১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নাগরিক অধিকার বনাম ঔপনিবেশিক মানসিকতা

-

করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপে মানুষ সঙ্গনিরোধ ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলেছেন। শহরের বেশির ভাগ নারী-পুরুষ হয়তো গ্রামে চলে গেছেন অথবা নিজ বাসায় সতর্কতার সাথে অবস্থান করছেন। কিছু মানুষকে জীবিকার তাগিদে অথবা অফিসিয়াল দায়িত্ব পালনে রাস্তাঘাটে দেখা যাচ্ছে। সরকারি পরিসংখ্যান মতে, দিন এনে দিন খায় এরকম মানুষের সংখ্যা বাংলাদেশে ছয় কোটিরও বেশি। রিকশাওয়ালা, ভ্যানচালক, দিনমজুরসহ খেটেখাওয়া মানুষ ঘরে বসে থাকলে পরিবারসহ না খেয়ে মারা যাবেন। আমাদের দেশ তো ফ্রান্স বা জার্মানি নয় যে, রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ বাসায় বাসায় খাবার পৌঁছে দেবে। জনসাধারণের সুবিধার্থে সরকার হাসপাতাল, ফার্মেসি, রেস্তোরাঁ, ভোগ্যপণ্যসামগ্রীর দোকান প্রভৃতি খোলা রাখার অনুমতি দিয়েছেন।
এটা অস্বীকার করার জো নেই যে, এ দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে অসচেতনতা বা নিয়ম না মানা বা আইন অমান্য করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। মজ্জাগত এ মানসিকতার পরিবর্তন সময়সাপেক্ষ। পিটিয়ে বা কান ধরে ওঠবস করিয়ে এ প্রবণতার ইতি টানা যাবে না। এ দিকে, সিভিল প্রশাসনকে সহায়তা করার জন্য সেনাসদস্যদের মাঠে নামানো হয়েছে। এটা সঠিক উদ্যোগ। কিন্তু জনগণ দুঃখের সাথে লক্ষ করছে যে, এক শ্রেণীর পুলিশ রাস্তাঘাটে যাকে পাচ্ছে বেধড়ক পেটাচ্ছে। কারো কথা শুনতে চাচ্ছে না। পরিচয় দিয়েও প্রহারের হাত থেকে রেহাই মিলছে না। সরকারি হাসপাতালের একজন ডাক্তার ডিউটি শেষ করে বাসায় ফেরার পথে জনৈক পুলিশ তাকে পিটিয়েছে। পরিচয় দেয়াতে তিনি আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। একজন সহকারী কমিশনার কর্তৃক চার সিনিয়র সিটিজেনকে কান ধরে ওঠবস করার দৃশ্য মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ভাইরাল’ হয়েছে। পথঘাটে চলমান মানুষদের বুঝিয়ে ঘরমুখো করার কথা; কিন্তু আইন হাতে নিয়ে নাগরিকদের সাথে যে রূঢ়, অসম্মানজনক ও অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে তা রীতিমত অপরাধ। একজন জেলা প্রশাসক তার অধীনস্থ তিনজন ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়ে গভীর রাতে এক সাংবাদিককে ঘর থেকে তুলে এনে উলঙ্গ করে নির্দয়ভাবে পেটালেন এবং মধ্যরাতে কোর্ট বসিয়ে তাকে জেলে পাঠালেন। এটা কোন ধরনের আইনের শাসন? কেন তারা এত বেপরোয়া?
ধর্ম, বর্ণ, বয়স ও জেন্ডার নির্বিশেষে দেশের সব নাগরিকের সাথে সৌজন্য, ভদ্রতা ও পেশাদারিসুলভ আচরণ করা উর্দিপরা বাহিনীসহ সরকারি কর্মকর্তাদের নৈতিক ও সাংবিধানিক দায়িত্ব। একজন নাগরিক রাষ্ট্রকে চালু রাখার জন্য ট্যাক্স দেবেন, রাষ্ট্রীয় আইনকানুন মেনে চলবেন। বিনিময়ে রাষ্ট্র নাগরিকের নিরাপত্তা দেবে এবং তার সাথে সম্মানজনক আচরণ করা হবে। এটা একজন নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। কোনো নাগরিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে বা তিনি বিধি ভঙ্গ করলে এর নিরপেক্ষ তদন্ত করা হবে এবং আইন অনুযায়ী বিচার হবে। এটাই আধুনিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সভ্যনীতি।
ব্রিটিশরা বিদায় হয়েছে প্রায় ৭৩ বছর আগে। ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান হলেও কর্তৃত্ববাদী ও প্রভুত্বসুলভ মানসিকতার পরিবর্তন হয়নি। ব্রিটিশ গোরা সৈন্যরা ভারতীয় বা দক্ষিণ আফ্রিকার কালো মানুষের সাথে যে ব্যবহার করত, স্বাধীন বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্য এবং এক শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী স্বাধীন দেশের নাগরিকদের সাথে একই ধরনের আচরণ করে যাচ্ছেন। তারা নিজেদের মনে করেন ‘লাট বাহাদুর’ বা ‘লর্ড অব পাবলিক’ অথচ তারা ‘পাবলিক সার্ভেন্ট’। আসলে তারা সেবক, প্রভু নন। আইনের রক্ষক, উৎপীড়ক নন।
স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৪৫ বছর আগে যে নির্দেশনা দিয়ে গেছেন তা অক্ষরে অক্ষরে মানতে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বাধ্য। ‘আপনি চাকরি করেন, আপনার মাইনে দেয় ওই গরিব কৃষক। আপনার মাইনে দেয় ওই গরিব শ্রমিক। আপনার সংসার চলে ওই টাকায়। আমরা গাড়ি চড়ি ওই টাকায়। ওদের সম্মান করে কথা বলুন, ইজ্জত করে কথা বলুন। ওরাই মালিক। ওদের দ্বারাই আপনার সংসার চলে’(১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণ)।
একটা কথা পরিষ্কার হওয়া দরকার। সরকারি ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তা, পুলিশ, র্যাব বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে নিঃসন্দেহে সৎ, দায়িত্বশীল, দেশপ্রেমিক, হৃদয়বান ও মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষ আছেন। তারা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের কেউ নন, তারা আমাদের সমাজের অংশ। তারা আমাদেরই ভাইবোন বা ছেলেমেয়ে। অনেকের বাবা-মা সাধারণ মানুষ, কৃষক বা শ্রমিক। তবে তাদের শতকরা হার কত নিশ্চিতভাবে বলা মুশকিল। রাষ্ট্রের যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী অপরাধে জড়িয়ে পড়েন অথবা বিধি ভঙ্গ করেন তাদের বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়। অনেকের ক্যারিয়ারও ধ্বংস হতে দেখা যায়। এ জাতীয় দুর্ঘটনাগুলোকে আমরা নিছক বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখতে চাই।
আমাদের দেশে ব্যুরোক্র্যাটিক যে সিস্টেম গড়ে উঠেছে তা ঔপনিবেশিকতার উত্তরাধিকার। এ কাঠামোতে অফিসাররা প্রভু, জনগণ ভৃৃত্য; পুলিশ ফ্রেন্ড নয়, মাস্টার। নির্দিষ্ট পরিসরে তারা নিজেদেরকে একেকজন সম্রাট ভাবেন, যাদের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ এবং যারা জবাবদিহিমুক্ত। এ জন্য বাংলায় প্রবাদ তৈরি হয়েছে ‘থানার সামনে কানাও হাঁটে না’। প্রধানমন্ত্রী ‘পুলিশ সপ্তাহ’ উপলক্ষে পুলিশদের উদ্দেশে যে বক্তব্য রাখেন তা প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, পুলিশকে জনবান্ধব হতে হবে, আর সে প্রবাদ শুনতে চাই না ‘বাঘে ছুঁলে এক ঘা আর পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা’। পথেঘাটে, থানায় বা অফিস-আদালতে অফিসার বনাম জনতা যে দৃশ্য ভাইরাল হয় তা ওই সিস্টেমের সরল সমীকরণ। দু-চারজনের শাস্তি হবে কিন্তু সিস্টেমে হাত পড়বে না। সিস্টেমকে পাল্টাতে পারলে অফিসার হবেন সেবক। থানা পর্যায়ের একজন অফিসারকে ‘স্যার’ না বলায় তুলকালাম কাণ্ড ঘটেছে অতীতে। একজন সম্মানিত নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মকর্তাকে ‘স্যার’ বলতে সাংবিধানিকভাবে বাধ্য নন। তিনি যদি সৌজন্যের খাতিরে বা ভদ্রতা দেখিয়ে কাউকে ‘স্যার’ ডাকেন, তাতে কোনো বাধা নেই বা আপত্তি ওঠার কথা নয়।
স্মর্তব্য, ঐতিহাসিক কারণে ‘স্যার’ শব্দটিতে লুকিয়ে আছে আধিপত্যবাদ, সামন্তবাদ ও সাম্্রাজ্যবাদের গন্ধ। মধ্যযুগে ফ্রান্সে প্রজারা সামন্তপ্রভুদের ‘সায়ার’ (Sire) বলে সম্বোধন করতেন। এর অর্থ Slave I Remain.। ফরাসি ‘সায়ার’ শব্দ থেকে ইংরেজি ‘স্যার’ শব্দের উৎপত্তি। ইংল্যান্ডে Sir শব্দ দ্বারা বোঝানো হতো Servant ও Remain.। ব্রিটিশরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ গড়ে তুললে ‘স্যার’ শব্দটির প্রয়োগ ও প্রচলন ব্যাপকতা লাভ করে।
যশোরের মনিরামপুরের এসি ল্যান্ড এবার একজন ভ্যানচালকসহ যে চারজন খেটে খাওয়া মানুষকে কান ধরে ওঠবস করিয়েছেন তাদের প্রত্যেকের বয়স ষাটোর্ধ্ব; শুভ্রশ্মশ্রুধারী; এ মহিলার বাবার বয়সী। এক কথায় তারা সিনিয়র সিটিজেন। এসি ল্যান্ড সেই দৃশ্যকে ভিডিও করার ঔদ্ধত্য দেখিয়েছেন। পৃথিবীর সব দেশে জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের জন্য রয়েছে বিশেষ সম্মান ও সুবিধা। ভারতের হাসপাতালে রয়েছে জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের অগ্রাধিকার, বসার আলাদা ব্যবস্থা, ট্রেন ও বিমানে হ্রাসকৃত মূল্যে ভ্রমণ, নির্ধারিত হারে কর ও টেলিফোন বিল রেয়াত। ফিলিপাইনে রয়েছে বিশেষ আইন (Senior Citizen Act ২০১০)। এ আইনের অধীনে একজন ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তি সরকারি ফি’র ২০ শতাংশ রেয়াত পাবেন। কোনো পণ্যক্রয়ে তাকে মূল্য সংযোজন কর (VAT) পরিশোধ করতে হয় না। ব্রিটেনে সিনিয়র নাগরিকদের রাষ্ট্রীয় ভাতার পাশাপাশি বাড়ি, খাবার, চিকিৎসা ও লন্ড্রি সুবিধা প্রদান করা হয়।
২৫ মার্চ ডিউটি শেষে হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে একজন ডাক্তারকে পিটিয়েছে আহত করেছেন রাজবাড়ী পাংশা মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ স্বয়ং। পাংশা উপজেলা কমপ্লেক্সে মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে কর্মরত ডা: সুপ্রভ আহমেদ জরুরি ডিউটি শেষে ফিরছিলেন। পথে তার ভ্যানের গতিরোধ করেন পাংশা থানার ওসি। সে সময় ডা: সুপ্রভ তার পেশাগত পরিচয় দেন। পরিচয় পাওয়ার পর অশালীন বক্তব্য দিতে থাকেন পাংশা থানার ওসি। একপর্যায়ে নির্যাতনের শিকার হয়ে চিকিৎসক ওসিকে জানান, তিনি জরুরি সেবায় নিয়োজিত এবং ডিউটি শেষে ফিরছেন। তখন ওসি বলেন, ডাক্তার হয়েছেন তো কী হয়েছে? বলেই ওই ডাক্তারকে লাঠি দিয়ে পায়ে আঘাত করেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ঘটনার বিবরণ দিয়ে বিচার চেয়েছেন ৩৯তম বিসিএসে নিয়োগপ্রাপ্ত রাজবাড়ীর এই মেডিক্যাল অফিসার। করোনায় আক্রান্তদের সেবা দিতে গিয়ে চিকিৎসকরা করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন। দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের অন্তত ৭০ জন ডাক্তার ও নার্স হোম কোয়ারেন্টিনে রয়েছেন এ কারণে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার পেটানোর ঘটনায় তোলপাড় সোশ্যাল মিডিয়া।
পুলিশ হেফাজতে আসামির মৃত্যু কি স্বাভাবিক ঘটনা? এরকম খবর শুনতে শুনতে পাঠক ক্লান্ত। ২৬ মার্চ বরগুনা জেলার আমতলী থানায় পুলিশ হেফাজতে থাকা হত্যা মামলার সন্দেহভাজন আসামি শানু হাওলাদারের (৫০) লাশ পাওয়া গেছে। পুলিশের দাবি, সে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: শংকর প্রসাদ অধিকারী জানান, শানুর শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। শানুর ছেলে সাকিব জানান, পুলিশ তাদের কাছে তিন লাখ টাকা দাবি করেছিল। তারা ১০ হাজার টাকা পুলিশকে দিয়েছেন। শানুর স্ত্রী ঝর্ণা বেগম অভিযোগ করেন, টাকা দিতে না পারায় পুলিশ তার স্বামীকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। বরগুনার পুলিশ সুপার জানান, ওসি (তদন্ত) ও ডিউটি অফিসার এসআইকে বরখাস্ত করা হয়েছে (যুগান্তর, ঢাকা, ২৬ মার্চ, ২০২০)।
বাংলাদেশে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন প্রতিরোধে একটি আইন ২০১৩ সালে প্রণয়ন করা হলেও এর প্রয়োগ নেই বললেই চলে। এ আইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা নেই। এ আইনে ভুক্তভোগীরা নিরাপত্তা হেফাজতে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনেরও বিচার চাইতে পারেন। বিবিসির পক্ষ থেকে নি¤œ আদালত, অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস এবং পুলিশ সদর দফতরে যোগাযোগ করে এই আইন প্রয়োগ করে কতগুলো মামলার বিচার হয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের মতে, ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১৭টি মামলা হয়েছে।
জাতিসঙ্ঘের নির্যাতনবিরোধী সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এই আইনটি প্রণয়ন করেছে। নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩ অনুযায়ী কেউ নির্যাতনের শিকার হলে এ আইনের ১১ (১) ধারায় অভিযোগকারী কোনো ব্যক্তি অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বিধানকল্পে দায়রা জজ আদালতে পিটিশন দায়ের করতে পারবে। (৪) নং ধারায় উপরে উল্লিখিত উপধারা (১) এ বর্ণিত এ ধরনের কোনো মামলা নিষ্পত্তিকালে আদালত প্রয়োজনবোধে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে অন্যূন সাত দিনের অন্তরীণ আদেশ দিতে পারবেন এবং সময়ে সময়ে ওটা বৃদ্ধি করতে পারবেন। শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ প্রমাণিত হলে শাস্তি হিসেবে ন্যূনতম ৫ বছরের কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। এ ছাড়া নির্যাতনের ফলে মৃত্যু হলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা অর্থদণ্ড হতে পারে।
পিটিয়ে হত্যা, চাঁদা দাবি ও সম্মানিত নাগরিকের সাথে অভদ্র আচরণ দেশে মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এগুলো ‘ওপেন সিক্রেট’। সংঘটিত ঘটনার মাত্র এক-দশমাংশ মিডিয়ায় প্রকাশ পাচ্ছে। বাকিগুলো অগোচরে ও আড়ালে থেকে যাচ্ছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিচ্ছেন। মাদরাসা ছাত্রী নুসরাতের বক্তব্যের ভিডিও ধারণ ও ফেসবুকে প্রচারের অভিযোগে ফেনীর সোনাগাজী থানার সাবেক ওসির সাজা হয়েছে। কুড়িগ্রামের ডিসি ও তিন ম্যাজিস্ট্রেট, আমতলী থানার ওসি এবং এসআই, যশোরের মনিরামপুরের এসি ল্যান্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পর দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার, তদন্ত কমিটি গঠন ও বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা আস্থার ভিত কিছুটা সৃষ্টি করেছে। সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, সচিব, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপির তাৎক্ষণিক পদক্ষেপকে জনগণ ভালোভাবে নিয়েছেন। এমনকি নিগৃহীত সিনিয়র সিটিজেনদের বাড়িতে গিয়ে ইউএনওর ক্ষমা প্রার্থনার ঘটনাও নাগরিকের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের উদাহরণ হয়ে থাকবে। এ ঘটনা থেকে সংশ্লিষ্ট সবাই শিক্ষা নিয়ে আচরণে পরিবর্তন আনতে সচেষ্ট হবেন, এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে বিভিন্ন ক্যাডারভুক্ত অফিসাররা মধ্যবিত্ত ও নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসেছেন। অতীত ও শেকড় ভুলে গেলে বিপর্যয় নেমে আসে; গতিপথ বদলে যায়; নক্ষত্রেরও কক্ষচ্যুতি ঘটে।
অধিকার মানুষের জন্মগত এবং আইনিভাবে স্বীকৃত। ১৯৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রণীত Civil Rights Act নাগরিক অধিকারের বাস্তব রূপ প্রদান এবং তা প্রয়োগের পথ উন্মুক্ত করেছে। বাংলাদেশে নাগরিক অধিকারগুলো ১৯৭২ সালের সংবিধানে বিধিবদ্ধ রয়েছে এবং এসবের প্রয়োগের ব্যাপারে উচ্চ আদালতের মাধ্যমে অঙ্গীকার করা হয়েছে। ২৬ থেকে ৪৭ (ক) অনুচ্ছেদগুলো নাগরিক অধিকার সংশ্লিষ্ট। বাংলাদেশ সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদের (২) নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।’ সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদের (ঘ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেয়া, নিষ্ঠুর, অমানবিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেয়া যাবে না।’ বাধাহীন, নিরুপদ্রব ও সুন্দর জীবনযাপনের জন্য সমাজের সব নাগরিকের প্রাপ্য অধিকারগুলো সাধারণত আইনি ঘোষণা বা সাংবিধানিক বিধিমতে প্রয়োজনে আইনের রক্ষকদের দ্বারা এসব অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়। এর ব্যত্যয় ঘটলে আইনের শাসন ব্যাহত হয়, ‘গুড গভর্ন্যান্স’ অবশিষ্ট থাকে না। সুশাসনই কল্যাণকর রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিফলন। শাসক ও শাসিতের পারস্পরিক সুসম্পর্কের ওপর নির্ভর করে রাষ্ট্রের আর্থসামাজিক উন্নয়ন। প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত ব্যক্তিদের জনবান্ধব মানসিকতা এ ক্ষেত্রে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। অনুরূপভাবে নাগরিকদেরও নিজেদের দায়িত্ব, কর্তব্য ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকা জরুরি।হ
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ওমর গণি এম ই এস ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম

 

 


আরো সংবাদ



premium cement