২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

পারিবারিক নির্যাতন একটি বিশ্ব সমস্যা

-

নারীর মর্যাদা রক্ষায় ইচ্ছুক আমার এক ভ্রাতুষ্পুত্রী আমেরিকায় পিএইচডি করেছে। সে আমাকে একটি চিঠি লিখেছে। যার সারমর্ম হচ্ছেÑ
‘আপনি কি জানেন যে, বাংলাদেশের গ্রামের এবং শহরের ইমামরা যৌতুক, স্ত্রীকে প্রহার, এসিড নিক্ষেপ প্রভৃতির বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখার জন্য কোনো ট্রেনিং পেয়েছেন কি না কিংবা তাদের কি উদ্বুদ্ধ করা হয়? এসব অন্যায়ের ফলে বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত নারীরা কষ্ট পাচ্ছে। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, বাংলাদেশের ওয়াজ-মাহফিলে ও খুতবাতে সাধারণত নারীদের স্বামীকে মানতে, খেদমত এবং সম্মান করতে বলা হয়। কিন্তু পুরুষদের তাদের স্ত্রীদের সম্মান করতে কদাচিৎ বলা হয়ে থাকে। কোনো কোনো সময় আমি শুনেছি, ওয়াজকারীরা স্ত্রীর প্রতি ভালো ব্যবহার করতে পুরুষদের বলেন। নিশ্চয় এটা ভালো কথা। কিন্তু ভালো ব্যবহার করা এবং দয়ালু হওয়ার বিষয় সম্মান করা থেকে আলাদা। আমার কাছে মনে হয়, যতক্ষণ না স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারিবারিক সম্মানবোধ সৃষ্টি হবে, ততদিন রাগের মাথায় স্ত্রীদের আঘাত করার প্রবণতা স্বামীদের মধ্যে থেকে যাবে। কেননা, স্বামী সাধারণত শারীরিকভাবে শক্তিশালী হয়ে থাকে এবং নিজেকে উৎকৃষ্ট মনে করে। সুতরাং পুরুষরা বাড়ির কর্তা হিসেবে যেমন ছেলেমেয়েদের শারীরিকভাবে শাস্তি দিতে পারে, তেমনি স্ত্রীকেও শারীরিকভাবে শাসন করতে পারে বলে মনে করে।
অধিকাংশ সমাজে, বিশেষ করে মুসলিম সমাজে নারী ও শিশুদের তাদের শারীরিক দুর্বলতার কারণে এক করে দেখার প্রবণতা রয়েছে। তথাপি আমি মনে করিÑ নারীকে শিশুর সাথে এক করে দেখা সঙ্গত নয়। তাকে পূর্ণবয়স্ক পুরুষের মতো মনে করতে হবে। তারও পূর্ণ গঠিত মস্তিষ্ক ও অনুভূতি রয়েছে। তারও একধরনের সম্মান পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আমি (ভাতিজি) এসব উল্লেখ করছি, কেননা ওই সব বিষয় এখানে আমার এক বন্ধুর সাথে আলোচনায় এসেছে।’
এ চিঠির উত্তরে আমি অত্যন্ত সংক্ষেপে লিখেছি যে, ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ মসজিদ মিশনÑ এসব সংগঠন ইমামদের ট্রেনিং দিয়ে থাকে। কিন্তু তাদের ট্রেনিং প্রোগ্রামে এমন কিছু আছে বলে জানি না যে, স্ত্রীকে মারা একটি নিন্দনীয় কাজ এবং একটি অপরাধ। তবে ইমাম সাহেবরা এসিড ও যৌতুকের বিরুদ্ধে কখনো কখনো বলে থাকেন। তোমার এ কথা ঠিক যে, তারা স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্মান অথবা নারীকে সম্মান করার কথা কদাচিৎ বলে থাকেন। তারা প্রকৃতপক্ষে এসব শব্দের পার্থক্যের তাৎপর্য বুঝে বলেন বলে মনে হয় না। যারা নিয়মিত আলোচনা করেন তাদের কেউ কেউ নারীর প্রতি অত্যন্ত সম্মানসূচক আলোচনা করে থাকেন। আমার কোনো সন্দেহ নেই যে, অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। আগামী দিনে মুসলিম নারীর অবস্থা আরো অনেক ভালো হবে।’
এর উত্তরে আমার ভাতিজি একটি দীর্ঘ চিঠি দেয়। এর সারসংক্ষেপ নিম্নরূপ : ‘আমার মনে পড়ে অল্প বয়সে পত্রিকা পড়ার সময় দেখতাম প্রত্যেক দিন স্ত্রীকে প্রহার করার খবর। আমাদের প্রতিবেশী এবং আত্মীয়দের মধ্যেও এসব গৃহবিবাদের কথা শুনতাম। পাশ্চাত্যে এর মূল কারণ মদ এবং মাদকজাতীয় দ্রব্য। পুরুষরা মদ খেয়ে মাতাল হয়ে স্ত্রীকে প্রহার করে থাকে। কিন্তু ইসলামে এসব হারাম। সুতরাং মুসলমানদের মধ্যে এগুলো হবে কেন? আমার মনে হয়, ইমামদের খুব ভালো করে শিক্ষা দিতে হবে। তাহলে হয়তো সুফল হতে পারে।
আমি কোনো মাওলানা সাহেবকে বলতে শুনি না, যেসব নারীর শিক্ষার জন্য তাদের পিতামাতা অনেক অর্থ ব্যয় করেছেন, ওই সব নারীও যুগের প্রেক্ষাপটে বেশি সময় ধরে অনেক বিষয়ে পড়ালেখা করেছেন এবং এখন যদি তাদের শিক্ষা অনুযায়ী কাজ করতে চানÑ তাহলে তাদের স্বামীদের উচিত ঘরের কাজে সাহায্য করা এবং স্ত্রীদের তাদের শিক্ষা অনুযায়ী কাজ করতে সুযোগ করে দেয়া।’ আমার মনে হয়, মাওলানাদের যদি সুযোগ থাকত তাহলে অধিকাংশ বিষয়ে নারীরা হয়তো পড়ালেখারই সুযোগ পেত না। কেননা, তাদের অধিকাংশই মনে করেন, মেয়েদের কাজ হচ্ছে ঘর-সংসার করা। যদি একজন মহিলা পদার্থবিদ্যা পড়ে পর্দাথবিদ হন, যে কাজে হয়তো তাকে ল্যাবরেটরিতে অনেক সময় দিতে হয়, তাহলে তার স্বামীর জন্য চা কে বানিয়ে দেবে?
চাচা আপনার কাছে স্বীকার করছি, যদিও অন্য কোথাও বলব না যে, নারী হিসেবে আমি আমেরিকায় নিজের দেশের চেয়ে অনেক বেশি সম্মান পাই। আপনার কাছে আমার কিছু দুঃখ প্রকাশ করছি।’
এর উত্তরে বিস্তারিত লিখেছি। তাতে নারী সমস্যার অনেক দিক তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমি তাকে লিখেছিÑ স্নেহের ভাতিজি, আমি তোমার সাথে একমত,পাশ্চাত্যের তুলনায় মুসলিম বিশ্বে মদ ও মাদকদ্রব্যের সমস্যা কম হওয়ার কারণে এখানে স্ত্রীর ওপর শারীরিক নির্যাতন হওয়ার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। কুরআনেও এর কোনো সত্যিকার ভিত্তি নেই। কিছু লোক অবশ্য তাদের আচরণকে ‘যুক্তিসঙ্গত’ প্রমাণ করার জন্য কোনো কোনো আয়াতের অপব্যাখ্যা করে। যেমন : সূরা নিসার ৩৪ নম্বর আয়াতে অপব্যাখ্যা করে বলা হয়, এ আয়াতে নারীদের মারার অনুমতি দেয়া হয়েছে। অথচ রাসূল সা: বলেছেনÑ নারীকে যারা মারে, তারা খারাপ লোক। এ আয়াতে যে ‘দারাবা’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে তার অর্থ ‘প্রহার করা’ ধরে নেয়া জরুরি নয়। ‘দারাবা’ শব্দের অনেক অর্থ আছে। তার মধ্যে প্রধান অর্থ হচ্ছে দূরে চলে যাওয়া। যেমন, রাসূল সা: স্ত্রীদের সাথে মতবিরোধ হলে দূরে অন্য বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে তুমি ড. আবদুল হামিদ আবু সুলেমানের বই (ম্যারিটাল ডিসকর্ড) পড়ে দেখতে পারো।
কুরআনে সূরা নিসার ১৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, আশিরূহুন্না বিল মারুফ অর্থাৎ স্ত্রীদের সাথে ভালোভাবে থাকো ও ভালো আচরণ করো। সূরা রুমের ২১ আয়াতে বিবাহের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে (লিতাসকুনূ ইলাইহা) অর্থাৎ বিবাহের উদ্দেশ্য, শান্তি লাভ করা। আমার মনে হয়, নারীদের অন্তত প্রকাশ্যে পাশ্চাত্যে অধিক সম্মান করা হয়। কিন্তু আম্মু! আমি নিশ্চিত নই যে, এ সম্মান প্রদানের ক্ষেত্রে তারা কতটুকু আন্তরিক। আমি পড়ে থাকি এবং শুনে থাকি, সেসব দেশের নারীরা ধর্ষণের ভয়ে সব সময় থাকে আতঙ্কিত। এ ব্যাপারে তোমার কাছে সত্যটা জানতে চাই।
আমার মনে হয়, মুসলিম বিশ্বে মানবাধিকার এবং সহনশীলতার ব্যাপারে গভীর সমস্যা আছে। এটি হওয়ার কারণ হলো,এখানে নানা কারণে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শিকড় গাড়তে পারেনি। এমনকি, পাশ্চাত্যেও কিছু ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের ওপর একনায়কত্বকে পছন্দ করেছে। আমি বিশ্বাস করি, মুসলিম বিশ্বে গণতন্ত্রের অগ্রগতি হবে। তাহলে সব সংখ্যালঘু এবং অসুবিধাগ্রস্ত সুবিধা পাবে। আম্মু! আমি মনে করি, পুরুষরা আরো বহু দিন এরকমই থাকবে। তারা স্ত্রীদের কাছে চা এবং খাবার চাইবে। জানি না, কিভাবে এর পরিবর্তন ঘটবে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করিÑ এটা চির দিন চলতে পারে না।
বুঝি না, যেখানে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাষ্ট্রীয় এবং নবীজীবনের সব দায়িত্বের ব্যস্ততা সত্ত্বেও ঘরের কাজ করতেন, সেখানে আমরা পুরুষরা কেন ঘরের কাজে সহায়তা করব না? আমার মনে হয়, মুসলিম বিশ্বে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। নারীর মর্যাদা ও অধিকার সম্পর্কে ইসলামের ইনসাফভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি স্কুল-কলেজের কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। মাদরাসার কোর্সে নারীর মর্যাদার ওপর বিস্তারিত আলোচনা থাকা উচিত। আলেমদের সব ট্রেনিংয়ে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। দেশের ইসলামী সংগঠনগুলোর উচিত, এটিকে দেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা এবং জনগণকে বিষয়টি বোঝানো। আগেই উল্লেখ করেছি, রাসূল সা: বলেছেনÑ যারা নারীকে মারে, তারা খারাপ লোক। আলেমদের ওয়াজ মাহফিলে এটি একটি নিয়মিত বিষয় হওয়া উচিত। আশা করি, এই বিষয়ে গভীরতা সবাই উপলব্ধি করবেন এবং যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন। হ
লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার

 


আরো সংবাদ



premium cement
লম্বা ঈদের ছুটিতে কতজন ঢাকা ছাড়তে চান, কতজন পারবেন? সোনাহাট স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করলেন ভুটানের রাজা জাতীয় দলে যোগ দিয়েছেন সাকিব, বললেন কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই কারওয়ান বাজার থেকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে ডিএনসিসির আঞ্চলিক কার্যালয় এলডিসি থেকে উত্তরণের পর সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে কার্যকর পদক্ষেপ নিন : প্রধানমন্ত্রী নারায়ণগঞ্জ জেলার শ্রেষ্ঠ ওসি আহসান উল্লাহ ‘ট্রি অব পিস’ পুরস্কার বিষয়ে ইউনূস সেন্টারের বিবৃতি আনোয়ারায় বর্তমান স্বামীর হাতে সাবেক স্বামী খুন, গ্রেফতার ৩ ফতুল্লা প্রেস ক্লাবের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত বদরের শিক্ষায় ন্যায়-ইনসাফের সমাজ প্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে : সেলিম উদ্দিন ইসলামের বিজয়ই বদরের মূল চেতনা : ছাত্রশিবির

সকল