১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ফেসবুক-ইউটিউবের বিষাক্ত ছোবল

-

‘ফেসবুক-ইউটিউব মনোযোগ বিনাশী ভয়ঙ্কর এক সময়খাদক’ শিরোনামের ওপর গত ১২ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট বার অডিটোরিয়ামে সেমিনার হয়েছে। আয়োজক ল’ইয়ার্স মেডিটেশন সোসাইটি। প্রধান বক্তা ও আলোচক মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান, যিনি সম্পাদক ও প্রকাশক সাপ্তাহিক বিপরীত স্রোত। সেমিনারের সঞ্চালক অ্যাডভোকেট মনিরুজ্জামান ফেসবুক-ইউটিউবের বহুল ব্যবহারের তুলনা করেÑ ‘ছোটদের বড়দের সকলের গরিবের নিঃস্বের বেকারের’ গানের সুরে প্রথমেই অ্যানিমেশন দেখিয়েছেন। সবাক অ্যানিমেশনের প্রাণবন্ত প্রতিবেদনে সোশ্যাল মিডিয়ার অস্বাভাবিক নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরা হলো। সোশ্যাল মিডিয়ার লাইক-কমেন্ট ফলোয়ার এক অস্বাভাবিক জটিলতার সৃষ্টি করছে। বিশেষত পারফেক্ট সেলফি তোলার অস্থিরতা আর বিপজ্জনক সেলফি তোলার মরিয়া ভাব ভোগাচ্ছে মানসিক অশান্তিতে। লাইক ও কমেন্টে যখন প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির গরমিল তখনই জড়িয়ে পড়ছে হতাশা, হীনম্মন্যতা ও বিষণœতায়Ñ কমছে মনোযোগ, পাঠে আগ্রহ, কল্পনা শক্তি, চিন্তাশক্তি এবং বাড়ছে দৈহিক স্থূলতা।
ভার্চুয়াল ভাইরাসের অসহায় শিকার
শিশুরা না বুঝে প্রতিনিয়ত ঢুকে পড়ছে অনলাইনে; তা যে আর কোনো দিনও মাথা থেকে মুছে যাবে না, তাও জানে না কোমলমতি শিশু-কিশোররা। এ বিষয়ে মা-বোনদের কাছে কয়েকটি প্রশ্ন, শিশুকে খাওয়াতে গিয়ে বা লাইক শেখাতে গিয়ে আপনি কী মোবাইল তুলে দেননি তার হাতে? শিশুকে সময় দিতে পারেন না বলে, ‘মোবাইল নিয়ে পড়ে থাক’ চাননি? পড়ার অবসরের সময়টা শিশু কী করে কাটায়, তা নিয়ে আপনি ভেবেছেন কখনো? বই পড়া, শরীরচর্চা করা ও মাঠে খেলতে যাওয়ার মতো চিন্তা করেছেন কখনো? আপনার শিশু কম্পিউটারের নেটে ঢুকে কী করে, তার কি খোঁজ নিয়েছেন কোনো দিন?
একটা নির্ধারিত সময় পর্যন্ত শিশুদের কোনো ডিভাইসের সামনে আসতে দেবেন না। পাঁচ বছর পর্যন্ত সন্তানের রোলমডেল হতে নিজেরাও বিরত থাকুন ফেসবুক-ইউটিউব থেকে। বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে সন্তানের হাতে স্মার্টফোন দেবেন না। ঘরে শিশু থাকলে স্মার্ট টিভি ওদের নাগালের বাইরে রাখুন। শিশুদের ভার্চুয়ালমুক্ত রাখতে নিজেও ‘ভার্চুয়ালমুক্ত’ থাকুন। শিশুদের একা থাকতে ও একা ভাবতে দেবেন না।
এক তথ্যে প্রকাশ, ‘সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এবিসি টেলিভিশন প্রকাশিত একটি প্রামাণ্যচিত্রে শিশুদের ওপর ডিজিটাল ভাইরাসের ক্ষতিকর দিক আরো স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। ছোট্ট শিশুটি কত দারুণভাবে স্মার্টফোন বা ট্যাবের স্ক্রিন ব্রাউজ করছে। দেখে আমরা অনেকেই হয়তো বিস্মিত, আনন্দিত অথবা গর্ব বোধ করি। তবে ফোনটা যখন নিয়ে নেয়া হয়, তখন তাকে কান্না করতে দেখা যায়।
একটা সমীক্ষায় দেখা যায়, শতকরা ৭০ ভাগ মার্কিন মা-বাবাই তাদের শিশুদের সামাল দেয়ার জন্য ট্যাব বা এ ধরনের ডিভাইস ওদের হাতে ধরিয়ে দেন। ইউনিসেফ বলছে, বিশ্বে প্রতি তিনজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর একজন শিশু। আর রোজ এক লাখ ৭৫ হাজার শিশু ইন্টারনেটে আসক্ত হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতি আধা সেকেন্ডে একজন শিশু নতুন করে ইন্টারনেটে যুক্ত হচ্ছে। আবার ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ২৫ শতাংশের বয়স ১০ বছরের চেয়ে কম। ছোট ছোট শিশুদের ওপর এসব ভার্চুয়ালআসক্তির কী ধরনের প্রভাব পড়ছেÑ এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন নিউইয়র্কের একদল গবেষক। তা একজন টোভা ক্লাইন। বার্নার্ড সেন্টার ফর টডলার ডেভেলপমেন্টের একজন পরিচালকও তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের এবিসি টিভিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, শিশুকে শান্ত করার জন্য যত বেশি আপনি এসব ডিভাইস ব্যবহার করবেন, তত সে নিজে নিজে কিছু শেখা থেকে পিছিয়ে পড়বে। এবিসি টিভিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি অভিভাবকদের পরামর্শ দিয়ে বলেন, শিশুরা যখন চিৎকার করছে অথবা রাগারাগি করছে, তাকে কোনো ডিভাইস না দিয়ে অন্যভাবে শান্ত করার চেষ্টা করুন।
ভৌতিক কল সিম্পটমে আক্রান্ত
মনে হয়, বেজে উঠছে সেট। এর কারণ, আধুনিক সময়ে মোবাইল ফোনের অতিপ্রয়োগে মস্তিষ্কের ভেতর যে বিভ্রম সৃষ্টি হয় তা মনকে এতই বেশি আচ্ছন্ন করে ফেলে যে, লাইক-কমেন্ট এলো কি এলো নাÑ সর্বদা সেট হাতে নিয়ে বারবার তা দেখার প্রবণতা জাগতে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, একজন মানুষ যখন অন্য মানুষের সাথে কথা বলে তখন সে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ নিজের বিষয় নিয়ে কথা বলে। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় ৮০ শতাংশ সময়েই সে নিজকে নিয়ে ভাবে। ডিভাইসে একবার ঢুকলে কখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার হয়ে যায়, টেরই পাওয়া যায় না। মাদক আর ফেসবুকে আসক্তি দুই আসক্তিই মস্তিষ্কের হোয়াইট বাটনগুলো ক্ষয় করে দেয়। এ হোয়াইট বাটন নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের আবেগ, মনোযোগ, চিন্তাশক্তি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। এটা ক্ষয়ে গেলে মনের এসব ক্ষমতা লোপ পায়। এমনকি ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। মানুষের মস্তিষ্ক থেকে এক প্রকার কেমিক্যাল নিঃসৃত হয়। এটা প্রয়োজনের অতিরিক্ত বাড়াতে চাওয়ার নামই আসক্তি। আসক্তি মনোযোগের ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়।
ডিজিটাল কোকেন
প্রবল আসক্তির নাম ‘ডিজিটাল কোকেন’। কোকেনের কারণে প্রতিদিনই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাসহ প্রাণনাশের খবরও পাওয়া যায়। প্রথম ঘটনা : কিছু দিন আগে রাজধানীর শেওড়াপাড়ার একটি ভবনের ছাদে ফেসবুকে ব্যস্ত ছিল ১৫ বছরের এক কিশোর। সে কথাও বলছিল কানে হেডফোন লাগিয়ে। ছাদের ওপর সে অবিরাম হাঁটলেও চোখ ছিল মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে। এক পর্যায়ে সে ছাদ থেকে পড়ে যায় নিচে। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু ঘটে। দ্বিতীয় ঘটনা : এসএসসিতে জিপিএ ফাইভ পাওয়া সাইফুল ইন্টারমিডিয়েটেই ফেল। রেজাল্ট দেখে হতবাক তার বাবা-মা। কী করে সম্ভব? অবশেষে তারা জানতে পারলেন, তাদের ছেলে লেখাপড়ার চেয়ে ফেসবুকেই ব্যস্ত থাকত বেশি। ঘর বন্ধ করেও ফেসবুকে চ্যাট করত। বাবা-মার ধারণা ছিল, তাদের সন্তান লেখাপড়ায় গভীরভাবে মগ্ন। বাসার সবাই হয়তো একটা বিষয় নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন, শুধু সাইফুল আলাদা। সে ফোনে ফেসবুক নিয়েই থাকতে ভালোবাসত।
ছাদ থেকে পড়ে মারা যাওয়া কিশোর আর ফেল করা সাইফুলÑ দু’জনই মারাত্মক ডিজিটাল কোকেনে আসক্ত। মনোবিজ্ঞানীরা এই নেশাকে নাম দিয়েছেন ‘ডিজিটাল কোকেন’। এই নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছেন সব ধরনের মানুষ।
সাইবার বুলিং
ফেক অ্যাকাউন্ট খুলে চ্যাট করে চ্যাট হিস্ট্রির স্ক্রিনশটও বিভিন্ন গ্রুপে ছড়িয়ে দেয়া হয়। অপর এক তথ্যে প্রকাশ, ‘ইন্টারনেটের এই সময়ে এসে সাইবার অপরাধ জটিল এক মনস্তাত্ত্বিক উপদ্রব। এর শিকার হচ্ছে কমবেশি সব বয়সের মানুষ। তবে কিশোর-কিশোরী এবং নারীরাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন সাইবার আক্রমণে। এই অপরাধের নাম দেয়া হয়েছে ‘সাইবার বুলিং বা বুলিজম’। বুলিং বলতে আমরা বুঝি দু’জন ব্যক্তির মধ্যে তর্ক বা কথা কাটাকাটির জের ধরে একজনকে সুনির্দিষ্টভাবে সবার সামনে দোষারোপ বা খারাপ ভাষায় আক্রমণ করা। আবার একজনের ছবি বা ভিডিও বিকৃতি করে অনলাইনে তুলে ধরাও বুলিংয়ের মধ্যে পড়ে। এটি এক ধরনের সাইবার অপরাধ। সাইবার বুলিংয়ের কারণে প্রতিনিয়তই কারো না কারো সম্মানহানি ছাড়াও ঘটছে আত্মহননের মতো ঘটনাও।
অ্যানিমেশনের সবাক ডকুমেন্টারি শেষ হওয়ার পর আলোচ্য সেমিনারে শুরু হয় ফেসবুকে-ইউটিউবের নেতিবাচক দিক নিয়ে বক্তব্য। মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামানের দীর্ঘ বক্তব্যের সারমর্ম, মানুষের জীবনসহ জগতের সব কিছুই সময় মেপে চলে। সময় খোয়ানোর পরিণাম সম্পর্কে যুক্তি ও উপমা তুলে ধরেন। ডিভাইস আসক্তির কারণে চারজন এক সাথে বেড়াতে গেলেও চারজন এক সাথে নেই। সবার মন ও দৃষ্টি নিজ নিজ ডিভাইসের স্ক্রিনে। কারো কথায় কারো মন নেই।
একজন প্রতিদিন গড়ে ২ ঘণ্টা ২৩ মিনিট ডিভাইসের স্ক্রিনে থাকেন। সে হিসাবে ৭২ বছর বয়সে চার থেকে পাঁচ বছর কাটে স্ক্রিনে। সোশ্যাল মিডিয়ায় সবচেয়ে বেশি প্রতিদিন গড়ে ৪ ঘণ্টা ৫৭ মিনিট কাটে ফিলিপাইনিদের। এর পরেই ব্রাজিলের স্থান। ব্রাজিলের মানুষের সময় কাটে ৩ ঘণ্টা ৩৯ মিনিট। বাংলাদেশের ওপর এখনো জরিপ করা হয়নি। অনেকের বিশ্বাস, জরিপে চেয়ে পিছনে থাকব না। কারণ, বিশ্বে ঢাকা হচ্ছে ফেসবুক ব্যবহারে দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। ঢাকার দুই কোটি লোক ফেসবুক ব্যবহার করছেন। প্রশ্ন উঠতে পারে, যে শহরে লোকসংখ্যা দুই কোটির কম, সেখানে কী করে দুই কোটি ফেসবুক ব্যবহার করা হয়? এর কারণ, কারো কারো রয়েছে একাধিক ফেসবুক অ্যাকাউন্ট।
এক জরিপে পাওয়া গেছে, সারা বিশ্বে ২০১২ সালে যেখানে ডিভাইসে প্রতিদিন গড় সময় কেটেছে ১ ঘণ্টা ৩০ মিনিট সেখানে বর্তমানে সময় কাটছে গড়ে ২ ঘণ্টা ২৩ মিনিট। ডিভাইস ছাড়া এখন কেউ যেন ভাবতেই পারছে না। ইউটিউব একটা দেখা শেষ করতে না করতেই আরেকটা দৃশ্য চোখের সামনে এসে পড়ে। একের পর এক দেখতে দেখতে মনের অজান্তেই পার হতে থাকে মিনিট, ঘণ্টা ও প্রহর।
হাসপাতালে বাবা অন্তিম শয়নে। সন্তান বাবার পাশে একদণ্ড বসার সময় পায় নাÑ সময় পায় না গায়ে হাত রেখে উত্তাপটা পরিমাপ করার। রুগ্ণ বাবার ছবি পোস্ট করে শুরু হয় লাইক ও কমেন্টের দিকে তাকিয়ে থাকার পালা। দাওয়াত খেতে বসে শুরু হয় খাবারের ছবি পোস্ট করা।
অথচ এই ডিভাইসের জন্ম যাদের হাতে, তাদের অবস্থা ঠিক বিপরীত। পত্রিকায় প্রকাশিত এক তথ্যে প্রকাশ, বিল গেটসের তিন সন্তান। ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত তাদের কারো হাতেই মোবাইল ফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ, ডেক্সটপ কম্পিউটারÑ কোনো ধরনের ইলেকট্রনিক যন্ত্র তুলে দেননি। ঘরে খাবার টেবিলেও মোবাইল আনা নিষেধ। বিল গেটস একাধিকবার আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বলেছেন, স্কুলে তাদের সহপাঠীরা মোবাইল ব্যবহার করত বলে আমার সন্তানরা মোবাইল-কম্পিউটার ব্যবহার করার জন্য গোঁ ধরত। আমি দিতাম না। ঘুমের ব্যাঘাত হবে এটা মনে করেই বয়স ১৪ পেরোনোর পরও তাদের অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহার করতে দেন না তিনি। সন্তানদের ঘুমানোর সময়টাও ঠিক করে দিয়েছেন। গেটস বই পড়তে পছন্দ করেন। সন্তানদেরও বই পড়তে উৎসাহ দেন সব সময়। এ ছাড়া পরিবারের সবার সাথে ঘুরতে যান সময় পেলেই। টেনিস খেলেন। বিল গেটস জানান, সন্তানদের সময় দেয়ার লোভ তার কখনোই কমেনি। ‘সুখী পরিবার’ হিসেবে প্রায়ই পত্রিকায় ছবি প্রকাশিত হয়। পারিবারিক ছবিতে কারো হাতেই মোবাইল দেখা যায় না। দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় ‘ভয়ঙ্কর’ শিরোনামে একটি শাখা রয়েছে। ‘ভয়ঙ্কর’ শাখায় সারা দেশের লোমহর্ষক ঘটনা প্রকাশিত হয়। এমন ঘটনার অধিকাংশই সাইবার বুলিং ও সেলফি নিয়ে। গত ২০ ফেব্রুয়ারি ‘ভয়ঙ্কর সেলফাইটিস’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন, ‘বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষ আজকাল স্মার্টফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেটের সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষ করে ফেসবুকে ব্যস্ত সময় কাটান এবং এটি দিয়ে ছবি তোলায় ব্যস্ত থাকেন। প্রতিদিন দু-চারটা সেলফি তোলা এখন আর ফ্যাশন নয়, রুটিন। নতুন চাকরি থেকে শুরু করে বিয়েবাড়ি, মন খারাপ থেকে শুরু করে মন ভালো, নতুন জামা কেনা থেকে শুরু করে স্কুবা ড্রাইভিংÑ সবখানেই সেলফি! এক ধরনের অবসেসিভ ডিসঅর্ডারের জেরেই এই সেলফি তোলে মানুষ এবং তা এমন পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে যে, বিপজ্জনক সেলফি তোলা থেকেও বিরত হচ্ছে না। তাতে প্রাণও যাচ্ছে। সেলফি তোলার সময় হাত থেকে মোবাইল ফোন পুকুরে পড়ে যায়। সেটি তুলতে গিয়ে ডুবেই রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মহিউদ্দিন তাজ (২৩) প্রাণ হারান গত ৩০ জানুয়ারি।
কয়েক দিন আগে রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় রেললাইনে সেলফি তোলার সময় ট্রেনের ধাক্কায় ইমরান হোসেন (১৬) নামে এক স্কুলছাত্রের মৃত্যু হয়। সম্প্রতি আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের একদল গবেষক তাদের গবেষণা শেষে প্রকাশ করেছেন, সেলফি তোলা একটি মানসিক রোগ। তারা সেলফিতে আক্রান্ত হওয়া রোগের নাম দিয়েছেন ‘সেলফাইটিস’।
এই নেশা একসময় মাদকের নেশার মতোই ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। সেলফি তোলা আর তা সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা নিয়ে সম্প্রতি একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে উঠে এসেছে ভয়াবহ তথ্য। যারা সেলফি তোলে তারা মূলত এ সেলফিগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করার জন্য এক ধরনের পাগলামি করতে থাকে। গবেষকরা আরো উল্লেখ করেন, এ সেলফাইটিস রোগের তিনটি ধাপ। ১. বর্ডার লাইন সেলফাইটিস। ২. অ্যাকিউট সেলফাইটিস। ৩. ক্রনিক সেলফাইটিস।
এতে আক্রান্তরা সারা দিনে নিয়ন্ত্রণহীন তাড়না বা ইচ্ছা থেকে বিরামহীনভাবে যখন তখন সেলফি তুলবে এবং দিনে অন্তত ছয়টি বা এর বেশি সেলফি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করবে। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, যারা খুব বেশি সেলফি তোলে তারা সামাজিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিত্বহীনতা প্রকাশ করে। তারা আরো বলেন, সেলফিতে আক্রান্তদের বেশির ভাগই কর্মজীবনে ও ব্যক্তিজীবনে ব্যর্থতার পরিচয় দেয় এবং সাধারণদের চেয়ে তাদের কনফিডেন্স লেভেলও কম থাকে। তাই তারা অনেক সময় হতাশা বা মেন্টাল ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হন। তাই যাদের খুব বেশি সেলফি তুলতে ইচ্ছা হয় এবং যারা খুব বেশি সেলফি তুলতে ব্যস্ত থাকে, তাদের অবশ্যই মনোচিকিৎসার প্রয়োজন। অস্ট্রেলীয় একদল গবেষকের মতে, সেলফি তোলার রোগীরা শুধু সেলফি তুলেই ক্ষান্ত হয় না, তারা তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার না করা পর্যন্ত স্বস্তি পায় না। তারা তাদের ছবিতে ভার্চুয়াল বন্ধুদের মন্তব্যও আশা করে। আর এই মন্তব্যের সূত্র ধরে তারা নিজেদের বিচার করা শুরু করলেই তা ‘ক্রনিক সেলফাইটিস’-এ রূপ নেয়। এভাবে ব্যক্তি নিজের অবস্থান ভুলে গিয়ে অন্যের বক্তব্যের ওপর বেশি নির্ভর করতে থাকে যাতে করে নিজের প্রতি বিশ্বাস ও মর্যাদা কমতে থাকে। অতঃপর ব্যক্তি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে এবং দুর্বল হয়ে যায়।
গবেষকরা বলছেন, এই সমস্যা থেকে বের হতে নিজের প্রতি যতœবান হতে হবে। সামাজিক জীবনে সময় কাটাতে হবে। পরিবার ও বন্ধুদের সাথে প্রাণবন্ত আড্ডা এ ধরনের সমস্যা কমিয়ে আনতে সাহায্য করবে। যারা খুব বেশি সেলফি ছবি তোলায় ব্যস্ত, তাদের আজ থেকেই সাবধান হতে হবে। অতিরিক্ত সেলফি তোলা থেকে নিজে বিরত থাকুন আর অন্যকেও বিরত থাকতে পরামর্শ দিন।
সমাপ্তি ঘোষণার আগে সুবীর নন্দীর,
‘নেশার লাটিম ঝিম্ ধরেছে/ চোখের তারায় রং জমেছে/ এখন কোনো দুঃখ নেই/ নেই কোনো ভাবনা/ এমন করেই দিন যদি যায় যাক না’ গানটার কথা মনে পড়ে।
এমন করেই কি আমাদের দিন যাবে? ফেসবুক-ইউটিউবের বিষাক্ত ছোবল থেকে পরিত্রাণের কোনো কি উপায় নেই? আছে। ‘মহাজাতক গুরুজীর ভাষ্যমতে’, ‘সৎসঙ্গসহ মেডিটেশন। মেডিটেশনে বুঝতে পারি, আমরা কী করছি, আমাদের কী করা উচিত।’হ
লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক


আরো সংবাদ



premium cement