২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

এক অঙ্কের সুদের হার ও ব্যাংক খাত

-

আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসঙ্ঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ এর মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে বর্তমান সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। এ লক্ষ্য অর্জনে সরকারের নীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে দেশের অর্থনীতির সাথে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থনীতির বিকাশ ও উন্নয়নের বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন করে কাজ করে চলেছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যাংক খাতের মজবুতি, টেকসই বিনিয়োগ ও অর্থের প্রবাহ ব্যাপক অবদান রাখতে পারে।
১,৪৭,৫৭০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছোট এ দেশটিতে প্রায় ১৭ কোটি মানুষের বাস। এই বিপুল জনসংখ্যার জন্য লাগে ১৭ কোটি বালিশ, পায়ের জুতা লাগে একজনের কমপক্ষে দু’জোড়া করে হলেও ৩৪ কোটি জোড়া জুতা। শুধু জুতা আর বালিশ তৈরির পেছনে ব্যাপক শ্রমিক, কাঁচামালসহ অনেক সেক্টর জড়িত। অর্থনীতির প্রত্যেক সেক্টর ঠিকভাবে সচল থাকলে টেকসই উন্নয়নের দিকে দেশ ধাবিত হয়। এ বিশাল জনসংখ্যা এ দেশের জন্য একটি বড় শক্তি, যদি একে সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়। তাই এ দেশ ছোট হলেও বহুজাতিক অনেক কোম্পানি এ দেশে ব্যবসার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে। কিছু দিন আগে বিশ^বিখ্যাত কোমল পানীয় ব্র্যান্ড কোকা-কোলার চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জেমস্ কোয়েনসি বাংলাদেশে সফরে এসেই ঢাকার একটি পাঁচতারকা হোটেলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে নতুন বিনিয়োগের ঘোষণা দেন। ১৯৬৫ সালে বাংলাদেশে আসে কোকা-কোলা। অবশ্য গ্লোবাল সিইও এই প্রথম এলেন। তিনি আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশে এক হাজার ৭০০ কোটি টাকার বিনিয়োগের ঘোষণা দিলেন। জনাব জেমস্ বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ একটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশ। দীর্ঘ মেয়াদে এ দেশে ব্যবসায় সম্ভাবনা বিপুল। আমাদের জন্য বাংলাদেশ শীর্ষ ৪০টি দেশের একটি।’ ব্যাপক জনসংখ্যা, ব্যাপক চাহিদার কারণে এ দেশে কোমল পানীয়ের বাজারের আকার তিন হাজার কোটি টাকার মতো। মাথাপিছু কোমল পানীয় গ্রহণের হার বছরে ১২ লিটার, যা ভারতে ১৮ লিটার। এটা শুধু একটি প্রোডাক্টের কথা বলা হলো। এভাবে এ দেশের হাজারও পণ্যের চাহিদা জোগানের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড আবর্তিত হচ্ছে। এসব কর্মকান্ডের পেছনে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর গুরুত্বপূর্ণ সহযোগিতা রয়েছে। তাই দেশের আর্থিক খাত যত মজবুত ও টেকসই হবে ততই ব্যবসাবাণিজ্যে ব্যাপক উন্নয়ন সম্ভব হবে। আমাদের চার পাশের যখন আথর্-সামাজিক উন্নয়ন হয় তখন ব্যবসাবাণিজ্যেরও টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হয়। আমরা জানি, ব্যবসায় উন্নয়নের সাথে ব্যাংক খাত জড়িত। কিন্তু বর্তমানে এ খাতের পরিস্থিতি খুব একটি ভালো যাচ্ছে না। ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে দেশের সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে অসাধু ঋণ গ্রহীতারা। বর্তমানে এক দশকের বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আছে। এ সময় অর্থনীতির সাফল্য যথেষ্ট। বিশেষ করে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ও অনেক সামাজিক সূচক এগিয়েছে। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে পুরো আর্থিক খাতের চিত্রটি ছিল উল্টো। নানা আর্থিক কেলেঙ্কারি, অর্থ আত্মসাৎ, খেলাপি ঋণের ব্যাপক বৃদ্ধিসহ এ ধরনের খবরের তালিকা যথেষ্ট লম্বা। এ সবের মধ্যে সরকার ব্যাংক সুদের হার নয়-ছয় পদ্ধতি অনুসরণ করছে। চলতি এপ্রিল থেকে ঋণের ওপর সুদের হার ৯ শতাংশ পর্যন্ত বেঁধে দেয়া হয়েছে। আর ফেব্রুয়ারি মাস থেকে আমানতের ওপর সুদের হার ৬ শতাংশ নির্ধারণ করেছে ব্যাংকগুলো। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পড়েছে সঙ্কটে। এই মুহূর্তে দেশে বিরাজমান আমানতের পরিমাণ হলো ১১ লাখ ৩৬ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকা। এ আমানতের ওপর গড়ে ৬ শতাংশ (১২-৬) সুদ কম দিলে আমানতকারীরা মোট ৬৮ হাজার ২১৮ কোটি টাকা কম সুদ পাবেন। এতে সরকার বিপুল অঙ্কের রাজস্ব হারাতে পারে। অন্য দিকে বর্তমানে পুরো ব্যাংকিং খাতে চলতি ঋণের পরিমাণ হলো ১২ লাখ ৮৮ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। ঋণ গ্রহীতারা ৯ শতাংশ সুদ দাবি করলে সরল হিসাবে প্রতি বছরে ব্যাংকগুলোকে প্রায় এক লাখ ৯৩ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হবে।
সুদের হার কমানোর বিষয়ে কারো দ্বিমত থাকতে পারে না। এটা সরকারের একটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এটি জোর করে করা ঠিক নয়। জোর করে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নিলে সংশ্লিষ্ট খাতের ক্ষতি হবে। এতে খেলাপি ঋণ কমা সম্ভব নয়। সরকার বাজার অর্থনীতিতে বিশ^াসী। কিন্তু কার্যত দেখা যাচ্ছে এর বিপরীতে অবস্থান নিচ্ছে। ব্যাংকগুলো তার গ্রাহক থেকে আমানত সংগ্রহ করে সে আমানত বিনিয়োগ করে যে আয় করে তা থেকে তাদের ব্যয় মিটিয়ে লাভ করে থাকে। এখন আমানতের সুদের হার ৬ শতাংশ করার ফলে মুদ্রাস্ফীতি সব খেয়ে ফেলবে। এর বাইরে ব্যাংকের মাশুল, কর আছে। ফলে গ্রাহকের আমানতের ওপর যে সুদ তা কমে আসবে। গ্রাহক তার আমানতের সুদ কম পেলে ব্যাংকে টাকা রাখতে নিরুৎসাহিত হতে পারে। ব্যাংক টাকা না পেলে ঋণ দেবে কিভাবে? ফলে ৯ শতাংশ সুদ তো পরের কথা, ব্যাংকের ঋণ বিতরণের সক্ষমতা কমে আসবে। উৎপাদনশীল খাতগুলোতে স্থাবিরতা দেখা দিতে পারে। বেকারত্ব বেড়ে যেতে পারে। মানুষ বেশি লাভ পাওয়ার আশায় সময়বায়, এমএলএম কোম্পানিতে ও গোপনে গড়ে ওঠা বিভিন্ন গ্রুপে অর্থ জমা রাখতে পারে। ১০ শতাংশ বা তার বেশি সুদে টাকা নিয়ে তা বিদেশে পাচার করতে পারে। এসএমই ও রিটেইল খাতে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়া হলে এ খাতগুলো থমকে যাবে। অনেকে বেকার হয়ে পড়বে, নতুন কর্মসংস্থান কমে যাবে। পত্রিকার রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ১০টি ব্যাংকের এক আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে ব্যাংকগুলোর ৭৫ শতাংশের বেশি আয় আসে সুদ বাবদ। বছরের বিভিন্ন সময়ে এসব ব্যাংকের সুদ আয় বাড়লেও অন্যান্য আয় তেমন বাড়েনি। ব্যাংক তার বিভিন্ন সেবা প্রদান থেকে যে আয় করে তারও মাশুল কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারণ করে দিয়েছে। ফলে ইচ্ছা করলেই ব্যাংকগুলো মাশুল বাড়াতে পারবে না। ফলে সুদ ছাড়াও অন্যান্য সেবা থেকে যে আয় করার পথ ছিল তাও প্রায় রুদ্ধ হয়ে যাবে। এপ্রিল থেকে নতুন সুদের হার কার্যকর হলে ব্যাংকগুলোর আয় অনেক কমে যেতে পারে। ঋণ প্রদানের সক্ষমতাও কমে যাবে। ব্যাংকগুলো তাদের সিএসআর খাতেও ব্যয় কমিয়ে ফেলবে। ফলে শিক্ষা স্বাস্থ্য খাতে এর নেতিবাচক প্রভাব দেখা দেবে।
লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক
main706@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
সোনাহাট স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করলেন ভুটানের রাজা জাতীয় দলে যোগ দিয়েছেন সাকিব, বললেন কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই কারওয়ান বাজার থেকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে ডিএনসিসির আঞ্চলিক কার্যালয় এলডিসি থেকে উত্তরণের পর সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে কার্যকর পদক্ষেপ নিন : প্রধানমন্ত্রী নারায়ণগঞ্জ জেলার শ্রেষ্ঠ ওসি আহসান উল্লাহ ‘ট্রি অব পিস’ পুরস্কার বিষয়ে ইউনূস সেন্টারের বিবৃতি আনোয়ারায় বর্তমান স্বামীর হাতে সাবেক স্বামী খুন, গ্রেফতার ৩ ফতুল্লা প্রেস ক্লাবের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত বদরের শিক্ষায় ন্যায়-ইনসাফের সমাজ প্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে : সেলিম উদ্দিন ইসলামের বিজয়ই বদরের মূল চেতনা : ছাত্রশিবির পরিবেশ দূষণে বাংলাদেশে বছরে ২ লাখ ৭২ হাজার মানুষের মৃত্যু : বিশ্বব্যাংক

সকল