২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

সুইডিশ মডেলই কি পথ দেখাল

অন্য দৃষ্টি
-

মধ্য মার্চ থেকে ধনী দেশগুলো স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, কর্মস্থল, গণপরিবহন বন্ধ করে দেয়। পাবলিক ইভেন্টের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে এবং বন্ধ করে দেয় আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ যাত্রী চলাচল। ধনীদের একটা মাত্র দেশ পশ্চিমের ব্যতিক্রম। জরুরি অবস্থা বা লকডাউনের পরিবর্তে তারা নমনীয় কিছু পদক্ষেপ নেয়। তাদের পদক্ষেপের মধ্যে ৫০ জনের বেশি জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কিছু স্বাস্থ্যবিধি আরোপ করার তাগিদ দেয়া হয়। তবে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনের ব্যাপারে তাদের আন্তরিকতা ছিল যথাযথ। রেস্তোরাঁ খোলা থাকল, শিশুদের স্কুল খোলা থাকল, নাগরিক জীবনযাপন প্রায় সব জায়গায় স্বাভাবিক থাকল। অনেক বিশেষজ্ঞ সুইডেনের নভেল করোনা মোকাবেলার এ নীতিকে ভয়াবহ বলে মন্তব্য করেন। অনেকে অভিযোগ করে বসল, বৃদ্ধদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে সুইডিশ কর্তৃপক্ষ। ঘটনার দুই মাস পর বিশ্ব করোনা পরিস্থিতি মূল্যায়নে বলছে, সুইডিশদের ভয়াবহ নীতি অন্যদের চেয়ে খারাপ কিছু ছিল না। বেশির ভাগ দেশ রক্ষণশীল ও সতর্ক নীতি নিয়েও সুইডিশদের চেয়ে ভালো কিছু করতে পারেনি।
সুইডেন তাদের এ কৌশলকে দলীয় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জনের পথ বলে জানান দেয়। যে সময় তারা এ পদক্ষেপ নিচ্ছিল, তখন প্রতিবেশী ইতালিতে ভীতিকর সংক্রমণ শুরু হয়েছিল। আশপাশের অন্যান্য দেশেও সংক্রমণ দ্রুত বিস্তার ঘটছিল। দলীয় রোগ নিয়ন্ত্রণ সক্ষমতা অর্জনের জন্য সুইডেন তখন কোনো লক্ষ্য নির্ধারণ করেনি। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন ৬০ শতাংশ মানুষের মধ্যে ভাইরাসটি বিস্তার ঘটলে সামগ্রিকভাবে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জিত হবে। সুইডিশ জনস্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান এপিডেমিওলজিস্ট এন্ডারস তেজনেল পূর্বাভাস দিচ্ছেন চলতি মাসের মধ্যে রাজধানী স্টকহোম দলীয় প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করবে। স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গণিতবিদ হিসাব করে দেখাচ্ছেন, ৪০ শতাংশ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জিত হলে ভাইরাসটি ছড়ানো বন্ধ হয়ে যাবে। তার মতে, স্টকহোমে সেটি মধ্য জুনে অর্জিত হবে।
পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবেশী ইউরোপের দেশগুলোর তুলনায় সুইডেনে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু অনেক কম। তবে নরডিক দেশগুলোর তুলনায় সেটি কম নয়। সাথে সাথে তারা বয়স্ক ও অভিবাসীদের রক্ষা করতে পারেনি এ কথাও বলা হচ্ছে। সুইডিশ কর্তৃপক্ষের যুক্তি হচ্ছে, এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া শেষ পর্যন্ত রোধ করা যাবে না। এখন আমাদের মৃত্যুহার শুধু নরডিক দেশগুলোর তুলনায় কিছু বেশি হলেও এক সময় তুলনামূলক সেটি কমে আসবে। সারা বিশ্ব যখন এর দ্বিতীয়বার ভয়াবহ ছড়িয়ে পড়া প্রত্যক্ষ করবে, সুইডেন সেই ভয়াবহতা এখনই মোকাবেলা করছে। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির মুখোমুখি আগেই হয়ে যাওয়া তাদের কৌশল। তাদের মতে, এর চেয়ে খারাপ পরিস্থিতি আর হয়তো হবে না। সাহসিকতার সাথে এ ঝুঁকি মোকাবেলা করায় তাদের জন্য ভবিষ্যতে আরো ভয়াবহ কিছু হবে তার আশঙ্কা কম।
দ্বিতীয়বার এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে কাঁপছে কঠোর লকডাউন সফলতা পাওয়া দেশ চীন। ইতোমধ্যে চীনের এক শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানীর পক্ষ থেকে আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে, দেশটিতে নতুন করে করোনাভাইরাসের ভয়াবহ সংক্রমণ ঘটতে পারে। ভাইরাসটির ছড়িয়ে পড়া গতিরোধ করে দিয়ে প্রথমবার তারা সফলতা অর্জন করে। ওই সব মানুষের মধ্যে ভাইরাসটির বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠেনি কিন্তু। চীনের প্রত্যেকটি মানুষ ভাইরাসটির আক্রমণ প্রতিরোধে এখনো অরক্ষিত। চীনে এখনো বাইরের দেশ থেকে প্রায় সংক্রমণ ঘটছে। তারা এ সংক্রমণকে কঠোর লকডাউনের মাধ্যমে এখনো নিয়ন্ত্রণ করছে। এভাবে সব কিছুকে স্তব্ধ করে কত দিন একটি দেশ এ ভাইরাস থেকে বাঁচতে পারবে। এভাবে আদৌ কি নিরাপত্তা অর্জন করা যায়। একই আশঙ্কা বিশ্বের সাড়ে ৭০০ কোটি মানুষের বেলায় রয়ে যাচ্ছে। ভাইরাসটি চিরতরে সারা বিশ্ব থেকে নির্মূল হয়ে না গেলে লকডাউন দিয়ে কৃত্রিমভাবে কিছু দিন ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব। এভাবে মানুষের নিরাপত্তা তৈরি করা যাবে না। এমন ব্যবস্থা স্বেচ্ছায় বন্দিত্ব গ্রহণ করার মতো।
সুইডেন নিজেদের কৌশলকে নিখুঁত দাবি করে না। তারা মনে করে, তরুণ ও সুস্থরা সংস্পর্শে এসে ভাইরাসটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সক্ষমতা অর্জন করে। তাদের এ অনুমান শেষ পর্যন্ত একেবারে ভুল প্রমাণ হয়নি। সুইডেনের হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র এখন রোগীর চাপে ন্যুব্জ হয়ে যায়নি। শিশুদের পরিচর্যা করার বাড়তি চাপ এখনো জেঁকে বসেনি। ইউরোপের বেশির ভাগ দেশে পরিস্থিতি একপর্যায়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এখনো ডে কেয়ার এবং শিশুদের স্কুল চালু রয়েছে সুইডেনে। সুইডিশ মডেলকে কেউ স্বীকৃতি দিচ্ছে না। তবে অনেকে আংশিকভাবে সেই পথে হাঁটছে। ডেনমার্ক-ফিনল্যান্ড শিশুদের স্কুল খুলেছে। জার্মানি সব ছোট দোকান খুলে দিয়েছে। ইতালি ও ফ্রান্সের যাত্রাও একই পথে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সুইডিশ মডেলের প্রশংসা করেছে। দেশটির বহু রাজ্যে লকডাউন শিথিল করা হচ্ছে আরো আগে থেকে।
সামনে থেকে ঝুঁকি নিয়ে কেন এই ভাইরাসটির মুখোমুখি হওয়া। এর পক্ষে যুক্তি কতটুকু। এ ব্যাপারে অনেক আলোচনা বৈশ্বিক অঙ্গনে ইতোমধ্যে হয়েছে। পরিস্থিতি বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, সবমিলিয়ে কত মানুষের মৃত্যু হবে তার হিসাব করতে কয়েক বছর লেগে যাবে। এর মধ্যে দেউলিয়া, লে অফ, আত্মহত্যা, মানসিক রোগ, জাতীয় উৎপাদন ও বিনিয়োগ হারানোসহ আরো অনেক কিছু ঘটবে, শুধু এ ভাইরাসের কারণে নয়, বরং এর সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে তার ভয়াবহ পরিণতি হিসেবে সেসব সামনে আসবে। ইতোমধ্যে লকডাউন করে যে পরিমাণ ক্ষতির মুখে মানুষ পড়েছে তা হিসাব করে শেষ করা যাবে না। উন্নত দেশগুলোর সংস্থা ওইসিডির পূর্বাভাস অনুযায়ী ধনী দেশগুলোর অর্থনীতি এক বছরের মধ্যে ২৫ শতাংশের বেশি সঙ্কুচিত হয়ে যাবে। বেকারের সংখ্যা দাঁড়াবে কল্পনাতীত। যা রাজনৈতিক বিরোধের জন্ম দেবে, সমাজে শ্রেণীবিভেদ সৃষ্টি করবে। এখন পর্যন্ত এর কোনো নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি কখন টিকা তৈরি হবে। এর মধ্যে অর্থনৈতিক সামাজিক রাজনৈতিক ভয়াবহ চাপ সৃষ্টি করবে। সে হিসাবে সুইডিশ মডেল একদম মন্দের মধ্যে ভালো পছন্দ। এটি বাছাই না করতে পারলে পরিণামে এর চেয়ে অনেক বেশি খারাপের জন্যই অপেক্ষা করতে হবে। এখন পর্যন্ত নভেল করোনার ব্যাপারে ভালোভাবে কিছু জানা যায়নি। লকডাউন করে একটি ভালো দিনের অপেক্ষায় থাকলে আরো খুব খারাপ কিছুর আশঙ্কাই বেশি। বাংলাদেশ আনমনে যেন সেই পথে হাঁটছে। দেশটিতে সংক্রমণ যখন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে তখন রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের জনজীবন খুলে দেয়া হচ্ছে। আমাদের মতো দরিদ্র ও জনবহুল দেশ পাকিস্তান ও ভারত করোনাভাইরাস মোকাবেলায় দ্বিধা সন্দেহের মধ্যে পড়ে গেছে। কঠোর লকডাউন দেয়ার পরও নির্ধারিত সময়ের ব্যবধানে এসব দেশে সংক্রমণ বাংলাদেশের মতো হু হু করে বাড়ছে। এসব দেশের কাছে খুব একটা বিকল্প কিন্তু নেই। বেশি দিন ঘরে বসে থাকলে এসব দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর আহার জোগাড় করাই অসম্ভব হয়ে উঠবে।
সুইডেন হার্ড ইমিউনিটি বা দলীয় রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা অর্জনের কৌশল অবলম্বন করে কতটা উপকৃত হয়েছে ইউরোপের অন্তত একটি দেশের সাথে তুলনা করে তা দেখা যেতে পারে। চলতি সপ্তাহের রোববার পর্যন্ত হিসাবে দেখা যাচ্ছে, সুইডেনে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ২৯,৬৭৭ জন। তাদের মধ্যে ৮,৬৪৫ জনের হিসাব ক্লোজ হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে ৩,৬৭৪ জন মারা গেছেন। যা ক্লোজ হওয়া রোগীর ৪২ শতাংশ। সুস্থ হয়েছেন ৪,৯৭১ জন, যা ক্লোজ হওয়া রোগীর ৫৮ শতাংশ। আক্রান্ত বাকি ২১,০৩২ জনের মধ্যে ২০,৭৫৪ জনের লক্ষণ মৃদু, যা মোট আক্রান্তের ৯৯ শতাংশ। জটিল অবস্থায় রয়েছেন ২৭৮ জন, যা আক্রান্তের মাত্র ১ শতাংশ। সুইডেনেরে জনসংখ্যা এক কোটি তিন লাখ।
একই সময়ে যুক্তরাজ্যে আক্রান্ত হয়েছেন দুই লাখ ৪০ হাজারের বেশি। মারা গেছেন ৩৪ হাজারের বেশি। যুক্তরাজ্যের জনসংখ্যা ছয় কোটি ত্রিশ লাখ। জনসংখ্যা ছয় গুণের বেশি কম হলেও সুইডেনে আক্রান্ত হয়েছে তার তুলনায় আট গুণ কম মানুষ। মারা গেছেন যুক্তরাজ্যের তুলনায় ১০ গুণ কম মানুষ। কেউ কেউ মন্তব্য করেছিলেন সুইডিশ মডেল ভয়াবহ। এই নীতি নিষ্ঠুর, মানুষদের স্বেচ্ছায় মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার মতো। তথ্যউপাত্ত বলছে, সুইডেন দলীয়,রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতার পথ গ্রহণ করে অন্য দেশের তুলনায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। বরং আক্রান্তের হার ও মৃত্যুর হার অনেক দেশের চেয়ে তাদের কম। দেশটির শাসকরা দাবি করছেন, সময় যত গড়াবে সুইডিশ মডেলের সাফল্য বোঝা যাবে। কারণ যে সময়টাতে সুইডিশরা রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা অর্জন করছে সেই সময়টাতে অন্যান্য দেশ পুরোপুরি ঝুঁকির মধ্যে রয়ে যাচ্ছে। পরের দিকে সুইডেনে মৃত্যু ও আক্রান্তের হার কমবে। কারণ এ দেশটিতে তত দিন দলীয় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে ফেলবে। অন্য দিকে অন্য দেশগুলোর পিছু হটার কারণে তাদের সংক্রমণের ও মৃত্যুহার দুটোই আরো দীর্ঘ দিন উচ্চ থাকবে। এভাবে তারা শেষ পর্যন্ত করোনা থেকে বাঁচতে পারবে কি না তার কোনো নিশ্চয়তাও নেই।
করোনা নিয়ে সারা বিশ্ব যখন ভয়ে কাঁপছে সুইডেন কেন এ ধরনের সাহসী মোকাবেলার পথ গ্রহণ করল। বলা হচ্ছে, সুইডেন একটি ব্যতিক্রমী জাতি। এ দেশের মানুষ অত্যন্ত সচেতন। তাদের নিজেদের মধ্যে রয়েছে উচ্চপর্যায়ে বোঝাপড়া। জনগণ ও সরকারের মধ্যে উচ্চ আস্থা রয়েছে। সুইডিশরা অন্য অনেক দেশের তুলনায় ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী। মানুষের প্রতি দায়িত্বশীলতা বিশেষ করে বৃদ্ধদের যতœআত্তিতে তারা আন্তরিক। স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রয়োজনীয় উপায় উপকরণ ও সেবা পৌঁছে দেয়ার মতো তাদের রয়েছে সক্ষমতা। সুইডেনকে ফলো করার আগে এসব বিষয় একান্তভাবে বিবেচ্য। অন্য দিকে, জাতীয় লকডাউনের কষ্ট অসহ্য হয়ে উঠছে। এর বিরুদ্ধে বিশ্বের অনেক জায়গায় মানুষ বিক্ষোভ করেছে। এভাবে অবরুদ্ধ হয়ে থাকা কত দিন সম্ভব হতে পারে? হ
jjshim146@yahoo.com

 


আরো সংবাদ



premium cement