১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সংস্কারাচ্ছন্ন বাঙালির নির্দয় হৃদয়

অন্য দৃষ্টি
-

টাঙ্গাইলের সখিপুরে একই পরিবারের পাঁচজনের করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হলে প্রতিবেশীরা তাদের প্রতি ঘৃণা ছড়িয়ে দেয়। তাদের গ্রাম থেকে বের করে দিতে চাপাচাপি করতে থাকে বিবেকবর্জিত লোকদের একটি পক্ষ। ওই লোকেরা সংখ্যায় কম নয়। প্রচারণা চালানোর মাধ্যমে জনগণের একটা অংশকে বিক্ষুব্ধ করে নিষ্ঠুরতা দেখানোয় পারঙ্গম তারা। নভেল করোনার আগমনের মাধ্যমে এ দেশের মানুষের বিশাল একটা অংশের কুসংস্কারাচ্ছন্ন অন্ধকার বর্বর চরিত্রই উৎকটভাবে প্রকাশ হচ্ছে।
করোনার হটস্পট নারায়ণগঞ্জের এক নারী চিকিৎসকের ওপর স্থানীয় বেশ কিছু লোক অমানবিক আচরণ করেছে। শুরু থেকে করোনা চিকিৎসায় সামনের সারিতে কাজ করছিলেন ওই ডাক্তার। তার পরিবারের ১৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গেল, সবাই করোনায় আক্রান্ত। তবে ওই ডাক্তার আর তার স্বামী করোনায় আক্রান্ত নন। প্রতিবেশীরা বাড়িটির ওপর হামলার পাঁয়তারা শুরু করে এবং উৎপাত করতে থাকে। তাদের বাড়ি থেকে বের করার দাবি উত্থাপন করে। এরা বেমালুম ভুলে যায়, এই ডাক্তার নিজে করোনা রোগীদের শুরু থেকে চিকিৎসা দিয়ে আসছেন। একজন নারী হয়ে দায়িত্ব পালনে কোনো ধরনের অবহেলা তিনি করেননি। সে জন্য পাড়া প্রতিবেশী এবং নারায়ণগঞ্জবাসীর পক্ষ তিনি যখন সহানুভূতি পাওয়ার কথা, তখন অকৃতজ্ঞ এলাকাবাসী ওই ডাক্তারের পরিবারের সদস্যরা যখন রোগাক্রান্ত হলেন তখন তাদের ওপর হামলায় উদ্ধত হলো। বিবেকহীন এসব মানুষ এটা চিন্তা করতে রাজি নয় যে, করোনা আক্রান্ত অসহায় এই রোগীরা এখন কোথায় যাবেন। চিকিৎসাসেবা দেয়ার পরও যদি ডাক্তার ও তার পরিবার স্থানীয় মানুষের কাছে সহানুভূতি না পান, পৃথিবীর অন্য কেনো একটি জায়গা কি এমন আছে যেখানে তারা আশ্রয় পেতে পারেন? বাড়িতে নিরাপদে আলাদা হয়ে থাকার চেয়ে গোপনে জায়গায় জায়গা ঘুরে বেড়ালে তাতে তো ঝুঁকি আরো বেশি। এই বিবেকবর্জিত লোকেরা কি এটা ভাবছে, অসংখ্য মানুষের মধ্যে এটা যদি ছড়ায় তা হলে তারাও নিরাপদ থাকবে না?
করোনা এক রহস্যময় ভাইরাস। হাসপাতালে কাজ করেছেন ডাক্তার। তিনি নিজে আক্রান্ত হননি। তার স্বামীও এতে আক্রান্ত নন। আক্রান্ত হয়েছেন পরিবারের অন্য সব সদস্য। এতে এটাও প্রমাণিত হয়, কেবল সংক্রমিত মানুষের সংস্পর্শ বিপজ্জনক। শুধু তা-ই নয়, অন্য অনেক মাধ্যমেও এটি ছড়াতে পারে। তরিতরকারি, কাঁচা মাছ, গোশত, অন্যান্য পণ্যদ্রব্য ও বাতাসের মাধ্যমে এটি মানুষের দেহে প্রবেশ করতে পারে। একজন মানুষ নিজে আক্রান্ত হবেন না, তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। ওই সব মানুষ সম্ভবত এমন ভাবছেÑ কোনো এক পাপের কারণে করোনার সংক্রমণ হচ্ছে শুধু পাপিষ্ঠ মানুষের ওপর। আর তারা নিজেরা ওই নির্দয় বর্বর আচরণ করার পরও পূতপবিত্র! পবিত্রতার এই স্বেচ্ছা নির্ধারিত সংজ্ঞা সারা দেশে বিরাট বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। নারায়ণগঞ্জের ওই নির্দয় মানুষদের ঠেকাতে স্থানীয় প্রশাসনের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি দলকে শেষ পর্যন্ত মাঠে নামতে হয়েছিল।
আমরা কুসংস্কারের গাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে আছি। এ অন্ধত্ব নিয়ে কোনোভাবে একটি মানবিক আলোকিত জাতি বিনির্মাণ অসম্ভব। গাজীপুরের করোনায় আক্রান্ত প্রথম ব্যক্তি একটি পত্রিকাকে জানান, তাকে বাড়ি থেকে যখন অ্যাম্বুলেন্সে নেয়া হলো, তখন থেকে
আত্মীয়স্বজনসহ অন্যরা অন্যদৃষ্টিতে দেখা শুরু করে। তার নিকটাত্মীয়রা তার প্রতি হীন দৃষ্টি প্রদর্শন করে। এমনকি মাঠে পাকা ধান কাটতে কেউ রাজি হয়নি। মাঠে ধান কাটার সাথে ব্যক্তির ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার কী সম্পর্ক থাকতে পারে? না, একজন ব্যক্তি ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তার ধান ক্ষেতেও সেটি ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের দেশের মানুষের আচার আচরণ দেখলে তো এমনটিই মনে হয়। পরে স্থানীয় এক রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি চাপ দিয়ে তার পাকা ধান কাটানোর ব্যবস্থা করান। একই জেলার অন্য একজন ডাক্তার জানান, ‘আমি একজন চিকিৎসক। অথচ আক্রান্ত হওয়ার পর মনে হয়েছে, আমি যেন আশপাশের মানুষের শত্রুতে পরিণত হয়েছি।’
সংবাদমাধ্যমে করোনা নিয়ে মানুষের অযাচিত অসৌজন্যমূলক অযৌক্তিক আচরণের অনেক খবর প্রকাশিত হয়েছে। এসব ঘটনা আমাদের ভেতরের কুসংস্কার ও হীনম্মন্যতাকে প্রকাশ করে দিয়েছে। আমরা সভ্য হতে পেরেছি কি, আমরা কি আসলে সেই অস্পৃশ্যতার কুসংস্কারে আক্রান্ত নই? আমাদের গর্বটা আসলে কোন জায়গায়। যেখানে রোগীর প্রতি সহনশীলতা, যতœ-দয়া-মায়া প্রদর্শনের ধর্ম সারা বিশ্বে স্বীকৃত সেখানে আমরা বেছে নিয়েছি ঘৃণা ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য প্রদর্শনের নীতি। ইউরোপ ও আমেরিকার চেয়ে বাংলাদেশে পরিস্থিতি এখনো অনেক সহনশীল পর্যায়ে রয়েছে। আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে এখন দৈনিক মৃত্যুর হার ডজনেরও নিচে। এর মধ্যে সরকার, নাগরিকসমাজ, পাড়া প্রতিবেশী, ডাক্তার-নার্স-কৃষক-শ্রমিক সবাই আমরা পরীক্ষিত হয়ে গেলাম। আমরা মানবিক ও সুষ্ঠু কাক্সিক্ষত আচরণ করিনি। মুদ্রার অপর পিঠও রয়েছে। কিছু মানুষ যারা জান-প্রাণ দিয়ে অসভ্য আচরণের পরিবর্তে অত্যন্ত ভালো আচরণ দিয়ে পুষিয়ে দিচ্ছেন। আমরা দেখেছি, হাসপাতালে সেই কর্মীটি যিনি একাই কয়েকজনের কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন। কারণ করোনা রোগীদের রক্ত সংগ্রহ করার ভয়ে অন্যরা পালিয়ে গেছেন। প্রত্যেক শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে এমন পরোপকারী সহৃদয় মানুষেরও দেখা মিলছে। সবার মধ্যে যেখানে এ সহৃদয়তা প্রদর্শন একটা সাধারণ ধর্ম হওয়া উচিত ছিল, সেখানে আমাদের মধ্যে সেই সংখ্যাটা নগণ্য।
বাংলাদেশে করোনাকেন্দ্রিক আতঙ্ক ও অপবাদের চরিত্র বোঝার জন্য একটি গবেষণা করা হয়েছে। ওই গবেষণার ফাইন্ডিংসে বলা হয়Ñ চীন থেকে ইতালিতে ব্যাপক সংক্রমণ শুরু করলে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে একটা ধারণা দেখা যায় যে, এটি অন্য দেশের রোগ এবং আমরা এ রোগ থেকে নিরাপদ। এর সাথে পাপাচার অনৈতিক জীবনযাপনের সম্পর্ক দেখাতে একদল আগে থেকেই তৈরি ছিল।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইতালিফেরত প্রবাসীদের চিহ্নিত করা হয়। এ চিহ্নায়ন তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের ঘৃণা তৈরি করে। প্রবাসীদের কাছে দোকানে জিনিসপত্র বিক্রি না করার নোটিশ ঝোলানো হয়। কোথায় কোথায় তাদের ওপর হামলার মতো ঘটনা ঘটে। তারা কঠোর পরিশ্রম করে আমাদের অর্থনীতি পুষ্ট করছেন। এত দিন দেশের হিরো হিসেবে ছিলেন সমাদৃত। অথচ এই কাক্সিক্ষত লোকদের অগ্রহণযোগ্য হিসেবে সমাজে চিহ্নিত করতে আমরা কুণ্ঠাবোধ করিনি।
লাশ সৎকার নিয়ে দেখা দেয় ভয়াবহ পরিস্থিতি। মানুষের লাশের কাছে কেউ আর আসতে চাইছে না। পরিবারের আপনজনরাও অনেকে সরে যাচ্ছে। নারায়ণগঞ্জে একজন ধনাঢ্য ব্যক্তির লাশ পড়ে থাকে সিঁড়িতে। নারায়ণগঞ্জে আরো বহু মর্মপীড়াদায়ক হৃদয়বিদারক ঘটনা আমরা দেখতে পেলাম। সেগুলোর বর্ণনা দিয়ে শেষ করা যাবে না। এ অবস্থায় সেখানে একজন সাহসী সমাজহিতৈষী মানুষের দেখাও মিলল। লাশের পাশে যখন নিকটাত্মীয়রা আসতে চাচ্ছিল না, স্থানীয় এক কাউন্সিলর সবার পক্ষ থেকে দায়িত্ব পালন করছিলেন। লাশের সৎকারের সব প্রক্রিয়া তিনি নিজে সশরীরের করেছেন। ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদের এমন পরোপকারী কর্মকাণ্ড দেশী-বিদেশী সংবাদমাধ্যমেও প্রশংসিত হয়েছে।
সংক্ষিপ্ত গবেষণায় দেখা যায়, গ্রামের লোকেরা মনে করছেÑ এটি ঢাকা শহরের রোগ। এভাবে নিজেদের জন্য তারা সান্ত্বনা
খুঁজে পায়। করোনা সন্দেহে আপনজনকে জঙ্গলে ফেলে আসা, ভাড়াটে উচ্ছেদ করা, করোনা রোগীর বাড়ি আক্রমণ করা, পাড়ায় মহল্লায় সোশ্যাল পুলিশিংও শুরু হয়। কেউ ফার্মেসিতে প্যারাসিটামল কিনতে গেলে তার বাড়িতে গিয়ে খোঁজখবর নেয়া। এভাবে অপবাদের সংস্কৃতি গড়ে তোলা হয়।
বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের সহায়তায় গবেষণাটি করেছেন যৌথভাবে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্সের জনস্বাস্থ্য গবেষক ড. শাহাদুজ্জামান ও ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের যোগাযোগ গবেষক ড. সুমন রহমান। সংক্ষিপ্ত পরিসরে এ গবেষণা চালানো হলেও বাংলাদেশের মানুষের সংস্কারাচ্ছন্ন দূষিত হৃদয়ের ছবি এতে প্রতিফলিত হয়েছে। আমরা জানি না করোনা পরিস্থিতি এ দেশে শেষ পর্যন্ত কতটুকু ভয়াবহ হয়। এখন পর্যন্ত যতটুকু খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে কোথাও মায়া-মমতা, দায়িত্বশীলতার ছোঁয়া নেই। এতে যদি হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটতে থাকে তা হলে আমরা আরো বহু নিষ্ঠুর ও পৈশাচিক ঘটনার মুখোমুখি হবো, এতে কোনো সন্দেহ নেই। হ
jjshim146@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement