২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

করোনা : সঙ্গ ত্যাগের ভাইরাস

-

এতদিন জেনে এসেছি, সঙ্গবঞ্চিত মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে। সঙ্গবঞ্চনার প্রথম ধাক্কা একাকিত্ব। একাকিত্বকেও এক ধরনের রোগ বলা হয়ে থাকে। কেননা একাকিত্বের যন্ত্রণা আরো নানা ধরনের রোগের কারণে পরিণত হয়ে থাকে। এ জন্য অধিকাংশ কবি বন্ধুর মিলনের আকাক্সক্ষা করেন এবং সঙ্গত্যাগকে মহামারী সাব্যস্ত করে থাকেন। ভাগ্যের লিখন দেখুন, আমাদের এ জীবনে এমন এক সময় দেখতে হচ্ছে, যখন সারা বিশ্বের চিকিৎসকগণ একাকিত্ব ও সঙ্গ ত্যাগকে এক ভয়ঙ্কর মহামারীর চিকিৎসা হিসেবে সাব্যস্ত করছেন। করোনাভাইরাস নামের আন্তর্জাতিক মহামারী চীন থেকে ইতালি এবং ইরান থেকে পাকিস্তান পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষের প্রাণ নিয়েছে। লাখ লাখ মানুষ এ মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছে। শক্তিধর দেশগুলো অস্ত্র ও পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণের পেছনে বার্ষিক হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে যাচ্ছে, অথচ করোনাভাইরাসের সামনে সব পারমাণবিক শক্তি আজ অসহায়। কারো কাছে এ মহামারীর কোনো চিকিৎসা নেই। কেননা স্বাস্থ্য ও বিশুদ্ধ জলবায়ু ওইসব শক্তিধর গোষ্ঠীর প্রাধান্যের তালিকায় যুক্ত ছিল না। এখন এসব শক্তিধর দেশ এ আন্তর্জাতিক মহামারী থেকে বাঁচার জন্য নিজেদের সীমান্ত বন্ধ করে দিচ্ছে। কোথাও কারফিউ জারি করা হচ্ছে। কোথাও করা হচ্ছে লকডাউন। মৃতের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আর অসহায় চিকিৎসকরা প্রিয়জনের সান্নিধ্য ও সংস্পর্শকে প্রাণঘাতী বিষরূপে সাব্যস্ত করছেন। তারা বলছেন, শিশুদের মাথায় চুমো দিবেন না, কারো সাথে কোলাকুলি করবেন না; এমনকি করমর্দনও করবেন না। দূরে থেকে হাতের ইশারা করবেন। দুই সপ্তাহ আগে বিশ্বের একমাত্র সুপারপাওয়ার আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস-এর সদর দফতর থেকে বেরিয়ে বন্ধু স্টিভেন বাটলারের সাথে কফিশপের দিকে যাচ্ছিলাম। সেখানে বব ডিয়েটস আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। বাটলার সারা রাস্তায় করোনাভাইরাস নিয়ে কথা বললেন। তিনি বলছিলেন, আজকের পর তিনি অফিসে আসবেন না। বরং ঘর থেকেই ল্যাপটপে কাজ করবেন। আমার কাছে কথাগুলো বড় আশ্চর্যজনক মনে হলো। একজন সাংবাদিক ঘরে বসে কিভাবে কাজ করবেন?
ডিয়েটসের সাথে সাক্ষাতের পর স্যানিটাইজার কেনার জন্য ব্রডওয়ের ফার্মেসির একটা বড় স্টোরে ঢুকলাম। ওই স্টোরে সব স্যানিটাইজার শেষ হয়ে গিয়েছিল। জানা গেল, মানুষজন খাদ্য-পানীয়সামগ্রী ও ওষুধপত্র কিনে ঘরের মধ্যে নিজেকে বন্দী করছে। সুপারপাওয়ার দেশের নাগরিক পর্যন্ত করোনাভাইরাসের কাছে অসহায়। দু’দিন পর পাকিস্তানে ফিরে এসে দেখলাম, আমাদের মিডিয়া করোনাভাইরাসের পরিবর্তে এই আলোচনা নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে যে, নওয়াজ শরিফ পাকিস্তান প্রত্যাবর্তন করবেন কি না। এ সময় জং গ্র“পের এডিটর ইন চিফ মীর শাকিলুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমার বিশ্বাস, গ্রেফতারির জন্য সময়টাকে বেছে নেয়ার পেছনে এ দুষ্টখেয়াল কাজ করেছে যে, করোনাভাইরাসের ঝুঁকিতে শাকিলুর রহমানের জন্য কেউ হইচই করবে না। কিন্তু এ ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কেউ মানুক আর না মানুক, সরকারের নীরবতার কারণে মিডিয়া অনেক পরে করোনাভাইরাসের প্রতি মনোযোগ দিয়েছে। সরকারের কিছু মন্ত্রী ও উপদেষ্টার কথা বলার ধরন থেকে এ আশঙ্কা অনুভূত হচ্ছিল যে, তারা নিজেদের অযোগ্যতা ও অনুপযুক্ততাকে পর্দাবৃত করার জন্য করোনাভাইরাসে মৃত্যুর দায়ভারও মিডিয়ার ওপর চাপিয়ে দিতে মোটেও কুণ্ঠিত হবেন না।
কেউ বলছে, করোনা আল্লাহর আজাব। কেউ বলছে, আজাব নয়, পরীক্ষা।’ ২০০৯ সালের কথা। খুব বেশি পুরনো হয়নি। মেক্সিকো থেকে সোয়াইন ফ্লু নামে এক মহামারী ছড়িয়ে পড়েছিল। এতে লাখ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। এর আগে প্লেগ, কলেরা, ইনফ্লুয়েঞ্জা ও পীতজ্বরের মতো আন্তর্জাতিক মহামারীও বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে। কয়েক বছর ধরে আমরা ডেঙ্গু ভাইরাসেরও মুখোমুখি হচ্ছি। কিন্তু কোনো মহামারী এতটা ভীতি ছড়ায়নি, যতটা করোনাভাইরাস এবার ছড়িয়েছে। এটাকে আজাব বা পরীক্ষা যাই বলুন, এটা তো নিশ্চিত, অধিকাংশ মহামারী নোংরা আবর্জনা থেকে ছড়ায়। আর এ জন্য চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরাও করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে এটাকেই চিকিৎসা মনে করছেন যে, বারবার হাত ধুতে থাকতে হবে এবং ভালোবাসা প্রকাশের ক্ষেত্রে সীমা অতিক্রমের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। একজন কবি বলেছিলেনÑ প্যাহলে তো তারকে তাআল্লুক কী ওবা ফ্যায়লেগী/ফের মুহাব্বাত কা ভী এনকার কিয়া জায়ে গাÑ প্রথমে তো সম্পর্ক ছিন্ন করার মহামারী ছড়িয়ে পড়বে/এরপর ভালোবাসাকেও অস্বীকার করা হবে।
সম্পর্ক ছিন্ন করা বা সঙ্গ ত্যাগের মহামারীর কবিতাটি মুমতাজ আহমদ শায়খের। এ ধরনের একটি কবিতা এতেবার সাজিদও রচনা করেছেনÑ চালী হ্যায় শাহর মেঁ আব কে হাওয়া তারকে তাআল্লুক কী/কাহেঁ হাম সে না হো জায়ে খাতা তারকে তাআল্লুক কী- শহরে এখন চলছে সম্পর্ক ছিন্নের হাওয়া/পাছে আমার দ্বারা সম্পর্ক ছিন্নের অন্যায় না হয়ে যায়।
প্রাচ্যের কবি আল্লামা ইকবাল বলেছিলেন, ‘জাতির সাথে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে ব্যক্তি বেঁচে থাকে। নিঃসঙ্গ একাকী অবস্থায় সে কিছুই নয়।’ অর্থাৎ জাতির সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে মিলেমিশে থাকাকে জাতির টিকে থাকা হিসেবে সাব্যস্ত করেছিলেন। কিন্তু আজ সব দেশের সরকার এবং সব চিকিৎসক বলছেন, জাতির সাথে সামাজিক সম্পর্ক তোমাকে বিনাশ করবে। এ জন্য সব সম্পর্ক ছিন্ন করে নিজেকে ঘরে আবদ্ধ করো।’ কিছু বন্ধু আমাকে বারবার মীর শাকিলুর রহমানের গ্রেফতারির বিরুদ্ধে বিক্ষোভে দেখে বেশ শক্তভাবে বলেছেন, আপনি যদি চিকিৎসকদের নির্দেশের ওপর আমল না করেন, তাহলে কে করবে? এক সন্ধ্যায় পরীক্ষামূলকভাবে কয়েক ঘণ্টার জন্য নিজেকে নিজে ঘরে বন্দী এবং বই-পত্রের সাথে সময় কাটানোর চেষ্টা করলাম। এ ধরনের একাকিত্ব আমাকে উদাসীন করে ফেলল। ভাবতে লাগলাম, আগে তুমি ভিড়কে ভয় পেতে। আর এখন একাকিত্বের সময় ভিড়কে মনে পড়ছে। আগে বন্ধু-স্বজনদের জন্য তোমার সময় ছিল না। আর এখন সময় আছে বটে, কিন্তু মাঝে দূরত্ব এসে গেছে।’ নেককার মানুষ নির্জন একাকিত্বে এবাদতে লিপ্ত থাকতেন। কিন্তু করোনাভাইরাস তো নেককার ও গুনাহগারের পার্থক্যও মিটিয়ে দিয়েছে। মসজিদ, মন্দির, গির্জা, সিনেমা হল, পার্ক, রেস্টুরেন্ট সব বিরান পড়ে রয়েছে। যার কাছে যত বেশি জ্ঞান ও অনুভূতি আছে, সে ততটাই বেশি ভীত। আর যে ব্যক্তি জ্ঞান ও অনুভূতিশূন্য, সে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। একাকিত্বের কষ্ট প্রশমনের জন্য আনমনে একটি গ্রন্থের পাতা উল্টাতে গিয়ে ইফতেখার আরিফের এ কবিতায় আটকে গেলামÑ খাব কী তারাহ বিখার জানে কো জী চাহতা হ্যায়/অ্যায়সী তানহায়ী কে মার জানে কো জী চাহতা হ্যায়Ñ স্বপ্নের মতো বিক্ষিপ্ত হয়ে যেতে মনে চায়/এমন একাকিত্বে মরে যেতে মনে চাচ্ছে। যদি ইফতেখার আরিফের সাথে সাক্ষাৎ হয়, তাহলে দূর থেকে সালাম দেয়ার পর জিজ্ঞাসা করব, জনাব, করোনাভাইরাস থেকে বাঁচার ওষুধ একাকিত্ব। কিন্তু একাকিত্বে মরে যেতে মনে চাইলে তখন কী করবেন? আমি ও আমার একাকিত্ব পরস্পর শেষ পর্যন্ত কতক্ষণ কথা বলব? এ সময় মনে পড়ল, জীবন ও মৃত্যু আল্লাহর হাতে, তাহলে করোনাভাইরাসকে ভয় কেন? কিন্তু ধর্মও যখন বলে, যেখানে মহামারী ছড়িয়ে পড়ে সেখানে যেও না, তখন সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। সবচেয়ে বড় সতর্কতা হলো পরিচ্ছন্নতা, যা ঈমানের অর্ধেক। জীবনের সব কাজ বন্ধ হবে না। কিছু কাজ অতীব জরুরি। কিন্তু এ কাজগুলো বেশ সতর্কতার সাথে করতে হবে। যে ব্যক্তি সম্পর্কের ছিন্নতা বা সঙ্গ ত্যাগকে মহামারী বলত, আজ তাকে মানতে হবেÑ সম্পর্ক ছিন্ন রাখা বা সঙ্গ ত্যাগ কিছু সময়ের জন্য একটি চিকিৎসাও বটে। তবে এ চিকিৎসা বেশি সময় চলবে না, কেননা প্রতিটি দুঃসময় একসময় চলেই যায়।হ
পাকিস্তানের জাতীয় দৈনিক জং ২৩ মার্চ সংখ্যা থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : পাকিস্তানের জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক


আরো সংবাদ



premium cement
গাজায় সাহায্য বাড়াতে ইসরাইলকে নির্দেশ আইসিজের দিল্লি হাইকোর্টে কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে জনস্বার্থ মামলা খারিজ বস্ত্র-পাট খাতে চীনের বিনিয়োগ চায় বাংলাদেশ জামালপুরে সাব রেজিস্ট্রারকে হত্যার হুমকি মামলায় আ’লীগ নেতা গ্রেফতার গাজায় অনাহার যুদ্ধাপরাধ হতে পারে : জাতিসঙ্ঘ ‘প্রত্যেককে কোরআনের অনুশাসন যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে’ মতলব উত্তরে পানিতে ডুবে ভাই-বোনের মৃত্যু প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের শেষ ধাপের পরীক্ষা শুক্রবার লম্বা ঈদের ছুটিতে কতজন ঢাকা ছাড়তে চান, কতজন পারবেন? সোনাহাট স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করলেন ভুটানের রাজা বছরে পৌনে ৩ লাখ মানুষের মৃত্যু দূষণে

সকল