২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`
বিজয়ের স্মরণে

একাত্তরের সেনাছাউনিতে এক প্রহর

-

মওলানা ভাসানীর ‘জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো’ সেøাগানের পর থেকেই দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো টিমটিম করে চলছিল। ’৭১-এর ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে, ‘আজ থেকে কোর্ট-কাচারি, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট, অফিস, আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। কোনো কর্মচারী অফিসে যাবেন না। এ আমার নির্দেশ। গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, তার জন্য রিকশা চলবে, ট্রেন চলবে আর সব চলবে।’
এ ঘোষণার সাথে সাথে দপ করে বন্ধ হয়ে যায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আমার নতুন শিক্ষকতার চাকরিও অচল হয়ে পড়ে। চাকরি অচল হলেও বেতন ছিল সচল। এ জন্য সপ্তাহে একবার কর্মস্থলে গিয়ে হাজিরা খাতাসহ বেতনের জন্য মাস্টাররোল ঠিক করে আসতাম। বেতন উত্তোলন করতাম পোস্ট অফিস থেকে। প্রতি মাসের ৭-৮ তারিখে বেতন আনতে যেতাম পোস্ট অফিসে। নারায়ণগঞ্জ ঢাকেশ্বরী এলাকায় পোস্ট অফিস। সোনারগাঁওয়ের বৈদ্যেরবাজার থেকে আসা-যাওয়ার পথে পাকিস্তানি সেনাদের সাথে একেবারেই যে দেখা হয় না তা নয়। কখনো কখনো ওদের সাথে একই স্কুটারে পাশাপাশি বসে চলাচলও করছি। ভয় পাইনি। কারণ আমার সাথে রয়েছে ছবিসহ শিক্ষকতার পরিচয়পত্র। সেনারা যে সরকারের লোক, আমিও সে সরকারের লোক। বাড়িতে বসে মুক্তিযুদ্ধের খোঁজখবর নেয়া, স্বাধীন বাংলা বেতারে চরমপত্র শ্রবণ, মাসে মাসে বেতন তুলে আনাসহ সদ্য বিয়ে করা বউয়ের সাথে লুকোচুরির রোমাঞ্চকর দিনগুলো মন্দ কাটছিল না।
তারিখটা ঠিক মনে না থাকলেও সময়টা মনে আছে। তখন ছিল বর্ষাকাল। রুটিন মোতাবেক সকাল ৮টার দিকে বৈদ্যেরবাজার ঘাটে পৌঁছি। ২০২০ সালের আর ১৯৭১ সালের বৈদ্যেরবাজার এক নয়। বর্তমান মেঘনা নদীর যেখানে পূর্বপাড় সেখানে ছিল থানাভবন। এর সামনে পাকা সড়ক (এশিয়ার প্রাচীন ও দীর্ঘতম গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড)। সড়কের দক্ষিণে ডাকবাংলো। থানার পূর্ব দিকে কাঁচা সড়কটি বৈদ্যেরবাজার এনএ মেমোরিয়াল (বর্তমান পাইলট হাইস্কুল) পর্যন্ত গেছে। থানা বরাবর কাঁচা সড়কের লাগোয়া ডাকঘর। ঝোপঝাড়ের পাশে নির্জন স্থানে, ডাকঘরটির দিকে তাকালেই কবিগুরুর ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পের রতনের কথা মনে পড়ত। থানার পশ্চিম দিকে। খালের ওপর কালভার্ট। কালভার্ট পার হয়ে বৈদ্যেরবাজার। বাজারের মাঝখান দিয়ে পূর্ব-পশ্চিম বরাবর ট্রাঙ্ক রোড। এটি সংস্কার করায় দু’পাশ থেকে রাস্তার উচ্চতা এক-দেড় ফুট বেশি। রাস্তার দু’পাশে ভাসমান দোকানপাট। তার পরই সারি সারি স্থায়ী দোকানঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। বাজারের পশ্চিম দিকে রাস্তার দু’পাশে কয়েকটি টেইলারিং শপ। আর দক্ষিণে নাল জমি। এই নাল জমির পরই নদী ত্রিবেনী বা মেনিখালির গাঙ, যা মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্রের সাথে সংযোগ স্থাপন করেছে। বর্ষায় মেঘনা, মেনিখালি ও নাল জমি পানিতে সয়লাব। জমি তলিয়ে পানি চলে আসে বাজারের গোড়ায়। নদীপথের নৌকাগুলো টেইলারিং শপ বরাবর দক্ষিণ পাশে অবস্থান করত। এনএ মেমোরিয়ালের ছাত্র হিসেবে বাজারের অনেকেই পরিচিত। বিশেষ করে টেইলার তালেব হোসেন আমার ফুফাতো ভাই। তিনি ‘তালেব খলিফা’ নামেই সমধিক পরিচিত। তার টেইলারিং শপ বরাবর উত্তর দিকে হামিদ খলিফার টেইলারিং শপ। হামিদ খলিফার বাবা পুলিশের লোক। সে চাকরিতে পশ্চিম পাকিস্তানে থাকার কারণে পরিবারের সবাই উর্দু বলতে পারে। হামিদ খলিফার ভাই শাহাদাৎ হোসেন আমার স্কুলটিচার। ক্লাসের ফার্স্টবয় হিসেবে হামিদ ভাইও আমাকে স্নেহ করতেন।
পাক সেনারা কয়েক দিন আগে বৈদ্যেরবাজার ছাউনি ফেলেছে। আশ্রয় নিয়েছে ডাকবাংলোয়। সংবাদ প্রচারিত হয় যে, অন্যান্য সীমান্ত এলাকার চেয়ে কসবা ও আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে ভারতের আগরতলা প্রবেশ অধিক নিরাপদ। বৈদ্যেরবাজার ঘাট থেকে সরাসরি কসবা ও আখাউড়ার প্রত্যন্ত এলাকা প্রায় হানাদারমুক্ত। মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেনিং নেয়ার উদ্দেশ্যে বৈদ্যের বাজার থেকে নৌপথে হোমনা-রামচন্দ্রপুর হয়ে কসবা কিংবা আখাউড়া সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় আত্মগোপন করে থাকত। আত্মগোপনে থেকে সুবিধাজনক সময়ে বর্ডার অতিক্রম করে সোজা আগরতলা। নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জ এলাকার বেশির ভাগ মুক্তিযোদ্ধা ভারতে প্রবেশের জন্য এই নৌপথটিই বেশি ব্যবহার করত বলেই সেনারা বৈদ্যেরবাজার ডাকবাংলোয় আশ্রয় নেয়। মূল লক্ষ্য, এলাকার নিয়ন্ত্রণসহ নৌপথে আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে আগরতলা যাওয়া ঠেকানো। এই সেনাদের কেউ বাইরে বের হয় না বললেই চলে। ডাকবাংলোর ঘাটে জলপাই কালারের স্পিডবোট এবং সামনের রাস্তায় জিপগাড়ি। এ দুই প্রকার যান নিয়ে সেনারা বাইরে চলাচল করে। ডাকবাংলোর চার দিকে বালুর বস্তার স্তূপের আড়ালে বসে রাইফেল তাক করে বাইরে নজর রাখে। বিশেষ করে মেঘনা ত্রিবেনী দিয়ে চলাচলকারী কোনো নৌকা দেখে সন্দেহ হলেই পাড়ে ভিড়িয়ে তল্লাশি করে। বিনা কারণে কালভার্টের পশ্চিম পাড়েও আসে না তাদের কেউ। এই পথে সপ্তাহে দু’বার করে আসা-যাওয়াকালে বাজার এলাকায় এক দিনও ওদের দেখা মেলেনি।
ঘটনার দিন সকালে নৌকা থেকে নেমেই দেখি, অবস্থা গরম। পাকিস্তানি সেনায় বাজার ভর্তি। আরো কয়েক গাড়ি পাক সেনা এসেছে। এক সাথে এত সেনা আসার কারণ কেউ বলতে পারছে না। তালেব ভাইয়ের দোকানে বসে ওদের দেখছিলাম। অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে সেনাদের দিকে বারবার তাকাতে দেখে তিনি ধমক দিয়ে বলেন, ‘ও দিকে তাকিয়ে কী দেখছিস, কাজ না থাকলে নৌকায় গিয়ে বসে থাক, সোজা বাড়ি চলে যা।’ ‘আমি বাড়ি থেকেই এসেছি, স্কুলে যাবো’ বলে চুপচাপ বসে পাক সেনাদের দেখছি। সেনারা কাঁধে এবং হাতে হালকা ও ভারী অস্ত্রশস্ত্রসহ মার্চ করতে করতে ট্রাঙ্ক রোড ধরে পশ্চিম দিকে রওনা করেছে। এর মিনিট দশেক পর স্কুটারের কাছে আসি। তখন বৈদ্যেরবাজার থেকে তারাব ঘাট পর্যন্ত স্কুটার চলাচল করত। বৈদ্যেরবাজার থেকে মদনপুর ভাড়া চার আনা। হবে না কেন! আমার মাসিক বেতন ছিল ৬০ টাকা এবং ২০ শতাংশ মহার্ঘভাতাসহ ৭২ টাকা। মদনপুরের উদ্দেশে স্কুটারে উঠে রওনা হওয়ার কয়েক মিনিট পরই গতি কমে যায়। কারণ সামনেই মার্চরত সেনাবহরকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সাধ্য ও সাহস কারো নেইÑ বিধায় সেনাদের হাঁটার সমান গতিতে মোগড়াপাড়া চৌরাস্তা পর্যন্ত আসতে হলো। চৌরাস্তায় এসে সেনাবহর যায় কাইক্কারটেকের দিকে, আর আমাদের স্কুটার হাইওয়ে ধরে মোড় ঘুরে উত্তর দিকে। স্কুলের কাজ শেষ করে বৈদ্যেরবাজার ফিরে আসি দুপুর ২টার দিকে। পরিবেশ থমথমে। যার দিকে তাকাই তার মুখেই আতঙ্ক। সবার চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ দেখে কারণ জানার চেষ্টা করি। খোঁজখবর নিয়ে যা জানতে পারি, বৈদ্যেরবাজার থেকে মাইল চারেক দূরে কাইক্কারটেক হাট (বিখ্যাত গরুর হাট)। সে হাটের কাছে এক হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা। ওইসব এলাকার লোকজন মুক্তিবাহিনীকে নানাভাবে সাহায্য-সহায়তা করে থাকেন। ওইসব গ্রাম থেকে বেশ কয়েকজন যুবক বর্ডার পার হয়ে ভারত চলে গিয়েছিল। তারা ট্রেনিংসহ অস্ত্রহাতে দেশে প্রবেশ করেছে। পাক সেনাদের ওপর লাঙ্গলবন্দের ব্রিজসহ আশপাশের কয়েকটি হামলা তারাই করেছে বলে নাকি খবর আছে। সে খবরের ওপর ভিত্তি করেই আজকের এই ‘অপারেশন’। হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামটি জ্বালাও-পোড়াও করা ছাড়াও যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই গুলি করেছে। জ্বালাও-পোড়াসহ গোলাগুলি শেষ করে সেনাবহর কিছুক্ষণ আগে ছাউনিতে ফিরেছে। তাই সবার চোখে-মুখে আতঙ্ক। কয়টা গ্রাম পুড়েছে, কতজন মানুষ মেরেছে, মেয়েদের ওপর নির্যাতন হয়েছে কি না এবং এসব করতে গিয়ে সেনারা মুক্তিবাহিনী কর্তৃক বাধা পেয়েছিল কি না, আগ্রহসহকারে খোঁজখবর করছিলাম। দোকানে বসে বসে খোঁজখবর নিতে দেখে তালেব ভাই বিরক্ত হলেন। ‘সাংবাদিকের মতো কী শুরু করেছিস? রঙ দেখছিস ঘুঘু দেখিসনি; বের হ এখান থেকে, বাড়ি যা বলছি।’ বলে ধমকসহ জোর করে ঘর থেকে বের করে দেন। তখন ঘাটে গিয়ে দেখি, নৌকা ছাড়তে তখনো বেশ দেরি। ঘাট থেকে ফিরে একটি দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে পাক সেনাদেরকেই দেখছিলাম।
ভয়ঙ্করেরও একটা রূপ আছে। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘সমুদ্রে সাইক্লোন’ পাঠের আগে ভয়ঙ্করের রূপ সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলাম না। ভয়ঙ্করকে যত কাছে থেকে দেখা যায়, নয়ন ও হৃদয় তত মুগ্ধ হয়ে যায়। ভয়ঙ্কর ও নিষিদ্ধের প্রতি অপ্রতিরোধ্য মোহ এবং অজানাকে জানার অদম্য তাড়না মানুষকে কখনো কখনো হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে ফেলে।
সেই তাড়নাই পেয়ে বসেছিল আমাকে। নজর চলে যায় উদাম গায়ের এক লোকের প্রতি। বয়স চল্লিশ-পঞ্চাশের মাঝামাঝি। মেদহীন, খাপখোলা তলোয়ারের মতো একহারা গড়ন। দুধে আলতায় মেশানো উজ্জ্বল গাত্রবর্ণসহ ছয় ফুট উঁচু লোকটির মাথায় কাঁচা-পাকা কদমছাঁট চুল। বৈদ্যেরবাজার এলাকায় এ রকম লোক আগে দেখেছি! ঠিক মনে করতে পারছি না। স্কুলজীবনে গৌরাঙ্গ নামে আমাদের এক সহপাঠী ছিল। কালভার্টের গোড়ায় ছিল তাদের চায়ের দোকান। গৌরাঙ্গের বাবা-মা দু’জনই দোকান পরিচালনা করতেন। তার বাবা দেখতে অনেকটা এরকম। তবে, গৌরাঙ্গের বাবার বয়স অনেক বেশি। লোকটা গৌরাঙ্গের চাচা হলে মানানসই হয়। অজানা অচেনা লোকটার দিকে তাকিয়ে আমি যখন অর্থহীন যোগ-বিয়োগ করছিলামÑ তখন আমার অজান্তে লোকটিও আমাকে নিয়ে যোগ-বিয়োগ শুরু করেছিল। লোকটি পূর্ব দিকে রওনা হয়ে কিছুদূর গিয়েই থেমে যায়। ফিরে এসে আমার দিকে তাকাতেই দু’জন চোখাচোখি হয়ে গেলাম। চোখাচোখি হতেই ইশারায় কাছে ডাকে। কাছে যেতেই, আমার আপাদমস্তক ভালো করে অবলোকন করার পর, গুরুগম্ভীর কণ্ঠে, Ñ‘তুম্ মুক্তিবাহিনী হ্যায়?’ লোকটির মুখে উর্দু বাতচিত শুনে আমার মাথায় যেন বজ্রপাত হলো। বুঝতে বাকি রইল না যে, আমি এতক্ষণ একজন পাকিস্তানি সেনাকে গভীর মনোযোগসহকারে পর্যবেক্ষণ করেছি। লোকটি আমার প্রতি সামনে বাড়ার ইশারাসহ সরোষে, Ñ হাঁট...। আমি বাক ও চলৎশক্তি রহিত হয়ে যন্ত্রচালিতের মতো হাঁটতে থাকি। কিছুদূর হেঁটে পেছন ফিরে লোকটির দিকে তাকাই। দেখি, সে আমার হাঁটার ধরন পরীক্ষা করছে। আমাকে ইশারায় থামিয়ে আমার খুব কাছে এসে। কাপড় সরিয়ে আমার হাঁটু ও কনুই পরীক্ষা করে দেখেন। শৈশবে খোঁচ-পাচড়া হয়েছিল, এ কারণ হাঁটুতে এবং কনুইয়ের মাথায় কড়ের মতো কালো দাগ ছিল। কলো দাগ দেখে, দৃঢ়ভাবে, ‘তুম্ মুক্তি হ্যায়, হামলোগ তুমকো ছোড়েগা নেহি।’ বলেই আমাকে ক্যাম্পের দিকে নিয়ে যেতে শুরু করে। মুক্তিবাহিনী হিসেবে ক্যাম্পের দিকে নিয়ে যাওয়ার পরিণাম টের পেতে শুরু করেছি। তার আঙুলের ইশারায় রোবটের মতো নড়াচড়া ছাড়া আমার কিছুই করার ছিল না। স্বপ্নচালিতের মতো হাঁটাচলায় কখন যে কালভার্র্ট পার হয়ে থানার সামনে এসে পড়েছি খেয়াল নেই। কয়েক কদম পরই ক্যাম্প। ক্যাম্প নজরে আসতেই মনে পড়ে পরিচয়পত্রের কথা। আমার পকেটে ছবিসহ থানা শিক্ষাকর্মকর্তার সিল-স্বাক্ষরযুক্ত আইডেন্টিটি কার্ড আছে। বিপদের রক্ষাকবজ এ কার্ড। সেনার তীর্যক চাহনি, দুর্বোধ্য ভাষা ও আমার সন্দিগ্ধ কর্মকাণ্ডের কথা মনে করে এতক্ষণ বুদ্ধিবিভ্রাট ঘটেছিল। তাই নিজের ওপর ধিক্কারসহ গলা শুকিয়ে গিয়েছিল আগেই। বোবায় পেয়ে যাওয়ার মতো, কথাও ঠিকভাবে বেরোচ্ছিল না মুখ থেকে। পরিচয়পত্রের কথা মনে পড়ায় বুকে বল পাই। ঢোক গিলে অনেক কষ্টে গলায় পানি সঞ্চয় করে, ‘আই এম অ্যা টিচার, আই হ্যাভ মাই আইডেন্টিটি কার্ড, হিয়ার ইজ দি কার্ড।’ বলেই বুক পকেট থেকে বের করে পাক সেনার হাতে দেই। হাতে নিয়ে একনজর দেখেই ছুড়ে ফেলে দিয়ে, ‘মুক্তি হ্যাজ মেনি ডান্ডি কার্ড, নো ডাউট দ্যাট ইউ আর অ্যা মুক্তি।’ বলেই আমার গর্দানে সজোরে ধাক্কা মারে। তাল সামলাতে না পেরে পড়তে পড়তে সোজা হয়ে যাই। আমাকে ক্যাম্পের দিকে যেতে বাধ্য করা হলো। মরিয়া হয়ে মাটি থেকে ছুড়ে ফেলা কার্ডটি কুড়িয়ে নিলাম।
আমাকে ক্যাম্পের ভেতর দক্ষিণের একটি কামরায় নিয়ে গেল। একপাশে লম্বা একটি বেঞ্চ। ইশারায় আমাকে বেঞ্চে বসতে বলে লোকটি কাপড় চেঞ্জ করতে শুরু করে। আর্মির পরিচ্ছদ চেঞ্জ করতে দেখেই আমার প্রাণপাখি পিঞ্জর থেকে বের হওয়ার জন্য ছটফট শুরু করে দেয়। এ মুহূর্তে আমি আমাকে নিয়ে যা না ভাবি, তা ভাবি মাকে নিয়ে। মা আমার জন্য শুধু কষ্টই করে গেলেন, এক ফোঁটা সুখের মুখ দেখে যেতে পারলেন না। মায়ের কষ্টের শুরু আমার জন্মের পরপরই। আমাকে নিয়ে মায়ের স্বপ্নের কথা মনে পড়তেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ১৯৬২ সালের ঘটনা। কড়া শীতকাল। ঘোরতর কলেরার সময় আমিও আক্রান্ত হয়েছিলাম। ভেদবমি করতে করতে একসময় আমার হাত-পা অসাড় হয়ে পড়াসহ দুই চোয়ালে খিঁচুনি শুরু হয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। জাগতিক সাধ্যের বাইরে চলে যাওয়ায় মা কেবলামুখী হয়ে সিজদায় মাথা ঠেকিয়ে রোদনসহ, ‘হে আল্লাহ, দ্বীন-দুনিয়ার মালিক, তুই এইটা কী করলি? আমার সারা জীবনের একমাত্র সাধনার ধন তুই নিয়ে গেলি? হে মালিকুল মউত, আলা কুল্লি শাইয়িন কাদির, যদি জীবনে কোনো একটা ভালো কাজ করে থাকি, তবে সেই কাজের ফজিলতের বিনিময়ে অভাগা মায়ের নাড়িছেঁড়া ধনকে ফিরিয়ে দিয়ে যা। ইয়া রাব্বুল আলামিন, আমার এ নাড়িছেঁড়া ধন থেকে কামাই খাওয়ার দরকার নেই, শুধু চরণ দর্শন করার জন্য হতভাগীর ছেলেটাকে ফেলে রেখে যা।’ মায়ের এ রকম অস্পষ্ট রোদন কানে নিয়েই কোনো একসময় আমার চেতনা লোপ পায়। যখন চেতনা ফিরে পান, তখন কানে প্রবেশ করে, ‘আসসালাতু খায়রুম মিনান্নাউম’। আজানের ধ্বনি কানে প্রবেশ করতেই, মা তুমি কাঁদছ? মা আমি মরিনি, আমি মরিনি মা। আমার ভীষণ তেষ্টা, পানি দাও।’ আমার কথা শুনে, আমাকে জড়িয়ে ধরে সজোরে হাউমাউ কান্না। মানুষ অতি কষ্টে যে কারণে হাসে, অতি আনন্দে সে কারণেই কাঁদে। সে কথা মনে পড়তেই, ‘সে দিন আজরাইলের হাত থেকে ফিরিয়ে রাখলেও পাক সেনার হাত থেকে বাঁচতে পারলাম না, মা।’ মনে করতেই বুক থেকে দীর্ঘনিঃশ্বাস বের হয়ে আসে। আমাকে সেনাছাউনিতে নিয়ে আসার বিষয় কেউ টের পেয়েছে কি না জানা নেই। যদি কেউ টের না পেয়ে থাকেন, তা হলে মায়ের কষ্ট আরো বেড়ে যাবে। যত দিন বেঁচে থাকবেন ততদিন দরজা বন্ধ করবেন না। বিনিদ্র নয়নে একমাত্র ছেলের প্রতীক্ষায় দরজা খুলে বসে থাকবেন। ভাবতে গিয়েই দরদর করে বেরিয়ে আসা উষ্ণ পানিতে দু’চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। মুখ দিয়ে অস্পষ্টভাবে বের হয়ে আসেÑ ‘মা, মাগো, তোমার কোনো স্বপ্নই পূরণ করতে পারলাম না। তোমার সাথে শেষ দেখা বুঝি আর হলো না। ক্ষমা করে দিও, মা।’
এসব কথা মনে পড়তেই ভেতরের কান্না গুমরে বের হয়ে আসছিল। মাকে নিয়ে যত ভাবনা এর কানাকড়ি ভাবনাও বউকে নিয়ে হয় না। কারণ আমার সদ্য বিয়ে করা বউ এতই অপরিণত যে, ‘বিয়ে’ কাকে বলে সেটাই জানে না। তাই, আমার এ দুর্দিনে ঘুরেফিরে শুধু মায়ের মুখটি সামনে চলে আসে। বাড়ি ফেরার সময় হলেই মা পথের দিকে তাকাতে শুরু করেন। এতক্ষণে মা হয়তো পথপানে তাকাতে শুরু করে দিয়েছেন। যাকে সামনে পান, তার কাছেই আমার কথা জিজ্ঞেস করছেন।
এই হ-য-ব-র-ল চিন্তায় ছেদ পড়ে হামিদ ভাইকে দেখে। যে সেনা আমাকে ধরে এনেছিল, সে তার সাথে হামিদ ভাইয়ের পরিচয়। উর্দু ভাষায় পারদর্শিতার কারণে দোভাষীর কাজও করে থাকেন তিনি। সেই সুবাদে কথা বলতে এসে বেঞ্চে বসা অবস্থায় আমাকে দেখতে পেলেন। বললেন, ‘তুমি এখানে কেনো?’ এতক্ষণ পর হামিদ ভাইয়ের মুখের বাঙলা কথা আমার কর্ণকুহরে মধু বর্ষণ শুরু করে। শরীরে পাই ‘দশ হাতির বল’। বসা থেকে উঠে সেনার দিকে ইঙ্গিত করে, ‘হামিদ ভাই, উনি আমাকে মুক্তিবাহিনী বলে ধরে এনেছে, বিশ্বাস করুন আমি তা নই।’
এ কথা শোনার পর, হামিদ ভাই উর্দু ভাষায় অনেকক্ষণ বাতচিৎ করলেন। কিন্তু কোনো যুক্তিতেই বোঝাতে পারলেন না যে, আমি মুক্তি নই। হামিদ ভাই যতই বোঝাতে চাচ্ছেন আমি একজন ভালো ছাত্র, তাদের স্কুলে ক্লাসের ফার্স্টবয়Ñ সেনাটি ততই বলতে চাচ্ছে, ভালো ছাত্ররাই বেশি করে মুক্তিযুদ্ধে যায়। দু’জনের কথার মাঝখানে, ‘হামিদ ভাই, এখন সরকারি চাকরি করি। আমি একজন স্কুলশিক্ষক।’
‘স্কুলশিক্ষক’ কথা শুনে হামিদ ভাই যেন অন্ধকারে আলো দেখতে পেলেন। তিনি জানতে চান, ‘তোমার পরিচয়পত্র আছে? শিক্ষকতার পরিচয়পত্র?’
‘জি আছে, এই আমার পরিচয়পত্র।’ বলেই হামিদ ভাইয়ের হাতে ওটা দেই। পরিচয়পত্র হাতে নিয়ে ভালো করে দেখেন, দেখে মনে বল পেয়েছিলেন। কার্ড পাক সেনার হাতে তুলে দেন। এরপর উর্দু ভাষায় জোর গলায় সাফাই গাইতে শুরু করেন। বাগ্যুদ্ধে একসময় হার মানে পাক সেনা। বাইরে এসে জানতে পারি, সেনাদের মেজর কর্তৃক আমাকে নিয়ে যাওয়ার খবরটা তালেব ভাই জানতে পারেন। তিনি-ই কৌশলে হামিদ ভাইকে আর্মি ক্যাম্পে পাঠিয়েছিলেন। হামিদ ভাই কাপড় মাপার অজুহাতে আমাকে ছাড়িয়ে আনার উদ্দেশেই ওখানে গিয়েছিলেন। সন্দিগ্ধ যুবকদের ইন্টারোগেশনের নামে রাতেই ঢাকা পাঠিয়ে দেয়া হয়। হামিদ ভাইদের অজ্ঞাতে যাদেরই ঢাকা পাঠিয়েছে, তাদের একজনও ফিরে আসেনি।
যখন বাড়ি পৌঁছি তখন রাত ৮টা। মা ঘরে নেই। খুঁজতে খুঁজতে মাকে পাই গায়ে ভেজা কাপড় জড়ানো অবস্থায়। জানতে চাই, ‘কী হয়েছে মায়ের?’ কারণ হিসেবে জানা যায়, মায়ের সারা শরীর জ্বালাপোড়া শুরু করে দিয়েছিল। পাখার বাতাসে নিবারণ না হওয়ায় কলতলা নিয়ে শরীরে ঠাণ্ডা পানি ঢালা হয়েছে। আমাকে দেখে, ‘বাজান, বল তোর কী হয়েছিল? তুই এতক্ষণ কোথায় ছিলি? Ñ (মায়ের ঘন ঘন প্রশ্নবাণে) মা, দেখো আমি তোমার সামনেই আছি। ভালো আছি। তোমার কী হয়েছে, মা? Ñ কী হয়েছিল জানি না। জোহরের সময় থেকে, শরীর জ্বালাপোড়াসহ বুকের ভেতর কেমন যেন তোলপাড় শুরু হয়, বলতে পারছি না। জানতে চাই, ‘এখন কেমন লাগছে?’
পানি ঢালতে ঢালতে আছরের পর থেকে সে জ্বালা কমতে শুরু করে। হ
লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক


আরো সংবাদ



premium cement

সকল