২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

প্রধান সমস্যা বেআইনি অস্ত্র

-

পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ‘ব্রিটিশ হিল ট্র্যাক্টস ম্যানুয়েল অ্যাক্ট-১৯০০’ অনুযায়ী, পাহাড়ের তিনটি জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের পাঁচ হাজার ৯৩ বর্গমাইল ভূমি আজ আর বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো ভূখণ্ড নয়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারত বিভক্তির পর র্যাডক্লিফ রোয়েদাদ অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামকে তৎকালীন পাকিস্তানের মানচিত্রে সন্নিবেশিত করা হয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে ১৬ ডিসেম্বর আসে আমাদের বিজয় দিবস। স্বাভাবিকভাবেই পার্বত্য চট্টগ্রামও তখন বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌম নতুন রাষ্ট্রের অঙ্গ হিসেবে একীভূত হয়েছে। আজ আর ব্রিটিশ কিংবা পাকিস্তানের কোনো আইনে নয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম চলছে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে এবং এর সংবিধানের বিধিমালার আলোকে।
স্বাধীনতার পর চাকমা চিফ ও রাজাকার নেতা ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের মন্ত্রি হিসেবে দীর্ঘ দিন পাকিস্তানেই মারা যান। বর্তমানে তারই ছেলে দেবাশীষ রায় পাহাড়ের চাকমা সার্কেল চিফ হিসেবে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। বাংলাদেশ সরকার স্বাধীন সার্বভৌম একটি এককেন্দ্রিক সরকার। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী অধিবাসী বাঙালি, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, পাংখু, লুসাই, মুরং, তনচঙ্গ্যা প্রভৃতি সব জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার নিশ্চিত করেই সরকার পাহাড়ে প্রশাসনকে ঢেলে সাজিয়েছে। তিনটি পার্বত্য জেলার স্বশাসিত ব্যবস্থা চালু আছে। তিনটি জেলা পরিষদ ছাড়াও আঞ্চলিক পরিষদ নামে ক্ষমতাশালী একটি পরিষদ রয়েছে, যার বেশির ভাগ ক্ষমতাই রাখা হয়েছে উপজাতীয় নেতাদের হাতে। তিন জেলার সংসদ সদস্য এবং মহিলা এমপি উপজাতীয়। তা ছাড়া, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি সার্কেল চিফ, হেডম্যান, কার্বারি, পাড়াপ্রধান প্রমুখসহ প্রায় সর্বক্ষেত্রেই উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর একাধিপত্য বিরাজমান। সরকার সাবেক শান্তিবাহিনীর কমান্ডার ও জনসংহতি সমিতির চেয়ারম্যান সন্তু লারমাকে ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর ও আত্মসমর্পণের পরপরই প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান পদটি ছেড়ে দিয়েছে। উপজাতীয় নেতাদের কাউকে উচ্চতর ভালো পদে বসানো হয়েছে, যাতে তারা নিজ সম্প্রদায়ের কল্যাণে অবদান রাখতে পারেন। এভাবেই শান্তিচুক্তির পর সরকার ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে একে একে সব বিষয় এবং সরকারি দফতরগুলোর নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা শতভাগ উপজাতীয় নেতাদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছে। ফলে, পাহাড়ে কিছুটা হলেও উন্নয়ন ও শান্তির সুবাতাস কম-বেশি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। তার পরও পাহাড়ের সাধারণ মানুষ তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসী বাঙালি, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা প্রভৃতি কেন পারস্পরিক দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছে? কেন তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে? কেন এত হত্যাকাণ্ড ও বন্দুকযুদ্ধ? শত শত ক্যাম্প প্রত্যাহারের পরও কেন তারা উপজাতি নেতাদের মুখে শুধু ‘সেনা প্রত্যাহারের দাবি শুনছে? কোথায় লুকানো আছে এত সব অস্ত্র? বাস্তবতা হলো, পাহাড়ের মানুষ বেআইনি অস্ত্রকে বেশি ভয় পায়, কিন্তু ভূমির জন্য তারা ততটা চিন্তিত নয়। উপজাতিরা বেশির ভাগই জুমচাষ করে এবং ভাসমান থাকে। তারা ভূমির জন্য স্থানীয় হেডম্যান ও কারবারিদের কাছেই জিম্মি কার্যত, বাংলাদেশ সরকারের কাছে নয়।
শান্তিচুক্তির শতভাগ বাস্তবায়ন হলেও কি পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি আসার গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবেন? টিআইবি, আইন সালিশ কেন্দ্র, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বা কথিত পার্বত্য চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক কমিশন কী জবাব দেবে? নাকি তখন আরো বেশি চাঁদাবাজি, মুক্তিপণ, গুম, খুন, বন্দুকযুদ্ধ, রক্তপাত ও আধিপত্যের লড়াই চলতে থাকবে? এরও কি কোনো আশঙ্কা নেই? পাহাড়ের সব ক্ষমতা সন্তু লারমাদের হাতে ছেড়ে দিলে তারা তাদের প্রতিপক্ষের জানমালের নিরাপত্তা ও মানবাধিকার নিশ্চিত করতে পারবেন কি না, সেই গ্যারান্টিও আজ সময়ের দাবি। বিভিন্ন এনজিও, ইউএনডিপি, হু, ইইসি এবং বিদেশী দূতাবাসগুলোকে বেআইনি অস্ত্রমুক্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের গ্যারান্টি দিতে হবে। ধতবেই তো প্রকৃত শান্তি। আদিবাসী বলে জাহির করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে দক্ষিণ সুদান ও পূর্ব তিমুরের মতো বিচ্ছিন্ন করা স্বপ্ন যারা দেখাচ্ছেন তারা মূলত দেশপ্রেমিক নন। এ দেশের মুক্তিযোদ্ধারা সেই সুযোগ কাউকে দিতে পারেন না। অনেকেই প্রশ্ন করেন, তিন পার্বত্য জেলার বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় সমস্যা কোনটি? আসলে পাহাড়ের নাগরিকদের হাজারো সমস্যা। এখানে বসবাসকারী বাঙালি, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ প্রতিটি সম্প্রদায়েরই একাধিক দাবি ও সমস্যা বিরাজমান। এগুলো চিরকালই থাকবে এবং ধাপে ধাপে কম-বেশি সমাধানও হয়ে যাবে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে সবার আগে কোন সমস্যাটি প্রকট এবং সমাধানযোগ্য সেটি নিয়েই ‘নানা মুনির নানা মত’।
সন্তু লারমা ও তাদের ঘনিষ্ঠ বুদ্ধিজীবী মহল দাবি করছে, শান্তিচুক্তির শতভাগ বাস্তবায়ন করলেই পাহাড়ের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এবং সরকার ভূমির অধিকার ও ক্ষমতা সন্তু লারমাকে দিয়ে দিলেই শান্তি চলে আসবে। অন্য দিকে, পাহাড়ের সুশীলসমাজ, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র-যুবক, শ্রমিক, নবীন-প্রবীণরা এ ব্যাপারে একমত নন। তারা বলছেন, শান্তিচুক্তির প্রায় সব শর্তই সরকারের কাছ থেকে পূরণ করে নিলেও চুক্তির প্রধান শর্ত তথা সব বেআইনি, অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, সাজ-সরঞ্জাম উদ্ধার এবং জেএসএস ক্যাডার ও ভিন্নমতাবলম্বীদের বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করতে সন্তু ব্যর্থ হয়েছেন। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আহূত বৈঠকেও তিনি সাড়া দেননি। বাস্তবে তাই বেআইনি অস্ত্র ও সশস্ত্র সন্ত্রাসীরাই পাহাড় নিয়ন্ত্রণ করছে। সরকারের সরলতাকে দুর্বলতা মনে করে এবং ‘শান্তিচুক্তি’কে নিরাপত্তার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে জনসংহতি সমিতি আর ইউপিডিএফ ক্যাডাররা অবাধে বন্দুকযুদ্ধ, খুন, চাঁদাবাজি ও সশস্ত্র সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিনই। চলছে বন্দুকযুদ্ধ, খুন, চাঁদাবাজি ও রক্তের বন্যা। এমনকি শাসকদল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির নেতাকর্মীরাও উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের অস্ত্রে জীবন হারাচ্ছেন।
ফলে, এটা অনস্বীকার্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান সমস্যা হলো ‘বেআইনি অস্ত্র’। যত দিন পাহাড়ে বেআইনি অস্ত্রধারীদের পদচারণা থাকবে, তত দিন পর্যন্ত স্থানীয় অধিবাসীরা নিরাপদ নয়। বর্তমানেও তিন পার্বত্য জেলা ও উপজেলার সদর দফতর ছাড়া অন্যান্য পাহাড়ে জনপদে সরকারের নিয়ন্ত্রণ আছে বলে এলাকাবাসী আস্থা রাখতে পারছে না। পাহাড়ের আধিবাসী বাঙালি বা উপজাতি উভয় সম্প্রদায়ই আজ জিম্মি হয়ে আছে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের কাছে। জীবন, জীবিকা, জানমাল-ইজ্জত-সম্মান সব কিছু জেএসএস ও ইউপিডিএফ ব্যানারধারী সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণে। দুর্গম এলাকায় সন্ত্রাসীরা বিচার-আচার, ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি, চলাফেরা, হাট-বাজার, খাজনা আদায়সহ সব বিষয়েই খবরদারি চালাচ্ছে। প্রশাসন মাঝে মধ্যে থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সন্ত্রাসীরাই সব দেখাশোনা করে থাকে। রাতের আঁধারে সমগ্র ক্ষমতা প্রয়োগ করে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা, জনগণ থাকে নিরাপত্তাহীন। তাই, পাহাড়ের আধিবাসী বাঙালি, উপজাতি নির্বিশেষে সবার প্রধান দাবি হলোÑ যাবতীয় অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার অভিযান চালিয়ে আগে করার জনগণের জানমালের নিশ্চয়তা দিতে হবে। নিজেদের কী জানমাল-ইজ্জত না বাঁচলে ভূমি দিয়ে কী হবে? ভূমির অধিকার দেবে বাংলাদেশ সরকার, উপজাতি নেতাদের সেই ক্ষমতা নেই। অস্ত্র দিয়ে সব কিছু হয় না। দেশের ভূমি, স্বরাষ্ট্র, আইন, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক ইত্যাদি পার্বত্য চট্টগ্রামের নাগরিকদের ভূমির অধিকার দিতে সচেষ্ট। কিন্তু,পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা জীবনের অধিকার কেড়ে নিলে তা ফিরিয়ে দেয়ার সাধ্য কারোই নেই। জীবন দেয়ার ক্ষমতা জনসংহতিরও নেই, ভূমি কমিশনের হাতেও নেই। গত ২৪ ফেব্র“য়ারি ঢাকায় পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি মোহাম্মদ আনোয়ারুল হকের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের প্রতিনিধিদল সাক্ষাৎ করে মূলত ওই দাবিটি তুলে ধরেছে। ভূমি অধিকারের জন্য আগে করতে হবে ভূমি জরিপ বা ক্যাডেস্ট্রাল সার্ভে যা করা হলে পাহাড়ের নাগরিকদের ভূমিতে বসবাসের বর্তমান অধিকার চিহ্নিত হবে। তাই ‘ঘোড়ার আগে গাড়ি’ নয়। ‘গাড়ির আগে ঘোড়া’ থাকতে হবে। তবেই পাহাড়ের ভূমি বিরোধ দ্রুত মিটে যাবে। বেআইনি অস্ত্রধারীদের আইনের আওতায় না আনা পর্যন্ত স্থানীয় জনগণ নিরাপদ নয়। এ বিষয়ে জাতীয় নেতৃবৃন্দ, বর্তমান সরকার, মানবাধিকার সংগঠনসহ দেশী-বিদেশী মানবতাবাদী কণ্ঠ যতই সোচ্চার হবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সব সম্প্রদায়ের নাগরিকরা ততই ঐক্য, শান্তি, সম্প্রীতি ও নিরাপত্তার সুবাতাস ভোগ করতে পারবেন। শান্তিচুক্তির শতভাগ তখন বাস্তবায়িত হওয়া সম্ভব হবে। হ

লেখক : পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং রাঙ্গামাটি জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার।

 


আরো সংবাদ



premium cement