২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী

-

দু’টি অসাধারণ অর্জন পাক-ভারত বাঙালি মুসলমান জনগোষ্ঠীর সম্মান, মর্যাদা ও গৌরবকে পৃথিবীর বুকে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তার একটি হলো ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, যা অর্জিত হয় মেজর মোহাম্মদ আবদুল গণির নেতৃত্বে। অপরটি হলো বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ, যা অর্জিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। এর একটি অপরটির সম্পূরক। তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাঙালিদের নিয়ে একটি মাত্র রেজিমেন্টই গঠন করা হয়েছিল। এর গোড়াপত্তন হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়ন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরুর সময় মোট আটটি ব্যাটালিয়ন ছিল এবং এ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টই স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করে এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মূল ভিত্তি রচনা করেছে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল উপনিবেশবাদী ব্রিটিশ বেনিয়াদের কাছে। দীর্ঘ প্রায় ২০০ বছর কঠিন ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পরও ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারতের মতো উপমহাদেশের মানচিত্রে বাংলা নামের এলাকাটি স্বাধীন দেশের মর্যাদা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করতে পারেনি। যদিও স্বাধীনতা আন্দোলনে এ দেশের জনসাধারণের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। পাকিস্তানি নেতাদের কূট চক্রান্তে আটকে পড়েন এ দেশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা। ক্ষমতার ষোলোআনাই পকেটে তুলে নেয় কুচক্রীমহল। আাবারো রিক্ততা ও বঞ্চনার ইতিহাসে জড়িয়ে পড়ে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। শুরু হয় গণ-আন্দোলন। ধীরে ধীরে এ আন্দোলন দানা বেঁধে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ নেয় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চে। গভীর রাতের নিকষকালো অন্ধকার ভেদ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দৈত্যের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরীহ, নিরপরাধ ও বিপন্ন বনি আদমের ওপর। সেনাবাহিনীর বুলেট নিñিদ্র অন্ধকার ফুঁড়ে আঘাত হানতে থাকে ঘুমন্ত মানুষের ওপর।
এমনকি এক পরিস্থিতিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসে (ইপিআর) কর্মরত সব স্তরের বাঙালি অফিসার ও জওয়ানরা মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন হানাদার বাহিনীর ওপর। সশস্ত্রবাহিনী সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে, তারা সহজেই বুঝতে পারবেন যে, একটি সুসংগঠিত সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে থেকে বিদ্রোহ ঘোষণা করা কত অকল্পনীয় ও কঠিন কাজ। কেন না, একটি দেশের সংবিধান ও পবিত্র কুরআন ছুঁয়ে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা শপথ করে থাকেন সরকারের প্রতি অনুগত থেকে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার জন্য। তাই বিদ্রোহ করা মানেই হলো দেশদ্রোহিতা। সরকারের বেসামরিক ব্যক্তিরা যত ধরনের বিদ্রোহই করুক না কেন, রাষ্ট্রদ্রোহিতা হলেও তাদের শাস্তি দেয়া দুরূহ, সময়সাপেক্ষ ও জটিল ব্যাপার। আর এ জন্য তাদের পক্ষে বিদ্রোহ করা বা অসহযোগ আন্দোলন ততটা ঝুঁকিপূর্ণ নয়। কিন্তু সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যদের জন্য রয়েছে ব্যতিক্রমধর্মী নিজস্ব আইন। এ আইনের সাহায্যে, বিদ্রোহ করার সাথে সাথে সামরিক আদালতের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা যায়। সে জন্য একটি জলন্ত অগ্নিকুণ্ডে স্বজ্ঞানে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো কঠিন কাজ হলো সশস্ত্রবাহিনীতে বিদ্রোহ করা। ঠিক এমন ধরনের ঝুঁকি নিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধে আমাদের সেনাবাহিনীর সদস্যরা চরম আত্মত্যাগের মতো কঠিন কাজ হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছিলেন।
বর্তমান বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ঐতিহ্যবাহী ও অত্যন্ত গৌরবময় ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং দেশবাসীর হৃত অধিকার পুনরুদ্ধার করার জন্য সব সময় সেনাবাহিনীর ভূমিকা অনন্য সাধারণ। প্রতিটি কাজে সততা, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা, খাঁটি দেশপ্রেম ও ঈমানের পরিচয় দিয়েছেন আমাদের অকুতোভয় সৈনিকরা। স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত জনগণের ভাবাবেগকে পুঁজি করে স্বার্থান্বেষী মহল যখন নামেমাত্র মুক্তিযুদ্ধের লেবাস পরিধান করে এবং ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সেজে আখের গোছানোর কাজে সদা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে, ঠিক সে মুহূর্তে সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে, ঈমানের বলে বলীয়ান হয়ে সেনাবাহিনীর সদস্যরা মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার কাজে সম্পূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করেছিলেন।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রথম থেকেই সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি সদস্যদের নিরস্ত্র করার কাজ শুরু হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ বাঙালি অফিসারদের নানা অজুহাতে সরিয়ে দেয়া হয় তাদের পদ থেকে। অনেক বাঙালি অফিসার ও জওয়ানকে জোরপূর্বক পাঠানো হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। অবসরপ্রাপ্ত সদস্যদের ওপরেও ছিল কঠোর নজরদারি। কিন্তু দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ বাঙালি সদস্যদের দমিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। নিরস্ত্র করা হলেও দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা ও কঠোর প্রশিক্ষণে দক্ষ সদস্যরা সময়মতো বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পরিত্যাগ করে সদলবলে দেশের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্রসংগ্রামের প্রয়োজনে অক্লান্ত পরিশ্রম শুরু করেন। সেনাবাহিনীতে একটি কথার ওপর খুব বেশি জোর দেয়া হয়। সেটি হলোÑ ‘শক্ত প্রশিক্ষণ, সহজ যুদ্ধ’। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তুলনামূলকভাবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সদস্য সংখ্যা কম হলেও যোগ্যতা, দক্ষতা ও নিষ্ঠার দিক থেকে পশ্চিমা সদস্যদের তুলনায় বাঙালিরা অনেক বেশি সাহসী, প্রশিক্ষিত ও অগ্রসর ছিলেন। সফল যুদ্ধের অভিজ্ঞতাও ছিল বাঙালিদের। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি শৌর্য, বীর্য ও সাহসিকতার পরিচয় দেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সদস্যরা। রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রদত্ত বীরত্বসূচক পদক আনুপাতিক হারে বাঙালি সদস্যরাই বেশি পেয়েছিলেন। ‘সিতারায়ে জুরাত’ পদক পেয়েছিলেন তিনজন এবং ‘তমঘায়ে জুরাত’ সাতজন।
স্বাধীনতাযুদ্ধে পূর্ব অভিজ্ঞতাকে সম্পূর্ণভাবে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছিল আমাদের সেনাবাহিনী। কেননা, পাকিস্তানের সাথে চাকরি করাকালে তাদের অস্ত্রভাণ্ডার, সাজ-সরঞ্জাম, রণনীতি, রণকৌশল, অভ্যাস আচরণ, নিয়ম-কানুন, শৃঙ্খলা, মনোভাব, চরিত্র এবং সর্বোপরি তাদের দুর্বলতা ইত্যাদি সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা ছিল আমাদের বাঙালি সদস্যদের। এ বাস্তবতাকে অতি সহজেই তারা কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছিলেন স্বাধীনতাযুদ্ধে। ২৫ মার্চের কালরাতে অসহায় নিরস্ত্র জনসাধারণের ওপর অতর্কিত আক্রমণে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন এদেশবাসী। কিন্তু দেশের মুক্তিপাগল অকুতোভয় বীর সেনারা ভীত কিংবা হতবিহ্বল হননি। দৃপ্ত ও দৃঢ় পদক্ষেপে, অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে দেশকে হায়েনাদের কবল থেকে মুক্ত করার কঠিন দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেন। এ দুঃসময়ে সেনাবাহিনীর অকুতোভয়, তেজস্বী ও একনিষ্ঠ দেশপ্রেমিক অফিসার, ৮ বেঙ্গলের উপ-অধিনায়ক তথা বাংলাদেশের ইতিহাসে ক্ষণজন্মা এক বিরল ব্যক্তিত্ব মেজর জিয়াউর রহমান ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এ ঘোষণার মাধ্যমে জাতি হয় উজ্জীবিত, পায় পথের দিশা। আর সশস্ত্রবাহিনী শুরু করে দেশকে শত্রুমুক্ত করার কঠিন যুদ্ধ।
সেনাবাহিনী, ইপিআর ও পুলিশের সব বাঙালি সদস্যকে সংগঠিত করে নেতৃত্ব গ্রহণ করেন আমাদের সেনা অফিসাররা। সব সময় অত্যন্ত নীরবে, নিঃস্বার্থভাবে যে সেনাবাহিনী এ দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছিল, তারা এক ক্রান্তিলগ্নে মহান আল্লাহর ওপর ভরসা করে এগিয়ে এলেন। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রাণপুরুষ অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল আতাউল গনি ওসমানীর নেতৃত্বে একত্রিত হলেন সশস্ত্রবাহিনীর প্রায় ২০ হাজার সুপ্রশিক্ষিত বাঙালি সদস্য। প্রবাসী বাংলাদেশী সরকার কর্নেল ওসমানীকে ‘মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক’ হিসেবে নিয়োগ দেন। সঙ্ঘবদ্ধভাবে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করার আগেই ২৬ মার্চ থেকে বাঙালি সদস্যদের দিয়ে গঠিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বীর সৈনিক, ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা সেনা অফিসারদের নেতৃত্বে শত্রুবাহিনীকে প্রতিরোধ করা শুরু করেছিলেন। দেশবাসীকে দমন করার জন্য পাকিস্তানিদের সশস্ত্র কার্যক্রমের তীব্র জবাব দান যখন শুরু হলো, তখন দলে দলে কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবক তথা জনসাধারণ বাঙালি সেনাদের সাথে যোগ দিতে শুরু করলেন। স্বাধীনতাযুদ্ধ সর্বপ্রথম শুরু হলো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঐতিহ্যবাহী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পাঁচটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন দিয়ে। এ ব্যাটালিয়নগুলো ছিল ১-ই বেঙ্গল, ২-ই বেঙ্গল, ৩-ই বেঙ্গল, ৪-ই বেঙ্গল, ও ৮-ই বেঙ্গল। পরে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে গঠিত হয় ৯-ই বেঙ্গল, ১০-ই বেঙ্গল ও ১১-ই বেঙ্গল। ৫-ই বেঙ্গল, ৬-ই বেঙ্গল ও ৭-ই বেঙ্গল তখন পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থান করছিল এবং এই পল্টনগুলো বাঙালি সদস্যদের সেনানিবাসের ভেতরে অবরোধ করে রাখা হয়। বলে রাখা দরকার, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠিত হয়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দুরন্ত, দুর্ধর্ষ, অকুতোভয় বীর বাঙালি সদস্যদের নিয়ে।
এই রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়ন ১-ই বেঙ্গল ‘সিনিয়রর্স টাইগার্স’ নামে পরিচিত। এই পল্টনের অসীম সাহসী সদস্যরা ১৯৭১ সালে ৩০ মার্চ যশোর সেনানিবাসে জীবন বাজি রেখে দেশপ্রেমের মূলমন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়। এ ঐতিহ্যবাহী ব্যাটালিয়নের বীর যোদ্ধারা ওইদিন ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার আবদুুর রহিম দুররানীকে নিরস্ত্র করে অস্ত্র ও বারুদাগারের তালা ভেঙে সব অস্ত্র-গোলাবারুদ নিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করেন। দীর্ঘক্ষণ যুদ্ধ চালিয়ে এ ব্যাটালিয়ন সেনানিবাস থেকে বের হয়ে আসে। এ যুদ্ধে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আনোয়ার হোসেন, বীর উত্তম শহীদ হন। এ ছাড়াও অন্য ৪০ জন বীর সৈনিক ওই সংঘর্ষে শহীদের মর্যাদা লাভ করেন। এরপর ১-ই বেঙ্গল তৎকালীন ক্যাপ্টেন মো: হাফিজ উদ্দিনের নেতৃত্বে চৌগাছায় একত্রিত হয়েছিল। ওই স্থানে হেডকোয়ার্টার স্থাপন করে তারা যশোরের বিভিন্ন এলাকায় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত অত্যন্ত বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে এ ইউনিট বেনাপোলের তিন মাইল আগে কাগজপুকুর এলাকায় সদর দফতর স্থাপন করে। ওই স্থান থেকে পাকিস্তানি বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করতে শুরু করে দেয় এ ব্যাটালিয়ন। ১৬ ডিসেম্বর দেশ মুক্ত হওয়া পর্যন্ত বীরবিক্রমে এ পল্টন যুদ্ধ করা যায়। এর অনেক বীর সৈনিক স্বাধীনতা যুদ্ধে শাহাদত বরণ করেন। বিখ্যাত ধলই যুদ্ধে এ পল্টনের সিপাহী মো: হামিদুর রহমান শত্রু বাহিনীর অধিনায়কসহ তিনজনকে হতাহত করেন এবং শত্রুর গুলিতে নিজেই শহীদ হন। তিনি ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। স্বাধীনতাযুদ্ধে এ ব্যাটালিয়নের পাঁচজন বীর উত্তম, ৯ জন বীর বিক্রম ও ১২ জন বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত হন।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অত্যন্ত দুর্ধর্ষ একটি ব্যাটালিয়ন ২-ই বেঙ্গল। তারা ‘জুনিয়র টাইগার্স’ নামে পরিচিত। স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময়ে এ ব্যাটালিয়নের অবস্থান ছিল জয়দেবপুর (বর্তমানে গাজীপুর), টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ। উপ-অধিনায়ক মেজর শফিউল্লাহর (পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান) নেতৃত্বে অসীম সাহসিকতার সাথে এ ইউনিট ২৭ মার্চ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ করে ২৯ মার্চ মোমেনশাহীতে একত্রিত হয়। ইতোমধ্যে ২-ই বেঙ্গলের বীর সৈনিকরা বহু পাকিস্তানি সৈন্যকে নিধন করেছিল। ২৯ মার্চ বিকেলে সব স্তরের নেতাকে নিয়ে মোমেনশাহীতে মেজর শফিউল্লাহ বৈঠক করেন। সেখানে তিনি যুদ্ধ পরিচালনার সার্বিক পরিকল্পনা পেশ করেন এবং সব স্তরের জনসাধারণ তার সাথে একাত্মতা পোষণ করে। সঙ্ঘবদ্ধভাবে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত ২-ই বেঙ্গলের নেতৃত্বে মোমেনশাহী ও টাঙ্গাইল জেলায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে এ পল্টনের বীরত্বগাথা চিরস্মরণীয়। ২৯ নভেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত এই পল্টন কর্তৃক পাকিস্তান বাহিনীর পাঁচজন অফিসার ও ১৯৪৭ জন সৈনিক নিহত ও ১০১ জন সৈনিক বন্দী হন। জুনিয়র টাইগার্সের একজন অফিসার, তিনজন জেসিও, ৫৬ জন সৈনিক শাহাদত বরণ করেন। স্বাধীনতাযুদ্ধে ব্যাটালিয়নের দুইজন বীর উত্তম, আটজন বীর বিক্রম ও ৯ জন বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত হন।
৩-ই বেঙ্গল ‘মাইনর টাইগার্স’ নামে পরিচিত। স্বাধীনতাযুদ্ধের শুরুতে ৩-ই বেঙ্গলের অবস্থান ছিল সৈয়দপুর সেনানিবাসে। সে সময়ে ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক ও উপ-অধিনায়ক পাঞ্জাবি ছিলেন। এর পরও বাঙালি অফিসার ও জওয়ানরা দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য বৃহত্তর স্বার্থে চরম আত্মত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন ৩১ মার্চ রাতে। বিদ্রোহ ঘোষণা করেন ৩-ই বেঙ্গলের সদস্যরা। শুরু হয় প্রচণ্ড যুদ্ধ। অসংখ্য পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করে বের হয়ে আসেন তারা সেনানিবাস থেকে। তরুণ বাঙালি অফিসারদের অসীম সাহস, তেজস্বিতা ও দেশপ্রেম সবাইকে উদ্বুদ্ধ করে। সেনানিবাস ছেড়ে এ ব্যাটালিয়ন ফুলবাড়ী এলাকাতে আস্তানা গড়ে তোলে এবং ছাত্র-যুব শ্রেণীকে তারা একত্রিত করে বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর বেপরোয়া হামলা পরিচালনা এবং অকল্পনীয় সাফল্য অর্জন করে। এভাবে আমাদের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করে তোলে। স্বাধীনতাযুদ্ধে এই পল্টনের ১১১ জন সদস্য শাহাদত বরণ করেন। ২৬ জন সদস্য বিভিন্ন বীরত্বসূচক জাতীয় খেতাবে ভূষিত হন।
৪-ই বেঙ্গল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গৌরবদৃপ্ত এক ব্যাটালিয়ন, যা ‘বেবি টাইগার্স’ নামে পরিচিত। বঙ্গ শার্দুল বাহিনীর বীরত্বপূর্ণ ইতিহাসে এ ইউনিটের অবদান অবিস্মরণীয়। স্বাধীনতাযুদ্ধের শুরুতে এর অবস্থান ছিল কুমিল্লা সেনানিবাস, মৌলভীবাজারের শমসেরনগর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকায়। ২৬ মার্চের সকালেই এ ব্যাটালিয়নের বাঙালি অফিসারদের নেতৃত্বে বীর জওয়ানরা, এর পাকিস্তানি অফিসার ও সৈনিকদের বন্দী করে বিদ্রোহ ঘোষণার মাধ্যমে সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকা করতলগত করেছিল। এ এলাকার ছাত্র-যুবকরা ৪-ই বেঙ্গলের সাথে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নেয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দুই-তিন মাস বীর বিক্রমে বৃহত্তর কুমিল্লা অঞ্চলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে নাজেহাল করার মাধ্যমে স্বাধীনতাযুদ্ধকে বহু দূর এগিয়ে নিয়ে যায় এ ব্যাটালিয়ন। স্বাধীনতাযুদ্ধে বেবি টাইগার্সের একজন বীরশ্রেষ্ঠ, পাঁচজন বীর উত্তম, আটজন বীর বিক্রম, আটজন বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত হন।
একইভাবে, ৮-ই বেঙ্গলের ইতিহাস ও স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই ইউনিট ‘দ্য পাইওনিয়ার্স’ নামে পরিচিত। হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত ও নির্লজ্জ আক্রমণের সাথে সাথে এ ব্যাটালিয়নের অফিসার ও সব পদবির সৈনিকেরা ব্যাঘ্র হুঙ্কারে ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রুর ওপর। এ ইউনিটের অসীম সাহসী, বীর উপ-অধিনায়ক কিংবদন্তি পুরুষ মেজর জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার সম্প্রচার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন অফিসারের কণ্ঠ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণার আওয়াজ সারা দেশে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে এবং স্বাধীনতাযুদ্ধে উজ্জীবিত হয় এ দেশের সর্বস্তরের জনসাধারণ। এর সাথে, ৮-ই বেঙ্গলের বীর সৈনিকরা তীব্রগতিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন শত্রুসেনাদের ওপর। ৮-ই বেঙ্গলের সাথে যোগদান করে চট্টগ্রামের ইপিআর, পুলিশ ও ছাত্র-যুবক-জনতা। শুরু হয়ে যায় আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ। বীর বিক্রমে যুদ্ধ পরিচালনা করেন মেজর জিয়া। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায় পাকিস্তানের সেনা বাহিনীকে পর্যুদস্ত করতে থাকেন ৮-ই বেঙ্গলের বীর সেনারা। স্বাধীনতাযুদ্ধে পাইওনিয়ার্সের ৯৩ জন সৈনিক শাহাদত বরণ করেছিলেন। বীরত্বপূর্ণ কৃতিত্বের জন্য পল্টনের সাতজন বীর উত্তম, ছয়জন বীর বিক্রম ও ৯ জন বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত হন। এ পল্টনের মুন্সি আব্দুর রউফ রাঙ্গামাটির নানিয়ার চর এলাকায় পাকিস্তানি হানাদারদের সাথে তীব্র লড়াইয়ের সময় শাহাদত বরণ করেন এবং বীর শ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত হন। তিনি তৎকালীন ইপিআর থেকে ৮-বেঙ্গলে যোগদান করেছিলেন।
এভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পাঁচটি ব্যাটালিয়ন দিয়ে শুরু করেছিল মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ। প্রথম কিছু দিন বিচ্ছিন্নভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আমাদের সেনাবাহিনী যুদ্ধ করার পর এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে জেনারেল ওসমানীর নেতৃত্বে অন্যান্য অফিসার একত্রিত হন। সুশৃঙ্খলভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করার জন্য সেনাবাহিনীকে তিনটি শক্তিশালী ব্রিগেডে বিভক্ত করা হয়। এগুলোর নামকরণ করা হয় জিয়াউর রহমান, শফিউল্লাহ ও খালেদ মোশারফের নামের আদ্যাক্ষর অনুযায়ী, যথাক্রমে জেড ফোর্স (১, ৩ ও ৮ ইস্ট বেঙ্গল), এস ফোর্স (৪, ৯ ও ১০ ইস্ট বেঙ্গল) এবং কে ফোর্স (২ ও ১১ ইস্ট বেঙ্গল) হিসেবে। সারা দেশকে বিভক্ত করা হয় ১১টি সেক্টরে এবং নিযুক্ত হন ১১ জন সেক্টর কমান্ডার। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যুদ্ধ পরিচালিত হতে থাকে। সারা দেশে হানাদার বাহিনী পর্যুদস্ত হয়ে সেনানিবাসে ফিরে আসতে থাকে। অসংখ্য হানাদার সৈন্য আহত ও নিহত হয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। নভেম্বর মাসের শেষ নাগাদ কেবল কয়েকটি সেনানিবাস ছাড়া পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বিশে^র মানচিত্রে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। এ স্বাধীনতার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অসংখ্য সদস্য শহীদ হয়েছেন, পঙ্গু হয়েছেন অনেকে। সেনাবাহিনীর আত্মত্যাগ এ জাতির ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে সেনাবাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকাকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। দীর্ঘ ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে প্রতিটি যুদ্ধ পর্যালোচনা করলে এ সত্যটি দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা সব ঘটনার সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন। প্রতিটি যুদ্ধের সিদ্ধান্ত গ্রহণ, কার্যকর ব্যবস্থার পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়ন করেছে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। লক্ষাধিক বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধার সংগঠিত করে, তাদেরকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ, রণকৌশল শিক্ষা দান, শত্রুশিবিরে অতর্কিত আক্রমণ ইত্যাদি কার্যক্রম বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সরাসরি করেছিল। দেশের প্রাণশক্তি হলো আমাদের প্রাণপ্রিয় সেনাবাহিনী। আমাদের সেনাবাহিনী যদি স্বাধীনতাযুদ্ধের নেতৃত্ব না দিত, তাহলে দেশের ইতিহাস হয়তো ভিন্ন হতো। নির্দ্বিধায় বলা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস আর আমাদের সেনাবাহিনীর ইতিহাস একই নিবিড় সূত্রে গাঁথা। হ
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
hoque2515@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement