্থালি ও শিল্প উৎপাদনে এবং সর্বোচ্চ এক হাজার ২৮১ কোটি ঘনমিটার কৃষিতে ব্যবহৃত হতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে প্রতিদিন ১০ কোটি লিটার বিশুদ্ধ পানির ঘাটতি রয়েছে। রাজধানীতে প্রতিদিন ২২০ থেকে ৩০০ কোটি লিটার পানির প্রয়োজন। গত তিন দশকে ভূগর্ভস্থ পানির জন্য প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত করা যায়নি। বর্তমানে সারা দেশে বছরে প্রায় তিন কোটি ২০ লাখ মানুষ পানি সঙ্কটে ভুগছেন। এ দেশে মানুষের প্রতিদিন সুপেয় পানির যে চাহিদা, ভূগর্ভস্থ পানি থেকে সেই চাহিদা পুরোপুরি মেটানো সম্ভব নয়। অপরিকল্পিতভাবে পানি উত্তোলনে প্রতি বছরই পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। ভূগর্ভস্থ খাবার পানির সাথে নলকূপে উঠে আসছে ক্ষতিকর ভারী ধাতু ও দূষিত পদার্থ, যা পান করায় মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। গ্রামাঞ্চলে সাধারণত অগভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করা হয়। অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের ফলে এখন বছরের একটা সময়ে, বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে পানি পাওয়া যায় না। এর সাথে যোগ হয়েছে ভূগর্ভস্থ পানির দূষণ। ভূপৃষ্ঠের উপরি ভাগের দূষক পদার্থ চুইয়ে মাটির নিচে চলে গিয়ে পানিতে মিশছে। তা নলকূপের মাধ্যমে উঠে আসে। সে পানি মানব শরীরে প্রবেশ করে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস করে দেয়। ফলে নতুন রোগ সৃষ্টি হচ্ছে।
আর্সেনিক ভূগর্ভস্থ পানিতে ব্যাপক হারে দূষণ ঘটাচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানি উন্নয়নে এটি সবচেয়ে বড় বাধা। আর্সেনিক দূষণের আগে গ্রামের মানুষ অনেকাংশে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল ছিল। মাটির নিচে বিশেষ স্তরে আর্সেনিক সঞ্চিত থাকে। নলকূপের পানির মাধ্যমে তা উত্তোলিত হয়। বিগত কয়েক দশক ধরে কৃষি উৎপাদনে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় বৃষ্টির পানিতে এসব মিশে দূষিত করছে নদী, নালা, খাল, বিল, সমুদ্রের পানি; এমনকি ভূগর্ভস্থ পানিও। জমিতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার আর্সেনিক দূষণের অন্যতম কারণ। মাটির বিশেষ যে স্তরে আর্সনোপাইরাইট পদার্থ আছে; ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত উত্তোলনে তা পানিতে মিশে যাচ্ছে। প্রতিদিন কৃষিকাজ থেকে শুরু করে নিত্যব্যবহারে যে কোটি কোটি লিটার পানি উত্তোলন করা হচ্ছে। এর ফলে ভূগর্ভে সাময়িক শূন্যতার সৃষ্টি হয়ে আর্সেনিক মিশে দূষণ ঘটাচ্ছে, যা সময়ের সাথে সাথে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
এদিকে মাটির নিচে পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় এর বেশি শিকার উপকূলীয় অঞ্চল। তাই দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ত এলাকা ক্রমেই বাড়ছে। তা ছড়িয়ে পড়ছে দেশের পশ্চিমাঞ্চলেও। কৃষি ব্যবস্থাপনা ও শস্যবিন্যাসে পড়ছে লবণের বিরূপ প্রভাব। ফলে শস্য উৎপাদন কমছে। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততায় পানের অযোগ্য হয়ে পড়ছে পানি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় এসব জনপদের এক-তৃতীয়াংশ গৃহস্থালি পানি দূষিত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে; যা জনজীবনের জন্য বিরাট হুমকি।
আর্সেনিক ছাড়াও লোহার উচ্চমাত্রা ও ম্যাঙ্গানিজের অত্যধিক আধিক্য পানির গুণ নষ্ট করছে। মলমূত্রের কলিফর্মও একটা বড় সমস্যা, বিশেষ করে অগভীর ভূগর্ভস্থ পানির জন্য। সেচে ব্যাপকভাবে পানি উত্তোলনে শুকনা মৌসুমে ভূ-জলপৃষ্ঠ নিচে নেমে যাওয়া একটি বড় সমস্যা। ভূ-জলপৃষ্ঠ ছয় মিটারের নিচে নেমে গেলে প্রচলিত হস্তচালিত নলকূপে পানি ওঠে না। ভূ-জলপৃষ্ঠের অব্যাহত অবনমন কূপ খননের খরচও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এটা নেমে যাওয়ার আরেকটি ক্ষতিকর দিক হচ্ছেÑ ভূমি দেবে যাওয়া। কলকারখানা ও পৌর বর্জ্য যত্রতত্র ফেলাতেও ঢাকার মতো বড় বড় শহরে ভূগর্ভস্থ পানির মান ক্রমেই অধিকমাত্রায় নষ্ট হচ্ছে। বিশ্ব উষ্ণায়নও বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির জন্য একটি বিরাট ঝুঁঁকি।
পেট্রো রাসায়নিক শিল্পে, পলিথিন ও প্লাস্টিক শিল্পে, জ্বালানি শিল্পে, খনিজ তেল পরিশোধন শিল্পে, নানা রকম যানবাহন নির্মাণ, ছোট ও মাঝারি ইলেকট্রিক্যাল এবং ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে প্রচুর দূষিত পদার্থ তৈরি করা হচ্ছে; যেমনÑ অয়ামোনিয়াম ক্লোরাইড, সায়ানাইড এবং বিভিন্ন ধাতুÑ জিংক, পারদ, সিসা ইত্যাদি মিশে পানিকে দূষিত করছে। গ্রাম ও শহরের আবর্জনা, বর্জ্য, যেমন দৈনন্দিন গৃহস্থালীর কাজে ব্যবহৃত পানি এবং হোটেল-রেস্তোরাঁ থেকে নির্গত পানি, খাদ্যদ্রব্যের ফেলে দেয়া অংশ, শাকসবজির পচা অংশ, ব্যাকটেরিয়া প্রভৃতি জীবাণু মিশ্রিত হয়ে পানি দূষণ ঘটাচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের আইইডিসিআর এবং সিডিসি প্রোগ্রাম সূত্রে জানা গেছে, পানি প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতার ঝুঁকি অনেকটা বাড়িয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও নগরায়নের কারণে আবাসিক এলাকা, হাটবাজার, রাস্তাঘাট, শিল্পকারখানা, পয়ঃনিষ্কাশন কেন্দ্র তৈরি হচ্ছে। তেলের ট্যাংকারের মতো উৎস থেকেও প্রচুর ধাতু, তৈলাক্ত পদার্থ, সিসা, পারদ, দস্তা ও ক্রোমিয়ামের মতো বিষাক্ত দ্রব্য পানিতে প্রতিনিয়ত পতিত হচ্ছে। অন্য দিকে, ভূপৃষ্ঠের পানি দূষণ সম্পর্কে কিছুটা সচেতন হয়ে গ্রামের মানুষ যখন নলকূপের পানির ব্যবহার শুরু করেছেন, তখনই তারা আর্সেনিকের শিকার হচ্ছেন। কীটনাশকে নাইট্রোজেন, পটাশিয়াম ও ফসফরাস থাকে। অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে তা মাটির ভেতরে গিয়ে পানিকে বিষাক্ত করে। শহরাঞ্চলের অভ্যন্তরে পানি দূষিত হওয়ার স্তরটি মারাত্মক পর্যায়ে চলে গেছে।
পানিতে মিশে থাকা কেমিক্যাল, ভারী ধাতু, মরিচা, সিসা, ক্যাডমিয়ামসহ বিভিন্ন দূষিত পদার্থ শুধু সিদ্ধ করার মাধ্যমে দূর করা সম্ভব নয়। পানিতে কোন কোন পদার্থ মিশে আছে, আগে তা শনাক্ত করতে হবে। এরপর পৃথকভাবে এগুলো পরিশোধনের ব্যবস্থা নিতে হবে। জীবাণুভেদে পানি বিশুদ্ধকরণে পৃথক ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হয়।
ব্যাকটেরিয়াও অন্যান্য ক্ষতিকর জীবাণু ধ্বংসের জন্য পানি সঠিক মাত্রায় ৩০ থেকে ৪০ মিনিট ফোটাতে হয়। কিন্তু সঠিক তাপমাত্রায় নির্দিষ্ট সময় ধরে পানি ফোটানো সবার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই ঝুঁঁকি থেকে যায়। দেখা যায়, ফোটানোর পর পানি থেকে ব্যাকটেরিয়া দূর হলেও ক্লোরিনের পরিমাণ কমে না। এমনকি পাত্রে রাখা, ফোটানো পানিতে আবার ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে পারে। তাই ফোটানো ছাড়াও বিভিন্নভাবে পানি বিশুদ্ধ করা যায়, যা আমাদের জানা উচিত।
উপকূলীয় অঞ্চলে পানির লবণাক্ততার মাত্রা কমিয়ে পানি নিরাপদ ও সুপেয় করার উপযোগী রাখতে প্রয়োজন যথাযথ ও বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা। কিন্তু উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ বরাবরই সুবিধাবঞ্চিত। তাই তারা পানির জন্য জীবনসঙ্কটের মুখোমুখি। টিউবওয়েলের পানি আর্সেনিকমুক্ত করতে আরো কার্যকর কৌশল উদ্ভাবন জরুরি। প্রতিটি শিল্পকারখানার সাথে শোধনাগার বা অ্যাফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি) স্থাপন বাধ্যতামূলক করা আবশ্যক। কৃষিজমিতে কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। ভূগর্ভস্থ পানি রক্ষণাবেক্ষণে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সবাইকে সচেতন হতে হবে, যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনা যেন না ফেলেন। নির্দিষ্ট জায়গায় ময়লা ফেলতে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। পানির অপচয় রোধ করতে হবে, যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই ব্যবহার করতে হবে। মনে রাখতে হবেÑ ভূগর্ভস্থ পানি সীমিত। বিশেষ করে, কৃষি ক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে হবে। বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে যাতে ব্যবহার করা যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাহলে আমরা পানির চাহিদা মেটাতে এবং ভূগর্ভস্থ পানির দূষণ রোধ করতে পারব।

লেখক : শিক্ষার্থী, কবি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ
হরঢ়ধংযবরশয১৩@মসধরষ.পড়স

 


আরো সংবাদ



premium cement
গাজার ২টি হাসপাতালে গণকবরের সন্ধান, তদন্তের আহ্বান জাতিসঙ্ঘের তীব্র তাপদাহে পানি, খাবার স্যালাইন ও শরবত বিতরণ বিএনপির ৬ জেলায় বয়ে যাচ্ছে তীব্র তাপপ্রবাহ, সিলেট বিভাগে বৃষ্টির সম্ভাবনা মাতামুহুরিতে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ ২ আপিল বিভাগে ৩ বিচারপতি নিয়োগ ফেনীতে ইসতিসকার নামাজে মুসল্লির ঢল গাজা যুদ্ধের মধ্যেই ১০০ শতাংশ ছাড়িয়েছে ইসরাইলের সামরিক ব্যয় মন্ত্রী-এমপি’র স্বজনরা প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করলে ব্যবস্থা : কাদের গ্যাটকো মামলা : খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে শুনানি ২৫ জুন বুড়িচংয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১ গলাচিপায় স্ত্রীর স্বীকৃতির দাবিতে ৩টি সংগঠনের নেতৃত্বে মানববন্ধন

সকল