১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

করোনাভাইরাসে মহামন্দায় গোটা বিশ্ব

-

করোনাভাইরাসের আয়ুষ্কাল চার মাস চলছে। এরই মধ্যে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের আকস্মিক মহামারী থেকে বিশ্ব অর্থনৈতিক ক্ষতি সামলাতে বহু বছর লেগে যেতে পারে। এ কথা বলেছে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা ওইসিডি। ওইসিডির মহাপরিচালক এঞ্জেল গুরিয়া বিবিসিকে বলেছেন, কেউ যদি ভাবে দেশগুলো দ্রুত তাদের অর্থনৈতিক ক্ষতি সামলে উঠতে পারবে, তাহলে সেটা হবে ‘স্তোক বাক্য।’ ওইসিডি সরকারগুলোর কাছে আহ্বান জানিয়েছে, তারা যেন তাদের ব্যয়নীতি ভুলে গিয়ে দ্রুত ভাইরাস পরীক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করে এবং ভাইরাসের চিকিৎসার পেছনে মনোযোগ দেয়।
করোনাভাইরাস গুরুতর আকারে ছড়িয়ে পড়লে বিশ্বব্যাপী প্রবৃদ্ধির হার অর্ধেক কমে তা ১ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়াবে বলে সম্প্রতি যে হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছিল, গুরিয়া বলেছেন তাও এখন খুবই আশাবাদী একটা পূর্বাভাস বলেই মনে হচ্ছে। গুরিয়া বলেছেন, কত মানুষ চাকরি হারিয়েছেন এবং কোম্পানিগুলোর কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা এখনো স্পষ্ট নয়। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে, বিভিন্ন দেশের জন্য এই ক্ষতি সামাল দিতে ‘বেশ অনেক বছর লেগে যাবে। তিনি বলেছেন, আগামী কয়েক মাসে বিশ্বের বড় বড় অর্থনীতির দেশগুলোতে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেবে এবং আর্থিক ক্যালেন্ডারের পরপর দু’টি কোয়ার্টার ধরে এ মন্দা চলতে থাকবে। বিশ্বব্যাপী মন্দা যদি নাও হয়, তার পরও বিশ্বের অনেক দেশে একেবারেই কোনো প্রবৃদ্ধি হবে না অথবা কোনো কোনো দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার হবে নিম্নমুখী। এসব দেশের মধ্যে বড় বড় অর্থনীতির দেশও থাকবে। ফলে সার্বিকভাবে এ বছর প্রবৃদ্ধি হবে নিম্নমুখী এবং প্রবৃদ্ধির পূর্ব অবস্থায় ফিরে আসতে সময় লাগবে।
গুরিয়া বলেছেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় যে বিরাট অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে তা আমেরিকায় ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলা-পরবর্তী বা ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সঙ্কটের পর অর্থবাজারে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল এবারের আঘাত তার চেয়েও ভয়াবহ। তিনি বলেছেন, এর কারণ হলোÑ এই প্রাদুর্ভাবের ফলে যে বেকারত্ব তৈরি হবে তা সামাল দেয়া কতটা কঠিন হবে আমরা তা জানি না। আসলে যে কত লোক বেকার হবেন, সেটাই এখনো স্পষ্ট নয়। আমাদের কাছে এটাও জানা নেই যে, ছোট ও মাঝারি কত লাখ লাখ প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা ইতোমধ্যেই ক্ষতির মুখে পড়েছে। বিভিন্ন দেশের সরকার ইতোমধ্যেই কর্মী ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সাহায্য করতে নজিরবিহীন নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। যুক্তরাজ্যের নীতিনির্ধারকরা ঘোষণা করেছেন, করোনা মহামারীর কারণে যারা কাজে যেতে পারছেন না সরকার তাদের বেতনের একটা বড় অঙ্ক সরকারি কোষাগার থেকে দেবে। সরকারগুলোর প্রতি গুরিয়া আহ্বান জানিয়েছেন, অর্থঋণ নেয়ার তাদের যেসব নীতিমালা আছে, সব ছুড়ে ফেলে দিন এবং এই সঙ্কট মোকাবেলা করুন।
করোনা সঙ্কটে বিশ্ব অর্থনীতি আজ যেমন মহামন্দার মুখে বাংলাদেশেও তার ধাক্কা লাগবে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ক্ষতির পরিমাণ ৩০২ কোটি ডলার, টাকার অংকে যা দাঁড়াবে ২৪ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা। মন্দা প্রলম্বিত হলে ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। এ অবস্থায় অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বাংলাদেশের সরকার চার ধাপে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলেও জানান। অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলায় নানা খাতে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মন্দা প্রলম্বিত হলে ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি জানিয়েছেন, সঙ্কট মোকাবেলায় সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি, আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ প্রদান, সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি এবং মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা হবে। এ দিন তিনি বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পের জন্য চার ধরনের আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। সেগুলো হলোÑ ১. বৃহৎ শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে ৯ শতাংশ সুদের হারে ৩০ হাজার কোটি টাকার ঋণসুবিধা। এই ঋণের ৪ দশমিক ৫ শতাংশ সুদ শিল্পমালিক দেবেন এবং বাকিটা সরকার ভর্তুকি হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে পরিশোধ করবে। ২. মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পের ওয়ার্কিং হিসেবে ৯ শতাংশ সুদের হারে ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণসুবিধা। এই ঋণের চার শতাংশ সুদ শিল্পমালিক দেবেন এবং বাকি পাঁচ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে ব্যাংককে পরিশোধ করবে। ৩. বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবর্তিত ইউডিএফ ফান্ডের সুবিধা বাড়ানো হবে। ১৫০ কোটি ডলার যুক্ত করে ইউডিএফ তহবিলের মোট আকার হবে ৫০০ কোটি ডলার। ৪. এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক ৭ শতাংশ সুদে পাঁচ হাজার কোটি টাকার নতুন ঋণসুবিধা চালু করবে। বাংলাদেশে ৮ মার্চ ২০২০ প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে।
বাংলাদেশে প্রভাবশালী গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ বা সিপিডি শঙ্কা ব্যক্ত করে বলেছে, বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার নেতিবাচক প্রভাবে বাংলাদেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা, সামগ্রিক জীবনযাত্রা, জীবন-জীবিকা, দ্রব্যমূল্য, অতি সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থানের সাথে সাথে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের কর্মকাণ্ডসহ বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে বড় মাত্রায় ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। প্রবাসীদের ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থান এবং রেমিট্যান্স ও রফতানির ওপর বড় মাত্রায় ঝুঁকির সৃষ্টি হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরো হতে পারে। পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ওপরও করোনা আরো বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করে সিপিডি। সম্প্রতি একটি ভার্চুয়াল মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এক দীর্ঘ প্রতিবেদনে বলা হয়েছেÑ করোনাভাইরাসের প্রভাবে ২০২০ সালে বাংলাদেশের এক লাখ কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি এবং একই সাথে প্রবৃদ্ধি হ্রাসের শঙ্কা রয়েছে। ভার্চুয়াল মিডিয়া ব্রিফিংয়ে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন রাজস্ব আয় প্রবৃদ্ধি, খাদ্য নিরাপত্তা, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, আমদানি-রফতানি হ্রাস, প্রবাসীদের আয় ও জনশক্তি রফতানিতে বড় ধরনের অনিশ্চয়তাসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক খাতে নেতিবাচক প্রভাবের কথা উল্লেখ করেছেন।
মহামারী রূপ নেয়া নভেল করোনাভাইরাসের সঙ্কট মোকাবেলায় বাংলাদেশকে জরুরি ভিত্তিতে ১০ কোটি ডলার সহায়তা দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। বাংলাদেশের মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ৮৬০ কোটি টাকা। ৪ এপ্রিল ২০২০, বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিস থেকে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ও সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেছেনÑ প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজটি সার্বিকভাবে একটি কাক্সিক্ষত পদক্ষেপ। প্রণোদনার যথাযথ ব্যবহার করতে হবে, দুর্নীতি যাতে না হয় সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। তারল্য সঙ্কটে ব্যাংক। তা হলে কিভাবে তারা ঋণ দেবে তাও ভেবে দেখা উচিত। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement