১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`
গৌতম দাস

ভাইরাসের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

-

যেদিকেই যাই যেকোনো দু’জনের মধ্যে আলাপের সাবজেক্ট একটাইÑ করোনাভাইরাস। মনে হচ্ছে এটা চলতি এপ্রিল মাস তো বটেই, এমনকি যতটুকু দূরে অনুমান করে দেখা যায় তাতে অন্তত আগামী জুন মাসের শেষ পর্যন্ত এটা চলবে। ভাইরাস পরিস্থিতি আরো মারাত্মক হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
বাংলাদেশে ভাইরাস বিস্তার কেমন, কত দূর ঘটেছে, আমরা কোন অবস্থায় আছি, সে চিত্রটা দেখানোর ক্ষেত্রে এখনো কেউ পাবলিকের আছে বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। অথচ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত ব্রিফিং ও ডেইলি সরকারি আপডেট দেয়া জারি আছে। নতুন খবর এসেছে যে, ভাইরাসের আরো পরীক্ষা কেন্দ্র ঢাকায় এবং ঢাকার বাইরে মোট ১৪টা স্থানে স্থাপনের উদ্যোগ চলছে, যেটা ২৮টা করা হবে সম্ভবত। মনে হচ্ছে টেকনিক্যাল সক্ষমতার উপায়গুলোর স্টক বাড়ার সাথে এর সম্পর্ক আছে। তবে ইকুইপমেন্ট ঘাটতি ছাড়াও ডাক্তার ও টেকনিশিয়ানের মধ্যে জড়তা বা উৎসাহ কম হবার পেছনে যদি ভয়ও একটা ফ্যাক্টর হয়ে থাকে তবে তা কাটাবার সবচেয়ে ভালো উপায় হতে পারে কিছু ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা।

করোনার পিক আওয়ার
এ পর্যন্ত অনেকের মধ্যে দেখেছি কী হতে যাচ্ছে সে উদ্বিগ্নতা যে, সরকার কি এগারো এপ্রিল তারিখের পরে সব খুলে দেবে অথবা আংশিক? যেমন ধরা যাক কারখানায় উৎপাদন ও যানবাহন খুলে দেয়া হবে? আর একবার যদি খুলে দেয়, মানুষ ঢাকায় ফিরে আসে এরপর সম্ভবত আবার ফিরে যেতে বা ঘরে বন্ধ থাকতে চাইবে না। মূল কথাটা হলো, বাংলাদেশের ভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিতে এর পিক আওয়ার মানে সর্বোচ্চ আক্রমণ ও ক্ষয়ক্ষতির কাল কি আমরা পেরিয়ে গেছি? আমাদের নতুন আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা কি কমতে শুরু করেছে? তা জানা নেই। কারণ পিক আওয়ার সময়ের পরে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা কমতে থাকে বা হঠাৎ করে একসাথে অনেক নিচে নেমে যায়। এটাই পিক আওয়ার পেরিয়ে যাওয়ার লক্ষণ। সে ক্ষেত্রে উপযুক্ত, অবাধ ও প্রচুর ডাটা থাকতে হবে। কেবল তবেই কোনো অর্থপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব যে, করোনাভাইরাস চলে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের লকডাউনের কাল বাড়ছে কি না, এই দুশ্চিন্তার আপাতত একটা হিল্লা হতে যাচ্ছে সম্ভবত। টিভির খবরে দেখা গেল ঢাকা মেডিক্যালের অধ্যক্ষ মতামত রাখছেন যে, আগামী দুই সপ্তাহ বাংলাদেশের জন্য খুবই বিপজ্জনক নির্ধারক সময়। তাই ১১ তারিখ পর্যন্ত ছুটি এপ্রিলের চতুর্থ সপ্তাহ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে দিতে তিনি সরকারের কাছে পরামর্শ রেখেছেন। তবে তিনি মনে করিয়ে দেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিবেচনা করার মতো অন্যান্য ইস্যু থাকতে পারে: সেগুলো সাথে নিয়েই তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন।’ এগুলোই ছিল তার কথার সারাংশ। ফলে মনে হচ্ছে সরকারি সিদ্ধান্ত এমনটাই হতে যাচ্ছে। এটা হলে একটা ভালো সিদ্ধান্ত হতে পারে। যদিও এর আবার অন্য পরিণতি আছে। যেমন আজকে পর্যন্ত অন্তত ঢাকারই নিম্ন আয়ের মানুষের যেসব নিউজ দেখা গেছে তা এক কথায় খুবই উদ্বেগজনক। রাস্তায় রাস্তায় দান-সদকা টুকিয়ে চলতে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে, এ জন্য মরিয়া ভাব আছে তাদের মধ্যে, যারা কাজকাম হারা এবং দিন এনে খায়, তারা নিরুপায়। তবে দান খয়রাতে এরা দু-চার দিন চলতে পারে কিন্তু বেশি দিন চলতে পারবে না। পুরো এপ্রিল বলতে গেলে এ নিয়ে শক্ত ও কমিটেড বিনামূল্যের সরকারি রেশন ধরনের ব্যবস্থা তাদের লাগবেই।

‘জীবন না জীবিকা’, কোনটার অগ্রাধিকার
গত বছর অর্থনীতিতে নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন সম্মিলিতভাবে তিনজন। এদের মধ্যে কলকাতায় জন্ম নেয়া আমেরিকান নাগরিক ‘অভিজিত ব্যানার্জি’ ও ফ্রান্সের ‘এস্থার দুফলো’ এরা দু’জন ঘটনাচক্রে সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী। আর সাথে তৃতীয় অর্থনীতিবিদের নাম মাইকেল ক্রেমার। তাদের মধ্যে প্রথমে দু’জন করোনাভাইরাস নিয়ে এক কথোপকথন বা প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে আলাপ করেছেন; যার ভিডিও ক্লিপ ও বাংলায় ট্রান্সস্ক্রিপ্ট ছাপিয়েছে কলকাতার ‘আনন্দবাজার’। সেখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ ছিল এই ভাইরাস আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে একজন নির্বাহী প্রধান- জীবন না জীবিকা কোনটার ওপর বেশি জোর দেবেন আজকের এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে? কারণ অর্থনীতির দিকে বেশি প্রায়োরিটি বা মনোযোগ দিতে পারলে ভাইরাস-পরবর্তী সময়ে মানুষের বিশেষ করে জীবিকা বাঁচানো সহজ হতে পারে। অর্থাৎ সে ক্ষেত্রে লকডাউন কম সময় রাখা বা শিথিল করে রাখা হতে পারে। কিন্তু তাতে বিপরীতে আবার খোদ জীবনই সঙ্কটে পড়ে যেতে পারে এবং বেশি মানুষ মারা যেতে পারে। তাহলে? অতএব দরকার একটা ‘অপটিমাম’ অবস্থান; আর সেটি অবশ্যই জীবন বাঁচানোকে প্রায়োরিটি দিয়ে। অভিজিত বলছিলেন, একজন ভালো নির্বাহী প্রধানের জন্যÑ জীবন না জীবিকা প্রশ্নে একটা ভারসাম্যের সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া বেশ কঠিন হতে পারে। কারণ, এ ক্ষেত্রে কোনো ভুল সিদ্ধান্তের জন্য বড় খেসারত দিতে হতে পারে। [বাংলাদেশের কিছু ওয়েব পত্রিকাও আনন্দবাজারের রেফারেন্স দিয়ে লেখাটা ছেপেছে।]
এই বিতর্কের আলোকে, আমরা যদি অন্তত এপ্রিলের শেষ পর্যন্ত লকডাউনের সময় বাড়িয়ে দেই তবে সেটা ভাইরাস থেকে জীবন বাঁচানোর দিক থেকে জরুরি হলেও আবার নি¤œ আয়ের লোকদের বাঁচানোর দিক থেকে খারাপ; অথবা বলা যায় তাদের জন্য রেশনের ব্যবস্থা করতে বাধ্য হতে হবে। অন্যথায় তাদের ঘরে বা রাস্তায় মরে পড়ে থাকতে দেখতে হতে পারে; যেটা নিশ্চয় ভালো অভিজ্ঞতা হবে না।

ভালো অর্থনীতির মুলা
কেউ কেউ ইতোমধ্যে ভাইরাস-উত্তর পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ‘স্বর্ণযুগ’ না হলেও ‘ভালো সময়’ আসবে বলে দেখছেন। এ ধরনের মন্তব্যগুলো নেহায়েতই চাঙ্গা করার উদ্দেশ্যে কথার কথা হিসেবে হলে সে ক্ষেত্রে কিছু না বলাই ভালো। ধরে নিচ্ছি, এগুলো নিছক চাঙ্গা করার জন্য কথার কথা নয়। সে আলোকে : প্রথমত, ব্যাপারটা হলো, ভাইরাস থেকে কে কী দশায় সার্ভাইভ করে আর তা কত কম ক্ষতিতে ইত্যাদিÑ সেই সার্ভাইভালের গুরুতর প্রশ্ন। সেই পরিস্থিতিটা ভালো দশা হবে কি না তা নিশ্চিত না হয়ে কোনো স্বপ্ন দেখার মানে নেই। বরং ‘স্বপ্নে পোলাও-কোরমা খাওয়া’ই মানসিক আঘাত হয়ে উঠতে পারে। কারণ, ভাইরাস-উত্তর সার্ভাইভাল বা বেঁচে থাকা যদি মারাত্মক লোকসংখ্যার হানি ঘটিয়ে হয় তবে এরপর সেই শক কাটিয়ে থিতু হওয়াই অনিশ্চয়তায় ডুবে যাওয়া অবস্থা হয়ে যেতে পারে। তাতে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা যতই আকর্ষণীয় হয়ে হাজির থাকুক তাতে কিছু আসবে যাবে না।
অতএব প্রথম টার্গেট-কাজ-সফলতা হতে হবে যত কম প্রাণহানি ও মানুষের ক্ষতি কম ঘটিয়ে সার্ভাইভ করা বা টিকে যাওয়া। এটা খুবই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর ওপর নির্ভর করছে আমাদের নিজেকে পুনর্গঠনে লিপ্ত হওয়ার যোগ্য থাকব কি না আর সেটা কতটা। এ ছাড়া গ্লোবাল ইকোনমি কতটা আর কত দ্রুত চাঙ্গা হতে পারবে আমরা জানি না। এর চেয়েও বড় কথা আমাদের নিয়ন্ত্রণে তা একেবারেই নেই। কাজেই অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির দিকে বেশি মনোযোগ দেয়ার সুযোগ নেয়াতে সুফল বেশি আসার সম্ভাবনা বরং বেশি।
দেশে বলা শুরু হয়েছে, এক-দেড় মাসের মধ্যে বোরো ধান উঠবে। গতবার ধান সংগ্রহের পারফরমেন্স ছিল খুবই খারাপ। ‘গোডাউনে জায়গা নেই’ অজুহাতে ধান প্রায় কেনাই হয়নি। পরে তা যতটুকু কেনা হয়েছে সে টি মিলমালিক থেকে। সব মিলিয়ে সংগ্রহ মূল্য কম ছিল বলে ধান উৎপাদকদের অসন্তোষ উঠেছিল চরমে। এবারের বাস্তবতাটা হলো, এক দিকে নিম্ন আয়ের মানুষকে ঘরে আটকে রাখতে হলে বিনামূল্যে এক-দু’মাসের রেশন দিতে হবে, অন্য দিকে বোরো সংগ্রহের জন্য গুদামে জায়গা থাকতে হবে, বাজার থেকে ধান সংগ্রহ করে উৎপাদকদের একটা ভালো দাম দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে ইত্যাদি। এসব দিক ছাড়াও বিবেচনার বিষয় থাকতে পারে। সব মিলিয়ে এ নিয়ে ‘ভালো সিদ্ধান্ত’ সরকারকে একটা ভালো ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে পারে। আবার এ থেকে পাবলিকের মনে এমন ধারণা হতে পারে যে, তাদের একটা সরকার আছে।
এর উল্টোটাও আছে। পাবলিকের মনে হতে পারেÑ তাদের জন্য কেউ নেই। আবার ভাইরাস থেকেও পরিত্রাণ নেই। কেউ তাদের জন্য কিছু করার নেই। আবার ভাইরাসে মরব তো, পরে যদি খেয়ে বেঁচে থাকতে পারি। কাজেই ভাইরাসের কথা ভুলে আগে খাবার সংগ্রহে নামি। এ ছাড়া যাদের খাওয়ার সমস্যা নেই তারা ভাবতে পারে সরকার কিছু করতে পারবে না, কেউ কারো জন্য নয়। কাজেই সরকারের ভরসায় না থেকে অন্যের ঘাড়ে চড়ে হলেও নিজেই ভাইরাস থেকে বাঁচার চেষ্টা করি। এর মিলিত ফলাফল হতে পারে এক বিশৃঙ্খলা; চরম আস্থাহীনতায় নিয়ম আইন সব ভেঙে পড়া। এমন অবস্থা যেন তৈরি না হয় সে জন্য আমরা কি ভালো কিছু আশা করতে পারি না? সেটি কি বিরাট আশা করা হবে?

তেল সর্বনিম্ন মূল্যে
জ্বালানি তেলের মূল্য নেমে তলানিতে ঠেকেছে। গ্লোবালি কলকারখানা মেশিন যান সব স্থবির হয়ে যাওয়ার আরেক চিহ্ন এটা। তেলের বিক্রি নেই, দাম সর্বনিম্ন তাই। কিন্তু কত নিচে?
এর আগে বলে নেয়া ভালো, এখন আমেরিকা তেল বিক্রেতা বা রফতানি দেশ। কারণ আমেরিকা বা জর্দান এরকম কিছু দেশÑ এদের এখন আছে মাটির নিচের এক ধরনের শুকনা কাদামাটির স্তর বা শ্লেটের খনি। এই শ্লেটগুলোকে প্রচুর পানিতে চাপে ও তাপে ফেলে তা থেকে জ্বালানি তেল বের করা সম্ভব। তেলের বাজারে এটা ডঞও বা ‘ওয়েস্ট টেক্সাস’ ক্রুড অয়েল নামে পরিচিত। এর উৎপাদন খরচ সৌদি তেলের চেয়ে বেশি। প্রতি ব্যারেল ৪৮ ডলারের উপরে দাম পেলে টেক্সাস ক্রুড লাভের মুখ দেখবে। এটাই ভাইরাসের প্রকোপের আগে ৫৩ ডলারে ছিল, যেখান থেকে নেমে তা মাত্র ২১ ডলারেও পৌঁছেছিল। তবে আজ তা ২৭ ডলার। গত দু-তিন বছরে তেলের দামের প্রধান নিয়ামক হয়ে আছে সৌদি আরব যার পলিসি হলো, টেক্সাস ক্রুডকে চাপে রাখা। পঞ্চাশ ডলারের আশপাশে দাম রাখলেই টেক্সাস চাপে থাকে। এ ক্ষেত্রে আরেক প্লেয়ার, পুতিনের রাশিয়া এতে খুশি যা কিছু দুঃখে মিশানো। এক দিকে আমেরিকা চাপে থাকলে সে খুশি। এটাই সে লবি করার চেষ্টা করে সৌদিদের সাথে। আবার অখুশি, কারণ সে নিজেও তেল বেচে বেশি দাম পায় না। গত ২০০৮ সালের দিকে ১৭৩ ডলারের তেলÑ মনে হয় না সে দিন দুনিয়াতে আর কোনো দিন ফিরবে।
তাই এক কথায় এখন এই তেলের দাম পড়ে যাওয়ার মানে হলো, গ্লোবাল সব উৎপাদন প্রায় একসাথে সব খানে স্থবির হয়ে আছে। কালকেই এটা আবার চলতে শুরু করলে দাম আবার বেড়ে আগের জায়গায় যাবে। ৫০-৫৩ ডলারের আশপাশে ফিরে আসবে অবশ্যই। অতএব, যারা এখন তেলের কম দাম এটা দেখিয়ে ভাইরাস-উত্তর আসছে দিন ভালো বলে আশার বাতি দেখাচ্ছেন এটা বাস্তবত তেমন আশার কিছু নয়। এটা অপ্রয়োজনীয় ও মিথ্যা আশা। কারণ, এমনিতেও ৫০-৫৩ ডলারের তেল গ্লোবাল অর্থনীতির জন্য তেমন বেশি মনে করা হয় না। তেলের দাম নয়, আসলে মূল ফোকাস হতে হবে গ্লোবাল অর্থনীতির ভালো চলতে দেখা। যেমন ভারত। তেলের দাম যখন ৫০-৫৩ ডলারের মধ্যে ছিল, তা সত্ত্বেও এর সুবিধা ভারত তখন তেমন নিতে পারেনি। কারণ অন্য নানা কারণে ভারতের খোদ অর্থনীতিই স্থবির হয়ে আছে। অতএব, সারকথা গ্লোবাল ইকোনমি একটু ভালো হতেই তেলের দামও আবার ৫০-৫৩ ডলারের স্তরে উঠে যাবে। কাজেই এখন তেলের দাম কম থাকা নিয়ে লোভ দেখানোর কিছু নেই। আর তেলের দাম কম থাকার চেয়েও গ্লোবাল অর্থনীতি চাঙ্গা থাকÑ এটা বরং আমাদের মতো অর্থনীতির জন্য একটা ভালো সময়ের নির্ণায়ক। অবশ্য সৌদি কোয়ালিটির (ব্রেন্ট) তেল সব সময় ৬-১০ ডলার বেশি থাকে, মানে সেটাও ৬০-৬৩ ডলারে চলে যাবে।

টাকার অবমূল্যায়ন
অনেকে করোনাভাইরাস-উত্তর পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের টাকার অবমূল্যায়নের জন্য পরামর্শ রাখছেন। এটা কোনো ভালো পরামর্শ না, মনে করার কারণ আছে। সাধারণত কোনো একটা রাষ্ট্রের অর্থনীতি ধসে গেলে বা ভেঙে ডুবে গেলে কেবল সেই পরিস্থিতিতেই অবমূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নিলে তা কার্যকর হতে পারে। অবমূল্যায়ন কথাটার খাড়া মানে হলো, নদীতে ডুবে যাওয়ার পরিস্থিতির মধ্যে নিজেকে ফেলে দেয়া। উদ্দেশ্য, বাজারের সবার ক্রেতাকে আমার কাছে আনা। কারণ সবাই এক ডলারে একটা শার্ট দিলে আমি বেশি, অর্থাৎ দুটো দেই। এটাই টাকার ‘অবমূল্যায়ন’। কেন? কারণ এবার আমাকে অন্যরা তুলতে এলে আমি অন্যদের কিছু কিছু করে ডুবিয়ে বিনিময়ে অনেক দূর পর্যন্ত ভেসে উঠতে পারার সুবিধা নেবো। টার্কিশ লিরা (২০০৯ সালে) ডুবে গেছে; সে লিরা অবমূল্যায়ন করতে পারে। তা হলে এটা কার্যকর হবে। ১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ার অর্থনীতি ফেলে দেয়া, এখানে রিংগিতের অবমূল্যায়নে পরিত্রাণ পাওয়া গিয়েছিল।
কিন্তু অবমূল্যায়ন পুরোটাই অকার্যকর হয়ে যেতে পারে। কখন? যখন সময়টা গ্লোবাল রিসেশন বা মহামন্দায় আছে বা সম্ভাবনা আছে এমন সময়ে। দেখা গেছে, এমন সময়ে একটা রাষ্ট্র নিজের মুদ্রার অবমূল্যায়নে গেলে তার লেজ ধরে অন্য সবাই অবমূল্যায়নে চলে যেতে পারে। এতে সামগ্রিক এফেক্ট বা ফলাফল হবে শূন্য। এই অবমূল্যায়নে কোনো একটা রাষ্ট্র বা কেউ বেশি ক্রেতা পেয়ে যাবে না। কিন্তু সব পণ্যের মূল্যই পড়ে যাবে। আজ পর্যন্ত সব গ্লোবাল মহামন্দার কালেই এমন গণ-অবমূল্যায়ন ঘটানো হয়েছিল। তাই একালের একটা চোস্ত প্রমাণ হলো, গ্লোবাল রিসেশন বা মহামন্দার বিপদের গন্ধ পেলেই আইএমএফ জি৭ গ্রুপের মিটিং ডাকার জন্য লবিং করে। আর সেই মিটিং থেকে প্রস্তাব পাস করিয়ে নেয় যে, কেউ অবমূল্যায়নের পথে যাবে না। কারণ এক রাষ্ট্র অবমূল্যায়নে গেলে বাকি সবাই একই পথে গিয়ে ফলাফল শূন্য করতে চাইবে। কিন্তু এই প্রতিযোগিতাই গ্লোবাল মহামন্দাকে নিশ্চিত করে ফেলে। গ্লোবাল মহামন্দার আমলে টাকার অবমূল্যায়ন করতে যাওয়া বিপজ্জনক হতে পারে। সার কথায়, যখন শান্ত নদী তখন ডুবে যাওয়ার চেষ্টা বা অবমূল্যায়নের চেষ্টা করা যেতে পারে এবং তা কার্যকর করা যাবে। যখন নদী অশান্ত, তখন ডুবে যাওয়ার চেষ্টা করলে অন্যরা সবাই আমাকে তোলার বদলে অন্যকে ডুবিয়ে নিজে উঠতে চেয়ে পরিণতিতে সবাই ডুবে যায় বলে এটা অকার্যকর এবং এর পরিণতি গ্লোবাল রিসেশন। হ
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 


আরো সংবাদ



premium cement