২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

করোনাভাইরাস

-

সম্প্রতি করোনাভাইরাস পৃথিবীতে ভয়াবহ আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। ভাইরাস হলো এক প্রকার অতিক্ষুদ্র জৈব কণা বা অণুজীব। যারা জীবিত কোষের ভিতরেই কেবল বংশবৃদ্ধি করতে পারে। ভাইরাস মানুষ, পশুপাখি ও উদ্ভিদের মধ্যে বিভিন্ন রোগের বিস্তার ঘটায়। কিছু ভাইরাস ব্যাক্টেরিয়ার মধ্যেও বংশবৃদ্ধি করে। বর্তমানে পৃথিবীতে করোনাভাইরাসের ব্যাপক ও দ্রুত বিস্তার ঘটছে। সমগ্র পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ চিহ্নিত হয়েছে। চীনের উহান প্রদেশ থেকে চিহ্নিত হওয়া এ ভাইরাস সমগ্র পৃথিবীর মানবমন্ডলীর মাঝে আতঙ্কের সঞ্চার করেছে। সংক্রমণের আশঙ্কায় অনেকে দেশে জনসমাবেশ, স্কুল, কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পরিবহন ব্যবস্থার উপরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হচ্ছে। এমনকি ধর্মীয় উপাসনালয়ে যেতেও সতর্কতা জারি করা হয়েছে। হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, যখন লোকের মধ্যে মহামারী দেখা দিবে আর তুমি সেখানে অবস্থান করো, তখন সেখানেই অবস্থান করবে (পালিয়ে যাবে না)।
অবশ্য অসুস্থ লোক ছাড়া সুস্থ মানুষের জন্য মসজিদে যাওয়া আসার ক্ষেত্রে ইসলামী শরিয়তে কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়নি। মহামারী আক্রান্ত হয়ে এর আগে পৃথিবীতে ইবোলা ভাইরাস ও সার্স ভাইরাসের প্রভাবে অনেক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। তবে করোনাভাইরাসের মতো এত দ্রুত অন্য কোনো ভাইরাস বিস্তার লাভ করেনি। মূলত ভাইরাস বা সংক্রামক রোগ একধরনের মহামারী। দেখা গেছে, কোনো দেশ বা জাতি যখন অতিরিক্ত মাত্রায় পাপে নিমজ্জিত হয়, আল্লাহপাকের জীবন বিধানের প্রতি অবজ্ঞা করে তখন আল্লাহপাক তাদেরকে সুপথ প্রদর্শনের জন্য নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। জাতি বা কওমের লোকেরা প্রেরিত নবী বা রাসূলের প্রদর্শিত পথ গ্রহণ করলে আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে সেসব জাতি বা কওমের জন্য দুনিয়ার শান্তি ও আখেরাতের মুক্তির পথ অবারিত হয়ে যায়। অপর দিকে যখন প্রেরিত নবী-রাসূলের প্রদর্শিত পথ বা আদর্শ মেনে নিতে জাতি বা কওমের লোকেরা অস্বীকৃতি জানায়, নবী-রাসূলদের ওপরে অত্যাচার করে তখন আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে সেসব কওম বা জাতির ওপরে বিভিন্ন মাধ্যমে ধ্বংস বা বিপদ নেমে আসে। নবুয়ত বা রিসালাতের বিরোধিতার কারণে আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের গজব বা শাস্তির ঘটনা অতীতে মানবজাতির ওপরে আপতিত হয়েছে। অতীতে বিভিন্ন মানব জাতির ওপরে নেমে আসা বিভিন্ন গজবের মধ্যে ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাস, বিভিন্ন প্রকার মহামারীর ঘটনা কালামে পাকে বিবৃত হয়েছে। হজরত লূত (আ:)-এর সময় সমকামিতার কারণে আদ ও সামুদ জাতির ওপরে চরম গজব ও ধ্বংস নেমে এসেছিল। পবিত্র কালামে পাকে বর্ণিত, ‘এবং আমি আদ, সামুদ ও কূপগুলোর অধিবাসী এবং ওদের অন্তর্বর্তীকালের বহু মানবজাতিকে, ওদের প্রত্যেককে দৃষ্টান্ত দিয়ে সতর্ক করেছিলাম এবং ওদের সবাকেই আমি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করেছিলাম।’ (সূরা আল ফুরকান আয়াত নং-৩৮.৩৯)
বর্তমানে করোনাভাইরাস সমগ্র পৃথিবীতে মানবজাতির মাঝে মহামারী আকারে দেখা দিয়েছে। করোনার বিস্তারের কারণ পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, অবাধ মেলামেশা করোনাভাইরাস বিস্তারের অন্যতম কারণ। আজকের পৃথিবীতে অবাধ মেলামেশার সয়লাব বয়ে গেছে।
বর্তমানে প্রমাণিত হয়েছে, পোশাক কেবল শালীনতাই রক্ষা করে না, উপরন্তু পোশাক রোগ প্রতিরোধের অন্যতম মাধ্যম। বর্তমানে দেহ প্রদর্শনের যে উন্মত্ত প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে তা কেবল শালীনতাবিরোধী নয়, বিভিন্ন রোগব্যাধি বিস্তারের অন্যতম কারণ। নগ্ন দেহ প্রদর্শনীর সংস্কৃতি যে মানবদেহের জন্য কল্যাণকর নয়। বর্তমানে মুখোশ, হাতের গ্লাভস বা শরীর ঢাকার যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে তাতেই তা প্রমাণিত। আদিকাল থেকে মানুষ শরীর ঢাকার জন্য পোশাক ব্যবহার করে। প্রাচীনকালে মানুষ গাছের লতাপাতা ও পশুর চামড়া দিয়ে পোশাক তৈরি করত। প্রাকৃতিক তন্তু বা সুতা আবিষ্কারের পর মানুষের পোশাক তৈরি সহজসাধ্য হয়েছে। কৃত্রিম তন্তু আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে মানুষ পোশাক শিল্পে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করেছে। বর্তমানে পোশাক পরিধান করা কেবল শরীর ঢাকার জন্য নয়, বরং তা আর্ট বা কালচারে রূপান্তরিত হয়েছে। ইসলামী শরিয়ত মতে, নারী ও পুরুষের পোশাকের মাঝে বিভাজন রয়েছে। আমরা জানি, নারী ও পুরুষের শরীরের গঠন এক রকম নয়। সে কারণে ইসলামী শরিয়ত নারীর শারীরিক অবয়ব ঢাকার জন্য তার শরীরের গঠনের আদলে পোশাক পরিধান করার বিধান রেখেছে। অন্য দিকে পুরুষের শরীরের গঠন অনুযায়ী তার শরীরের পোশাক পরিধান করার বিধান চালু আছে। ইসলামী শরিয়তের বিধান অনুসারে শালীন পোশাক পরিধানের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। মেয়েদের ক্ষেত্রে পুরো শরীর ঢেকে রাখার বিধান ইসলামী শরিয়তে অনুমোদিত। বর্তমানে আধুনিকতার ধুয়া তুলে এক শ্রেণীর মানুষ নারী ও পুরুষের পোশাকের সমতা বিধানের দাবি তুলেছে। নেকাব পরে শ্রেণিকক্ষে ঢোকার কারণে পৃথিবীর অনেক দেশে এমনকি বাংলাদেশেও মেয়েদের শ্রেণিকক্ষ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বিষয়টি সমগ্র বিশ^ব্যাপী বহুল আলোচিত। বর্তমানে ভাইরাস সংক্রমণের কারণে দেহ ঢাকার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। শ্রেণিকক্ষ তো দূরের কথা রাস্তাঘাটেও নারী-পুরুষের মুখোশ ব্যবহার শুরু হয়েছে। মূলত দৈনন্দিন জীবনে ইসলামী রীতির পোশাক পরা সর্বোত্তম। পবিত্র কালামে পাকে মানবজাতিকে শালীন পোশাক পরিধানের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পবিত্র কালামে পাকে ঘোষিত হয়েছে, ‘যিনি পবিত্রতা অর্জন করেছেন তিনিই সফলকাম’। (সূরা শামস আয়াত নং-৯)
পরিচ্ছন্নতা দুই প্রকার। ক. দৈহিক। ইসলামী জীবন দর্শনের আলোকে আমরা জানি যে, পবিত্রতা অর্জনে ইসলামের বিধিবদ্ধ নিয়ম রয়েছে। ভোরে ঘুম থেকে উঠে প্রথমে দুই হাতের কব্জি পর্যন্ত ধুয়ে ফেলা, এরপর মেছওয়াক করে মুখ পরিষ্কার করা, পরে ওজুর মাধ্যমে দেহ পরিচ্ছন্ন করে নামাজ আদায় করা। এভাবে দৈনিক পাঁচবার ওজু করা বা পরিচ্ছন্ন হতে হয় প্রত্যেক মুসলমানকে। পরিচ্ছন্নতার এই বিধান কেবল মুসলমানের নয়, গোটা মানবজাতির জন্য রোগ মুক্তির মাধ্যম হিসেবে অনুশীলন করা যেতে পারে। খাওয়ার আগে ও পরে দুই হাতের কব্জি পর্যন্ত ধুয়ে নিতে হবে। পরিশুদ্ধ খাবারের জন্য তা ঢেকে রাখা একান্ত কর্তব্য। অপরিশুদ্ধ খাবার রোগব্যাধির জীবাণু বহন করে। হাদিস শরিফে এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে।
বর্তমানে করোনা প্রতিরোধে সমগ্র পৃথিবীতে জনসমাবেশের ওপর সতর্কতা জারি করা হয়েছে। আমরা জানি, উন্মুক্ত কনসার্ট, সিনেমা হল, থিয়েটার, খেলাধুলার মাঠে, রাজনৈতিক বক্তৃতার ময়দানে অনেকে খোলামেলা পোশাকে অংশ গ্রহণ করে থাকে। এসব অনুষ্ঠানে মানুষ একত্রে অপরিচ্ছন্নভাবে বিভিন্ন খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। যা রোগ বিস্তারের অন্যতম মাধ্যম। আমরা জানি, বিদেশ ভ্রমণ জ্ঞান লাভের অন্যতম উৎস। প্রাচীনকাল থেকে মানুষ জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে, শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার লক্ষ্যে বিদেশ ভ্রমণ করে থাকেন। বর্তমানে বিদেশ ভ্রমণ বিনোদন, ফ্যাশন প্রদর্শন, দৈহিক নগ্নতা প্রদর্শন ও বিকৃত যৌনাচারের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে পরিণত হয়েছে। অবাধ মেলামেশার কারণে এসব ভ্রমণ ক্ষেত্র থেকে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন রোগব্যাধি বা ভাইরাস বিস্তারের পথ উন্মুক্ত হচ্ছে।
এখন সময় এসেছে আত্মসমালোচনার। সময় এসেছে আত্মোপলব্ধির। দৈহিক পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি আত্মিক পরিচ্ছন্নতায় গুরুত্ব দেয়া বিশেষ কর্তব্য। মন অসুস্থ হলে তা দেহের ওপর প্রভাব ফেলে। আমরা জানি, বর্তমান পৃথিবীতে আত্মহত্যার ঘটনা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। অনুন্নত বিশ^ থেকে উন্নত বিশে^ আত্মহত্যার হার বেশি। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, অর্থনৈতিক কারণ বা অভাব-অনটনের কারণে নয়, এসব অর্থনৈতিক প্রাচুর্যের দেশের মানুষ কেবল আত্মিক অপরিচ্ছন্নতা ও মানসিক বৈকল্যের কারণে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। আত্মিক পরিচ্ছন্নতা বা মানসিক স্থিতিশীলতার প্রধান মাধ্যম সৃষ্টিকর্তায় বিশ^াস বা আস্থা স্থাপন। বিপদাপদ ও সুখ-দুঃখে সব অবস্থায় আল্লাহ পাকের সিদ্ধান্তের ওপর সন্তুষ্ট থাকা। যেকোনো ধর্মে স্রষ্টায় নিবেদিত মানুষ জীবনের সব ঘাত-প্রতিঘাতে স্রষ্টার প্রতি সমর্পিত হয়। ফলে তাদের মনে কোনো হতাশা বা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় না। ইসলামে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার নির্দিষ্ট রুটিন বা ছক নির্ধারিত আছে। সে ছক অনুসরণ করলে কোনো মানুষের হৃদয়ে বিড়ম্বনা, হতাশা বা উদ্বেগ বাসা বাঁধতে পারে না। ইসলামী জীবনাদর্শ মানুষের অবাধ মেলামেশা, নগ্নতা, অনৈতিক জীবনাচরণ, মাদকতা, সমকামিতা ও বহুগামিতা থেকে বিরত রাখে। যে কারণে ইসলামী জীবনাদর্শের আলোকে জীবন যাপনে অভ্যস্ত ব্যক্তি দুরারোগ্য অনেক রোগব্যাধি, মানসিক হতাশা ও আল্লাহপাকের দেয়া মহামারী থেকে রক্ষা পায়।
আল্লাহপাক সর্বশ্রেষ্ঠ স্রষ্টা। তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ। সে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব জাতিকে বসবাসের জন্য তিনি এই পৃথিবী সৃজন করেছেন। মানুষের জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে পৃথিবীর সব উপাদান ভোগ করা বৈধ। তবে জেনে রাখা প্রয়োজন যে, এ পৃথিবীতে সব প্রাণী ও জীবজন্তুর বসবাসের জন্য আল্লাহপাক উপযোগী পরিবেশ তৈরি করেছেন। মানুষ যদি অন্য প্রাণিকুলকে ধ্বংস করে কেবল একাই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে চায়, সে ক্ষেত্রে আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে আজাব বা গজব আসাই স্বাভাবিক। সাম্প্রতিক সময়ে আমাজন ও অস্ট্রেলিয়ার বনভূমিতে কৃত্রিম দাবানল তৈরি করে শত শত কোটি বৃক্ষ, তরুলতা ও জীবজন্তুর প্রাণনাশ করা হয়েছে। এসব প্রাণীর আহাজারি আর কেউ না শুনলেও আল্লাহপাক ঠিকই শুনেছেন। হাজার হাজার বর্গমাইলের বনভূমি ভস্মীভূত হওয়ায় যে ব্যাপক পরিমাণ কার্বন বায়ুমন্ডলে মিশ্রিত হয়েছে, তা সমগ্র পৃথিবীর বায়ুমন্ডলকে প্রভাবিত করেছে। শিল্প-কলকারখানা মানবসভ্যতার অগ্রগতির অন্যতম উপাদান। তবে শিল্প-কলকারখানার বর্জ্য শোধন করে তা যত দূর সম্ভব কার্বনমুক্ত করা শিল্প উদ্যোক্তাদের একান্ত কর্তব্য। পরিবেশ বিজ্ঞানী ও বোদ্ধা মহল অনেক আগে থেকে এ বিষয়ে বিশ^ বিবেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। মহানবী সা: পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য বনায়নের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। সবশেষে বলা যায়, আল্লাহপাক কালামে মাজিদে বলেছেন, ‘জলে ও স্থলে যত বিপর্যয় তা মানুষের হস্তার্জিত পাপের ফসল।’ সময় এসেছে সতর্ক হওয়ার। সময় এসেছে আত্মোপলব্ধির। সময় এসেছে পাপাচার থেকে প্রত্যাবর্তন করার।
পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন, মাদক ও ধূমপানমুক্ত পরিবেশ, বনায়ন, শালীনতা ও স্রষ্টায় নিবেদিত হওয়াই বর্তমান করোনা মহামারী থেকে মানবজাতির মুক্তির একমাত্র পথ। হ


আরো সংবাদ



premium cement